বেদবাণী তৃতীয় খণ্ড

(১) স্বত:সিদ্ধ কাম পূর্ণ করিয়া সত্যনাথের অধীন হইয়া থাকিতে অভ্যাস করুন।  ন কর্ত্তৃত্বং ন কর্ম্মাণি লোকস্য সৃজতি প্রভু:।  ন কর্ম্ম ফলসংযোগ স্বভাবস্তু প্রবর্ত্ততে। ।  শ্রুতি বাক্য। স্ব স্ব ভাগ্যই ফল জন্মাইয়া থাকেন তাহা ছাড়া অন্য কাহারো ভাগ্য ফল দেবার ক্ষমতা নাই। যাহা হউক, আপনি সত্যের অংশে সকল ভার রাখি[য়া] সঙ্করের ঋণ সকল পরিশোধ করিতে যত্নবানের অভ্যাস করিতে থাকুন, সত্যই সকল ব্যবস্থা করিবেন।  ভাগ্যগতিকেই লোকে দেহ সমাজ স্বজন বন্ধুবান্ধব স্ত্রী পুত্রাদি এবং স্থানাদি লাভ করিয়া থাকে। যখন যাহা লোকের সংঘটন ঘটিয়া থাকে তাহার কর্ত্তা ভাগ্যই জানিবেন। স ভাগ্য ছাড়িয়া পরের ভাগ্যের অধীনে গেলে কালচক্রের অন্তের [?] অধীন হইয়া পড়িতে হয় জানিবেন।  বাড়ীঘর যেখানে হইবার হইবে-তাহা ভাগ্য অর্থাৎ ভগবানই বিধান করেন তাহার চিন্তা বৃথা। (ভাগ্যং ফলতি সর্ব্বত্র)সত্যনারায়ণকে ভুলিবেন না।


(২) উৎ (আলোকে) সব (থাকা) দুই সখীগণে উৎসব ঘটনা হইয় থাকে। দক্ষযজ্ঞের দ্বারা সত্যনারায়ণ দূরবর্ত্তী হইয়া যায়।


(৩) ………এই ব্যাসের অর্থাৎ পূর্ব্বপার (যাহাকে সম্মুখে দেখা যায়), আব্রহ্মস্তম্ভপর্য্যন্ত যাহা কিছু মনুষ্যাদি পশু পক্ষী কীট বৃক্ষ তরুলতা তৃণগুল্ম প্রভৃতি সকলই অপরাধ যুক্তে এই ব্যাসকাশীতে বন্দী পড়িয়া গ্রহগণের এবং প্রকৃতির গুণের অংশে পরিচালিত হইয়া থাকে। কেহই অর্থাৎ দেবতাই হউক,  আর দানবই হউক, আর মানবই হউক, সকলের মধ্যে কাহারো কিছু করিবার অধিকার নাই। সকলেই প্রকৃতির গুণের তরঙ্গে পরিচালিত হইয়া থাকে। অতএব পূর্ব্বপার ব্যাসকাশী অর্থাৎ সীমাবদ্ধ জ্ঞান জানিবেন। পশ্চিম পার অর্থাৎ যাহাকে ভুলিয়া ত্রিলোকের লোকসকল এই পূর্ব্বপার সীমা জ্ঞানে আটক পড়িয়া থাকে, সেই পশ্চিম পার অর্থাৎ’পিছনে’ (যাহা লোকে পাছে বলে) সেই পিছনে অন্নপূর্ণার অবিমুক্ত স্থানহারা হইয়াই লোক অহংকারের ঘেরায় আটক পড়িয়া কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় ভাবে মগ্ন হইয়া গিয়া ভাল-মন্দ, সৎ-অসৎ স্থির করিতে না পারিয়া সুখের জন্যই লোভ করিয়া জ্ঞানহারা হইয়া থাকে। ইহাকে কাম কামনা বলে জানিবেন।  আমি অবিদ্যার ভাষা পরিদর্শক-কাজে কাজেই কিছু বুঝাইবার অঙ্ক আমার গোচরে নাই। ………সত্যনারায়ণ অর্থাৎ সত্যের আশ্রয় এই ভাব অর্থাৎ যোগ মিলনে সমস্ত বন্ধন কাটিয়া এই বর্ত্তমানের দেহত্যাগ হইলে পুনরায় আর দেহপাশ ভোগ করিতে হয় না জানিবেন। ”যদচ্ছালাভ সন্তুষ্ট দ্বন্দ্বাতীত বিমৎসর”ইত্যাদি সত্যের সেবক জানিবেন।  নিজ নিজ অধিকারের দাবী না করিয়া কর্ত্তব্য সম্বন্ধে যত্নবান হইলে নির্দ্বন্দ্ব হয়। জীবের কোন বিষয়েই কর্ত্তৃত্ব নাই জানিবেন। স্ব স্ব ভাগ্যানুসারেই কর্ম্মফল পাইয়া ভোগ করিতে থাকে জানিবেন। ইহাকেই কর্ম্মফলদাতা ভগবান বলে। সংসার ভুলের আকর জানিবেন। সকলই অস্থায়ী। সত্যের অংশ নাই সকলই স্থায়ী জানিবেন।


(৪) আমি অন্ধ এবং (কর্তা) হইয়া যাহা বোধ করি তাহা সকলই ক্ষয়শীল, অস্থায়ী, কাজেই ক্ষয়েরই কর্ত্তা। যদি আমি ক্ষয়েরই কর্ত্তা হইলাম, আমি ক্ষয়ের কর্ত্তা বলিয়া নিশ্চয় জানিলাম, তবে আমার স্ত্রী কি পরিবার ক্ষয়যুক্ত স্থিতিহীন। কিন্তু সকলের দেহী অক্ষয়, নিত্য, অসীম পূর্ণরুপে বিরাজ করে, তার ক্ষয়ও নাই, গতাগতিও নাই জানিবেন। বিশেষত: আমি যখন ঘুমাই তখন আমার কেউ থাকে? তাহারা যায় কোথায়? জানিতে পারেন? তবে কেন দেহীকে ছাড়িয়া দেহ, অনিত্য অস্থায়ী বস্তুর চিন্তা করেন? শৈশব হইতেই দেহ রুপান্তর হইতেছে। দেহী একরকমই থাকেন-ক্ষয় নাই। ……… দেহীর পরিবর্ত্তন ও হ্রাস-বৃদ্ধি নাই। দেহই কাল্পনিক[?] পরিবর্ত্তনশীল, দেহ অস্থায়ী;তাহার ত্যাগ না হওয়া পর্য্যন্ত সত্যরুপকে বন্ধন হইতে কি করিয়া মুক্ত করা হয় (?) দিন রাত্রি ত রোজই হইতেছে। বিরাম নাই। সেইরুপ দেহেরও বিশ্রাম নাই ঘড়ির কাটার মত সর্ব্ব সময় কাল চক্রাকারে ঘুরিতেছে-বিশ্রাম নাই। দেহীর কোন বন্ধন নাই। বড় ছোট সকলের মধ্যেই আলক পূর্ণ বিরাজ করে। তাঁহার সঙ্গ হইলে দেহত্যাগ হয়-নচেৎ নয় জানিবেন।


(৫) যিনি নাম পাইতে ইচ্ছা করিয়াছেন তাহাকে এই নাম লইয়া নামের সেবা করিয়া করিয়া দক্ষযজ্ঞ ত্যাগ হইয়া যখন নামের অধীন অভিমানভুক্ত হইবে তখন নাম পাইবে।  যেই নাম সেই কৃষ্ণ ভাব নিষ্ঠা করি।  নামের সহিত থাকে আপনি শ্রীহরি। ।  নাম সত্য।  (গোপাল গোবিন্দ) এই নামের সেবক হইলে শ্রীযুক্ত হয়।


(৬) ভাগ্যং ফলতি সর্ব্বত্রং। সত্যনারায়নের সেবা করুন তাঁর ভাগ্য নাই, প্রকৃতি হইতেই বিভক্ত হইয়া থাকে। সেই প্রকৃতি ত্রিগুণের বশে আকৃষ্ট হইয়া বহু রকম অবস্থায় বিকৃত হইয়া নানান উপাধি সাগরে উর্দ্ধ অধ: গতিদ্বারা জীবগণের লাঞ্চনা ভোগ সর্ব্বদা ঘটিয়া থাকে। মনের দ্বারাই এই ভোগ হয়। ………সঙ্করের নিকট ঋণ দায়ে ত্রিলোক ঠেকা হেতু কালচক্রে সকল ঘুরিয়া বেড়ায়। ইহাকেই জন্মমৃত্যু বলে। ভাগ্য অনুসারে যোগাযোগ, আপন-পর, শত্রু-মিত্র, শান্তি-অশান্তি, সুখ-দুঃখ  লাভ করে। ইহাই ভোগ বলিয়া জানিতে হয়। ভাগ্য ভোগ দান [ত্যাগ] হইলে সত্যনারায়ণকে পাওয়া যায়, তাঁহাকে পাইলে ভাগ ভোগ থাকে না। কারণ প্রকৃতির সীমার পার হয়। ইহাকেই প্রাণ (পরায়ণ) বলিয়া জানিবেন। ইহাকেই সত্য-নারায়ণের সিন্নি (ভিন্ন বুদ্ধি না করা), ইহাকেই সত্যনারায়ণের সেবা বলে। …………অহংকার অর্থাৎ সীমাবদ্ধ হইয়া কর্ত্তা অস্থায়ী বিচার করিয়া তাতে আবদ্দ থাকে। তাহাতেই আপনার দোষ না দেখিয়া পরদেহে দোষ দৃষ্টি দর্শন করে। যেমন মেঘ সূর্য্যকে আচ্ছন্ন করে, সূর্য্য তাতে মলিন হয় না, সে পবিত্রই থাকে। মেঘই নষ্ট হইয়া পড়ে। অহংকার দোষই যাইবে, কিন্তু পিতা-মাতা নষ্ট হয় না। পিতাস্বর্গ: পিতাধর্ম্ম: পিতাহি পরমন্তপ:। পিতৃসেবায় রত সত্যবানের উপাখ্যান দ্রষ্টব্য। পুত্র কর্ত্তৃত্ব করিয়াই মাতৃকোল অধীরতা (অসত্যতা) হেতু কর্ত্তাপাশে বদ্ধ হইয়া মায়ের কোল ত্যাগ করিয়া বিবিধ পাশে বদ্ধ হইয়া এই ভবাদ্ধি অকূল সাগরে উর্দ্ধ অধ:-গতিতে জীব সকল লাঞ্চিত হইয়া থাকে। কাজেই পিতামাতা যে সত্যব্রত ভুলিয়া স্বয়ং কর্ত্তা হইয়া দিশাহারা হয়। যাহা হউক, সত্য-নারায়ণের ব্রত ভুলিবেন না। ………ভগবানের পিতৃমাতৃ দত্ত দুটি কুল, উভয়ের দোষগুণ পরিত্যাগ করিয়া ধৈর্য্যের দ্বারা প্রাণে প্রাণে অভিন্নরুপে পিতামাতার সেবাকার্য্যের শক্তি আহরণ করুন, ইহাতে পিতা মাতা পুত্র তিন কুল মুক্ত করিতে পারিবেন। তখন সত্যবস্তুর উপলব্ধি হইবে, স্বরুপ পাইবেন।


(৭) পতিসেবাই পরম ধর্ম্ম, পতি সেবাই চিরমঙ্গল জানিবেন। ভগবান পতিসেবারুপে এই ত্রিজগতে অধিষ্ঠান থাকেন। সর্ব্বদাই পতি চিন্তা করিবেন, সেই চিন্তা হইতেই পতিদেবতা মঙ্গল আবরণে থাকিয়া শান্তিবর্ষণ করিবেন। সর্ব্বদাই নামে লিপ্ত থাকিতে চেষ্টা করিবেন। প্রাক্তনই সম্বন্ধ বিবর্জয় করিয়া আবার প্রাক্তনই নির্ম্মঞ্চন করিয়া থাকে। ভাগ্যে যখন যাহা ঘটিবে তাহার জন্য উপীড়ন বুদ্ধিকে ধৈর্য্য [?] ধরার সঙ্গে রাখিয়া ভগব [?] উদ্দেশে পবিত্র চিত্তেতে নামের প্রতিষ্ঠা করিয়া নিত্য সেই পতিদেবতার নিত্য নাম স্বরুপের সেবা করিবেন। ………সত্যই পরম ধর্ম্ম, সত্যকে সর্ব্বদাই হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা রাখিতে হয়। সত্যই সর্ব্বশক্তি-মান, সত্য ছাড়া ত্রিজগতে আর কিছুই নিত্য নয়।  (সত্যং পরম ধীমহি) সত্যই জাগ্রত থাকিবে।  (সর্ব্বমঙ্গল মঙ্গল্যে শিবে সর্ব্বার্থসাধিকে। শরণ্যে ত্র‍্যম্বকে গৌরি নারায়ণি নমোহস্তুতে। । )


(৮) নাম বলিতে চিন্তাকেই বুঝাইছে।  নাম চিন্তামণি: কৃষ্ণশ্চৈতন্য রসবিগ্রহ:।  নিত্যশুদ্ধো নিত্যমুক্তোহভিন্নাত্মা নাম নামিনো:। ।  যখন মনে বুদ্ধিতে সকল অবস্থায় সকল শব্দেতে একটি নামই বোধ হইবে তখন নামের সফলতা লাভ করিতে পারিবে। অতএব সর্ব্বদা সকল অবস্থায়ই ঐ নামই করিবেন। যাহা আপনি ধারণা করিয়াছেন, সেই নামেরই বিভূতি সকল নাম জানিবেন। ঐ নামেই আপনারা সবান্ধবে মুক্তিস্থান লাভ করিতে পারিবেন। এই জন্যই ইহাকে পতিব্রত-ধর্ম্ম সত্যনারায়ণ-ব্রত বলিয়া বেদাদিতে ঋষিগণ প্রকট করিয়া গিয়াছেন।  ”ওঁ তৎসৎ ওঁ সত্যং পরং ধীমহি ওঁ নমো ব্রহ্মণ্য দেবায় নমস্তে ব্রহ্মতেজসে। । ” এই বলিয়া প্রতি বারে প্রতি সময়েই শ্বাস-প্রশ্বাস যত সময় শরীরের মধ্যে সহজে কষ্ট না হয় এমন ভাবে রাখিতে পারেন ইহা করিয়া নাম করিবেন, তবেই শান্তি পাইবেন।


(৯) বর্ত্তমানে সংসারের চক্রে প্রাক্তন দত্ত ভোগের তরঙ্গ চলিতেছে এই ভোগ চিরকালের জন্য থাকিতে পারে না। সর্ব্বদা ভগবানের নাম সঙ্গ করিবেন, ভগবানই উদ্ধার করিবেন। অদৃষ্টচক্রের ভোগ একমাত্র নামই মুক্ত করিয়া থাকেন।


(১০) সংসারের গতি কালচক্র, এই চক্রই ভাল-মন্দ বুদ্ধির উদয়-অস্ত দ্বারা শান্তি-অশান্তি ভোগ হইয়া থাকে। ইহাকে প্রারব্ধ বা অদৃষ্ট বলে। অদৃষ্ট অর্থাৎ ভাগ্যফল অতিক্রমের জন্য চিন্তা ভাবনা না করিয়া কেবল পতিসেবা সর্ব্বদা করিতে থাকুন, পতি-প্রসাদে পরম শান্তির প্রকাশ হইবে। সর্ব্বমঙ্গলময় সাবিত্রী বেহুলা প্রভৃতি সতীগণের অনুসরণের দ্বারা নিত্যশান্তির প্রকাশ হইয়া আনন্দ পাইবেন। ………প্রারব্ধবশে স্থানাস্থানে বিচরণ করিতে হয়। কোন দিন যে কোথায় থাকিতে হইবে জানা থাকে না।


(১১) সর্ব্বদা নাম করিবেন। নামকেই অনন্য চিন্তা বলিয়া থাকে। প্রাক্তনসূত্রে নানান রকম উপাধি সংযোগ করিয়া তোলে। তাহার বেগ ধৈর্য্য ধরিয়া ক্ষয় করিতে হয়। ………নামে পড়িয়া থাকিলে কোন অভাব আসে না। ………বর্ত্তমানে এই জগতের কেন,  স্বর্গাদিরও অভাব হইয়া পড়িয়াছে। কালে সকলি হইবে। কেবল নামই সত্য, নাম বৈ আর কিছু এ জগতে থাকিবে না।


(১২) সর্ব্বদা ধৈর্য্য সহকারে নাম করিবেন। নাম করিতে করিতেই আপনার মনে শান্তি আসিবে। এক নাম ব্যতীত মনে শান্তি পাইবার আর কোন উপায় নাই। …………সর্ব্বদা ধৈর্য্য ধরিতে চেষ্টা করিবেন এবং নাম করিবেন, তবেই আপনার মঙ্গল আসিবে।


(১৩) নাম লয় শব্দের অর্থ ফেলে না। নামের সম্বন্ধ মনের সঙ্গে হয় না, প্রাণের সঙ্গে গাঁথা থাকে বলিয়া নাম লয়। মনের দ্বারা সুখ-দুঃখ  ভোগ হয়, মনের সঙ্গকে ভাগ্যকে, অদৃষ্ট বলিয়া তত্ত্বদর্শিগণ নির্ণয় করিয়াছেন।  ”মন:করোতি পাপানি মনো লিপ্যতে পাতকৈ:”,  অতএব নাম লইয়া পড়িয়া থাকাই কর্ম্ম, নাম ধরিয়া রাখাই ধর্ম্ম, মনের দ্বারা যে সকল কার্য্য হয় [তাহা] কল্প ক্ষয়শীল।  ”নাম চিন্তামণি: কৃষ্ণশ্চৈতন্য রসবিগ্রহ:।  নিত্যশুদ্ধো নিত্যমুক্তোহভিন্নাত্মা নাম নামিনো:। । ” ………নামের কোন শব্দ অর্থ নাই, নাম সত্য নিত্য;তাহার কীর্ত্তনই আনন্দ। এইজন্য লোকে সত্যনারায়ণ বলে।


(১৪) এই যে জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, ইহা ভবিতব্য সংস্কার ছাড়া যো নাই। যার যেখানে যে যে অবস্থায় উহা সংঘটন হইবে তার সেইখানেই ঘটিবে সংশয় নাই। এইজন্য চিন্তা ভাবনা না করিয়া সত্যের সেবা করিতে থাকুন;সত্যই সকল ঋণ (পাশ) মুক্ত করিয়া পরমানন্দ শান্তিধাম মুক্ত করিয়া দিবেন। জীবের জন্য ফলাফল যোগাযোগ সৃষ্টি করে নাই। কর্ম্ম করিবারই অধিকার। ফলদাতা সত্যনারায়ণ। সত্যনারায়ণের সেবা করিতে থাকুন। সত্যই মঙ্গল করিবেন।


(১৫) ভাগ্যানুসারে ভালমন্দাদি সুখ-দুঃখ  সংঘটন ঘটিয়া থাকে। অতএব ভাগ্যই ফলদাতা জানিবেন। ……সত্যনারায়ণের সেবা করিবেন। তাঁহার সেবায় ত্রিলোকের সকল ঋণ পরিশোধ হইয়া থাকে।


(১৬) লোকসকল স্ব স্ব ভাগ্যবশে আকৃষ্ট হইয়া দেহ গেহ সমাজ স্থান লাভ করিয়া অভিশপ্ত আবৃত দ্বারা সত্যধাম পতন হইয়া এই অস্থায়ী, সীমাবদ্ধ ভাবে আবদ্ধ হইয়া পড়ে। ইহা হইতে ভাগ্যভোগ উৎপন্ন হইয়া স্ব স্ব অদৃষ্ট ক্রমে স্বজন বন্ধু-বান্ধব প্রভৃতি আত্মীয় কুটুম্ব সম্মিলনে সুখী-দু:খী, শান্তি-অশান্তির তরঙ্গে পড়িয়া নানান লাঞ্চনা ভোগ করে। তাহার প্রধান কারণ কর্ত্তৃত্বাভিমান। এইজন্যই কালচক্রের অংশের দন্ড উৎপন্ন হইয়া মন বুদ্ধির দ্বারা কর্ত্তাকে সীমাবদ্ধ করিয়া দন্ডবিধান করিয়া থাকে। সত্যের অংশও নাই, দন্ডও নাই। অসত্যের অর্থাৎ অস্থায়ী বস্তুরই অংশ ভগ্নাংশ হইতে দন্ডাংশ হইয়া থাকে। ইহাকেই ভাগ্যফল বলিয়া জানিবেন। ……কালচক্র ভ্রমণ করিতে করিতে যখন দুঃখ কাল ক্ষয় হইয়া সুখকাল উপস্থিত করিবে তখন শান্তি ধারণা হইবে। অতএব কাহারো কোন দোষ নাই। স্ব স্ব ভাগ্য হইতেই দেবাসুরের আবির্ভাব হইয়া আত্মীয়কে অনাত্মীয় করিয়া তোলে। তাহার প্রমাণ নল, দময়ন্তী, শ্রীবৎস, চিন্তা, হরিশ্চন্দ্র, শব্যা,  রামসীতা, বেহুলা, লক্ষ্মীন্দর, প্রভৃতি মহাজনের জীবনীর যোগে দেখায়। ঐ সব চিন্তা না করিয়া সত্যের সেবায় রত হইয়া থাকিতে চেষ্টা করুন তিনিই সকল দু:স্তর ভবসাগরের পাড়ে পৌঁছাইয়া নিষ্কণ্টকময় আনন্দ ধামে পৌঁছাইয়া দিবেন সন্দেহ নাই;বিশেষত: আপনি ত কতই শান্তিস্থাপনের জন্য নানান চেষ্টা করিতেছেন এবং করিবেন, পুনরায়ও চেষ্টা করুন কোন বিধান করিতে পারেন কিনা। ভাগ্যে যাহা ঘটিবে তাহাই হইবে। সত্যনারায়ণ আপনার সকল বিষয় [?] [ব্যবস্থা] করিবেন। তাঁহার অধীন হইতে চেষ্টা করুন।


(১৭) যে কোনরুপ বিপদই হউক না কেন নাম করিলেই সমস্ত শান্তি হইয়া যাইবে এবং নিজেও শান্তি পাইবে।


(১৮) প্রারব্ধ ভুঞ্জমানানি গীতাধ্যান পরায়না। লোক সকল স্ব স্ব ভাগ্যানুসারে মরভূমে মনের দ্বারায় প্রলোভিত হইয়া প্রকৃতিকে আকর্ষণ করিয়া মনের দ্বারা ভাগ্যফল আমদানি-রপ্তানি করিয়া থাকে। কিন্তু ফলের অধিকার নাই। ফলদাতা সত্যব্রত জানিবেন। ……সত্যের সেবায় রত থাকিলে কোন অভাব হয় না জানিবেন। ভাগ্যফলের চিন্তা না করিয়া ভগবানেরই চিন্তা করিবেন। তিনিই সকল সঙ্কট মুক্তির স্থান। ……মিছামিছি অনর্থক বাজে চিন্তা না করিয়া সত্যের অধীন হইতে চেষ্টা করুন। তিনি ন্যায়পরতার আনন্দে রাখবেন।  ভাগ্যফল ত্যাগই সত্য। সত্যং পরমং ধীমহি। ত্যাগং, সত্য, শুচি দয়া জানিবেন। ধৈর্য্য ধরিয়া ভগবানের অধীন থাকুন, তিনিই পিতা যেমন পুত্রকে পালন করেন সেইরুপ তিনিও আপনাকে পালন করিবেন।  [?]


