তৃতীয় অধ্যায় (২)

আমার মেস হইতে ঠাকুর সেবার গিয়েছিলেন মঁতিলাল বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের বাড়ীতে । মতিবাবু তখন বৌবাজারে গিনি হাউসের নিকটে একটা গলিতে থাকিতেন, নামটা স্মরণ হইতেছে না। সে বাড়ীতে এক তলায় আর এক ঘর ভাড়াটিয়া ছিলেন, মুখে কিছু না বলিলেও তাহাদের হাবভাবে বুঝা যাইত যে, তাহারা ঠাকুরকে বিশেষ পছন্দ করিতেন না। ঠাকুরের কাছে যে সর্বদা লোকজন আসিত ইহাতে তাহারা অত্যন্ত অসুবিধা বোধ করিতেন এবং মুখভার করিয়া থাকিতেন। আবার এদিকে মতিবাবুরও কোন সন্তানসন্ততি ছিলনা, তিনি বাড়ি না থাকিলে তাহার স্ত্রীর নিকট সংবাদ পাঠাইয়া উপরে যাইবার ব্যাবস্থা করাও অনেক সময়ে কঠিন হইয়া উঠিত। বাজার সারিয়া দোকানে যাইতে মতিবাবুর প্রায় ৮টা বাজিয়া যাইত, সুতরাং একটু তাড়াতাড়ি প্রাতঃকৃত্য সারিয়া চা সহযোগে কিঞ্চিৎ জলখাবার খাইয়া ৭/৩০-টার মধ্যেই মতিবাবুর বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। মনে করিয়াছিলাম যে, মতিবাবুকে নিশ্চয়ই বাসায় পাইব এবং আমার দোতলায় যাইয়া ঠাকুর দর্শনে কোনও অসুবিধা হইবে না। নীচের তলায় ছোট্ট একখানি বসিবার ঘর ছিল, সেখানে গিয়া দেখিলাম যে, এক ভদ্রলোক অপেক্ষা করিতেছেন। তাহার নিকট জানিলাম যে, মতিবাবু বাড়ি নাই, তথাপি ‘মতিবাবু’ , ‘মতিবাবু’ বলিয়া দুই তিনবার হাঁক দিলাম, মনে মনে এই আশা যে আমার আওয়াজ শুনিয়া কেহ হয়তো আমার উপরে যাইবার ব্যবস্থা করিয়া দিবে। দুই তিন মিনিট অপেক্ষা করিলাম কিন্তু কোন সাড়াই পাইলাম না, তখন অগত্যা তক্তাপোশের উপর সেই ভদ্রলোকের পাশে যাইয়া বসিলাম। তাহার দিকে তাকাইতেই বুঝিলাম যে, তিনি অত্যন্ত চটিয়াছেন। আমাকে বলিলেনঃ “ ‘মতিবাবু’ , মতিবাবু’ ব’লে ষাড়ের মত চেঁচালেন কেন মশাই, আমার কথা আপনার বিশ্বাস হ’ল না?” আমি তাহাকে আমার উদ্যেশ্য বুঝাইয়া বলিতে তিনি যেন কিছুটা ঠাণ্ডা হইলেন মনে হইল। আমি তাহাকে আশ্বাস দিলাম যে, মতিবাবু শীঘ্রই আসিয়া পড়িবেন এবং আমরা দু’জনে গল্পগুজব করিয়া অনায়াসেই সময়টা কাটাইয়া দিতে পারিব। তাহার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিতে তিনি বলিলেনঃ “ সে পরে হবে এখন, আগে আমার একটা কথা শুনুন। এই দুনিয়াটা কি ক’রে ভাল করা যায় বলতে পারেন?” আমি কোন উত্তর না দিয়া একটু নিবিষ্ট ভাবে ভদ্রলোকের দিকে তাকাইলাম। আগে ততটা লক্ষ্য করি নাই, এখন দেখিলাম যে অদ্ভুত চেহারা। বয়স আন্দাজ ৫০/৫৫ বৎসর, মুখে কাঁচা পাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি, বোধ হয় ৮/১০ দিন ক্ষুরের সংস্পর্শে আসে নাই, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, উন্নত নাসা, চোখ দুইটি বুদ্ধির প্রাখর্য্যে সমুজ্জ্বল। সমগ্র চেহারায় একটা বৈশিষ্টের ছাপ। পোষাকেও বৈচিত্রের অভাব নাই। পায়ে ক্যাম্বিশের জুতা, পরিধানে মোটা মিলের ধুতি, গায়ে একটি লংক্লথের ফতুয়া, তাহার উপর একখানি মোটা চাদর এবং সর্ব্বোপরি একখানা লাল রঙের জাপানী কম্বল। আমি এক দৃষ্টে তাহার দিকে তাকাইয়া আছি দেখিয়া ভদ্রলোক বলিলেনঃ “হয়েছে তো , এইবার আমার প্রশ্নের জবাব দিন্‌”। আমি একটু লজ্জিত হইলাম এবং বিনীতভাবে বলিলামঃ “ঠাকুরের কাছে আসিয়াছেন, তাঁহাকেই জিজ্ঞাসা করিবেন, আমি আর কি জবাব দি।” উত্তরে তিনি আমাকে জানাইলেন যে, গত রাত্রিতে ঠাকুরের সঙ্গে তাহার সাক্ষাৎ হইয়াছিল এবং তাঁহাকেও তিনি এই প্রশ্ন করিয়াছিলেন। কিন্তু ঠাকুর তাহার কথার জবাব না দিয়া উল্টা তাহাকে প্রশ্ন করিয়াছেনঃ “দুনিয়াটা ভাল করার আপনার কি প্রয়োজন?”  জবাবে তিনি কি বলিয়াছেন, জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি বলিলেনঃ “কথাটা তাহ’লে আপনাকে খুলেই বলি। আপনি বোধ হয় আমাকে অর্ধ উন্মাদ বা ঐ রকম একটা কিছু ঠাওরাইয়াছেন, অনেকেই ঐরূপ ভাবে, কিন্তু আগে আমার কথাটা শুনুন।” ভদ্রলোক বলিলেন যে, তাহার বাড়ী যশোহর জেলার কোনও এক গ্রামে, পশ্চিমাঞ্চলে সেচ বিভাগে চাকুরী করিতেন। ৩ বৎসর পুর্বে অসময়ে চাকুরী হইতে অবসর গ্রহণ করিয়াছেন। ভদ্রলোকের দুইটি কন্যা, বিবাহ হইয়া গিয়াছে। স্ত্রীও ৫ বৎসর পূর্ব্বে গত হইয়াছেন, সুতরাং এখন তাহার ঝাড়া হাত-পা। প্রায় দু’শ টাকা পেন্সন পান এবং এখানে সেখানে ঘুরিয়া বেড়ান। চাকুরী জীবনের এক  নিদারুন অভিজ্ঞতাই নাকি তাহার অসময়ে অবসর গ্রহণ করিবার কারণ। সেচ বিভাগে চাকুরীর সময় তিনি দেখিতেন যে, একটা নিখুঁত পরিকল্পনা কিছুতেই করিয়া উঠা যায়না। একদিকে খাল কাটিয়া জল সরবরাহের ব্যবস্থা হইল, অনাবাদী জমি আবাদে আসিল, সুন্দর সুন্দর নূতন গ্রাম গড়িয়া উঠিল কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সংবাদ আসিল  যে, এই দিকে অতিরিক্ত জল চলিয়া যাওয়ায় অন্য একদিকে জলাভাব উপস্থিত হইয়াছে, আবাদের অসুবিধা হইতেছে এবং স্থানে স্থানে ম্যালেরিয়াও দেখা দিয়াছে। এই নুতন সমস্যারও যাহা হউক একটি ব্যবস্থা করিতে না করিতে আবার তৃতীয় কোনও স্থান হইতে অভিযোগ আসিতে আরম্ভ করিল। দেখা গেল যে নিছক ভাল কিছুই করা যায়না, ভাল’র সঙ্গে মন্দ যেন ওতপ্রোতভাবে জড়াইয়াই আছে। তাহার মনে এক বিপ্লব উপস্থিত হইল। ইতিমধ্যে স্ত্রী গত হওয়ায় সংসারের দায়িত্বও আর বিশেষ কিছুই রহিল না, চাকুরীতে ইস্তফা দিয়া বাহির হইয়া পড়িলেন।

অনেক স্থানে ঘুরিয়াছেন, প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ,সাধু, সন্ত প্রভৃতি অনেকের সঙ্গেই আলাপ আলোচনা করিয়াছেন কিন্তু তাহার সমস্যার সমাধান হয় নাই। অবশেষে পশ্চিমের কোনও এক স্থানে অশীতিপর বৃদ্ধ, সৌমকান্তি, দীর্ঘশ্মশ্রু এক সাধুর সহিত তাহার সাক্ষাৎ হয়। সাধুবাবা কয়েকজন  শিষ্যসেবক লইয়া একটি আশ্রমে বসবাস করিতেছিলেন। সাধুবাবার নিকট তাহার সমস্যার কথা উত্থাপন করিতেই তিনি বলিলেনঃ “ বেটা, আপ ভালা তো জগত ভালা।” কথাটা পুরাতন এবং পূর্ব্বেও তিনি ইহা বহুবার শুনিয়াছিলেন কিন্তু ঐ সাধুবাবার মুখে কেমন যেন নুতন নুতন ঠেকিল। ভদ্রলোক সেখানে কিছুদিন থাকিবার ইচ্ছা প্রকাশ করায়  সহজেই অনুমতি পাইলেন এবং তাহার জন্য একটি ছোটো ঘর নির্দিষ্ট হইল। সাধুবাবার সংসর্গে কিছু কাল বেশ আনন্দেই কাটাইলেন। তাঁহার কথাবার্তায় একটা সজীব সরসতা অনুভব করিতেন এবং তাঁহার শিষ্যত্ব গ্রহন করিবেন কিনা, এরূপ চিন্তাও যে মাঝে মাঝে না আসিত এমন নহে। কিন্তু হঠাৎ একদিন আবার এক খটকা লাগিয়া গেল। “আপ্‌ ভালা তো জগৎ ভালা” কথাটা লইয়াই আলোচনা হইতেছিল। সাধুবাবার কথায় ভদ্রলোক বুঝিলেন যে, তিনি ভাল হইলেই জগৎটাও যে সঙ্গে সঙ্গে ভালো হইয়া যাইবে তাহা তো সাধুবাবা বলিতেছেন না। তাঁহার কথার তাৎপর্য্য তিনি এই বুঝিলেন যে, তিনি ভালো হইলে জগতের ভালমন্দ বোধ তাহার থাকিবে না, ভালমন্দ যেমন আছে তেমনি থাকিবে। তাহার সমস্যার এরূপ সমাধান তো তিনি চাহেন নাই, সুতরাং সেই রাত্রিতেই বিছানা বাক্স বাঁধিয়া কাহাকেও কিছু না বলিয়া সেখান হইতে সরিয়া পড়িলেন। এদিক ওদিক দু’চার জায়গা ঘুরিয়া কাশী আসিয়া উপস্থিত হ’ন এবং সেখানেই ঠাকুরের সন্ধান পান। স্থানীয় এক ভদ্রলোকের নিকট হইতে মতিবাবুর ঠিকানা লইয়া কলিকাতায় আসিয়াছেন।

এই কাহিনী শুনিয়া সহজেই বুঝিতে পারিলাম যে, ভদ্রলোক বাতিকগ্রস্ত এবং তাহাকে কিছু বলিতে যাওয়া বিড়ম্বনা মাত্র। কিন্তু তথাপি কেন জানি না, চুপ করিয়া থাকিতে পারিলাম না। তাহাকে বলিলামঃ “দেখুন, একটা কথা বলি, অপরাধ লইবেন না। আমি বিশেষ কিছুই জানি না এবং ঠাকুরের সঙ্গে পরিচয়ও আমার বেশী দিনের নয়, তথাপি আমি বলিব যে আপনি গোড়ায়ই