(১৯) সর্ব্বশক্তিমান ভগবৎপদ অর্থাৎ আশ্রয় ভুলিয়া ভাগ্যবশে প্রকৃতির তারতম্যানুযায়ী দেহ, গেহ, জাতিমান, সমাজ, বিদ্যা-বুদ্ধি, শত্রুমিত্র, সুখদুঃখ , শান্তি অশান্তি নানারুপ ঐশ্বর্য্য অনৈশ্বর্য্য উপভোগ করিয়া থাকে। ঐ প্রকৃতি গুণের দ্বারা পরিচালিত হইয়া লোক সকল অনুভূতি করিয়া থাকে। এই কারণেই অস্থায়ীর কর্ত্তৃত্বাভিমানে সীমাবদ্ধ হইয়া হিতাহিত জ্ঞান হারাইয়া অবিদ্যার প্রাঙ্গনে ভ্রমণ করিয়া সত্যকে অর্থাৎ বেদ, জ্ঞান, ব্রহ্ম আত্মাকে ভুলিয়া, নিজে স্বয়ং কর্ত্তৃত্বাভিমানে অবিদ্যার আলয়ে আটকিয়া কর্ম্মপাশে বিভিন্ন উপাধি বন্ধনে আটকিয়া যায়। উদ্ধারের উপায় জানিতে পারে না বলিয়াই আপন পর জ্ঞান উপলব্ধি হইয়া থাকে। মহাত্মার আকর্ষণে পড়িলে আর উপাধির অংশই থাকে না। ছোটকালে মায়ের কোল মনে আসে না। গাঢ় ঘুমের কোনও [জ্ঞান] মনে আনে না, পশ্চাতস্থ [?] জ্ঞান কি করিয়া মনে আনিবে? অতএব জরা প্রকৃতি মন গুণের দ্বারায় উপভোগ করিয়া থাকে, মনের দ্বারা বন্ধন মুক্ত হয় না। মনেই সত্যকে ভুলাইয়া পূর্ব্বপার অর্থাৎ সম্মুখে যাহা দেখে লোকে সকলি রুপান্তর অস্থায়ী। সত্যের যে স্থায়ী বস্তু মনে তাহা আনিতে পারে না। অতএব মনকে বাদ দিয়া অর্থাৎ মনের বেগ ধৈর্য্য ধরিতে ধরিতে অভ্যাস করিতে করিতে মন আপনিই লয় প্রাপ্ত হইবে। কাজেই মনের দ্বারা যাহা উপলব্ধি করা হয় সকলি অস্থায়ী এবং বন্ধন বলিয়া জানিবেন। ………সত্যনারায়ণ শব্দটি হইল সত্যের আশ্রয়কে (অয়ন) বলে। ইহা হইতেই সত্যনারায়ণ শব্দ বিন্যস্ত হইয়াছে। …………ভাগ্যের অতিরিক্ত কেহই কোন সময় পাইতে পারে না। ভাগ্যই ফলদাতা জানিবেন।


(২০) সত্যকে ভুলিয়া প্রয়োগ গারদে প্রকৃতির তারতম্য অনুসারে মায়া প্রপঞ্চে বন্দী হইয়া……প্রকৃতির গুণের পরিচালনের দ্বারা বহুরুপ ইত্যাদি অবলম্বন করিয়া সুখী-দু:খী ভাগ্য হইতেই ঘটিয়া থাকে। ভাগ্যই ফলদাতা, ভাগ্যকে মানিয়া ভাগ্যরথে চলিলে আর পরদেহ ভোগ করিতে হয় না জানিবেন। অবিদ্যারই তরঙ্গ হয়, বিদ্যা অবিদ্যা দুইভাগ ইহাকেই দ্বন্দ্ব বলে। ইহা হইতেই মন, বুদ্ধি, অহংকার উৎপন্ন হইয়া থাকে জানিবেন।  শত চেষ্টা করিয়াও লোকে ভাগ্যের অতিরিক্ত কিছুই লাভ করিতে পারে না। মধ্য হইতেই দ্বন্দ্ব উপভোগ ভুগিতে হয়। অতএব ভাগ্যকে আশ্রয় করিয়া সকল ঋণ পরিশোধ করুন। ……নাম সংকীর্ত্তনকেই যজ্ঞ বলে এবং নিত্যানন্দ স্বরুপ জানিবেন।  ব্রহ্ম, বেদ, যজ্ঞ, ব্রাহ্মণরুপে প্রকাশ। ”যজ্ঞ, দানং তপ:কর্ম্ম, পরমাণি মণীষিণ:”যজ্ঞের জন্যই কর্ম্ম, সীমাজ্ঞানে কর্ম্ম বন্ধ হয় জানিবেন। সত্যনারায়ণের আশ্রয় নিয়া থাকিলে কর্ম্ম মুক্ত হইয়া সমাপন করিয়া থাকে জানিবেন। ভাগ্যরুপেই ভগবান, তাহাকে তুলিয়া দুস্তর সাগরের উর্দ্ধঅধ: গতির দ্বারা কূল পাইতে পারে না।  ধৈর্য্যই ধর্ম্ম, ধৈর্য্যই কর্ম্ম, ধৈর্য্যই জ্ঞান, ধৈর্য্যই ধ্যান জানিবেন।


(২১) ভাগ্যানুসারে লোক দেহ গেহ সমাজ বিদ্যা বুদ্ধি ইত্যাদি লাভ করিয়া প্রকৃতির গুণের তরঙ্গের গতিতে ভোগ উপভোগ করিয়া থাকে জানিবেন। অতএব ভাগ্যই ফলদাতা। দেহ হইতেই ভোগ উৎপত্তি হয়, দেহত্যাগই ভোগদান, দেহই বন্ধনের কারণ দিবা-নিশি অর্থাৎ জন্মমৃত্যু ঘটাইয়া থাকে। দিবার অষ্টমকেই জন্মমৃত্যু বলে, অষ্টমকাল পর্য্যন্ত কাম, ক্রোধ, লোভের বেগ সহিষ্ণুতা শক্তির দ্বারা অবরোধ করিয়া থাকাকেই দেহত্যাগ বলে। ইহাকেই দু:খের ভাগ ত্যাগ করা বলে এবং সুখী বলে জানিবেন। আত্মার রথে চলিতে চলিতে সকল বন্ধন কাটিয়া যায়। যখন গাঢ় ঘুম হয় তখন তো মন থাকে না। আত্মা থাকে তো। সুখ-দুঃখ  থাকে না। সুখ-দুঃখ  মনের জল্পনা-কল্পনা জানিবেন। কর্ত্তা ছাড়িয়া সত্যের দাস অভিমানের শক্তিতে সকলি পাওয়া যায়। কর্ত্তা হইয়া ভাগ্যের বেশী কিছু পায় না জানিবেন।


(২২) পিতৃ সম্পদ হয় ধর্ম্ম, পতি সম্পদ হয় কর্ম্ম, পুত্র সম্পদ হয় পবিত্র। এই তিন কুল সাবিত্রীব্রত জানিবেন। শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ। ফাঁকিতে না পড়িয়া পিতৃসম্পত্তি উদ্ধার করিতে যথা- সাধ্য চেষ্টা করিতে ত্রুটি করিতে নাই। ভাগ্যং ফলতি সর্ব্বত্র। ভাগ্যকে মান্য করিয়া ভাগ্যরথে চলিলে দেহত্যাগ হইয়া দেহীকে মুক্ত করিতে পারে। নিজ নিজ দাবী না করিয়া কর্ত্তব্য সম্বন্ধে সচেতন থাকিতে হয়।


(২৩) সংসারের যে সকল সুখ-দুঃখ প্রদ আগমপায়ী গতাগতি অস্থায়ী আবরণের প্রতি যত্ন নেওয়া কি তাহার পরিহারের জন্য কোন রকমই ব্যাপ্ত থাকিতে নাই। ঐ সকল পদার্থই কালচক্রে প্রারব্ধ-ভোগ মাত্র উপস্থিত করিয়া থাকে। এই সকলি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মাত্র। ইহাদের আহরণ করার বিষয়কে তুচ্ছ করিয়া যাইতে হয়। ……সহিষ্ণুতাই পরম শক্তি। ………সংসারে একমাত্র পতিসেবাই পরম ধর্ম্ম, ইহার হাত ছাড়িতে যদি কোন বাধা উদয় হয় তবে তাহাকে সর্ব্বদা ত্যাগ করিবে। এই ত্যাগের জন্যই সহ্য করা দরকার। যে গিয়াছে তাহাকে পাওয়া যাইতে পারে না ইহাই জানিয়া বিচার করিয়া নিত্যই ধৈর্য্য আহরণ করিবে। এ সংসারে যাহা কিছু দেহ নিয়া সম্বন্ধ তাহা কখনও স্থির হইয়া থাকে না। সকলি চলিয়া যায়। বালক হইতে বৃদ্ধ জরা ব্যাধি দুঃখ  আসিয়া আক্রমণ করিয়া থাকে। এই অনিত্য বস্তুর জন্য চিন্তাভাবনা করা উচিত নহে। যতদিন বাঁচিয়া থাকিবে ততদিন তাহার প্রতি যথাসাধ্য শান্তি দেবার চেষ্টা করিবে। মরিয়া কি নষ্ট হইয়া গেলে তাহার জন্য দুঃখ  করিতে হয় না। ইহাই সত্য।


(২৪) ভগবানের ইচ্ছায় যাহা হইবে তাহার জন্য বাধা বাধক কি হইতে পারে?


(২৫) সত্যং পরং পরাধ্যেয়ং সর্ব্বমঙ্গল সুচনা।


(২৬) ভগবানের কৃপা ভিন্ন এ জগতে কিছু ঋণ পরিশোধের জীবে কোনই শক্তি ধারণ করিতে পারে না।


(২৭) বর্ত্তমানীয় সংসার জীবের কর্ত্তত্বমানী সম্পদ হইতে প্রাক্তন ভোগায়তন বিবৃত হয়। গুণাবর্ত্তনে যখন যাহা যাহা উপস্থিত হইয়া থাকে তাহাকে নিবৃত্তির উপায় না করিয়া ভোগে রাখাই জীবের কর্ত্তব্য। ইহাতে প্রারব্ধ ক্ষয় হইয়া পরম পদার্থ উৎপন্ন হয়। ভোগের জন্য ভয় করিতে গেলে সত্তাপ্রকৃতির অভাবই থাকিয়া যায়। সত্যং পরম ধীমহি। অদৃষ্ট চক্রে সুখ দুঃখ  ভ্রমণ করিয়া থাকে।


(২৮) দুর্ব্বলতা হেতু মনের স্থৈর্য্যশক্তির অভাব হয়।


(২৯) সংসার মায়াময়, চরাচর বৃত্তির পরিচর্য্যাবর্ত্তী দ্বারা মুগ্ধা করিয়া দিগদিগন্ত করিয়া থাকে। ইহার আবরণ মুক্তির প্রভাবে সকল জঞ্জাল নিবারণ করিয়া লয়, ভগবান আশ্রয় দ্বারা সর্ব্বশক্তি সাধন সমাপ্ত করে।


(৩০) ধৈরজ ধীর প্রকৃতি সদাশয় হইয়া থাকে।


(৩১) সময় হইতেই সকল প্রকাশ হইয়া থাকে। প্রারব্ধই ইহার বিধায়ক।


(৩২) সময় গতিকে সমস্তই ঘটিতেছে, তজ্জন্য চিন্তা ভাবনার কিছুই নাই। মেঘ জগতে কালক্রমে সঞ্চার হয়, পরিশেষে কালেতে আপনা হইতেই সর্ব্বপ্রকার নির্ব্বিঘ্ন হইয়া যায়।


(৩৩) ”প্রারব্ধংভুঞ্জমানানি গীতাধ্যান পরায়ণা। ”ভগবানের নাম রুপ একই। নাম নিয়া পড়িয়া থাকিলেই নাম করা হয়, অর্থাৎ কর্ত্তৃত্বদেহের অহংজ্ঞানকে পরিহার নিমিত্ত নামের প্রতিষ্ঠা করিয়া সেই নামের মন্দির দেহ মনে করিয়া বোধ হইলেই নাম প্রতিষ্ঠা হয়। সেই নামেরই সেবা করিয়া যাইতে যাইতে পরম পুরুষার্থ যে সামর্থা শক্তি ভগবান তাঁহার প্রকাশ হইয়া থাকে। এই দেহ ছাড়িয়া গেলে সেই যে ভাব আবরণ লাভ করিয়া জীবের বন্ধন যে প্রাক্তন তাহা মুক্ত হয়। ঐরুপ নামের চিন্তা করিতে করিতে প্রারব্ধ দেহ মুক্ত হইয়া নিত্যধামে চলিয়া যায়। এই সংসারের কাহারো কোন দোষগুণের প্রশংসা অপ্রশংসা না নিয়া নিরপেক্ষ ভাবে ভগবানের অধীন হইয়া থাকিলে কোন উৎপাত হৃদয়ে স্থান পায় না। পরম শান্তির আধার হইয়া থাকে। অতএব যে যেরুপই করুন না কেন সকলই তাহার গুণের প্রারব্ধ, সময়েতে যখন বুঝিতে পারিবে তখন আপনা আপনিই স্থিরবুদ্ধি হইয়া আসিবে। তার জন্য বাধা না দিয়া মিত্রতা রাখাই পরম শ্রেয়।


(৩৪) অদৃষ্ট হইতে যাহাই হইবে বহন করিতে কোন বিষয়ে চঞ্চল হইতে নাই। ভগবান যাহা করেন তাহাতে কোনরুপ অমঙ্গল হয় না, কারণ তিনি মঙ্গলময়। ভ্রান্তিবশত: নানান বিষয় দ্বারা চঞ্চল হইয়া জীবসকল দুঃখ  পায়। ভগবানে নির্ভর করিয়া থাকিলে তিনি মঙ্গলই দান করেন।


(৩৫) চেষ্টা করিতে বিরত না থাকিয়া কাজকর্ম্মের উন্নতির জন্য চেষ্টা করাই শ্রেয়:, সন্দেহ নাই। চেষ্টা করিবেন, পরে ফলাফল যাহা আছে অদৃষ্টচক্রেই প্রকাশ পাইবে।  ভাবনা কি?


(৩৬) প্রারব্ধ ভোগের বাধা দিবার কাহারো কোন ক্ষমতার আয়তনে আছে কিনা জানিতে পারি নাই। সংসার মায়াময়, ভ্রান্তজাল, এই অচ্ছেদ্য ভ্রান্ত সাগরেই জীবের দশা ঘুরিতেছে।


(৩৭) সহিষ্ণুতাই জগৎ মুক্ত করিয়া থাকে, ধৈর্য্যই পরমানন্দ।


(৩৮) জগতে মায়াভ্রান্তবশত: সর্ব্বদা সুখদুঃখ  অন্বেষণ করিয়া জীবদ্দশা ভোগ করিয়া থাকে। এই মায়াভ্রম হইতে উদ্ধারের পথ একমাত্র পতিসেবা অনন্যচেতা। এই বই আর কিছুই নাই। অতএব সর্ব্বদাই পতিশরণ দ্বারা নিত্যভক্তি আহরণ করিয়া নিত্য সেবায় সর্ব্বদা আবৃত থাকিতে সকল বেগ যাহা অদৃষ্টচক্রে যখন প্রতিভাত হইয়া থাকে সহ্য করিতে চেষ্টা করিবেন। ইহাতে পরমানন্দ যুগল মিলন হইতে পারিবে। মায়াভ্রান্ত তরঙ্গ অপসারণ হইয়া নির্ম্মল ভক্তির আবরণ লাভ করিতে পারিবেন।


(৩৯) এ জগতে চিন্তাময়ী দেবী পরমানন্দ হরিভক্তি স্বয়ং ভগবান জানিবে। এই যে অদ্বৈত, অনন্যচেতা, ইহাই ভগবৎভক্তি লাভে পরাকাষ্ঠা। ভগবান ধীর প্রকৃতিতে সতত বিরাজ করেন, ক্ষেম-শক্তি হইতে ধীরত্ব লাভ হইয়া থাকে।


(৪০) সংসার মায়াময়, নিত্য অনিত্যে প্রবাহমান। ইহার তাড়নার কবল অতিক্রমজন্য কেবলমাত্র সহ্য করাই ধর্ম্ম। যাহা হউক, প্রাক্তন সম্বন্ধদ্বারা কালচক্রে ব্যবস্থা হইয়া থাকে, ইহার ভোগদানই মুক্তি পদ। স্বরুপ শক্তি লাভের জন্য সর্ব্বদা ভোগান্ত সহিষ্ণুতার সাহায্য নিয়া সাধিত করিতে হয়।


(৪১) যজ্ঞ, ব্রত, তপ, জপ, তীর্থানুসেবনং এই সকলি গুরুতত্ত্বে সন্নিহিত [?] রহিয়াছে। গুরু আদিষ্ট পথ অবলম্বনে পড়িয়া থাকিলেই জগৎ মুক্ত হয়, এই জন্যই সহজ কর্ম্ম করিতে উপনিষদ প্রকাশ করে। কর্ত্তৃত্বাভিমান যোগে যে সকল কর্ম্মপ্রয়াস যুক্তে যা করা যায় সকলি ভ্রান্তফল উৎকর্ষণকারী হইয়া থাকে। স্বভাবের আশ্রয় ধর্ম্ম স্বধর্ম্ম প্রতিরোধক হইয়া পরিশেষে পরমানন্দ পদ উপভোগ করিতে পারে। উপস্থিত আয় ব্যয়াদি দ্বারায় যে সকল সুখের দু:খের অনুভাবন হইয়া থাকে তাহাও স্থায়িত্বের অভাব। অতএব ভক্তিযোগ পরমানন্দ সাধ্যসম্পদে অস্থায়ী কর্ম্মফলকে নাশ করিয়া নিত্যস্বরুপ পরিচর্য্যা ভগবৎ শক্তির আশ্রয় পাইয়া থাকে।


(৪২) কোন বিষয়ে পুরুষের [?] অধীর হইতে নাই। জগতে এক পরমাত্মার সঙ্গে সম্বন্ধ রাখিয়া সংসারের কার্য্য নির্ব্বাহ করিতে হয়। জগতে যাহা কিছু দেখা যায় এবং ব্যবহার করা যায় মমতাহেতু কর্ত্তৃত্ব অভিমান প্রাপ্ত হইয়া মোহিত হয়। ইহাতে পরমাত্মার শরণ থাকে না। অতএব দিবানিশি এ সংসারে প্রারব্ধ-বশত: যাহা যাহা সঙ্গ হয় সকলের মধ্যেই আলগ্ ,  যেমন আকাশ সকল বস্তুতেই মিশিয়া থাকে………তস্য হেতু আকাশের কোন অভাব হয় না, তেমনি আলগ্ হইয়া থাকিতে থাকিতে পরমাত্মার স্থান দর্শন হয়, শান্তির আকরে পড়িয়া যায় অভাব থাকে না।


(৪৩) পতিব্রতা ধর্ম্ম আচরণ করিতে করিতে নিত্যসিদ্ধ বিগ্রহ সকল আদিত্যলাভে বিশুদ্ধ ভাব ধারণ করিয়া সেবা বিঘ্ন পরিহার করে। অদৃষ্টচক্রই ফলাফল সুখ দুঃখ  প্রভৃতির দ্বারা ভাসমান থাকে। দেহ ছাড়িয়া গেলে পতিব্রতা কিছুরই অভাবে পড়ে না। নিত্যমুক্ত হইয়া ভগবানের সমীপ্য লাভ করিয়া তদ্দ্বারা ভক্তিপূর্ণ হইয়া থাকে।


(৪৪) ভাগ্যযোগে সকল ভোগবিলাস সমাগত হইয়া থাকে।


(৪৫) সত্য অপেক্ষা জগতে কি আছে?সত্য অনুশীলনে পরমানন্দ-ময় নিত্য সেবার শক্তি পাইয়া পরম প্রীতি লাভ করিয়া থাকে, অহৈতুকী প্রেমে ভাসাইয়া ফেলে। রসাল আনন্দ সত্যমন্দিরে অক্ষুন্ন থাকে। (সত্যং পরম্ ধীমহি)…(যুগল ভজন করে যারা, প্রেমানন্দে ভাসে তারা)মহাজন বাক্য।  স কালেনেহ মহতা যোগো নষ্ট: পরন্তপ।


(৪৬) ভগবান সর্ব্বত্র সম প্রকৃতির আশ্রয় নিয়া বিলাস করিয়া থাকেন। গুণ আবর্ত্তনে বিষমত্ব লাভ হইয়া অজ্ঞানবশত: সুখ দুঃখ ,  আয়ব্যয়ে পরিণত হয়। এই দুঃখ জ মুক্তের জন্যই ভগবৎ-সেবায় রত থাকিয়া নিরপেক্ষতা লাভ করেন, ইহাই মুক্তি। পাপপূণ্য দ্বারা জীবের শরীরে ভোগ হয় না, প্রাক্তনলব্ধ জন্য হইতে ব্যাধিসকল আক্রমণ করে। সমস্তই গ্রহবৈগুণ্য মাত্র। কালচক্রের গতি অনবরত পরিক্রমণ করিয়া থাকে। যখন যে সত্তায় উপভোগে অধিষ্ঠান থাকে তাহাই ভোগে লিপ্ত হয়।


(৪৭) সাধুর ভাগ্যে থাকিলে পাইয়া থাকে, বিধি অবিধি কিছুই নাই।


(৪৮) সংসার মায়াচিত্র [?] (ধোকাবাজি) সত্য অসত্য বিকাশ। মাত্র পতিব্রতাচারণী ধর্ম্ম হইতে এই সকল মায়া ভ্রান্ত দূর হইয়া ত্রিসন্ধ্যা লাভ করে, মুক্ত সত্তা পূর্ণরুপে জাগিয়া পরমানন্দ সেবায় স্নিগ্ধতা উদ্বর্ত্তন করে। মাত্রাস্পর্শীয় সুখাদি চঞ্চল স্পৃহা [?] নির্ব্বাণ চক্রে আবৃত করে, পরম তত্ত্বজ্ঞান জাগ্রত হইয়া অর্দ্ধমাত্রায় পরিণত করে, জীব ইচ্ছা ত্যাগ হইয়া কুলধর্ম্ম সনাতনী প্রকৃতি পতিব্রত রতিশক্তির পূর্ণতা করিয়া প্রেমানন্দ সাগরে আনন্দ সমুদ্রে নন্দরসে ডুবাইয়া চিরবন্ধন মুক্ত করে।


(৪৯) প্রারব্ধ এবং প্রাক্তন, ভাগ্য, অংশসম্ভূত ও এক কর্ত্তৃত্বজ্ঞানই হইবে। সূর্য্য উদয় হয়, দন্ডপলাদি বিভক্তরুপে মানব মাত্রই ভোগ করিতেছে, কোন মানবই সেই অংশ রুপ দণ্ডপলাদি ত্যাগ করিতে পারে না বলিয়াই ইহার অংশীভূত আশ্রয়ের সময়কে প্রারব্ধ বলে এবং কালচক্র বলে। সূর্য্য উদয় হইতে পুনরায় উদয়কালকে যে যে রুপে বিভক্ত বুদ্ধির সঙ্গ হয় তত্তৎ বোধের বিষয়কে ভোগ বলে। এই ভোগ আব্রহ্মস্তম্বপর্য্যন্ত সকল প্রাণিকেই আশ্রয় করিতে বাধ্য হয়। ত্যাগ করিবার কাহারও শক্তি নাই। গুরু আদিষ্ট [?] কর্ম্মের বৃদ্ধি করিতে করিতে আপন হইতেই সকল বিষয়ের বোধ হয়, কাহারো বুঝাইয়া দিবার ক্ষমতা নাই।


(৫০) গীতাখানা টীকা অন্বয় না দেখিয়া ধৈর্য্যভাবে পাঠ করিবেন। তাহাতে অনেক……বক্তব্য বিষয়কে জানাইয়া দিবে। ঐ গীতাটি ভগবানের হৃদয়, সন্দেহ নাই। এই শরীরে ভগবান আছেন তাঁহাকে জানিয়া লইতে পারিবেন। তাঁর নিকট সকল চেষ্টা রাখিতে পারিলেই সকল সংসার মুক্ত হয়।


(৫১) সংসার স্বার্থবশে ঘুরিতেছে, আপনার দোষ কি?পরের দেহে ভগবানকে দোষারোপে আরোপ করিয়া নিজ অস্থায়ী [?] স্বভাবের তাড়নায় বিবৃত থাকে। ইহা আপনার দোষ নয়, স্বভাবেরই বলিতে হয়। ইহা ভগবানের মায়া জানিবেন। আসুরিক ভাবের প্রাদুর্ভাবে আপনাকে বর্ত্তমান করিয়া আত্মসুখ পথ অন্বেষণ করিয়া থাকে, প্রবৃত্তির নিকট শক্তি ধরিতে পারে না। যাহার যে ভাগ্য তাহার ব্যতিক্রমের অধিকার জগতে কারই নাই। (ভাগ্যং ফলতি সর্ব্বত্র)মরাকে মারিতে কষ্ট [?] সংগ্রহ হয় না, জ্যান্তকে বুঝাইতে অনেক হাবিডুবি খেলতে হয়।


(৫২) নাম করিতে কোনরুপ ধারণ বজায় করবার বিধান নাই। ”নাম চিন্তামণি: কৃষ্ণশ্চৈতন্য রসবিগ্রহ:”।  কর্ত্তৃত্বাভিমান নিয়া তাঁর সেবা করিতে পারে না। অতএব নামের অধীন থাকিবার চেষ্টা করাই নামের কাছে থাকা। মনের দ্বারা সুখ দুঃখ , শান্তি অশান্তি উপলব্ধি হইয়া থাকে। নাম করিতে মনের কোন সাহায্য লাগে না, ইহা প্রাণের দ্বারা সম্পাদন হয় জানিবেন। অতএব নামই সত্য, তাকে ভুলিয়া গিয়া মনের ভ্রান্তি আকরে পরিভ্রমণ করিয়া জীব ত্রিবিধ, নানান ভাবে সঙ্কর জ্বালা ভোগে পড়িয়া যায়। সর্ব্বদাই নামের অধীন হইতে চেষ্টা করুন, নামে উদ্ধার করিয়া নিয়া যাইবে। নামের কোন ফলাফল নাই।


(৫৩) সংসারের তাড়নায় এই ত্রিজগতের মধ্যে এই ভগবানই নিষ্কৃতি লাভ আছেন, এতদ্ভিন্ন [?] দেব, দানব, গন্ধর্ব্ব, সিদ্ধচারণাদি পর্য্যন্ত এই সংসারে মায়ার নাটে পড়িয়া প্রারব্ধ ভোগ করিয়া যাইতেছেন। মানবের তো কথাই নাই। এই ভগবানের যে মায়া তাহার হাত হইতে ত্রাণের জন্য একমাত্র সত্যনারায়ণ আছেন। তিনি প্রতি ঘরে ঘরে নামরুপে বিরাজ করিয়া থাকেন। এই যে কৃতজ্ঞশালী মহাত্মাগণ শাস্ত্ররুপে জীবের মুক্তির জন্য নাম বিতরণ করিয়া রাখিয়াছেন। সেই নামের শরণ নিয়া পড়িয়া থাকিলেই এই কন্টকময় প্রারব্ধ দণ্ডভোগ মুক্ত হইয়া নিত্যধামে পরানন্দে ডুবিয়া সত্যস্বরুপ পতিদেবতার অপার শক্তি পাইতে পারে, সেই শক্তি হইতে প্রারব্ধ আকর্ষণ শক্তি ক্ষয় হইয়া যায়। তখন সকল শান্তি পাইতে পারে।


(৫৪) দেহ আবরণে পড়িলেই দেহীর জীব আখ্যা হয়। দেহ সকল প্রকৃতির গুণ হইতে উৎপন্ন হইয়া থাকে এবং গুণ সকলের তারতম্য বশত: কামনা, বাসনা, ইচ্ছা প্রভৃতির ক্ষেত্রে বিকার জন্মিয়া থাকে, তাহা হইতেই মন, বুদ্ধি, প্রাণ, অহংকার এবং অভিমান দ্বারা জীব সকল বদ্ধ হয়। ইহা হইতেই সুখী দু:খী, প্রাপ্ত এবং অপ্রাপ্ততার জন্ম হয়। ঈশ্বর কোন কিছু করেন না, কারণ ঈশ্বর নির্লিপ্ত। তাঁহাকেই জ্ঞানীগণ স্বভাব বলিয়া থাকে। তাঁর কোন অভাব নাই, কাজেই, সৃষ্টি করেন না। প্রকৃতির গুণ হইতেই সত্ত্বগুণের দ্বারা সুখী, রজ:গুণের দ্বারা দু:খী, তমগুণের কার্য্য হয় কেবল শোক-সন্তাপ। এই সকল গুণের তারতম্যতা হেতু বাসনাদি উৎপন্ন হয়।  “কাম এষ ক্রোধ এষ রজোগুণসমুদ্ভব: মহাশনো মহাপাপ্না বিদ্দ্যেনমিহ বৈরিণম”। ।  ভগবানের বাক্য গীতায় প্রকট আছে। এই সকল কর্ম্মের দ্বারা ভগবানকে জানা যায় না। ভগবানের সঙ্গে সম্বন্ধ জীবের স্বরুপ (অর্থাৎ আনন্দময়), সেই আনন্দ পাইতে বাধক, ঐ সকল গুণের বিকৃতি মাত্র। প্রলোভনে পড়িয়া কর্ত্তা হইয়া গুণের তারতম্য শাসনে নিযুক্ত থাকিলেই স্বরুপ ভুলিয়া গিয়া মায়া ভ্রান্তির দাস হইয়া ঘুরিতে থাকে। এই জন্যই অহং অহংকার দ্বারা বুদ্ধিভ্রম হইয়া সুখের লালসায় অপার অগাধ সাগরে পড়িয়া থাকে, কৃষ্ণ স্মৃতি [?] হয় না। স্মৃতিভ্রংশ ঘটিয়া পড়ে, এই জন্যই ভগবানকে জানিতে পারে না। অহংকার বিমূঢ়াত্মা কর্ত্তাহমিতি মন্যতে, ভাগবতে বলিয়া থাকে।  কামনাদি যাহা কিছু কর্ত্তৃত্বাভিমানে সুখ-দুঃখ জনক দেহীর নিকট উপস্থিত হয় [সেই] সকল বেগ সহ্য করিতে করিতে দেহে সঙ্গে সঙ্গে গুণের প্রারব্ধ দণ্ডমুক্ত হইয়া ভগবানের সম্বন্ধতা লাভ করিয়া থাকে। জীব সকল নিত্য ভগবানের দাস, গুণের বিকৃতি বাসনায় পড়িয়া কর্ত্তা হইয়া নানান উপাধি হইয়া এই সংসারে ঘুরিয়া বেড়ায়। রজ:গুণ হইতে যাহা উৎপন্ন হয় তাহাকে কামনা বলে, বাসনা বা [?] ইচ্ছা বলে। এই কামনাদির [দ্বারা] আহত হইলেই রাগ, দ্বেষ, হিংসা প্রকাশ হইয়া পড়ে, ইহার দ্বারা সর্ব্বদাই জন্ম মৃত্যুর কবলে পড়িয়া যায়। এইজন্য এই স্থানকে মরুভূমি অর্থাৎ দুষ্পুরণ স্থান বলে। ইহা পূর্ণ হয় না। অতএব সর্ব্বদাই ইহাদের বেগ ধৈর্য্য ধরিতে ধরিতে ভগবৎতত্ত্ব বোধ হয়। হ্রাস হয় না। কেবল নাম করিবেন। প্রাক্তনের কর্ম্ম সকলই দেহের সঙ্গে সঙ্গে তরঙ্গে পড়িয়া থাকিব। নিত্যধাম অবিচ্ছিন্নরুপে লাভ করিতে পারিবেন, সন্দেহ নাই। ……দেহে বন্ধনের শক্তিতে শক্তিহীন জন দেহত্যাগে পূর্ণ শক্তিমান হ’ন। দেহেরই মৃত্যু কিন্তু দেহী জন্মেন না, মরেন না। তিনি সর্ব্বদাই থাকেন।


(৫৫) সংসারে প্রারব্ধ বশত:ই জীবের সুখ দুঃখ  গতাগতি চলিয়া থাকে। কোন জীবই প্রারব্ধ হাত এড়াইতে চাহিলেও পারে না। এই জন্যই আসা যাওয়ার নিশ্চয়তা কিছুতেই বলিতে পারে না। জীব অধিষ্ঠানে যাহা যাহা উৎপন্ন হয় সকলি প্রাক্তন জানিয়া নিবৃত্তি হয়। যখন সময় অধিষ্ঠান হয় তখনই সেই সেই কার্য্য করিতে জীবের ক্ষমতা প্রকাশ পায়, ভ্রমতাবশত: ভাব অভাবের ধারণা করিয়া থাকে।


(৫৬) ”সত্যং পরম ধীমহি” শ্রুতির বাক্য। পতিব্রতা ধর্ম্মকেই ব্রজবাস বলিয়া জানিলে মনের চঞ্চলতা অভাব থাকে না, কারণ সর্ব্বদাই অষ্টকাল সত্যস্বরুপ ভগবান লীলা প্রভাবে ধীরা স্থিরা গম্ভীরা রসে ডুবিয়া থাকেন। সেই লীলার প্রেমরস তরঙ্গে টলমল হইয়া চঞ্চল রসে মনও চঞ্চল তরঙ্গে উথলিয়া ভাসে এবং বেড়ায়। সেই মন স্থির করিবার জন্য চেষ্টা করিতে নাই। কারণ মনের স্থির দ্বারা আদি শান্তির বৃদ্ধি হয়, ইহার স্থিতি সংসারেরই বন্ধন, কারণ………মাত্র সুখ পাওয়া যায়, মনের সুখ স্থিতি থাকে না, গতিশীল [?]যেহেতু মনই ইন্দ্রিয় অধিপতি। ইন্দ্রিয়সকল মাত্রা সীমাবদ্ধ বলিয়াই সুখের অন্তে দুঃখ , দু:খের অন্তে সুখ ইহাই হয়, ব্রজ ছাড়িয়া পড়িয়া যায়, ব্রজে বাস হয় না। এইজন্য মনকে সর্ব্বদাই চঞ্চল হইতে দিবে যে পর্য্যন্ত দেহ অভিমান থাকে। দেহ অভিমান যখন চলিয়া যায় তখন সাবিত্রীর শক্তিতে অনাবরণ পতি যাহাকে বেদে নিত্য সত্যবান, ভগবান বলিয়া প্রকাশ হয় (?)। মনের দ্বারা অভিমানী হইয়া জীবভাবে হ্রস্ব, দীর্ঘ, প্লুত তিনটি অবস্থা হয়। তদ্দ্বারা অভিমানী হইয়া জীবগণ পতিসেবা ভুলিয়া মায়ামৃগ অর্থাৎ অনিত্য সুখের প্রত্যাশিত [হইয়া] সীতা যে পবিত্র…….. অশোকবনের চেড়ীর দৌরাত্মে পড়িয়া বৃথা চিন্তায় মন চঞ্চলতা-বশত: সুখদু:খের তরঙ্গায়িত হইয়া কষ্ট পায়। এইজন্য রাবণের অশোক বনে সীতা আটক থাকিয়া চেড়ীদের প্রলোভন (ঐহিক সুখ ভোগ) শাসন (ঐহিক দুঃখ ) বোধ করে। এই সুখের অভাবই দুঃখ  এবং দু:খের অভাবকেই সুখ আখ্যা হয়। এই প্রকার চেড়ীর উৎপাত বিষয়গণকে সংসার বলে। এই সংসারের যত বেগ সমস্তই ভাগ্যানুসারে হয়, কারণ পতিসেবা ভুলিয়া অভিমানের সেবায় যোগ দিয়া থাকাতে হইয়াছে। অতএব ঐ তরঙ্গ হইতে উদ্ধার হওয়ার একমাত্র ধৈর্য্য ধরিয়া পতিসেবা করিতে করিতে পতি অনাবরণে প্রবেশ করিয়া উদ্ধার করিয়া লয়, যত বাধক সকলকে সংহার করিয়া। এই ধর্ম্মের নায়কনায়িকাগণ পতিসেবার পরাকাষ্ঠা পথ নিদর্শন করিয়া খুলিয়া দিয়া রাখিয়াছেন। এই পতিসেবাই ধর্ম্ম, ইন্দ্রিয়ের সুখ অন্বেষণ ধর্ম্ম নয়। অতএব সর্ব্বদা সকল বাসনার বেগ ধৈর্য্য ধরিয়া পতিসেবায় তৎপর থাকিবার চেষ্টাই উপাসনা। পতি সর্ব্বদাই অকলুষ থাকেন, যেমন সূর্য্য মেঘাচ্ছন্ন হইলেও মলিন হয় না। সেইরুপ পতিকে কেহ নিন্দা করিলেও পতি কলুষিত হ’ন না। নিন্দা সকলই পতিসেবাপরায়ণ সতীর প্রভাবে নিন্দাস্বরুপ যে মেঘ তাহা ভস্ম হইয়া গিয়া পতি নির্ম্মল জ্যোতি-প্রভা জ্যোতির্ম্ময় আনন্দকারী শক্তিশালী হয়। সর্ব্বদাই পতি দেবতা হৃদয়ে রাখিয়া দিলে কোনরুপ মেঘে আচ্ছন্ন করিতে পারিবে না। কেবল নাম করিবেন।


(৫৭) চেড়ীর শাসন এবং প্রলোভন মুক্তির জন্য কর্ত্তৃত্ব, অর্থাৎ মনে যাহা ভাল বোধ হয়, সেই বেগ সহ্য করিয়া যাইতে যাইতে দেহাদি প্রতিভা মুক্ত হইয়া যখন নিরাময় চিত্ত নির্ম্মলতা প্রাপ্ত হয় তখন আর মায়ামৃগ থাকে না, অর্থাৎ প্রতিমায় প্রলোভিত হয় না। চেড়ীও থাকে না, দুঃখ ও থাকে না। দানব, রাক্ষস, মানব, এ কোন উপাধি থাকে না। কেবল অনাবরণ আনন্দই বহিয়া যায়। এই অবস্থাকে ভগবানের প্রাপ্ত বলা যায়। সকল জল্পনা কল্পনা, ভালমন্দ বিচার না করিয়া শাস্ত্রমত পতিসেবা করিয়া চলিতে থাকুন, এই পতিসেবাই পরম পদার্থ পদ প্রকাশ করিবে। অন্ধ বিশ্বাসই হউক, স্মৃতি বিশ্বাসই হউক, তাহা না দেখিয়া কেবল সত্যনারায়ণের সেবাপরা হইয়া থাকুন, তাঁহার প্রসাদে পরাশান্তির উৎপন্ন হইয়া পরম সুখ, যাহা বিচ্ছেদ হয় না, তাহাই পাইবেন। বলে,  ”বিদ্যাধনমদেনৈব মন্দভাগ্যাশ্চ যে নরা: পতিসেবাং ন কুর্ব্বন্তি সত্যং সত্যং বদাম্যহম্। ” পতিসেবা পরং তীর্থং অন্য তীর্থমনর্থকম্ সর্ব্বাতীর্থাশ্রয়ং দেবী সত্যসেবাং বদাম্যহম্। ।  অতএব সর্ব্বদা পতি বৈ আর কোন গ্রন্থই না পড়িয়া, কাব্য রচনার অধিপতি না হইয়া স্বভাবসিদ্ধ পতিভক্তি, প্রীতি, শ্রদ্ধাশক্তি আহরণে সর্ব্বদা যত্নশীল হউন পতিসেবা শক্তিতেই আপনাকে দুর্গম, দুর্গতিময় সংসার গারদ বন্ধন মুক্ত করিয়া সত্যলোকে নিত্য-ধামে নিয়া যাইবে সন্দেহ নাই। পতিসেবা ছাড়া এ জগতে কিছুই নাই……[যখন] ক্ষণিক ফলাফল মুক্ত হইয়া পতিসেবাই প্রবল হয়, তখন কালের কবল হইতে পতি উদ্ধার করা যায়। তখন যে ভাব সেই ভাবই পতিসেবা। ভগবৎ সেবায় তারতম্যবুদ্ধি থাকিবে না। স্ত্রীত্ব, পুরুষত্ব অভিমান মাত্রা, আর কিছুই থাকে না; যেমন সাবিত্রী, কালী, দুর্গা, সরস্বতী, গঙ্গা প্রভৃতির পবিত্রতা। ভগবান যাহাকে বলে ভগবতীও সেই অর্থ ই হয়। ইহাতে পাপ পুণ্য ভিন্ন বুদ্ধি থাকে না। পাপ শব্দই ভ্রমমাত্র।