একটু গলদ করিয়া বসিয়াছেন। জগৎটাকে আপনি কখনও ভাল করিতে পারিবেন না, কারণ ইহার প্রকৃতিই দ্বন্দ্বজ। ঠাকুর বলেন ইহা সুখদুঃখে গঠিত গতাগতি, সুতরাং ভাল টানিলেও মন্দও কিছু সঙ্গে সঙ্গে আসিবে, ইহার অন্যথা করিবার শক্তি কাহারও নাই।” ভদ্রলোক চটিয়া গেলেন এবং একটু রাগতভাবেই বলিলেনঃ “ আপনি তো প্রকারান্তরে সেই সাধুবাবার কথাই বলিলেন ।” আমি কি একটা বলিতে যাইতেছিলাম হঠাৎ দেখি যে ছোট্ট একটি মাটির খোরা হাতে লইয়া ঠাকুর নিজেই নীচে নামিয়া আসিয়াছেন। আমরা সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম এবং পরে ঠাকুরকে প্রনাম করিলাম। খোরাটি আমার হাতে দিয়া ঠাকুর তক্তাপোশের এক পার্শ্বে উপবেশন করিলেন। খোরার ভিতরে চারিটি রসগোল্লা ছিল, আমরা দুইজনে তাহা প্রসাদ পাইলাম এবং উঠানের কলে হাত মুখ ধুইয়া আসিয়া ঠাকুরের নির্দেশানুসারে তক্তাপোশের উপর তাঁহার সম্মুখে বসিলাম। ইহার পর যে দৃশ্যের অবতারণা হইল তাহা যেমন আকস্মিক, তেমনই অভাবনীয়। ঠাকুর ওই ভদ্রলোকের দিকে এক দৃষ্টে চাহিয়া ছিলেন, হঠাৎ তিনি ভেউ ভেউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন এবং এই কান্না কিছুক্ষণ ধরিয়া চলিল। ভদ্রলোক কি যেন একটা বলিতে চেষ্টা করেন কিন্তু কথা বাহির হয় না, কেবল কাঁদিতেই থাকেন। এই রূপ প্রায় ১০ মিনিট চলিবার পর ভদ্রলোক ক্রমে ক্রমে প্রকৃতিস্থ হইলেন এবং কিছুক্ষণ ঠাকুরের পায়ে মাথা রাখিয়া পড়িয়া রহিলেন। ঠিক এই সময় মতিবাবু বাজার লইয়া ফিরিয়া আসিলেন। ঠাকুর উঠিলেন এবং আমিও তাঁহার সহিত উপরে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইলাম, কিন্তু দেখিলাম যে ওই ভদ্রলোক বাহির হইয়া যাইতেছেন। তাহার আচরণে আমার এমন একটা কৌতূহল উদ্রেক হইয়াছিল যে, এত সহজে তাহাকে ছাড়িয়া দিতে ইচ্ছা হইল না। আমি ঠাকুরকে প্রনাম করিয়া রাস্তায় আসিয়া ভদ্রলোককে ধরিলাম এবং অনেক পীড়াপীড়ি করিয়া তাহাকে আমার মেসে লইয়া আসিলাম।

জামা কাপড় ছাড়িয়া, হাত মুখ ধুইয়া একটু সুস্থ হইয়া বসিয়াই আমি ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করিলাম যে, তিনি ঠাকুরের সম্মুখে হঠাৎ এমন হাউ হাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিয়াছিলেন কেন। তিনি নীরবেই রহিলেন এবং একাধিকবার কথাটা জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও কিছুই বলিতে চাহিলেন না। কিন্তু আমিও নাছোড়বান্দা, অত্যন্ত পীড়াপীড়ি শুরু করিয়া দিলাম। অবশেষে