(৫৮) [এই পত্রখানা দেখিলেই বুঝা যায় যে পত্রলেখিকা একখানা কাগজে কতকগুলি প্রশ্ন লিখিয়া উত্তরের জন্য শ্রীশ্রীঠাকুরের নিকট পাঠাইয়াছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুরও ঐ কাগজখানাতেই প্রশ্নগুলির পাশে তাঁহার উত্তর লিখিয়া ঐ ভদ্রমহিলাকে পাঠাইয়া দেন। স্থান সঙ্কীর্ণতার দরুন শ্রীশ্রীঠাকুরকে অনেক স্থানে অত্যন্ত ক্ষুদ্রাক্ষরে লিখিতে হইয়াছে এবং কখন কখন লাইনগুলি একের উপর আর একটি উঠিয়া বিশৃঙখলার সৃষ্টি করিয়াছে। অতি কষ্টে এই পত্রখানার পাঠোদ্ধার করিতে সক্ষম হইয়াছি। ] ১।  চিত্ত স্থির করিবার উপায় কি?-বাসনা, ত্যাগ, দরকার না থাকা [?] পতি বৈ আর কিছুই নাই এই পতিব্রতা ধর্ম্ম, পতিগত বাসনা।  ২।  ভগবানকে পাইবার উপায় কি এবং প্রাণের কিরুপ অবস্থায় তাঁহাকে পাওয়া যায়?-পতিতে প্রেম উৎপন্ন হইয়া চিত্তের কর্ত্তার উপাধি যখন থাকে না তখন এই পাখীর পতিই ভগবৎশক্তি প্রকাশকারী স্বরুপ করেন, প্রাপ্ত দেন।  ৩।  ধ্যান কাহাকে বলে?-চিন্তাকে, যে চিন্তা অবিচ্ছিন্নভাবে দৃঢ় অনুরক্ত হয় তাহাকেই ধ্যান বলে। এই চিন্তাকেই নাম বলে।  ৪।  জীবের মনের কোন অবস্থাকে ভক্তি বলে?-অনর্গল [?] ভগবানের ছায়া স্বরুপ অবিয়োগে অকর্ত্তার অবস্থা যখন হৃদয়ে উদয় হয়। ভগবান এবং ভক্ত একই, তৎ-চৈতন্য ভক্তিরুপা।  ৫।  পূজা কাহাকে বলে?-আপন কর্ত্তৃত্বাভিমান সহ সকল ইন্দ্রিয়, ইচ্ছা বাসনাদি সকল দান করাকে।  ৬।  পুষ্প, চন্দন, ধূপ, দীপ জ্বালাইয়া পূজা করিবার অর্থ কি?-জীব যাহা কিছু ভাল, সুখকর বলিয়া বোঝে সেই সমস্তই ভগবানেতে দান।  ৭।  বাহ্যিক উপকরণ ব্যতীত ভগবানের পূজা অথবা তাঁহাকে পাওয়া যায় কি না এবং তাহা কি উপায়ে পাওয়া যায়?-অন্তরের সুখকর ইচ্ছা বর্জ্জিত হইলেই ভগবানের পূজা হয়। পতিসেবাই পূজা। পতিসেবায় যখন পতির দেহ ইন্দ্রিয়াদি অভিমান মুক্ত হইয়া কাল বণ্টন হইতে অনাবরণে প্রবেশ হয় তাহার প্রতি লক্ষ্য [?] যোগই সত্যবান হয়। ইহাকেই দশচক্রে ভগবান ভূত বলে। বাসনা মুক্তই ভগবান।  ৮।  আত্মা এবং পরমাত্মার পার্থক্য কি?-একই বস্তু। … ৯।  আত্মারুপে ভগবান ভিন্ন দেহে প্রকাশিত হইবার কারণ কি?-প্রলোভন, মায়ামৃগ আচ্ছন্নতা। কর্ত্তা হওয়াই কারণ।  ১০।  দেহত্যাগের পর আত্মা কোথায় যায় এবং প্রত্যেক আত্মার কয়বার জন্ম হয়?-আত্মা কোথায়ও যায় না;মনের প্রয়োজন বদ্ধতার দরুন আত্মা সীমাবদ্ধ হয়, এইজন্যই বাসনা ত্যাগ হইলেই মুক্ত হয়। বাসনায় আচ্ছন্ন থাকে, মন বুদ্ধির সহ পতিগত বাসনা হইলে আত্মার উপাধি যায়।  ১১। আত্মার সদ্ গতি কাহাকে বলে?-কর্ত্তা বুদ্ধিহীনতা ভাবকেই সদ্ গতি [বলে]; বাসনা শূন্য [হইলেই] সদ্ গতি হয়।  ১২। আকস্মিক কোনও রুপ আঘাত প্রাপ্ত হইলে জীবদেহ হইতে প্রাণ চলিয়া যায় কেন?-কোষবদ্ধ [?] বাহির হইলে খালি কোষই অর্থাৎ দেহ পড়িয়া থাকে, তাহার কোন কর্ম্মই থাকে না। যন্ত্রের দুর্ব্বলতার দরুন হার্ট ফেল যাকে বলে।  ১৩।  জীবের প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন হইবার কারণ কি?-গুণের তারতম্যই কারণ; সত্ত্বগুণের পবিত্রতা, রজের চঞ্চলতা, তমের অভাব, এই জন্যই জীবে তারতম্য ঘটিয়া যায়।  ১৪। প্রারব্ধ শাসন কাহাকে বলে? “প্রাক্তনের ফল” এই কথার অর্থ কি?-প্রাক্তন বলে গুণে শ্রেষ্ঠতাভাবের দ্বারা যেই গুণের শ্রেষ্ঠতা তাহার অধীন হইয়া চলে বলিয়াই প্রারব্ধ, ভাগ্য, অদৃষ্ট উপাধি হয়। যখন রজ:গুণ সাম্য অবস্থা হয় তখন গুণাতীত হইয়া প্রারব্ধ মুক্ত হয়। জীবত্ব থাকে না, শিবত্ব হইয়া যায়, বাসনা শূন্য হয়।  ১৫।  পাপ পূণ্য কি?-মনোবৃত্তি, মনের ভ্রমেই পাপ পূণ্য হয়।  “মন: করোতি পাপানি মনো লিপ্যতে পাতকৈ:। । ” ১৬।  সুকৃতি দুষ্কৃতির ফলাফল কি?-সুকৃতি সুখ, দুষ্কৃতি দুঃখ ফল হইয়া থাকে।  ১৭।  স্ত্রীজাতিকে পাপযোনী কেন বলা হয় এবং সাধনভজনে তাহাদের কোনও অধিকার আছে কিনা?-মনের অভিমানই স্ত্রী পুরুষ; ঘুম হইলে স্ত্রী পুরুষ ভিন্ন বোধ থাকে না। যখন কর্ত্তাভিমান বিয়োগ হইয়া মন পতির প্রাণের অধীন হইয়া যায় [তখন] কোনরুপ দেহের ইন্দ্রিয়ের [বোধ থাকে না] ১৮।  কি কর্মের ফলে কোন্ যোনীতে জীবকে কতবার জন্ম নিতে হয়?-কর্মফলেই জীবকে আকৃষ্ট করিয়া গুণের তারতম্য সূত্রে ফলাফলরুপ দেহ পাইয়া নানারুপ আবরণে পড়ে। বাসনানুযায়ী মনের (মানের) সীমার অধীন হইয়া ভিন্ন ভিন্ন ভাবে থাকে। সীতা মায়ামৃগে চাড়িত হইয়া রাবণ (অহংকার) হইতে রাক্ষসপতি অর্থাৎ ক্ষয়শীল (ভূত) প্রবৃত্তির আধারে আটক থাকিয়া কেবল সুখই ভাল বুঝিয়া তাহাই রক্ষা করবার জন্য ব্যস্ত হয়।  এই জন্যই ইহাকে অশোক বন বলা যায় চেড়ীতে সর্ব্বদা এই অশোক বনে দুঃখ  দেয়, কারণ প্রলোভন ও শাসন। যেখানে প্রলোভন সুখের প্রতিমায়ই হইয়া থাকে ক্ষরতা হেতু সেই প্রলোভনীয় প্রতিমার হ্রাস হইলে দুঃখ  হয়। অস্থায়ী বিষয় বলিয়াই ইহাদিগকে চারণ বলে, ইহারাই প্রলোভন শাসন।


(৫৯) এই সংসারে নিত্য, নিরঞ্জন ধৈর্য্য স্থায়ীরুপে জাগাইতে চেষ্টা করাই পরম উপাসনা। সর্ব্বদা যাহাতে অকর্ত্তা বুদ্ধির গোচরে যাওয়া যায় তৎপক্ষে নিত্য চেষ্টা করাই স্বধর্ম্ম জানিবেন। ……চিন্তা করিবেন না।  মন বুদ্ধিতে যাহা প্রাপ্ত অপ্রাপ্ত দ্বারা সুখ দুঃখ , ভাব অভাবাদি উৎপন্ন হয় তাহার সকলি স্বপ্ন জানিবেন, এবং ভ্রান্তিমূলক মাত্রা ক্ষর পদার্থ-অতএব সুখে দু:খে লাভে অলাভে সমং কৃত্বা কার্য্য করিবে। ফলাফলে যাইতে নাই। যখন যে অবস্থা সেই অবস্থায়ই ভগবৎ শরণ লইতে যাইবে।


(৬০) এই সংসারে ভাগ্যানুসারে জীবের প্রকৃতি দণ্ডাদি ভোগ করিয়া থাকে। যে পর্য্যন্ত ভোগের অবসান না হয়, সেই পর্য্যন্তই পাপপুণ্য, ধর্ম্ম অধর্ম্ম, শান্তি অশান্তি প্রভৃতির তরঙ্গ খেলিতে থাকে। এই তরঙ্গ শাসনের হাত হইতে উদ্ধার হইলেই পরম শান্তি উপস্থিত হয়। যাহা পাইলে তরঙ্গ থাকে না। অতএব, এই অনিত্য, অস্থায়ী, সীমাবদ্ধ বিষয় ভেদাদি কর্ত্তৃত্বাভিমানের উৎপত্তি সংলগ্ন সুখের দু:খের জন্য পিপাসা ত্যাগ করাই পরম ধর্ম্ম। ক্ষণিক মাত্রাস্পর্শ সুখের মোহে অনন্ত সুখকে নষ্ট করিবেন না।  সংসার মায়াময়, ভ্রান্তমুগ্ধ অজ্ঞান বশত লোকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হইয়া ক্ষণিক হুজুগ সুখের লালসা রসে [?] বিবৃত হইয়া সৎ অসৎ জ্ঞানশূন্য হইয়া সত্যধর্ম্মকে ত্যাগ করে। তৎ বিষয় দ্বারা পরিণামে নরক যন্ত্রণা ভোগের বিষয় জানিতে পারে না। যাহা হউক, আপনি সর্ব্বদাই নাম করিয়া যাইবেন, পাপপূণ্য দায়িত্ব বন্ধন হইতে আপনাকে অচিরেই ভগবান কৃপা করিয়া উদ্ধার করিবেন সন্দেহ নাই। আপনি নাম ভুলিবেন না। ঐহিক সুখের লালসা ভোগাদিকে তুচ্ছ করিয়া নামের আধিপত্য দ্বারা সকল অভাব ক্ষয় করিতে থাকুন। ……ভাগ্যবশে যাহা লাভ করেন ভোগ করিয়া যান্।


(৬১) নাম সত্য, নাম বৈ আর এ জগতে কিছুই নাই।


(৬২) কালী আর কৃষ্ণ, কি রাধা, কি ভগবান দ্বিতীয় কিছুই নাই। সকলই একাদশ [?] বলিয়া জানিতে হয়। যত কিছু ভিন্ন ভিন্ন নাম পাওয়া কি দেখা যায় সকলই পতির বিভূতিমাত্র জানিতে হয়। তাহাতে ক্ষোভের হেতু নাই।


(৬৩) সংসার মায়াময়, কর্ত্তৃত্বাভিমানে জরাকীর্ণ থাকায় সৎসঙ্গ ভ্রম হইয়া নানাবিধ ভোগ বিলাসে চিত্ত আবর্জ্জন থাকে। অতএব সর্ব্বদা অকর্ত্তা হইতে যত্নশীল থাকাই জীবদ্দশার কর্ত্তব্য।  ”ন কর্ত্তৃত্বং ন কর্ম্মাণি লোকস্য সৃজতি প্রভু:।  ন কর্ম্মফলসংযোগং স্বভাবস্তু প্রবর্ত্ততে। । ”অতএব কর্ত্তৃত্বাভিমান না থাকাই জীবের স্বভাব। গুণের মধ্যে কর্ত্তৃত্ববুদ্ধি হইয়া স্বভাব গুণগত দাসত্ব শঙখলে বন্দী হইয়া গুণাবর্ত্তে নানান বাসনায় জড়ীভূত হয়। এই কারণে সুখী দু:খী, লাভ লোকসান, ইত্যাকার দ্বন্দজ জ্ঞান হয়। দুঃখ  মোচন জন্য সৎ অসতের আবরণে পড়ে বলিয়াই জন্মমৃত্যুর ঘোষণা থাকে। অতএব সকল অবস্থায়ই সর্ব্বতোভাবে বুদ্ধিকে স্থিরেতে রাখিবার চেষ্টা করিতে করিতে বুদ্ধিও নিদ্রিতাবস্থার ন্যায় অকর্ত্তা হইয়া স্বপ্নের ন্যায় প্রারব্ধকর্ম্মের ভোগ ইন্দ্রিয়াদির ক্রিয়া সাধন সমাপ্ত হয়, অর্থাৎ স্বপ্নের মধ্যে যেমন নানান স্থানে গতাগতি কথাবার্ত্তা ইন্দ্রিয়াদির ক্রিয়া হয়, নিদ্রাভঙ্গ হইলে তাহার অস্তিত্ব কিছুই থাকে না, সেইরুপ জাগ্রত অবস্থায় বিষয়কর্ম্ম ইন্দ্রিয়াদির দ্বারায় সমাপন করিয়াও তাতে অস্থির বুদ্ধি মিশে না। এইভাবে সংসারবন্ধন মুক্ত হইয়া দেহত্যাগ প্রাপ্ত হয়, ইহাই মুক্তি। এই পদ ভিন্ন বাসনাদি দ্বারায় আবদ্ধ থাকায় সংস্কার [?] বশত দেহত্যাগ করিতে পারে না। বাসনা পূরণ জন্যই ভুয় ভুয় শরীর ধারণের দরকার হয় বলিয়া মুক্তি পায় না।


(৬৪) প্রার্থনাই জগৎ বন্ধন করে, এই জন্যই পৃথ্বী উপাধি লোকে সৃজন করে।  “ধ্যানমূলং গুরুমূর্ত্তি পূজামূলং গুরু পদম। মন্ত্রমূলং গুরুর্ব্বাক্যং মোক্ষমূলম গুরু কৃপা। । ” তারাতারি পাকাইতে গেলে……সমস্যা হয়।  ”ধৈরজই ধর্ম্ম বলিয়া থাকে, স্বধর্ম্মই যুগল মিলন করিতে পারে। পরধর্ম্মে বেগ ত্যাগ, নিবারণ অপেক্ষা সহ্য করাই শ্রেয়!” (কালে আত্মনি বিন্দন্তি)


(৬৫) যাহা পারেন সতত উপদেশ পালনের চিন্তা করিতে থাকুন। ঐ চিন্তাই নাম করা হয় (নাম চিন্তামণি: কৃষ্ণশ্চৈতন্যরস বিগ্রহ:।  নিত্যশুদ্ধো নিত্যমুক্তোহভিন্নাত্মা নামনামিনো:।।) এই প্রমাণে অস্তিত্ব রাখিয়া লইবেন……মা শব্দ জগতের সকলেই করে, এবং পিতাও তাই, আমিও শব্দবাচ্য, অতএব আমার মা, আমার পিতা আমি জগন্ময়ই হইয়া আছি। পুত্র, কন্যা, কলত্র ভিন্ন শব্দ নয়, একমাত্র ভগবানই, ভ্রমবশত: ভিন্ন বুদ্ধি ঘটায়, ভ্রান্ত যুক্ত হইলেই এক ভাষাই সর্ব্বময় দিবানিশি;ব্রহ্মচৈতন্যই জগতের মা। চিন্ময় আশ্রয়ই বধু, আমি তদ্ভাব, এই সমবেত বুদ্ধিই গুরু, জগৎকে উদ্ধার করে। অতএব সকলকে সকল ভাবাপন্ন লোকের প্রতি এই উপদেশে জগতকে ভাসানই উপাসনা। অকর্ত্তাবুদ্ধির প্রতিষ্ঠাই পরমানন্দ পদ প্রাপ্ত হইয়া থাকে।


(৬৬) আপনি সর্ব্বদা সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তৃত্ব অংশটুকু, যে নাম অধিকার করিয়াছেন, সেই নামের অধিকারে দিয়া তাঁহারই সেবক অভিমান দ্বারা তাঁহারই নিত্য অর্থাৎ অবিচ্ছেদে সেবা করুন। তিনিই আপনার সকল কলুষ পরিহার করিয়া আপন কোলে স্থান দিবেন। যেই নাম করিতেছেন, ঐ নামই সত্য, সত্যের অধীন হইলে সতী উপাধি হয়। সতীই দেহত্যাগ করিয়া গৌরীপদ লাভ করত: সত্যরুপ বিশ্বনাথের মিলনে হরগৌরী উপাধি হইয়া থাকে। অন্নপূর্ণা, বিশ্বনাথ, কি জগ্ননাথ, কি ব্রজনাথ, ইনিই রামসীতা, রাধাকৃষ্ণ বা ভগবান সত্যবান বলিয়া জানিবেন। ইহা ছাড়া আর কিছুই যাহা দেখা যায়, বুঝা যায়, সকলি অস্থায়ী জানিবেন (মরুভূমি); ঐ নামই সত্য। …… জগতে পরিচয়ের বিভিন্নতা কিছু নাই, কারণ আত্মা, যাকে প্রাণ বলে, তিনি এক জানিবেন। দেহসকল প্রকৃতি বিভিন্নতায় রুপ রুপান্তর হয়, প্রকৃতির গুণের দ্বারায় পরিচালিত হয় মাত্র জানিবেন।


(৬৭) লোকসকল মনের দ্বারা আকৃষ্ট হইয়া সত্যকে ভুলিয়া অস্থায়ী প্রকৃতিতে ভাগ্য অনুসারে পড়িয়া তাহার গুণের উর্দ্ধ অধ: প্লাবন [?] দ্বারা পরিচালিত হইয়া কালচক্রের অধীন হইয়া সত্যকে ভুলিয়া প্রকৃতির সহচর হইয়া থাকে। এই সঙ্কট হইতে মুক্তির জন্যই সত্যের অধীন হইতে চেষ্টা করিবার অভ্যাস করিতে করিতে সকল ঋণ মুক্ত হইয়া অবিচ্ছেদে সত্যের প্রসাদও লাভ করিয়া পরম শান্তি প্রাপ্ত হয় জানিবেন। অতএব নিজ নিজ অধিকারের দাবী না করিয়া কর্ত্তব্য সম্বন্ধে সচেতন থাকাই কর্ম্ম জানিবেন।  জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, ইহার কর্ত্তা ভবিতব্য ব্যতীত আর কাহারো কোন অধিকার নাই। ভাগ্যানুসারে সকল হইয়া থাকে। যখন যাহার ভবিতব্য উপস্থিত হইবে তখনই লোকে ভাগ্যলাভ করিতে পারিবে।


(৬৮) না লইবে কারো দোষ,  না করিবে কারো রোষ।  আপনি হইবে সাবধান। ।  কাহারো ভাবে অভাবে আপনি না থাকিয়া আপনার প্রাক্তনীয় সকল পরিষ্কার করিয়া যাইতে থাকুন। ভগবান মঙ্গল করিবেন। ভাল মন্দের জীবের বিচার করিবার শক্তি রাখেন নাই।  ন কর্ত্তৃত্বং ন কর্ম্মাণি [ইত্যাদি] গীতার ভাষ্য জানিবেন। যখন জানিবেন যে আমি কর্ত্তা নই তখনই পক্ষ বিপক্ষ সমান বুঝিবেন। যে পর্য্যন্ত এইভাবের উদয় না হইবে সে পর্য্যন্ত কাহারো কোন দোষগুণের অধীন না হইয়া কেবলমাত্র কর্ত্তব্য উপস্থিত কর্ম্ম যাহা আপনার গোচর প্রারব্ধে করিয়া দেন, অনন্যভাবে তাহাই করিতে থাকুন। ভগবান আপনার সকল অভাব দূর করিয়া দিবেন সন্দেহ নাই। যে যখন কর্ত্তার পরিচয় পাইবেন সে তখনই চিত্তে সবল সরল শান্তিময় প্রকাশ পাইবেন। স্বধর্ম্মের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করিবেন, সংশয়মাত্র নাই।


(৬৯) পাপ পূণ্য দ্বারা জীবের আরোগ্য অনারোগ্যতা ঘটে না। প্রারব্ধজনিত নিয়ম অনিময়তা বশত:ই জীবের শরীরে ভোগ হয়। পূর্ব্বকৃত পাপহরণ হইলেও দৈহিক ভোগের নিবর্ত্তন হয় না। সংসারই পরম ধর্ম্ম, সত্যই পরমানন্দ আশ্রয়। অতএব নিরপেক্ষ-ভাবে পরমানন্দ লাভ করিয়া জীব দ্বন্দ্ব হইতে মুক্ত হইয়া থাকে। পূর্ব্বজন্মার্জ্জিত পূর্ব্ব অবস্থার্জ্জিত [?] যাহা পাপ ঘটিয়াছিল তাহাই হরণ হইয়াছে। দৈহিক প্রারব্ধকৃত সুখদু:খাদি ভোগের দণ্ড ভিন্ন হরণ ত হইতে পারে না, তাহার অনেক প্রমাণ দেবাদি বেদপুরাণে প্রকাশ আছে।


(৭০) সংসার মায়াময়, সকলই ভ্রান্তে চলিতেছে। কেবল কর্ত্তা হইয়াই ইহার ভোক্তা হইতে হয়। প্রারব্ধযোগের যখন যাহা যাহা ভাগ্য গতিতে উপস্থিত করে তাহাদিগকে ধৈর্য্য ধরিয়া নিবারণ করাই ধর্ম্ম। বর্ত্তমানে উপস্থিত কার্য্য কর্ত্তব্যানুরোধে সংসারের তাবৎ কার্য্যই ত্রুটিহীন হইয়া যত্নসহকারে করিয়া যাইতে হয় ফলাফলের জন্য প্রতীক্ষা করিতে হয় না। ইহাই ধর্ম্ম।


(৭১) নাম আর ভগবানের ভেদ [?] নাই। নামের নিকট থাকা ভগবানের নিকট। বিচ্ছেদ না হইলেই শান্তি এবং আনন্দ অনুভুতি থাকে না।


(৭২) মন হইতে লোকসকল জড়াজাত উপভোগে লালায়িত হইয়া অবিদ্যায় [?] বহু বর্ণ পাইতে আশা করিয়া বিবর্ণতা হেতু নানান বাসনায় বন্দী হয়। ভোগ আয়তন দেহত্যাগ করিতে পারে না বলিয়াই নানান রুপ ধারণ করিয়া শান্তি অশান্তির ভাগ্যভোগ ভোগিয়া থাকে। অতএব ধৈর্য্য ধরিয়া সকল ঋণ মুক্ত হইয়া সত্যের অংশ উপভোগ করুন।


(৭৩) ভাগ্য সকল ফলদাতা। যখন যাহার যে ভাগের উপস্থিত হয়, জীবগণ তখন সেই ভাগই ভোগ করিয়া থাকেন। তাহার অতিরিক্ত কিছুই জীবের করিবার ক্ষমতা নাই। অতএব সর্ব্বদা সকল অবস্থায়ই সত্যনারায়ণের অধীন থাকিতে চেষ্টা করিয়া ঐ সকল ভাগ্যফল ত্যাগ করিয়া শান্তিময় ভগবদ্ভক্তি লাভ করিয়া জীবসকল মুক্তিপদ প্রাপ্ত হইয়া থাকে। চিন্তা করিবার কিছুই নাই। সত্যের দাসের কোন অপচয় হয় না। তিনি সকল বন্ধন মুক্ত করিয়া শান্তি বিধান করিয়া থাকেন।  ভাগ্য হইতেই লোকের ভোগ জুটিয়া থাকে। ভাগ্যরুপে অন্নপূর্ণা বিরাজমান জানিবেন। সত্যং পরম ধীমহি। তাহার কোন অংশ না থাকাতেই বেদে পুরাণে অন্নপূর্ণা মাসী বলিয়া আশির্ব্বাদ-মন্ডিত করিয়াছেন, অতএব ভাগ্যই ভগবান। অন্নপূর্ণা মায়ের কোলে থাকিবেন। তিনি সর্ব্বময় এবং সর্ব্বনিয়ন্তা বলিয়া জানিবেন।


(৭৪) প্রারব্ধভোগ দেহেই সম্বন্ধ থাকে, দেহমুক্তির পথ অবশেষ অনাবরণ আনন্দই থাকে। এইজন্য পতিসেবা পরং তীর্থ জানিয়া পতিসেবা করিয়া নিত্যমুক্ত পাইতে অবিচ্ছিন্ন পতিলাভের জন্য তারই অনুগত থাকিতে ভুয়: ভুয়: চেষ্টায় লিপ্ত থাকিতে চেষ্টা করাই কর্ত্তব্য। পতিসেবা ভিন্ন এই জগতে সুখকর জিনিস পত্রে মুগ্ধ থাকিতে দেহত্যাগ করিতে পারে না। প্রারব্ধ সংকর্ষণে নিয়া নানানভাবে প্রলোভন দিয়া আকর্ষণ করে এবং শাসন করিয়া ভুয়: ভুয়: জন্মমৃত্যুর আবর্ত্তন দিয়া সুখ-দুঃখ ময় করে। অতএব ধৈর্য্য ধরিয়া সর্ব্বদা ভগবানের নামের শরণ নিয়া প্রত্যাশী থাকিতে চেষ্টা করাই উচিত। আশ্রম ত আমার কোন স্থানে হয় নাই, যেখানে যেখানে আশ্রম করিয়া আছে, তাহাদের কর্ত্তৃপক্ষের আনন্দ উৎসব মাত্র। অতএব আমি আশ্রমে যাইব না। আমার প্রারব্ধ একমাত্র চক্র ভ্রমণ ভোগই বহন করিতে হইবে এবং হইতেছে। ……প্রারব্ধভোগ দেহের সহিষ্ণুতার দ্বারা পতিসেবাপদ শক্তি নিয়া পরিচর্য্যায় ব্যাপ্ত থাকাই ধর্ম্ম। পতিসেবা পরম তীর্থ। পতি দেবতার আশ্রয় নিয়া পড়িয়া থাকিলে যথাসময়ে পতি আসিয়া সঙ্গে করিয়া নিত্যধামে নিয়া যাইবে। ঐহিক সুখের জন্য পতি হারাইতে নাই। প্রারব্ধ-ভোগের পরিণাম শেষ করিতে পতি দণ্ডবিধান করেন। এই বিষয় সমগ্র শাস্ত্রে বেদে পুরাণে প্রোথিত রহিয়াছে। সাবিত্রীব্রত অনুষ্ঠানই ধর্ম্ম।


(৭৫) এই জগতে সীমাবদ্ধ রং বেরং অস্থায়ীরুপ লাবণ্যে মুগ্ধ হইয়া সত্যবস্তুকে ভুলিয়া এই মরুভূমে আটক পড়িয়া দিশা হারাইয়া ভাগ্যবশে যোগ বিয়োগ ঘটিয়া থাকে। যখন গাঢ় ঘুমে আকৃষ্ট থাকেন, তখন কি আপনি, কি আপনার শরীর কি আপনার কর্ত্তৃত্ব অধীনের স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, বন্ধুবান্ধব কেউ থাকে?যদি সেই সময়ে কেহই না থাকিল তবে আপনার কে হইতে পারে?এইটাকে আমি আমার বিদ্যাবুদ্ধির দ্বারা উপলব্ধি করিতে পারিলাম না। অতএব ঐ সমস্তই প্রকৃতির গুণজাত বিকার জানিবেন। যদি আপনার কেহ থাকিত তারা কি আপনাকে কোন অংশে ত্যাগ করিতে পারিত, কি পারে? যিনি আকাশ বলিয়া পরিচিত তিনি কাহাকেও ত্যাগ করেন না এবং কেহই আকাশকে ছাড়িয়া থাকিতেও পারেন না। তাহা বুঝিতে পারি না কেন?এই সকলই প্রকৃতির বিকার মাত্র জানিবেন। আর যে আপনাকে ছাড়িয়া গিয়াছে তাহাকে কি আপনি দেখিয়াছেন?কেবল তারই ঘেরা বেশকে আপন বলিয়া দেখিয়াছেন। কি সত্য যে ঘরের চেতনা ছিল, তাহাকে তো কোন সময় উপলব্ধি করেন নাই। কাজেই সে আপনার নিকটই আছে, থাকিলেও দেখেন না। সত্যের সেবা করুণ, সত্য ছাড়া আপনার কেহ নাই জানিবেন।


(৭৬) সংসার বিষয় বিষে দিবানিশি হিয়া জ্বলে, জুড়াইতে উপায় করিতে হয়। প্রাক্তন শক্তিতে লোকের অবস্থা ভাগ্যানুসারে ভোগ ভুগিতেছে। এই সংসারে নিত্য ভগবান ভিন্ন আর কেহই উদ্ধার করিতে পারে না। যাহা কিছু সুখ দুঃখ  সকলি ভাগ্যানুসারে ঘটিয়া থাকে। তাহাতে বিচলন না হইয়া ধৈর্য্য ধারণ করিয়া সর্ব্বদা নাম করিতে হয়। যত [?] কিছু পরিজন সুখদুঃখ দাতা সকলি ভাগ্য অনুসারে মিলন হয়। ইহা আবহমান [?] চলিয়া আসিয়াছে। ………আপনার যদি ভাগ্যে থাকে তবে স্বজনকে পালন করিতে পারিবেন। ভাগ্যে না থাকিলে কিছুই করিতে পারিবেন না। আপনি আপনার ভাগ্যকেই মানিয়া চলিবেন।


(৭৭) পতিসেবাপরা হৃদয় ব্যতীত প্রেম উদগম হয় না। যদিচ কর্ত্তাভিমানে কোন সাধনসিদ্ধ সুখ [?] বিভোরা হইয়া পড়ে সে স্বভাব প্রেমের নয়। তাহা সকলি মায়ামুগ্ধ মোহ মাত্র, স্বপ্নের বিকার স্বরূপ জানিবেন। সাবিত্রীব্রত ভিন্ন প্রেম আসে না, সে স্বভাব কখনও কোন মায়ায় ভোলে না।  “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে। । ” এই তারকব্রহ্ম নাম প্রাণের উজল [?] ঘটিয়া থাকে।  নামের শরণেই জগৎ মুক্ত হয়। নাম ভিন্ন গতি নাই। নামই সত্য, কলির পতিতপাবনী শক্তি।  সাধ্য সাধনের দ্বারা ভূত পৈশাচিক আবর্ত্তন ঘটে। সর্ব্বদা নাম করিতে করিতে হৃদয়ের বল উদ্ধার হয়। দেহ প্রাক্তনের গুনবশে চালিত হয়, নাম ভিন্ন দেহমুক্ত হয় না। ঐহিকের দেহ ইন্দ্রিয়ের যে সুখ দুঃখ তাহারা দেহের সঙ্গেই থাকে। শান্তি প্রাণের নিকট জানিবেন।


(৭৮) সদানন্দময়ী গণেশজননী বিশ্বেশ্বরী অন্নদা অম্বিকা অম্বালিকা। ……মাতৃপদ শরণাগত পালনং। ……সত্যং পরং ধীমহি। শ্রীমতি সতী দেহ দক্ষযজ্ঞে ত্যাগ করিয়া সত্যরুপ যজ্ঞের অবিচ্ছেদ হইয়া হরগৌরীপদ লাভ করিয়াছেন।


(৭৯) সতীসত্ত্বা হৃদয়বাসী গণেশ জননী জন্ম মৃত্যু জরা বন্ধনমুক্ত করিয়া আপন কোলেই সন্তানগণকে পালন করিয়া থাকেন। এই জন্যই মাতৃভূমি সম্বন্ধ উচ্চারণে ”মা” শব্দটি ব্যাপ্ত হইয়া পড়ে জানিবেন। এই ব্যাপ্তরুপ বুদ্ধিকেই বৈষ্ণবী শক্তি অর্থাৎ অখন্ড, অবিচ্ছেদ অত্যাগ বলিয়া কথিত হয়। ইহার প্রকৃতি-সম্ভার অচিন্ত্য, অকথ্যরুপে ছড়াইয়া পড়িয়া আছে। বাসনাই বন্ধনের হেতু।


(৮০) মাতা গণেশজননী দেব, দানব, মানব সকলকেই কোলে স্থান দিয়াছেন বলিয়া বেদে অর্থাৎ জ্ঞানে তাঁহাকে গণেশজননী বলিয়া আখ্যা করিয়া থাকেন। তিনি কাহার কোন ভাষা ছন্দ বন্ধনে মুগ্ধা হইয়া ভালবাসা কি মন্দ বলিয়া ত্যাগ করেন না।  “মা” শব্দটী বিরল। ঐ শব্দমুগ্ধ হইতে পারিলে কোন প্রার্থনা থাকে না। কারণ মন, বুদ্ধি, অহংকার থাকে না। কেবল থাকে সত্য, এই সত্যের অধীন হইলে সতী হয়। এই সতীই দেহ ত্যাগ করিয়া গৌরী হয়। ইহাকে পুত্র কি সন্তান বলিয়া থাকে। এই অবস্থাই অন্নপূর্ণা অর্থাৎ মায়ের আশ্রয় লাভ করিয়া থাকে। এখানে কোন ভাষা নাই। সেই অবস্থা জীবে [র] শৈশব উত্তানশায়ীর অবস্থা এবং গাঢ় নিদ্রার অবস্থা জানিবেন। সেই অবস্থা হারাইয়া স্বয়ং কর্ত্তাভিমানে মোহিত হইয়া পাশবদ্ধ হইয়া মাতৃপদ ভুলিয়া, মনের বুদ্ধির দৌরাত্ম্যদ্বারা মাতৃপদ হারাইয়া হতোহস্মিতে [?] বিবৃত হইয়া পাশমুক্ত হইতে পারে না। কর্ত্তা হইয়া যে যা করে সকলি দক্ষ-যজ্ঞ জানিবেন। এই যজ্ঞ কখনও পূর্ণ হয় না। পাশ ও ছেদন হয় না। ভূতগণের সহচরও ত্যাগ হয় [না]। সতীরসও পায় না। অতএব সত্যের অধীন থাকিয়া দেহ ত্যাগ করিলে গৌরীত্ব লাভ করিতে পারে, মা কখনও সন্তানকে ত্যাগ করে না বলিয়াই গণেশ-জননী বলিয়া বেদাদিতে আখ্যা করিয়াছেন।


(৮১) কার্য্যকরণ কর্ত্তৃত্বে হেতু: প্রকৃতিরুচ্যতে।  ”পুরুষ স্বভাব ভুক্তা সংকরে প্রীতিজায়তে। । ” গণেশজননী সর্ব্বদাই সর্ব্বতোভাবে ত্রিগণকে [?] কোলে করিয়া রাখিয়াছেন। তিনি কাহাকেও ত্যাগ করেন না। আমি অন্ধ বলিয়া তাহা বুঝিতে পারি না।


(৮২) মাত: তাতস্য দেহ মাতৃগর্ভ নিয়োজিত। তাহার কর্ত্তা কারণ কর্ম্মহেতু সেই পদ্মানেত্রা কমলবাসনী [?] জননী ছাড়া কেহই নাই। পিতা মাতা ত্যাগ করে না। অহংকারে বিচ্ছেদ করিয়া মায়ের কোল ছাড়ায়। তাতেই মন বুদ্ধির চরিত্র বিচ্ছিন্নতা ধারণ [?] করিয়া থাকে।


(৮৩) অপরাধ প্রাপ্ত সূত্রে অপরাধীদ্বারা আকৃষ্ট জগতে প্রকৃতির তার-তম্যানুসারে লোক [সকল] এই মরভূমে ব্যাস কোলে পড়িয়া পূর্ব্বপারস্থিত অস্থায়ীরসে রং বেরং মোহিত জীবদ্দশা ভোগ করিয়া মাতৃকোক্ষি ছাড়া হইয়া স্ব স্ব ভাগ্যভোগ ভুগিতে ভুগিতে দিশাহারা হইয়া মন বুদ্ধি হইতে নানা উপাধিতে বন্দী হয়। ইহা পূর্ব্বপারেই অবস্থিত থাকে। পশ্চিমপার যাইতে না পারায় অন্নপূর্ণার অভাব হেতু জন্ম মৃত্যুকেই বরণ করিয়া গতাসু আশ্রয় ত্যাগ করিতে পারে না। … মা সত্য, মা পথ্য [?], মা সর্ব্বস্ব ধন বলিয়াই লোকে আনন্দময়ী ভাষার দ্বারা অভিষিক্ত করিয়া থাকে। নন্দনবনে নিত্য দেবগণ দ্বারা অর্চ্চিত হইয়া আনন্দ বিস্তার ত্রিলোকে বিতরণ করেন, এই তো মায়ের স্বভাব।


(৮৪) বিশ্বনাথ, অন্নপূর্ণা পশ্চিমপারে অবস্থিতি। পূর্ব্বপারে ব্যাস বাস করিয়া থাকেন, অন্নের অভাব জাগ্রত হইয়া ধৃত বস্তুর চলন্তি প্রচার হয়। ভগবৎ রস পূর্ণরুপে পশ্চিমপারে পূর্ণ আছে। মাত: গণেশজননী গণপতিদিগকে কোলেই রাখেন, ত্যাগ করেন না। সত্যরুপা সতী ব্যাস ত্যাগ করিয়া গৌরী (পবিত্র) রুপ অবিচ্ছেদ-ভাবে পূর্ণমাসী পদ ধারণ করিয়া ত্রিলোকের চৌদ্দ ভুবন মুক্ত করিতেছেন। কাত্যায়নী মিশ্রণ [?] সম্পদ দিয়া সত্য সত্য মাতৃপদ অনুবন্ধন করিয়া আছেন, শঙ্করী বিরজা জয়া সম্বন্ধে জিত সায়র প্রসার করিতেছেন। মা কি কখন সন্তানকে ত্যাগ করেন? ……ব্রহ্মাদি বালক যার, গিরী বালিকা সেই তার।  বালক ভানু, বালক তনু, বালক কোলে দোলে।  ……… কূলে মা, আকুলে ”ধা”।


(৮৫) যে জন না যায় তীর্থ পর্য্যটনে।  কালী বৈ আর না শোনে কানে। ।  (পরাত্মিকা রামপ্রসাদস্য উক্তি) ধীরা, স্থীরা, গম্ভীরা, বিরাজিত লম্বোদরীর ক্রোড় জানিবেন।


(৮৬) লোকসকল কামনা হইতেই আকৃষ্ট হইয়া সীমাবদ্ধ জ্ঞানের আবরণে পড়িয়া সম্মুখেই যাহা ভাল মন্দ বুঝিয়া উর্দ্ধ অধ: গতিকে বদ্ধ হইয়া অকূল সাগরে তরঙ্গায়িত হইয়া থাকে, কূল পায় না। অতএব কাম্যবস্তু পরিহার না করিয়া মায়ের কোল পাই কি করিয়া বুঝি না। যখন মায়ের কোলে উত্তানশায়ী ছিলেন তখন কি প্রয়োজন বুঝিয়াছিলেন?এখন মায়ের কোল ছাড়িয়া অহংকারের কোলে পড়িয়াই ত দুষ্পূরণীয় কামের জ্বালায় পড়িয়া অবিদ্যার কোন বন্ধনের জন্যই ত প্রয়োজন বোধ হইতেছে। এই কাম থাকিতে প্রেম হয় না কর্তৃত্বাভি[মান]যোগে। অতএব মায়ের কোল কখনও সন্তানকে ছাড়ে না, সন্তানও মায়ের কোল ছাড়িয়া থাকিতে পারে না। সেই মাকে ভুলিয়া অবিদ্যারুপ সীমাবদ্ধ ব্যাসের কবলে পড়িয়া নানান রুপ লাঞ্চনায় হিতাহিত বর্জ্জিত [?] দুরন্ত পারাবারে উর্দ্ধ অধধ: তরঙ্গ ভোগ করিয়া লাঞ্চনা পাইয়া থাকে।  সতী দেহ ত্যাগ করিয়া উত্তরবাহিনী অবিমুক্ত করিল কেন?বিচার করিলে তাহাকেও ত পাইতে পারি। সীতা অশোক বনে আটক হইল, শরীর যে রাক্ষস (অহংকার) ঘেরা তাকে বন্ধ করিল কেন?সাবিত্রী সত্যবানের ব্রত করিয়া তাহাকে কালের চক্র হইতে উদ্ধার করিল কেন?বুঝিতে তো পারিলাম না। … রামপ্রসাদের শরণের অনুষ্ঠান করুন, পরে মায়ের কোল পুনরায় লাভ করিতে পারিবেন। কর্ত্তা হইয়া পারিবেন না।


(৮৭) সংকর ঋণ পরিশোধ একমাত্র মাতৃকুক্ষি বৈ আর কিছুই নাই। ইনিই অন্নদা, অম্বিকা, গণেশমাতা, ঈশ্বরী। (আমি মাতৃহীন)


(৮৮) মায়ের কোলে কোন অস্থায়ী বস্তুর প্রশংসা রাম পায় নাই। তিনি স্থির বসে মায়ের কোলই অধিকার করিয়া ছিলেন।


(৮৯) জলে স্থলে অন্তরীক্ষে আশে পাশে সর্ব্বত্রই মাতা বিরাজপুর, মাতা ছাড়া কি আছে শব্দ জানি না। স্থীরা, ধীরা, গভীরা রুপেতে মাতা আকাশ পাতাল সমষ্টিতে [?] মা। মা আপনাকে সর্ব্বদা কোলে রাখিয়াছেন, মা ছাড়া আপনি কোথাও নাই। মা’র কুক্ষি পূর্ণ করিয়া অবিচ্ছেদে থাকুন।