তিনি বলিলেনঃ “ কথাটা বলিবার ইচ্ছা আমার আদৌ ছিল না, কিন্তু আপনি যখন কিছুতেই ছাড়িবেন না, তখন না বলিয়াই বা করি কি। মতিবাবুর বাড়ীতে সেই তক্তাপোশের উপর বসিয়া আমার মনে হইল যেন বহুদিনের এক বিস্মৃতির আবরণ ধীরে ধীরে সরিয়া গেল, দেখিলাম যে যিনি সম্মুখে বসিয়া রহিয়াছেন তিনি যেন আমার চিরপরিচিত নিতান্ত আপনজন ।” কথা কয়টি বলিয়াই তিনি আবার কাঁদিতে শুরু করিলেন। আমি নীরবেই রহিলাম, কিছুক্ষণ পরে তিনি নিজেই শান্ত হইলেন। স্নানাহারের পর প্রায় ঘন্টা দুই তাহার সহিত নানা বিষয়ে কথাবার্তা হইল। বুঝিলাম যে, তিনি একজন কৃতবিদ্য লোক এবং অনেক বিষয়েই রীতিমত পড়াশুনা করিয়াছেন। স্পষ্ট স্মরণ আছে যে, তাহার সহিত লেনিনের নব-গঠিত বোলসেভিক রাষ্ট্র সম্বন্ধে অনেক আলোচনা হইয়াছিল। দেখিলাম যে, তিনি মার্ক্সবাদ সম্পর্কে অনেক খবর রাখেন এবং মনে হইল যে, এই দুঃখময় মানবসমাজকে চেষ্টার দ্বারা শান্তি ও প্রাচুর্য্যের ( Peace and plenty) এক নূতন স্বর্গে পরিণত করা যায়, মার্ক্সপন্থীদিগের এই জ্বলন্ত বিশ্বাসই তাহাকে মার্ক্সবাদের দিকে আকৃষ্ট করিয়াছে। সে যাহাই হউক , কিছুক্ষণ পরেই আমরা দুইজনেই একটু বিশ্রামের চেষ্টা করিলাম। আমি ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম, জাগিয়া দেখি যে ভদ্রলোক নাই। একতলায় আসিয়া অনুসন্ধান করিয়া জানিলাম যে , তিনি চলিয়া গিয়াছেন । জীবনে আর তাহার সহিত সাক্ষাৎ হয় নাই।

শুধু একবার ৪-৫ ঘন্টার জন্য এই ভদ্রলোকের সঙ্গ পাইয়াছিলাম, তাহার নামটাও জানিয়া রাখি নাই, কিন্তু তথাপি তিনি আমার মনে বরাবরই একটা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়া রহিয়াছেন । তিনি যে অভাবনীয় রকমের ঠাকুরের কৃপা লাভ করিয়াছিলেন তাহা আমি আজও ভুলিতে পারি নাই। আর তাহার সেই ‘ দুনিয়া ভালো করা ‘ বাতিকের কথা লইয়া অনেক ভাবিয়াছি এবং অনেক আলোচনা করিয়াছি কিন্তু সেদিন তাহাকে যাহা বলিয়াছিলাম আজও আমার সেই মত অটুটই রহিয়াছে । আমার বাড়ীতে আসিয়া কথাপ্রসঙ্গে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন যে, সাম্যবাদীরা যদি তাহাদের সঙ্কল্প কার্য্যে পরিণত করিতা পারে, খাওয়া , পরা , বাসস্থান , শিক্ষা , চিকিৎসা , ইত্যাদি ব্যাপারে মানুষ যদি নিশ্চিন্ত হইতে পারে তাহা হইলে দুঃখ বহুলাংশে কমিয়া যাইবে একথা আমি স্বীকার করি কিনা। আমি বলিয়াছিলাম যে , সুখ দুঃখের রকমফের হইবে ইহা আমি অবশ্যই স্বীকার করি, কিন্তু তাহাদের পরিমাপ অন্যপ্রকার হইবে আমি তাহা মানি না। আজ ৩৫ বৎসর পরেও আমি আমার এই মত পরিবর্ত্তনের কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজিয়া পাই নাই । কোথায় যেন পড়িয়াছিলাম যে, পুত্রশোক মহাদুঃখ সন্দেহ নাই কিন্তু “ ক্ষুধাৎ পরতরং নাস্তি ।” ক্ষুধার মতন দুঃখ মানুষের অল্পই আছে , এমন যে প্রবল সন্তান-শোক তাহাকেও ক্ষুধাই প্রথম ছাপাইয়া ওঠে । শোক যত মর্মান্তিকই হউক না কেন, দু’দিন আগেই বা পরেই হউক , শোক-বিহ্বলা মাতাকেও কিছু না কিছু মুখে দিতেই হয় এবং তখনই শোও প্রশমনের আরম্ভ। সুতরাং ক্ষুন্নিবৃত্তির এবং মানুষের প্রাথমিক প্রয়োজনগুলির যদি একটা নিশ্চিত ব্যবস্থা হইয়া যায়, তাহা হইলে একদিক হইতে মানুষের দুঃখ যে বহুলাংশে লঘু হইয়া যাইবে কোন স্থির মস্তিষ্ক ব্যাক্তি ইহা অস্বীকার করিবেন না। কিন্তু আধিভৌতিক দুঃখই মানুষের একমাত্র দুঃখ নহে। গ্যালিলিও যখন প্রকাশ্য আদালতে তাহার বৈজ্ঞানিক অবদানকে প্রত্যাহার করিয়া লইতে বাধ্য হইয়াছিলেন , তাহাতেই তাহার বেশী দুঃখ হইয়াছিল , অথবা বাকী জীবন অর্ধাশনে , বা কখনও কখনও অনশনে কাটাইলে বেশী দুঃখ হইত, এই প্রশ্নের বিচার করিবার কোন নির্ভরযোগ্য আছে বলিয়া আমি জানি না। মানব সমাজের অন্ত্ররনিহিত দ্বন্দ্বই সাম্যবাদের অবলম্বন এবং উহা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বলিয়াই পরিচিত। মার্ক্সবাদীদের মতে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হইতে না হইতেই তাহার প্রতিবাদও সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হইয়া যাইবে, পরে আসিবে এক নূতন সমাধান, আবার প্রতিবাদ, আবার সমাধান, মনুষ্য-সমাজের বিবর্তন অতীতেও এইভাবেই হইয়াছে , ভবিষ্যতেও এই ভাবেই হইবে। কিন্তু আমরা সচরাচর দেখি যে , যেখানে দ্বন্দ্ব সেখানেই দুঃখ , সুতরাং এই দ্বন্দ্বের মধ্যে থাকিয়া এবং ইহাকেই নিত্য বলিয়া স্বীকার করিয়া লইয়া দুঃখাবসানের চেষ্টা পণ্ডশ্রম মাত্র।

ব্যষ্টি এবং সমষ্টির পারস্পরিক অধিকারের সীমা-নির্দ্দেশ মানুষ কখনও করিয়া উঠিতে পারে নাই। ব্যাপারটা একাধারে জটিল এবং সূক্ষ্ম , উভয়ের দাবী-সাম্য বজায় রাখা মোটেই সহজসাধ্য নহে । ফল দাঁড়াইয়াছে এই যে , মানুষ কখনও জোর দিয়াছে ব্যষ্টির উপর , আবার কখনও জোর দিয়াছে সমষ্টির উপর, সমস্যাটার একটা সন্তোষজনক সমাধান কোনদিনই হয় নাই। আমার বিশ্বাস যে এই কথাটাকে সূত্ররূপে গ্রহন করিয়া ইতিহাসের আলোচনা করিলে কিছুটা নূতন আলোকসম্পাত হইতে পারে। সে