(৯০) যখন মায়ের কোলে উত্তানশায়ী পদে ছিলাম তখন কিছুই চাই নাই, কোথায়ও যাই নাই, কোন অভাব বুঝিতাম না। সেই উত্তান অবস্থার [?] অংশ ছাড়ি স্বয়ং কর্ত্তাভিষিক্ত মাতৃপদ ত্যাগ করিয়া বিমাতার ক্রোড়ে থাকতে চাই তাহা তো মায় দেখে না [?]। এই আমার ভুল সম্পদ, অর্থাৎ মনের পিপাসা মাত্র। এই পিপাসার অধিকার মায়ের কাছে জানিবেন। মা আপনার শক্তি মুক্তি, আপনার ভক্তি শক্তি, মা আপনার আনন্দরস অক্ষুন্ন করিতেছেন। আপনি যখন বিমাতারুপ মনের অংশ ত্যাগ করিয়া মায়ের সেবা [?] প্রেম তরঙ্গে ডুবিয়া পড়িবেন তখন মায়ের ধন সমস্ত নিজে ভোগ করিয়া ত্রিলোককে বিলাইয়া দিতে পারিবেন। এই অফুরন্ত [?] জানিবেন। মনের তৃপ্তি বন্ধন, প্রাণের তৃপ্তি নির্ব্বন্ধন [?] জানিবেন।


(৯১) ভাগ্য হইতেই ভোগ আয়তনী দেহ লোকে লাভ করিয়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা মন, বুদ্ধি, অহঙ্কারগত হইয়া সুখ-দুঃখ , জন্ম-মৃত্যু উপভোগ করিয়া কর্ম্মবিপাকে গতাগতি পুন: [পুন:] হইয়া পড়ে, দেহমুক্ত হইতে পারে না। দেহই বহুরুপ। দেহী একই, তাহার রুপ কি গুণ কি বিয়োগ হয় না। দেহীর সহচর হইয়া দেহের বন্ধন সকল মুক্ত করা যায়। ইহাকেই সাবিত্রীব্রত বলিয়া থাকে। কর্ত্তৃত্বাভিমান ছাড়িয়া সত্যের দাস হইয়া সত্যের সেবক হইলে জন্ম-মৃত্যু থাকে না, ইহাকেই দেহত্যাগ বলে।  লোক যখন ঘুমায় তখন দেহাদি মন বুদ্ধি কোন চিন্তা ভাবনা কিছুই থাকে না। তখনই দেহী থাকে। অতএব দেহীর আশ্রয় নিয়া তারই সেবা [?] করিয়া ভাগ্যভোগ মুক্ত হইয়া সত্যলোক অবিয়োগে পাইয়া থাকে। এখানে কালের কোন অধিকার নাই জানিবেন।


(৯২) এই জগতে যত লোকের আবির্ভাব হয় দেখা যায়, সকলেই সত্য যে অখন্ড, অকম্প, অক্ষর, যাহাকে কেহই কিছুতেই বাদ দিয়া থাকিতে পারে না, যাহার সাহায্য ছাড়া কেহ কিছু ক্ষমতা পায় না, সেই সত্যকে ভুলিয়া, অসত্য অর্থাৎ অস্থায়ী, পরিবর্তনশীল, এক প্রকার থাকে না, ক্ষয়শীল সেই প্রকৃতির বর্ণে, রসে মোহিত হইয়া “অহংকারের আবরণে পড়িয়া নানানরুপ অবস্থায় নানান সুখকর বস্তুর পাবার লোভে মনের দ্বারায় আকৃষ্ট হইয়া ভোগ করিতে গিয়া জরাতুর অবস্থায় আটকাইয়া পড়ে। সেই জন্যই লোক কেহই প্রকৃতির বিকারী গুণের তরঙ্গ হইতে রেহাই না পাইয়া কর্ম্ম, অকর্ম্মে লিপ্ত হইয়া, নানান কর্ম্মপাশে বদ্ধ হইয়া সত্যকে জানিতে পারে না বলিয়াই লোকসকল মনের অধীন হইয়া দায়স্বরুপ ঋণপাশে বন্দী হইয়া পড়ে। এই ঋণমুক্ত না হইলে কেহই সত্যকে পাইতে কি জানতে পারে না বলিয়াই লোকে মোঘাষা মোঘ কর্ম্মে বিচেতসা হইয়া, কর্ত্তা হইয়া, অহংকারে মুগ্ধ হইয়া, মনের অধীন হইয়া এই সংকর সাগরে উর্দ্ধ অধ: গতিতে ভ্রমণ করিয়া সত্যকে না পাইয়া অধ: পদ লাভ করে;অতএব মনের বেগ সহ্য করিয়া অর্থাৎ মনের সহচর না হইয়া নামের (সত্যের) সঙ্গে থাকিয়া সতী যেমন কর্ত্তৃত্ব মান (সীমা) দেহত্যাগ করিয়া গৌরী অর্থাৎ পবিত্র, অবিমুক্ত ক্ষেত্র যাহা ক্ষয় হয় না, তাহা পাইয়াছিল, সেই রকম অবস্থা পাওয়াকেই মন্ত্র বলে, অর্থাৎ মাত্রা থাকে সীমা, বেস জ্ঞান বলে, তাহা ত্যাগ হইয়া যায়;পরে অসীমত্ব সত্যকে লাভ করিয়া জন্ম মৃত্যু ইত্যাদি কালের কবল হইতে উদ্ধার হইয়া থাকে। এই অবস্থাকেই মন্ত্র বলে জানিবেন।  মনের বেগ ধৈর্য্যধরাকেই ধর্ম্ম বলে, এই ধর্ম্মকে আশ্রয় করার নাম সাবিত্রীব্রত, এই ব্রত হইতে সত্যবান যে কালচক্রে সীমাবদ্ধ হইয়া (আত্মা) নামে উপাধি ধারণে নানান অনুষ্ঠান দ্বারা বন্ধন হইয়া যিনি জীবরুপে পরিভ্রমণ করিয়া থাকেন, তাঁহার অর্থাৎ সত্যবান অখন্ড সত্যকে কালচক্রের খন্ডবন্ধন হইতে সাবিত্রী মুক্ত করিয়া পিতৃকুল (ধর্ম্ম), পতিকুল (কর্ম্ম), পুত্রকুল (পবিত্র), যাকে শুদ্ধ শুচি বলে এই তিন কুল মুক্ত করিয়া, জন্ম-মৃত্যুরুপ জরাবন্ধন মুক্ত করিয়া সত্যের অধীনত্ব লাভ করিয়াছিল। সেইরুপে এই সত্যব্রতের দ্বারা জীব সকল মুক্ত হইতে পারে। এতদ ভিন্ন যাহা মনের দ্বারায় করা হয়, সকলি দক্ষযজ্ঞ জানিবেন।  মনেই পাপ করে, মনেই পাপে লিপ্ত হইয়া কালচক্রের সঙ্কর স্থান ত্যাগ করিতে পারে না, জানিবেন, বদ্ধই হইয়া থাকে। ইহাকেই মনের বাসনা (বন্ধন)বলে, ইহা কখন পূর্ণ হয় না, পাশ বন্ধনও যায় না। (অহঙ্কার বিমূঢ়াত্মা কর্ত্তাহহমিতি মন্যতে) সত্যং পরং ধীমহি, সত্যই পরম জানিবেন।  “অরেখজাত পরমুষ্ম বর্জ্জিত।  যদক্ষরং ন ক্ষরতে কথঞ্চিত। । ” সেই সত্যবান, তাকে রাখিতে পারিলে সকল মনের জল্পনা কল্পনা দূর হইয়া যায়, যেমন ঘুমাইলে থাকে না সেইরুপ। এই অবস্থাকে প্রাপ্ত বলে। আর যখন মায়ের কোলে উত্তানশায়ী ছিলেন তখন কিছুতেই কি ভাল, মন্দ অহংকারাদি মনের জল্পনা কল্পনা [ছিল] না। সেই অবস্থাকে সম্যকরুপে ন্যস্ত অর্থাৎ সন্ন্যাস বলিয়া জানিবেন। ইহাকেই চৈতন্যের মাস বলে এবং নিভৃত নিকুঞ্জ বলে। এই সত্যকে আশ্রয় পাওয়াকে সত্যনারায়ণ বলিয়া জানে। অতএব কর্ত্তৃত্ব ছাড়িয়া অকর্ত্তা হইয়া দেহের আয়ুর্ব্বেদের ঋণ পরিশোধ করিয়া এই জরা অর্থাৎ অজ্ঞানবদ্ধ জীবত্ব মুক্ত করুন।


(৯৩) ভগবানের কৃপার লক্ষ্যে সর্ব্বদা থাকুন। অন্ধকারে চলিতে হইলে একটা আলো নিয়া চলাই কর্ত্তব্য।


(৯৪) সর্ব্বদা নাম করিবেন। নাম পরম ব্রহ্ম জীবের মোক্ষ ধর্ম্ম। নানা চিন্তা ভাবনা না করিয়া যাহাতে সর্ব্ব রকম ন্যস্ত করিয়া সংসারের যাবতীয় কর্ম্ম করিয়া কর্ম্মক্ষেত্রের ঋণ পরিশোধ করিয়া লইতে পারেন তাহার প্রতি পূর্ণ দৃষ্টি রাখিবেন।


(৯৫) কালচক্রের উৎপন্ন ভূমিরুপ যে অভিমানী দেহ, এই দেহ উদয় অস্ত দ্বারা প্রারব্ধ জঞ্জাল ভোগ আয়তনে বিকশিত থাকে। এই দেহেই সকলরুপ সংবর্দ্ধনদ্বারা নানাবিধ অবস্থায় মনের চঞ্চলতা ঘটে, এই দৈহিক সুখ দুঃখ  কেবল কর্ত্তাভিমানীর বুদ্ধির যোগেই ঘটিয়া থাকে। অত [এব] সর্ব্বদা মনের অবস্থায় লক্ষ্য না রাখিয়া [?] কেবল নামের প্রতি লক্ষ্য রাখিতে যত্নবান থাকিবেন। সুখের প্রত্যাশী কেবল মায়ার বঞ্চনা মাত্র জানিবেন। প্রারব্ধের আবরণে [, ] যাহা যখন প্রাপ্ত হইবার আছে [?] সেই ভাবেই পাইবেন। নামের যোগের অংশ ত্যাগ করিবেন না। পুরাণাদিতে সাধু জীবনীর শরণ করিতে করিতে নিত্যানন্দের আশ্রয় লাভ করিয়া থাকে। ভগবান আপনার যাবতীয় সংসারের আয় ব্যয়ের বিধান করিতেছেন, আপনি তাহার কোনই কর্ত্তা ন’ন। ভগবান আপনার মঙ্গল করিবেন। জগতে কাহাকেও বিশ্বাস করিবেন না, কেবল ধৈর্য্য সম্পদের আয় বৃদ্ধি করিতে চেষ্টা করুন।


(৯৬) মন এবং বুদ্ধি দুই-ই প্রাণের বিকৃতি অবস্থা জানিতে হয়। পতিভক্তি অর্থাৎ পতিসেবা উন্মুখ হইয়া থাকিতে থাকিতে প্রারব্ধ ভোগ কাটিয়া পতির অবিচ্ছেদ যোগ সম্মিলন লাভ করিতে পারে। নচেৎ মন এবং বুদ্ধিতে যে সকল সুখ দুঃখ  আবাহন হইয়া থাকে তাহা সকলি প্রারব্ধ অর্থাৎ অদৃষ্ট সম্মিল [ন] মাত্র। অতএব প্রারব্ধ বন্ধন ক্ষয় জন্য অক্ষর যে ভগবান, যিনি প্রাণরুপ আখ্যা [?] ধারণ করিয়া জীবের গোচরে অবস্থিত রহিয়াছেন তাঁহাকে লাভ হয়। মন বোধনীয় যে সকল প্রাপ্ত অপ্রাপ্তে সুখ দুঃখ  বোধন হয় সকলই প্রাণের মায়া অর্থাৎ ভ্রান্তি জানিবেন। মন ইন্দ্রিয় অর্থাৎ মাত্রা সীমাবদ্ধ ভাবকে বলিয়া থাকে। সীমাবদ্ধ সুখ দুঃখ  তাহা ভ্রম হইতেই হইয়া থাকে। অতএব সর্ব্বদা পতিসেবায় উন্মুখ হইয়া থাকিবেন।  [তাহাতেই] প্রারব্ধ ত্যাগ হয় নচেৎ নয়।


(৯৭) সর্ব্বতোভাবে সকল অবস্থায়ই সহিষ্ণুতার সঙ্গ করিতে চেষ্টা করিবেন। ………সংসারের আবর্ত্তন নৃত্য সচরাচরে ভ্রমণ করিয়া থাকে। ইহাদের তরঙ্গ উল্লাসের বেগ যত সহ্য করিতে পারে ততই ভগবৎ শক্তিতে শান্তির শান্তিরথ খুলিয়া পড়ে।


(৯৮) এই সংসার অদৃষ্টচক্রে ভ্রমণ করাইয়া এই দেহেতে মন বুদ্ধির দ্বারা ভাগ্যবশত: প্রকৃতির গুণের দ্বারা চালিত হইয়া থাকে। তজ্জন্য দুঃখ  না করিয়া কেবল প্রারব্ধের কর্ম্ম রীতিমত করিয়া যাইতে হয়। কর্ত্তা হইয়া প্রারব্ধের উপর বাধা দিতে গেলে প্রারব্ধ দণ্ড ক্ষয় হয় না বলিয়াই পূর্ব্বপুরুষগণ সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি চার যুগেই ভগবানের অবতার হইয়া ও প্রারব্ধ ভোগ দান করিয়া স্বগণকে উদ্ধার করিয়া নিয়া গিয়াছেন, কোন অবতারেই কোন প্রারব্ধের বাধা না জন্মাইয়া মিত্র আবরণে [?] প্রাক্তনকে ক্ষয় করিয়াছেন। যুধিষ্ঠিরাদি, রামচন্দ্র, পরশুরাম প্রভৃতি হরিশ্চন্দ্র, শ্রীবৎস, নল প্রভৃতির অবস্থা দেখিয়া সকল কার্য্যই বুঝিতে পারা যায়। তাহারা কেহই প্রারব্ধ ত্যাগ করে নাই। যখন সকল ভার দিয়াছেন তখন আপনার চিন্তা করার কি আছে? ভাবনা নাই, প্রারব্ধ ভোগ এই দেহতেই হইয়া যাইবে। পরের পথের চিন্তা নাই, সেখানে প্রারব্ধের কোন অধিকার নাই জানিবেন।


(৯৯) ধৈর্য্য ধরিয়া সকল কর্ম্ম করায় নামই হয়। ধর্ম্ম অনন্যচেতায় অধিষ্ঠানের নামকে কর্ম্ম বলিয়া ঋষিগণ প্রকাশ করেন। সর্ব্বদাই ভগবানের আশ্রয়ে থাকিয়া তাঁহাকে কর্ম্ম করিয়া যাইতে হয়, যেহেতু ভগবান নিরপেক্ষ, অসঙ্গ বলিয়া খ্যাত আছেন।


(১০০) নামের সঙ্গে শ্রীহরি বিরাজ করেন।  (হেলায় শ্রদ্ধায় বাপি হরিনাম পরায়ন। ) ভক্ত বাক্য। যাহা ভাল মন্দ দেখিয়া নাম করিতে জীবের শক্য হয় না। জীবের কর্ম্ম খিলাপেও ভগবান দোষ ধরেন না। অতএব নামই সত্য।


(১০১) এই জগতে কাহাকেও বিশ্বাস করিতে নাই। নদীনাঞ্চ লক্ষ্মীনাঞ্চ [?] শ্রীদিনাম শস্ত্রপাণয়:।  বিশ্বাস নৈব কর্ত্তব্য স্ত্রিষু রাজকুলেষু চ। সর্ব্বদা ধৈর্য্য ধরিয়া যাইবেন। অদৃষ্টে যাহা আছে হইবে। অদৃষ্টভোগ এই দেহ গেহ নিয়া কেহই স্বর্গে যাইতে পারে না। অদৃষ্টভোগ ঋণশোধ না হইলেও দেহযাত্রা মুক্ত হয় না। চিন্তা করিবার কিছুই নাই, সকলি ভুয়া।


(১০২) অদৃষ্ট ফলের দরুন হর্ষ বিষাদে না জড়াইয়া এই জড়তা মুক্তের জন্য সর্ব্বদা ধৈর্য্য ধরিয়া যাইতে হয়। এই জগতে যাহা কিছু ঘটে সকল ভাগ্যেই হইয়া থাকে। তাহার জন্য ধর্ম্ম নষ্ট করিতে নাই। সর্ব্বদাই নাম করিবেন। চিন্তা ভাবনা করিয়া কিছুই তো করিতে পারেন না। ………ভগবানই চালানের কর্ত্তা, জীবের কোনও কর্ত্তৃত্ব নাই।


(১০৩) সংসারের শান্তি অশান্তির যোগ সর্ব্বদাই শরীরাদি দ্বারাই উপভোগ করিয়া থাকে। সর্ব্বদাই সহিষ্ণুতা শক্তির আশ্রয় নিয়া থাকিতে চেষ্টা করা উচিত। মনের দ্বারায় এবং বুদ্ধির দ্বারায় যাহা যাহা শুভ অশুভ, ভাল মন্দ, সুখ দুঃখ , স্থির এবং অস্থির উপলব্ধি হয় সে সমস্তই ক্ষণস্থায়ী ভ্রান্তির আকরমাত্র;তাহার উদয় অস্তের জন্য চেষ্টা না করিয়া কেবল ধৈর্য্য ধরিয়া যাইতে এবং অদৃষ্টগতিকে যখন যাহা ঘটে তাহাই ভোগ সহ্য করিতে চেষ্টা করিয়া যাইবে। উপস্থিত কর্ত্তব্য কর্ম্ম সরকারী যাহা যাহা আইন ব্যবস্থা আছে তাহার কোনরুপে ত্রুটি না হয় তজ্জন্য সর্ব্বদাই চেষ্টা করিবে। ভগবানের অধীন হইয়া থাকাই নাম সংকীর্ত্তন। সুখ দু:খাদি তাহা নিয়াই হইয়া থাকে, ভগবৎ [পদ] ছাড়িয়াই কষ্ট পাইতে হয়।


(১০৪) ভগবানের সেবায় ত্রিলোক পবিত্র হয় [?]। কালীয় দহজনিত (অর্থাৎ শরীরস্থ ভাব অভাবজনিত) যাহা কিছু উৎপন্ন হয়, সে সকলি বিষ অর্থাৎ ভেদ বোধন মাত্র। কেবল উদয় হইয়াই অস্ত হয়; এই সকলকে মরভূম ও জন্ম-মৃত্যু বলিয়া বিজ্ঞগণ নিশ্চয় করিয়া থাকে। ইহাদের অর্থাৎ এই যে অস্থায়ী দেহস্থ যে সকল বিষয় লাভে সুখ হয় পরক্ষণেই তাহার সকল অভাবের তরঙ্গে ভাসিয়া যায়, স্থিতি থাকে না। অতএব এই সুখ-সু:খের প্রত্যাশী বা বিরক্তি না হইয়া কেবল নামের অধীন হইয়া থাকিবে। যেই নাম সেই কৃষ্ণ ; নাম আর কৃষ্ণ যদি এক হয় তবে যেখানে কৃষ্ণ থাকে অর্থাৎ নাম বর্ত্তমান থাকিবে তাঁহার স্থানকে বৃন্দাবন বলা যায়। সুতরাং নাম করিতে করিতে ব্রজবাসীই হইয়া যায়। এই স্থানে কালের কোন অধিকার প্রচার থাকে না। কালীয় দমন, পুতনা প্রভৃতি অঘাসুর বকাসুর প্রভৃতি সকলই মুক্ত হইয়া যায়, কাহারই কোন বন্ধন থাকে না। বন্ধন শব্দে বেসন, আবরণ বস্ত্রাদিই বলে এবং বাসনা বলে। এইজন্য ব্রজভূমে কৃষ্ণ দর্শনে বস্ত্রহরণ করিয়া লয়, কৃষ্ণ বাসনায় পরিবৃত রাখিয়া বৃন্দাবনেতে রাসবিহারী ভগবান প্রকাশ হইয়া পড়েন। তখন ভ্রম দ্বন্দ্ব সকলি মুক্ত হইয়া অনাবরণে সত্যলোকে ব্রজপতি ভগবান আপনার করিয়া লইয়া থাকেন, আর বিচ্ছেদ হয় না। এই অবস্থাই প্রাপ্ত হয়। ভগবানকে পাইলেই শান্তি, তাকে ছাড়িয়া যতবিধ অশান্তি ভোগ করিতে হয়। অতএব নামে সুখই হউক দুঃখই হউক, ইহাদিগকে অনিত্য এবং ত্যজ্য জানিয়া সর্ব্বদা সকল অবস্থায়ই নাম নিয়া পড়িয়া থাকিতে হয়। এই নামেই উদ্ধার করিয়া লইবেন। নাম যখন প্রতিষ্ঠা হইয়াছে তখন কৃষ্ণ বহির্ম্মুখে আপনাকে নিতে পারিবে না। সর্ব্বদাই সঙ্গে থাকিতেছে এবং থাকিবে। আপনি যথাসাধ্য যাহা পারেন নাম করিয়া যাইবেন, নামের ফলের দিকে লক্ষ্য করিবেন না। নামই সত্য, নামই আপনাকে রক্ষা করিবেন।


(১০৫) অদৃষ্টচক্রে সংসারে নানাবিধ ঘটনাই ঘটিয়া থাকে, তাহাতো [?] মানবেই ভোগ করিয়া থাকে। ভাগ্যে যাহা ঘটিবে তাহাতেই সন্তোষ থাকিয়া সর্ব্বদা নাম করিয়া যাইতে যাইতে ভগবানের নিত্যধামে যাইতে পারে। সেখানে অদৃষ্টচক্রের অধিকার নাই, কেবল নিত্যমুক্ত আনন্দময়। এই জগতে প্রার্থনা মাত্রই ঋণবদ্ধ হইয়া থাকে। যদি ভাগ্যে থাকে সকলি পাইবেন, চিন্তা করিবেন না। ………জগতের জন্ম-মৃত্যুর হাত নিবারণের জন্য একমাত্র ভগবানের শরণ নিতে হয়।


(১০৬) সংসারের মলিন তরঙ্গ সদা সর্ব্বদাই ভবসাগরে বিচরণ করিয়া থাকে। পুরুষাকারাদি শক্তিতেই সেই সকল বাসনায় কলুষিত ব্যাপারে জীবের চিত্ত সংশ্লিষ্ট হইয়া নানান রকম উপাধি হইয়া থাকে। কর্ত্তা হইয়া নানান উপাধি ধারণ করিতে হয়। এইজন্যই সর্ব্বদা চিন্তা আছে, এই সকল চিন্তা রজগুণ হইতেই হইয়া থাকে। সর্ব্বদাই ঐ সকল অবস্থার বেগ সহ্য করিবার চেষ্টাই সর্ব্বতোভাবে করিবে। চেষ্টা করিতে করিতে যখন আর পারা যায় না, অক্ষম হইয়া পড়ে তখনই যে অবস্থা হয় তাহাই ভগবানের নিকট স্থান জানিবেন। যতক্ষণ কর্ত্তা থাকা যায়, চেষ্টারও উদ্যম প্রয়াস হয়, ততক্ষণ পর্য্যন্ত শুভ অশুভ বিষয়ের জল্পনা কল্পনা ঘটিয়া নানান উপাধির উচ্চ নীচতা দেখিয়া ভয় এবং লোভ সৃষ্টি হইয়া নানান আশাপাশ বন্ধনকারী বিষয়ে কামনাদির তরঙ্গে পড়িয়া কষ্ট পাইয়া থাকে। সর্ব্বদাই কেবল নামের অধীন থাকিতে চেষ্টা করিবেন। নাম নষ্ট হয় না।  শরীরের যখন যে যে অবস্থা হয় তাহার সমতার জন্য সর্ব্বদা ঔষধ ব্যবহার করিতে হয়। ভাগ্যের ফলাফলে লোভ কি ক্ষোভ করিতে নাই। ……… ইহ শরীরজনিত যে সকল প্রারব্ধ ভাব আপনাকে কর্ত্তব্য মনে ধারণা করাইবে তাহা করিয়া চলিতে থাকুন। ………অন্যান্য ধর্ম্মশাস্ত্র যথাবিধি যাহা যখন পারেন করিবেন, না পারেন না করিলেও কিছুই আপনার প্রত্যবায় হইবে না।  ভগবান বলে কেন?তার কোন অভাব নাই, এইজন্য। ষড়ৈশ্বর্য্যপূর্ণ য: ইহ ভগবান:।  শ্রুতিবাক্য। ঐশ্বর্য্য ছাড়িলেই অভাবে পড়িতে হয়। সেই অভাবে পড়িয়া যদি কর্ত্তৃত্ব সুখের জন্য কোন কামনার পূরণ করিতে ইচ্ছা করিয়া চেষ্টা করিতে হইলেই ঋণে বদ্ধ হইতে হয়, তার কারণ ঐশ্বর্য্যহারা হইয়াছে। অতএব সর্ব্বদা যখনই যে কামনা হৃদয়ে উদ্ভব হইয়া (হয়) সতত চেষ্টা ধরিতে করিবে। ধৈর্য্য না ধরিয়া বাসনা পূর্ণের চেষ্টা করিতে গেলেই ঋণী হইতে হইবে।  কেন? আমি ঐশ্বর্য্যকে হারাইয়াছি। এই সকল মনের মধ্যে সর্ব্বদা জাগাইবার চেষ্টাই উপাসনা। এই রকম ধৈর্য্য ধরিতে ধরিতে চেষ্টা করিতে করিতে বুদ্ধি স্থির হইয়া থাকে।  লোকের মন্দ দেখিতে কোন দরকার রাখিবেন না। লোকসকল গুণের বশে চলিতেছে, গুণ-মুক্ত হইলে এক দেখিয়া থাকে। কাহারো দোষ চিন্তা করিতে নাই। স্ব স্ব ভাগ্যবশত: চলিতেছে। আপনাকে সাবধান থাকিতেই চেষ্টা রাখা কর্ত্তব্য।


(১০৭) আপনি বাজে চিন্তার আবর্ত্তন হইতে ধৈর্য্য ধরিয়া সত্যনারায়ণের নাম সর্ব্বদা করিবেন। এইরুপ অভ্যাস করিতে করিতে স্থির চিন্তা আসিয়া আপনাকে পরম শান্তি দিবেন। ভগবান একমাত্র ধৈর্য্য হইতেই প্রকাশ হন। ধৈর্য্যই ধর্ম্ম, ধৈর্য্যই ভগবান, দ্বন্দ্বে স্থির থাকাই আনন্দ। অধৈর্য্য হইলে লাভ দ্বারা যে সকল সুখ পাওয়া যায় তাহা ক্ষণস্থায়ী মাত্র, উদয় এবং অস্তশীল বলিয়া জানিবেন। প্রারব্ধ (ভাগ্যই) সেই সমস্ত বিষয় ভেদজ্ঞানের আবরণে টানিয়া নিয়া যায়, অতএব সর্ব্বদা প্রারব্ধ বেগ সহিষ্ণুতার দ্বারা পবিত্র করিয়া পবিত্র হইতে চেষ্টা করিবেন। এই প্রকার মনের, বুদ্ধির শরীরের বেগ সহ্য করিতে করিতে মন, বুদ্ধি, শরীর ভেদ (দ্বৈত) ভাবের তরঙ্গ হইতে মুক্তি হইয়া পরিমাণ [?] শক্তি জাগিয়া পড়িবে সংশয় নাই। এই সংসার মায়ামুগ্ধ হওয়ায় কিংকর্ত্তব্যহারা হইয়া ভ্রান্তি বিষয় অমূলক চিন্তায় নিমগ্ন হইয়া, হিতাহিত জ্ঞান বর্জ্জিত হইয়া কার্য্য-কলাপে নানান উপসর্গ সৃষ্টি করিয়া থাকে। ইহা হইতে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় এই ধৈর্য্য হইতে অভ্যাস করা। ইহা ব্যতীত অন্য কোন উপায় নাই।


(১০৮) সংসার প্রারব্ধবশে চলিয়া জীবমাত্রকেই [?] নানাদিধ উৎপীড়-নাদি অভিযুক্তে ভ্রান্তি জন্মাইয়া শাসন করিয়া প্রলোভনে উৎপাতাদি সঙ্গে কষ্ট দিয়া থাকে। ঐ সকল ভ্রান্তমুগ্ধ হাত হইতে ত্রাণ হইবার একমাত্র ধৈর্য্যই সম্বল। অতএব সর্ব্বদা ধৈর্য্য ধরিয়া প্রীতির দ্বারা ভগবানের সেবা অনন্যচন্তায় ভগবানের শরণ নিয়া পড়িয়া থাকিতে হয়। তাহা হইলে মায়া আর কর্ষণ করিতে পারিবে না। সর্ব্বদা ভক্তির আধার লাভ করিয়া চির সুখী হইতে পারিবে।


(১০৯) সকলি প্রাক্তনে জন্মায়, ভোগ দণ্ড শেষ পর্য্যন্ত জীব অবস্থায় কর্ম্মত্যাগ করিতে কি ধরিতে পারে না। সংসারে মায়া আচ্ছন্ন ভ্রান্তিরসে মুগ্ধা হইয়া হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়। সত্য কি মিথ্যার উপলব্ধি করিতে ক্ষমতা রাখে না, কেবল ঐহিক সুখের [জন্য] মনের শান্তি খুঁজিয়া বুদ্ধিকে কলুষিত করিয়া রাখে। পরিণামে যে অসীম সাগরের পারাপারহীন ভবতরঙ্গ আছে বলিয়া বুঝিতে পারে না। কেবল অস্থায়ী আসুরিক ভারের প্রতি লুব্ধ থাকিয়া সংসারের স্বর্গ নরক দুয়েরই সঞ্চার পোষণ করে। …..ভগবৎ সেবার অধিকারী হইতে হইলে কালচক্রের অনেক যন্ত্রণা ভোগ করিতে হয়। সুখের জন্য কেবল ভবসাগরই তরঙ্গ দিয়া ঘুরিতেছে। ভগবানের নিকটে যাওয়ার বন্ধ দ্বার খুলিতে পারে না। পূর্ব্বাপর হইতে রাজা বাৎসার কতই দণ্ড হরিশ্চন্দ্র প্রভৃতি শ্রীবৎস্য, নলরাজা, রাম-সীতা, যুধিষ্ঠিরাদি, কৃষ্ণ, মান্ধাতা প্রভৃতির জীবন-চরিত্রে জানা যাইতেছে। তাঁহারা ভবিষ্যৎ ভগবৎ সমীপে ধর্ম্মরক্ষার জন্য সংসারের প্রারব্ধ জ্বালাতনাদি কতই [সহ্য] করিয়াছেন, কেহই ঐহিক সুখের প্রলোভনে আত্মহারা হন নাই। সকলেই নানান কষ্ট ভোগ করিয়া সত্যলোকে স্বর্গারোহণে সক্ষম হইয়াছিলেন। কেহই প্রলোভনে সুখের তারে মজিয়া জ্ঞানহারা হইয়া সত্যধর্ম্ম ত্যাগ করেন নাই [?]। আশু সুখ পরিণাম দুঃখ  এই ভাবকেই আসুরিক ভাব বলে। আশু কষ্ট, পরিণাম সুখ, ইহাকেই দৈব ভাব বলে। এই দৈবভাব ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে রাক্ষসী আসুরীভাবের মোহ উদঘাটন করিতে পারে না। একমাত্র ভগবানই সর্ব্বশক্তি, তাঁর সঙ্গ ব্যতীত বর্তমান সুখ-দুঃখ  ক্ষয় করিতে পারা যায় না। অতএব সকল অবস্থায় শরণ নিয়া থাকিতে সতত চেষ্টা রাখাই কর্ত্তব্য। ব্রজবাসীদের মনের স্থির কি মনের শান্তির জন্য প্রয়াস করে না, কেবল পতিব্রতা ধর্ম্ম সহায় করিয়া, প্রাক্তন যাতনা ভোগ করিয়া পরমানন্দে নিত্যসেবার রস অধিকার করিয়া লইয়া ব্রজবাসী অন্তরঙ্গ পরিকর হইয়াছে। পূর্ব্ব-কালে এত সাধু সন্ন্যাসীর আবর্ত্তন ছিল না, পথেরও শাখা-প্রশাখা ছিল না বলিয়াই তাহারা পতিসেবায় রত থাকিয়া পরম শান্তিধামে পদার্পন করিতে সক্ষম হইত। তাহারা আগে সকল সুখের পিপাসা জলাঞ্জলী দিয়া পরম পবিত্র পতিসেবায় সুখ অক্ষুন্ন লাভ করিয়া ধন্য হইতেন। … ভগবান ভিন্ন অন্য কাহারো কোন শক্তিতে জীবের অভাব মুক্ত করিতে শক্তি রাখে না। ……..আমার এই পথ গুরু পরিষ্কার করিয়া দিয়া প্রারব্ধ ভোগ করিতে দিয়াছেন। এই পথ ছাড়িয়া অন্য পথ অবলম্বন করিতে আমার সাধ্য নাই। এই সহিষ্ণুতা ভিন্ন এই সংসারের প্রারব্ধ দণ্ড ভোগমোচনের অন্য কোন শক্তি ভগবান শ্রীগুরু আমাকে দেন নাই। যিনি আমার সাথে আসিয়া মারতে পারেন তিনিই সত্য ক্রিয়া পাইবেন, পতিভক্তি ভিন্ন আমি জানি না।


(১১০) সংসারের ভবিষৎ চিন্তা করিতে আপনার কোন প্রয়োজন নাই। কারণ আপনার সংসার চালাইবার কর্ত্তা ভগবান। তিনিই আপনার সকল অভাব দূর করিয়া আপনার তৃপ্তি করিবেন। বিশেষত: আপ-নার প্রারব্ধ বিষয়ে কোন কর্ত্তৃত্ব নাই।  ভগবান আপনার মঙ্গলই করিবেন, যেহেতু তিনি মঙ্গলময়, তাঁহার উপর সমস্ত ভার অর্পন করিয়া নির্ম্মল বুদ্ধি লাভ করিবেন। …ছেলেদের চিন্তাও আপনার করিবার কিছুই নাই, কারণ ছেলেদের ত এক একটা ভাগ্য আছে। তাহাদের সমস্ত শক্তিই ভগবৎ কৃপায় পরিপূর্ণ হইতেছে, তাহাদের জন্যও কোন চিন্তা করিবেন না। ভগবানই তাহাদিগকে রক্ষা করিতেছেন এবং করিবেন, আপনি তাহাদের কিছুই করিবার শক্তি [রাখেন না]। অতএব ঐ সকল অনিত্য অমূলক চিন্তা না করিয়া আপনি যথাশক্তি স্থির ও ধৈর্য্য সর্ব্বতোভাবে করিতে চেষ্টা করিবেন, অন্য কোন চিন্তা করিবেন না। সেই সকল চিন্তা ভগবান করিতেছেন। ………এই সংসার ভ্রান্তমূলক, উদয় অস্ত বিভাষ মাত্র। এইজন্য চিন্তার কোন কারণ নাই।


(১১১) জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ ইহার কর্ত্তা ভবিতব্যই হয়, অন্য কাহারো কোন শক্তি নাই। যদি থাকিত তবে কেন মেয়ের বিবাহের জন্য এত ব্যাকুল হইয়াছেন, আপনি ত বিয়ে দিতে পারিতেন। যখন যে ভাবে যে কালে পরিণয় ভবিতব্য উপস্থিত করিবেন, তখন সেই ভাবেই যোগাযোগ মিলন হইবে, ইহার কর্ত্তা কেহই না, জানিবেন। লোকসকল ভাগ্যানুসারে দেহ, গেহ, জাতি, মানাদি এই মরভুমে পড়িয়া থাকে। এই ভাগ্যতে সন্তোষ না হইয়া পরে ভাগ আকর্ষণে পড়িয়া দণ্ড ভোগ করিতে থাকে। ইহাতে যমদণ্ড, কালদণ্ড, ব্রহ্মদণ্ড বলিয়া জানিবেন। সত্যনারায়ণের সেবা করিলে এই সকল দণ্ড মুক্ত হইয়া সত্যলোক, যেখানে ভাগ নাই, সেই স্থানে যাইতে পারে।


(১১২) সকল প্রকারের লোকসকল স্ব স্ব ভাগ্যানুসারে দেশ, সমাজ, স্বগণ সহায়তা প্রাপ্ত হইয়া থাকে। একেই ভাগ্য, অদৃষ্ট বলিয়া থাকে। লোক সকলি স্বীয় ভাগ্যের অনুরুপ ফলভোগ করিয়া থাকে। এই ভাগ্যতেই লোকের দেহ দ্বারা বদ্ধ হইয়া সুখ-দুঃখ  উপভোগ করে। অতএব এই ভাগ্যফলের অনুসরণ না হইয়া সর্ব্বদা সত্যরুপের, যাহার ভাগ নাই, তাহার অনুসন্ধানে থাকিলে পরে সৌভাগ্য-শালীতার [?] লাভে সুখ-দুঃখ হীন সম্ভার প্রাপ্ত হয়। এই অবস্থায় জন্ম-মৃত্যু নাই। এইজন্যই ত্রিসংসারে ভগবানের শরণ নেয়ার বিধান হইয়াছে।  আপনার ভাগ্যে যাহা পাইয়াছেন তাহা পাইবেন, যাহা হারাইয়াছেন তাহা পাইবেন না, ইহা জানিয়া ধৈর্য্য ধরিয়া সত্যের সেবা করুন তবেই শান্তি। অভিসম্পাত বশেতে লোক মরভূমে ভাগ্য সহ আসিয়া থাকে, এই ভাগ্য ফল ত্যাগ না হইয়া সত্যকে পাইতে পারে না। ইহার ভুয়: ভুয়: নজির পাওয়া যায়। 


(১১৩) সংকরাবর্ত্তনে স্থিতির অভাব দ্বারা সত্যবস্তু যাহা স্থির তাহা ভুলিয়া যায়।


(১১৪) এই কালচক্রের সংসার অস্থায়ীরুপে পরিচালিত হইতেছে, স্থিতি নাই। যাহা কিছু করি, যাহা কিছু দেখি, যাহা কিছু খাই, যাহা যাহা ব্যবহারে সুখের এবং দু:খের সৃষ্টি হইতেছে সকলি ইন্দ্রিয় (মন) স্পর্শ মাত্র চঞ্চল, অস্থির, অভাব জানিয়া মনের কল্পিত বেগ ধৈর্য্য ধরিতে ধরিতে সত্যরুপ প্রাপ্ত হইয়া এই সংসার নিবৃত্তি পায়, তাহাকেই গোবিন্দ বলে।  ভবিতব্য হইয়াছে বিবাহের কর্ত্তা, যাকে প্রজাপতি বলে। যখন যেখানে যে অবস্থায় যার সঙ্গে যার মিল করিয়াছেন সেই স্থানে সেই ভাবে সেই সময়ে বিবাহ লোকের হইয়া থাকে। তার ব্যতিক্রমের আপনি, কি আমি এবং কেহই নাই। ……এই শরীর তো কালের আশ্রয়, তাহার ব্যবস্থায় জীবের গতাগতি ঘটিয়া থাকে।


(১১৫) লোকসকল স্ব স্ব ভাগ্যানুসারে দেহ, গেহ স্বজনমণ্ডিত হইয়া সুখী দু:খী ইত্যাদির তাড়নায় পড়িয়া পথাপথ গতাগতি করেন এবং ভাগ্যফল উপভোগ করিয়া থাকেন। এই ভোগের ফলদাতা ভগবান ছাড়া আর কেহই নহেন। ঘুমের মধ্যে থাকিতে যিনি থাকেন তিনিই আপন, যাহারা থাকেন না তাহারা পর জানিবেন। অতএব আপদে, বিপদে-সম্পদে, জন্মে-মরণে যিনি [?] ত্যাগ করেন না তিনিই নাম। বিশুদ্ধ চিন্তার দ্বারা আপন সত্ত্বারুপা নাম লাভ করিয়া থাকে। এইজন্য নামকে চিন্তারুপা বলিয়া থাকে। সদাচারী অনুশীলনে ইহাকে পাওয়া যায়। ইনিই সত্য জানিবেন। তিনি কোথাও যান না, সর্ব্বদাই স্থির ধীর গভীরতাভাবে বিরাজ করেন। তাকে পাইলে জন্ম-মৃত্যু থাকে না।


(১১৬) ভাগ্যং ফলতি সর্ব্বত্র। প্রার্থনাই বন্ধন জানিবেন। সত্যনারায়ণ সর্ব্ববিধ শান্তিদাতা। তাঁহাকে ভুলিয়া অহংকারের আশ্রয়ে পড়িয়া অভাব সাগরে উর্দ্ধ অধ: গতিতে বন্ধন হইতেছে। অতএব সেই সত্যদেবের অধীন হইয়া তাঁহার কৃপা পাইতে পারেন।


(১১৭) প্রারব্ধ সূত্রে দেহের সুখ দুঃখ  রোগ শোকাদিতে জড়িত থাকে। এই ভোগের জন্য উদ্বিগ্ন হইলে নিত্যের প্রসাদ উপস্থিত করিতে পারে না। সুতরাং সর্ব্বদাই প্রাক্তন বিষয় শরীরে ভোগ লইবে। ভগবৎ দাসত্বই স্বরুপভাবে প্রবেশ করায়। অহংকারাদির দ্বারা ইহ-সুখের প্রত্যাশিত হইয়া আত্মার মর্য্যাদা লঙঘন করিয়া জন্ম-মৃত্যু সুখ দোষাদির আবরণে পতিত হইয়া থাকে। অতএব সর্ব্বদা ভগবৎ চিন্তায় মগ্ন থাকাই জীবের মোক্ষ ধর্ম্ম। নাম করিতে করিতে শান্তির উপকর্ষণ হইয়া সদানন্দ উপভোগ করিতে পারে।


(১১৮) কোন চিন্তা করিবেন না। সর্ব্বদা ভগবৎ অধীন হইয়া থাকিতে চেষ্টা রাখিবেন। সংসার মায়াময়, প্রারব্ধ ভোগের অন্ত হইলেই শান্তি হয়। প্রারব্ধ ভোগের জন্য বিচলন হইতে নাই।


(১১৯) যাহা প্রাক্তনে উপস্থিত করে যথাযোগ্য ভাবে সর্ব্বদা সহ্য করিয়া যাইতে থাকুন। ইহাই ভগবৎ কৃপার স্থান।