যাহাই হউক, আমার বক্তব্য হইল এই যে , ব্যষ্টি ও সমষ্টির মধ্যে এই চিরাগত দ্বন্দ্ব বর্তমান থাকার জন্যই কোন মতবাদ বা তদানুষঙ্গিক কোন বিল্পব সর্বাংশে প্রগতিশীল হইতে পারে না। একদিক হইতে দেখিলে যাহা প্রগতি , অন্যদিক হইতে দেখিলে তাহা প্রতিক্রিয়া। কিন্তু মতোন্মত্ততা যাহাদিগকে পাইয়া বসিয়াছে তাহারা কোন কথাই শুনিতে চাহিবে না। কিছুদিন পূর্ব্বে  আমার পরিচিত একজন অত্যুগ্র প্রগতিবাদী কোন কার্য্যোপলক্ষে আমার বাড়িতে আসিয়া ছিলেন। কথাপ্রসঙ্গে আমি এই ব্যষ্টি ও সমষ্টির সমস্যাটা তুলিয়া তাহার সহিত আলোচনা করিতে চাহিয়াছিলাম। ইহা একটা সমস্যাই না , এসম্বন্ধে অনেক আলোচনা হইয়া গিয়াছে , ইত্যাদি ধানাই পানাই নানা কথা বলিয়া প্রকৃত প্রস্তাবে কথাটি এড়াইয়া যাইতে চাহিলেন । আরো কিছুক্ষণ এলোমেলো ভাবে কথাবার্তা চলিতে লাগিল; হঠৎ দেখি যে আমার টেবিলের উপর হইতে তিনি রামায়ণের সারানুবাদখানা তুলিয়া লইয়াছেন । দু’চার পাতা উল্টাইয়া তিনি আমাকে বলিলেনঃ “ এই রামায়ণের মতো এতগুলি অপদার্থ চরিত্রের একক সমাবেশ আর কোথাও আছে বলিয়া জানি না। স্বজাতিদ্রোহী , দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক বিভীষণ , তাঁহাকে আপনারা বানিয়াছেন একটা ধর্মপ্রাণ মহাভক্ত ।” এই কথা বলিয়া পরে শম্বুকের শিরশ্ছেদের সেই মামুলী কাহিনীটার উল্লেখ করিয়া রামচরিত্রের নৃশংসতা প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করিলেন। এ সকল কথা আগেও অনেকবার ইহার মুখে শুনিয়াছি কিন্তু বিশেষ কিছু বলি নাই, কিন্তু সেদিন আর নীরব থাকিতে পারিলাম না। আমি তাহাকে বলিলামঃ “ কমিন্টার্নের যুগে যে সকল আন্তর্জার্তিক সাম্যবাদী মস্কোতে বসিয়া নানাপ্রকার ষড়যন্ত্র করিতেন, আমি যদি বলি যে তাহারা সকলেই অল্প বিস্তর দেশদ্রোহী ও স্বজাতিদ্রোহী ছিলেন, আপনি তাহা মানিয়া লইবেন কী ?” ভদ্রলোক বলিলেনঃ “ইহাদের সঙ্গে আপনি বিভীষণের তুলনা করিলেন, ইহারা যাহা করিয়াছেন, দেশ, জাতি ইত্যাদি অপেক্ষা একটা উচ্চতর আদর্শের অনুপ্রেরণায়ই তাহা করিয়াছেন ।” আমি বলিলামঃ “ বিভীষণও তো ঠিক তাহাই করিয়াছিলেন, তাহার ইঙ্গিত তো রামায়ণে যথেষ্ঠই আছে ।” তিনি চটিয়া উঠিলেন, একটু রাগত ভাবেই বলিলেনঃ “ একটা রাজ্যলোলুপ বিশ্বাসঘাতক , তাহার আবার আদর্শ ।” এবারে আমিও একটু ঊষ্মার সহিতই বলিলামঃ “ যদি তাহাই বলেন , তবে আমিও বলিন যে আদর্শের বালাই আপনাদেরও বড় একটা নাই, লোভ, হিংসা ও ক্ষমতালিপ্সাই আপনাদের চালকশক্তি ।” এবার তিনি আরও চটিয়া গেলেন এবং “ আপনাদের সঙ্গে কোন কিছু বলাই বিড়ম্বনা” এই কথা বলিয়া উঠিয়ে পড়িলেন। কিন্তু আমি পথরোধ করিয়া দাঁড়াইয়া তাহাকে বলিলামঃ “ এতটাই যখন শুনিয়াছেন, শম্বুকের কথাটাও শুনিয়া যান। তখন সমাজে যে আদর্শ প্রচলিত ছিল, সেই আদর্শানুযায়ী সমষ্টি সংহতি রক্ষা করিবার জন্যই শম্বুকের শিরশ্ছেদের প্রয়োজন হইয়াছিল। ইহাকে সমষ্টিত স্বার্থে ব্যষ্টির উপর নির্যাতন বলা যাইতে পারে। রামের সম্বন্ধে এরূপ দৃষ্টান্ত আর দু’একটির বেশী নাই, অথচ সুযোগ পাইলেই রাম চরিত্রের এই কলঙ্কের কথাটা আমাকে শুনাইয়া যান। কিন্তু আপনাদের পীঠস্থানে সিকি শতাব্দী ধরিয়া যে নৃশংসতা ও বর্বরতার অনুষ্ঠান চলিয়াছে সেগুলিকে ধনতান্ত্রিক অপপ্রচার বলিয়াই উড়াইয়া দিতে চাহিয়াছেন এবং যেটুকু অস্বীকার করিতে পারেন নাই, সমষ্টি-স্বার্থের অজুহাতেই তাহা সমর্থন করিয়াছেন। কিন্তু এখন তাহারা নিজেরই হাটে হাঁড়ি ভাঙ্গিয়াছেন; কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, সুতরাং আপনারাও নূতন সুরে গাহিতে আরম্ভ করিয়াছেন ।” ইহার পর আর ভদ্রলোককে কিছুতেই ধরিয়া রাখা গেল না। 

কি বলিতে কোথায় আসিয়া পড়িলাম। বলিতেছিলাম যে দ্বন্দ্বের মধ্যে দুঃখাবসনার অনুসন্ধান কখনও ফলপ্রসূ হইবে না। সুখী হইতে হইলে হয় নির্দ্বন্দ্ব হইতে হইবে , না হত দ্বন্দ্বাতীতের সহিত সম্বন্ধ পাতাইতে হইবে। শ্রুতির সহিত সম্পর্কবর্জ্জিত যে স্মৃতি তাহা কখনই পরিণামে কল্যাণকর হইতে পারে না। ঠাকুরের কথা বলিতে বসিয়া এই সকল যুক্তি তর্কের কচকচি নিতান্তই বিরক্তকর মনে হইতেছে, কিন্তু এই বস্তুতান্ত্রিক যুগে কিছু কিছু না বলিয়াই পারিতেছি না। আমি জানি যে আমার এই লেখা অতি অল্প লোকেই পড়িবে; তাহাদের মধ্যে যাহারা স্বাভাবিক আস্তিক্যবুদ্ধিসম্পন্ন , তাহাদের হয়তো কিছুটা উপকারে আসিতে পারে, এই ভরসায়ই মাঝে মাঝে কিছু কিছু অবান্তর যুক্তি তর্কের অবতারনা করিব। আমার সুদীর্ঘ কর্মজীবনে তথাকথিত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সহিত ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশিবার আমি যথেষ্ঠ সুযোগ পাইয়াছি এবং তাহাদের তাহদের মতিগতির সঙ্গেও আমার সাক্ষাৎ পরিচয় আছে। ইহাদের মধ্যে অধিকাংশই যে আমার কথাগুলি নিতান্ত তাচ্ছিল্যের সহিত উড়াইয়া দিতে চাহিবেন, তাহাতে আমার কোন সন্দেহ নাই।

ERROR: It had not been possible to open the file. Review your name and your permissions.