(১২০) অপার করুণাপদ ভগবান সংসারে বিস্তার করিয়া রাখিয়াছেন।


(১২১) অভিন্নচেতা নামনামিন:। নামই ব্রজবাসী, বৃন্দাবনবাসী, মথুরাবাসী। ব্রজবাসীর নিকট সর্ব্বদা ভগবান থাকেন। নামই ব্রজেন্দ্রনন্দন। …… নামের শক্তি গদাধর, নামের ভাব অদ্বৈত, নামের রুপ শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। নামই ভক্তি, নামই চৈতন্য।


(১২২) কোন চিন্তা করিবেন না। কালেই সকলি সুফল ফলে। অনন্য-চেতা কর্ম্মই জগৎ মুক্তকারী। সংসার মায়াময় নিত্য অনিত্য দ্বন্দ্বজে পরিণত। চক্রবৎ পরিক্রম, সুখের দু:খের খনি। এই অনিত্যকর অসুখজনক সংসার হইতে নিষ্কৃতি লাভই ভগবৎ ইচ্ছা। তারই দাস হওয়াই ধর্ম্ম।


(১২৩) “প্রারব্ধ ভুঞ্জ মানানি গীতাধ্যান পরায়ণা। ” ইহাই সত্য, অর্থাৎ নামই সত্য, নাম বৈ আর কিছুই নাই। যেই নাম সেই ভগবান। নিষ্ঠার ভাবেই তাহাকে লাভ করিয়া থাকে। সর্ব্বদা নাম নিয়া থাকিবেন। অদৃষ্টচক্রেই সকল চালিত হইয়া থাকে।


(১২৪) প্রারব্ধ ভোগেই জগৎকে চালনা করিয়া থাকে, ভাগ্যবশত: সকলেরই বুদ্ধি উৎপন্ন হয়। এই মহামায়া প্রভাবে জীবগণ সর্ব্বতো-ভাবে ত্রিগুণের বশবর্ত্তী হইয়া চালিত হইয়া থাকে। অতএব সর্ব্বদা সকল অবস্থায়ই ধৈর্য্য ধরিয়া সর্ব্বকাল নামের আশ্রয় লইয়া থাকিতে হয়। এই নামেই প্রারব্ধ ক্ষয় করিয়া পরমানন্দপদ দান করিয়া লইবে, সন্দেহ নাই। …ভগবান মঙ্গলময়, ভগবান নামরুপেতে জগতে সকল স্থানে সকলের নিকট প্রতিভাত হইয়া থাকেন। সেই নামের সঙ্গ করিতে করিতে মনবুদ্ধি পবিত্র হইয়া মহামায়ার বিরুপ গতি মুক্ত হয়। যাহার যেমন ভাব মহামায়া তার নিকটে তেমনই বুদ্ধি হন। যেমন আলোটি জ্বলিতে থাকে, লাল নীল, সবুজ প্রভৃতি বহুরঙ্গে রঞ্জিত হয়। সেইরুপ মহামায়াও আবরণ বিশেষে বিশেষরুপ ধারণ করিয়া থাকেন। অতএব সর্ব্বদা ধৈর্য্য ধরিয়া সেই ভগবানের নির্ম্মল ভক্তির জ্ঞানাবরণ শক্তি…প্রকাশ করিবার চেষ্টা দেখিবেন। কোন চিন্তা করিবেন না।


(১২৫) নাম এবং ভগবান একই পদার্থ, নাম সর্ব্বদা হৃদয়ে জাগিয়া থাকিলেই নাম প্রতিষ্ঠা এবং চৈতন্য হইয়া থাকে। নাম করিতে ভালই লাগুক, মন্দই লাগুক, নামেই উদ্ধার করিয়া নিবে। … (গ্রহরুপী জনার্দ্দন) ভগবানের নাম করিতে করিতে গ্রহবৈগুন্যসকল সহজ ভোগে কাটিয়া যায়।


(১২৬) এই জগতে পুরুষের আধিপত্য উপস্থিত হইলে নানান রকম উপাধিতে নানান ভাবে নানাদিকে আকর্ষণ করে। এই আকর্ষণে কেবল মহৎ প্রকৃতির নিকটই ঘুরিয়া বেড়ায়। মহৎশক্তিসম্পন্ন বিজ্ঞজন [?] ঐ সকল গুণ বিগুণ তরঙ্গের বেগে পড়িয়া ধৈর্য্য শক্তির শরণ নিয়া সর্ব্বদা থাকিতে চেষ্টা করিয়া থাকেন, অধীর হ’ন না। অদৃষ্টচক্রে যাহাই আবির্ভাব হইবে তাহাই সহিষ্ণুতা দিয়া ক্ষয় করিতে চেষ্টা রাখাই উচিত।


(১২৭) চিরস্থায়ী এই দেহ নহে বলিয়াই ইহাকে মরভূম বলিয়া থাকে। কেবল আগমপায়ী [?] আসে আর যায়, স্থিতি নাই। এইজন্য জন্ম-মৃত্যুর জন্য দুঃখ  না করিয়া নাম করিতে করিতে দেহত্যাগ হইলেই আর এই মরভৌতিক জগতে [?] জনমে মরণের অধীন হয় না, মুক্তিপদ লাভ করিতে পারে। যখন যাহার সময় হয় তখনই তাহাকে এই দেহজরাপিণ্ড ত্যাগ করিতে হয়।


(১২৮) ভগবানের নিকট সর্ব্বদা থাকিতে চেষ্টা করাই ধর্ম্ম। প্রাক্তন বশত: নানান দেশ ঘুরিয়া নানান উপাধি ধারণ করিয়া বেড়াইয়া থাকে। কাহারও কোন ক্ষমতা নাই। যা’র যা’র যে যে প্রারব্ধ (ভাগ্য) ঘটিবে তাহা কেহই ত্যাগ করিতে কি রাখিতে পারে না, ভ্রমবশত: কর্ত্তাভিমানে মুগ্ধ হইয়ক এই জগতে নানান বাসনায় বন্ধন হইয়া থাকে। মরভূমে যেমন চতুর্দ্দিকেই জল ভ্রম হয়, অন্বেষণ দ্বারা ক্লান্তি বৈ আর পিপাসা লাঘব হয় না, ইহাও তাহাই। ইদং তীর্থমিদং তীর্থ আপন সুখের পিয়াসে ঘুরিয়া বেড়ায় কিন্তু কোনই উপায় হইতে আশা পরিপূর্ণ হয় না।  (সর্ব্বতীর্থ ময়ং দেবী শ্রীগুরুপদ সেবনাৎ) যাহা হউক, যা’র যাহা প্রাক্তনে আছে তাহা ঘটিবেই, তা’র দেবার জন্য চেষ্টা করা বৃথাই আড়ম্বর মাত্র। …আপনি যদি শ্রীমানদের জন্য কোটি কোটি সংস্থান করিয়া যান, ভাগ্য না থাকিলে তাহাও তাহারা ভোগ করিতে পাইবে না। আর যদি আপনি কিছুই না করিয়া যান তাহা হইলেও ভাগ্যে থাকিলে তাহারা পরম আনন্দে জগতের ধন জন বৈভব সকলি প্রতিষ্ঠা করিতে পারিবেন, সন্দেহ নাই। যাহা হউক, ভগবানের নামে পড়িয়া থাকিলে ভগবান কোন অভাব রাখেন না, যেহেতুক [তিনি] স্বভাবময়।


(১২৯) নাম শব্দের অর্থ ই চিন্তা বলিয়া কথিত হয়।  (যেই নাম সেই কৃষ্ণ ভাব নিষ্ঠা করি, নামের সঙ্গেতে ফিরে আপনি শ্রীহরি)।  ইহা শাস্ত্রবাক্য। …এই সংসার শব্দকে শাস্ত্রাকার জ্ঞানীগণ শরীর পরিগ্রহ সংসার বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন অর্থাৎ বাসনাদি নানাবিধ রকমের ভাবকে শরীর বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন। যাহা হউক, প্রারব্ধই ইহার কর্ত্তা, গুণ হইতেই তারতম্য হেতু প্রারব্ধ হয়। এইজন্যই প্রকৃতি অর্থাৎ স্বভাব বলিয়া থাকে। ঐ প্রাকৃতিক গুণের দ্বারায় চঞ্চল করিয়া স্থির বুদ্ধি যে প্রজ্ঞাকে হরণ করিয়া ইন্দ্রিয়ের আবর্ত্তনে মোহগর্ত্তে নিপতিত করেন তাহাকে মায়া অর্থাৎ ভুল বলিয়া থাকে। এই মায়ামুক্তির একমাত্র ভগবানই শক্তি রাখেন, এতৎভিন্ন অহংকার বাসনার দ্বারা ঐশ্বর্য্যাদিতে এমন কি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবত্বেও এই মায়াভুল ক্ষয় করিতে পারে না। এই অবস্থায় বুঝিতে হয় যে নাম ছাড়া আর উপায় নাই। এইজন্যই শাস্ত্রকারেরা অর্থাৎ শাসনকারীদের দ্বারা জ্ঞাপন প্রকাশ হইয়াছে যে “নাম চিন্তামণি: কৃষ্ণশ্চৈতন্য রস বিগ্রহ:।  নিত্যশুদ্ধো নিত্যমুক্তোহভিন্নাত্মা নাম নামিনো:। ।  অতএব দিবানিশি প্রারব্ধ হাত হইতে দেহ বাসনাদি মুক্তির জন্য সকল অবস্থায়ই নামের অধীন থাকিবার চেষ্টা করিবেন।


(১৩০) প্রারব্ধতা বশত:ই সংসারের ক্ষণের [?] পরিচয়ে ভাল মন্দ ফল প্রকাশ পাইয়া থাকে। আচার প্রাক্তন বশত:ই ভাল মন্দ রুপ ধারণা করিয়া যায়। এই সকলি অদৃষ্টচক্র জানিয়া শান্তি লাভ করিতে পারে। সংসারের ভাব সকলই মনের দ্বারা চলিয়া থাকে। সেই মনের জন্য কোন প্রতিশোধনের চেষ্টা না করিয়া সর্ব্বদা নাম করিয়া যাইতে হয়। নাম পরম ব্রহ্ম, মোক্ষ ধর্ম্ম, নামই সত্য, নামই আনন্দ, নাম করিতে করিতে মনের প্রয়োজন হয় না। নাম স্বভাবত:ই পবিত্র, নামকে চিন্তামণি বলিয়া ঋষিগণ প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন।


(১৩১) সংসারের চক্রে ভাগ্যবশত: লোকে শান্তি অশান্তিময় সুখ-দুঃখ  তরঙ্গ দ্বারা ভাসিয়া বেড়ায়, তাহাতে লোকের অভাব চিরকালই অবিচ্ছন্নে চলিয়া থাকে। এই অভাব মোচন জন্যই সর্ব্বদা পতিসেবা করিয়া পরম পবিত্র চিত্তে নির্ম্মল পতিদেবের চিত্ত-পরায়ণ হইয়া নিত্য ভগবানের নিকট থাকিতে পারা যায়। নচেৎ অধৈর্য্যাদির দ্বারা তথায় যাওয়ার কোন উপায় লাভ করিতে পারে না। অতএব পতি [সেবা] করিতে করিতে নিত্য স্থির বুদ্ধির দ্বারা চিত্তের ভ্রান্তি কলুষ-নাশ করিয়া লইলে ভগবান নাম রুচি প্রদান করেন। অতএব সর্ব্বদা পতিসেবা করিবেন। পতিস্নেহের প্রত্যাশিত হইয়া সর্ব্বদা অহং কর্ত্তাভিমান পতিতে দিয়া পরম শান্তি লাভ করিতে পারিবেন, সন্দেহ নাই। সংসার মায়া বন্ধন মুক্তির একমাত্র পতিসেবাই ধর্ম্ম।


(১৩২) ব্রহ্মচর্য্য শব্দের অর্থ ব্রহ্মেতে বিচরণ করা অর্থাৎ আকাশের ন্যায় স্থির হইয়া থাকা। আকাশ যেমন কোন বিষয়ে কম্পিত হয় না, আগুনের দ্বারা তাপিত হয় না, অস্ত্রের দ্বারা ভাগ হয় না, এই প্রকার চিত্তকে করিবার চেষ্টাকে ব্রহ্মচর্য্য বলে। অতএব সর্ব্বদা তৎ বিষয়ে চেষ্টা করিবে। যখন ভগবান যাহা করিবেন তাহাই হইবে, কেবল গুরু আজ্ঞা পালন সতত করুন। কার্য্যে অনুরাগ বৃদ্ধি হইলে পতন হয় না। সংসারে থাকিয়াও সাধ্য সাধন করিতে পারে। তবে কেবল সর্ব্বদা ভগবানের উপর নির্ভর রাখিয়া অনাসক্তভাবে সংসার করিয়া যাওয়া।


(১৩৩) আপন কর্ত্তৃত্বের মধ্যে না থাকিয়া কেবল ভগবানের উপর নির্ভর করিয়া লাভ, লোকসান, অসিদ্ধ, সিদ্ধ, জয়, অজয়,  ভাল, মন্দ কোন বিষয়ে লক্ষ্য না রাখিয়া সংসারে গুরোপদিষ্ট কার্য্য করিতে থাকুন। ভগবান যাহা করেন তদ্বিষয়ে ‘সন্তোষ’ থাকিয়া কেবল কর্ম্ম করিবেন কেবল ভক্তি ব্যতীত সকল ভাবই সংসার বন্ধন হেতু। কাশীক্ষেত্র (শরীর),  ভক্তিশ্রদ্ধা (গয়া) তৎসাধ্য হইয়াছে গঙ্গা, নিজ গুরুচরণ প্রয়াগ।  কাশীক্ষেত্রং শরীরং ত্রিভুবন জননী ব্যাপিনী জ্ঞান গঙ্গা,  ভক্তিশ্রদ্ধা গয়েয়ং নিজগুরু চরণং ধ্যানং তীর্থ: প্রয়াগ:।


(১৩৪) লোকের কথায় কি যায়?সত্যের আবরণই রজ: তম:,  একেই ম্নেচ্ছ অর্থাৎ ময়লা বলে। সত্য কখনও মলিন হয় না। যে যাহা বলুক, যে যাহা করুক সর্ব্বদাই সহিষ্ণুতাকে আশ্রয় করিয়া সহ্য করিয়া কেবল গুরু স্মরণ করিবে।


(১৩৫) জিতেন্দ্রিয় কাহাকে বলে?যিনি গুরু বই আর কিছুতেই মনেতে উদয় করিতে পারে না, তাহাকেই জিতেদ্রিয় এবং শরণাগত বলে। সকল ভার গুরুকে দিয়া কেবল গুরুর প্রতি যাতে মন থাকে-তাহাই চেষ্টা করিতে হয়। ঐহিক সংসারের সুখ-দুঃখ  যাহা প্রারব্ধ কর্ষণে উপস্থিত হয় তাহা যথাসাধ্য করিয়া যাইবে। মন, বুদ্ধি, বাসনা সকল গুরুপ্রাপ্তি ইচ্ছায় রাখিয়া দিবে। কোন বিষয়েই অধীর হইতে নাই। সর্ব্বদা কেবল গুরুর দিকে লক্ষ্য রাখিবেন, গুরু আপনার মঙ্গল করিবেন।


(১৩৬) গর্ব্বহারী ভগবান কারো গর্ব্ব অভিমান থাকতে দেন না।  ”জীবের ইচ্ছা কোটি বাঞ্চা করে।  কৃষ্ণের যে ইচ্ছা সেই ফল ফলে। । ” ইহা মহাজনের বাক্য, অভ্রান্ত।


(১৩৭) গুরুকৃপা হইতে সমস্ত বন্ধন মুক্ত হইয়া যায়, এবং ভগবানকে লাভ করা যায়। তিনি সমস্ত স্থানেই আছেন।  ”অভিমানশূন্য নিতাই নগরে বেড়ায়। “


(১৩৮) বুঝান যায় সকলকেই, বুঝে না নিজ মন।


(১৩৯) মানুষের প্রকৃত অভাব অতি কম, কল্পিত অভাবই সর্ব্বনাশের মূল। 


(১৪০) ”লাগিয়া থাকিলে মাগিয়া খায় না, ” লোকে কথায় বলে।  ”হর্ষ লাগ্ রহ ভাই, তেরা বনত বনত বন যাই, ” এ তো সাধুবাক্য অতএব এক রকমভাবে শ্বাসের কার্য্য করিতে ভুলিবেন না।


(১৪১) ”ভাগ্যং ফলতি সর্ব্বত্র”।  ভাগ্যফলই ভোগ, এই ভোগদানই মুক্ত। সত্যনারায়ণের নিকট কর্ত্তৃত্ব রাখিয়া আপনি কর্ত্তব্য কর্ম্ম করিয়া যাইতে থাকুন, তিনিই সকল ব্যবস্থা করিবেন। প্রারব্ধ ভোগের অন্তকারী সত্যই জানিবেন। প্রাক্তন ভোগ না গেলে জন্ম-মৃত্যুর হাত হইতে ত্রাণ পায় না। অতএব শান্তিময় সেই সত্যনারায়ণের অধীন হইতে যত্ন করুন, তিনিই ব্যবস্থা করিবেন।


(১৪২) ”নাম” যাহা পাইয়াছেন তা’ই সার,  ”নাম” এক ভিন্ন দ্বিতীয় নাই,  ঐ নিয়াই থাকুন। নামেই সব হবে।


(১৪৩) অনেক কিছু এক সঙ্গে আরম্ভ করিলে দরিদ্রতা আসে। একটা নিয়া থাকাই ভাল।


(১৪৪) দুঃখ  কষ্ট গ্রহবৈগুণ্যে হয়। ভাগ্যে যাহা তাহা ভোগ করিতেই হয়। ভাগ্যে যাহা নাই তাহা কোথা হইতে আসিবে? কাহারও ইচ্ছায় কোনও কিছুই হয় না। চেষ্টা তো করিতেছেন, চেষ্টা করিতে করিতে যেটুকু ভাগ্যে আছে সেইটুকু আসিবে।


(১৪৫) বিবাহাদি কার্য্য ভবিতব্যই করিয়া থাকে, কাহারও কোন বাধা কি বিধি দিবার অধিকার নাই।


(১৪৬) নাম মন্ত্রাদির কাছে সর্ব্বদা থাকাই নাম করা বলে, নামের কোন বিধি বিধান নাই।  ”গীতা শব্দটি সত্যের (ভগবানের) প্রকাশে থাকার জন্য থাকিতে চেষ্টা করা, এই গীতা অধ্যয়ন জানিবেন। নাম আর ভগবানের কোন পার্থক্য নাই। কোন চিন্তা ভাবনা না করিয়া সর্ব্বদা সকল অবস্থায়ই ধৈর্য্য ধরিয়া সত্যনারায়ণের নিকট থাকিতে চেষ্টা করুন। তিনি ছাড়া শঙ্করের ভাগ্য ঋণমুক্তির [শক্তি] আর কাহারও নাই।  যে কোন ব্যবসা বাণিজ্য যে যা’ করে তাহাতে আসক্তি হইয়া পড়িয়া থাকিলে যাহা লাভ হইবে তাহাতেই সংসার কার্য্য নির্ব্বাহ করিবার চেষ্টা করিবেন। তাহা হইলে কোন অভাব জীবের হয় না। ভাগ্যের অতিরিক্ত আশাধারী হইলে কোন ব্যক্তিই কুলন করিতে পারে না, কারণ ভাগ্যের অধিক পাওয়া দুরাকাঙ্ক্ষা মাত্র।


(১৪৭) আপনি সর্ব্বদা সর্ব্বতোভাবে সত্যের অধীন থাকিতে সতত চেষ্টা (অভ্যাস) করুন। তাঁহার আশ্রিত (দাসের) ধবংস হয় না। লোকের সকল অবস্থায়ই ভাগ্যের দ্বারা কালচক্রে ভ্রমণ করিয়া প্রকৃতির বিকার যে গুণগণের তারতম্য সংঘটন ভোগ করিয়া থাকে। তাহাতে বিচলিত না হইয়া কর্ত্তাভিমান ভুলিয়া সত্যের দাস হইতে চেষ্টা করাকেই নাম, মন্ত্র, জপ, পূজা অনুষ্ঠান করা বলে। অতএব সত্যের নামে পড়িয়া থাকুন, তিনিই সকল দুস্তর সাগর হইতে পার করিয়া শান্তির কোলে স্থাপন করিবেন। যাহার যে পাওনা দেনা উভয় কর্ষণ থাকিলে নিত্যস্বরুপ সত্যরস উপভোগ করিতে পারে না। এই জন্যই নাম নিয়া পড়িয়া থাকার ব্যবস্থা জ্ঞানীগণ করিয়াছেন। সত্যের নামে পড়িয়া থাকুন, তাঁর কৃপার ভিখারী হইয়া থাকুন, তিনি সকল বিষয়ই মীমাংসা করিবেন।


(১৪৮) ত্রিলোকের লোকসকল স্ব স্ব ভাগ্যবলে দেহ, গেহ, স্থান, সমাজ এবং পরিজনাদির দ্বারা ধনী, মানী, সুখী, দু:খী হইয়া থাকে। সকলি প্রাক্তন ভোগের তাড়নায় পড়িয়া উর্দ্ধ অধ: গতি লাভ করিয়া থাকে এবং শান্তি অশান্তি নানা উপাচার উপভোগ করে। ইহা সকলি দণ্ড বলিয়া জানিবেন। চিন্তা শ্রীবৎস, নল দময়ন্তী, হরিশ্চন্দ্র শৈব্যা রুহিদাস, বেহুলা লক্ষ্মীন্দরেরাও এই ভাগ্যের ভোগ পূর্ণরুপে ভোগ করিতে বাধ্য হইয়াছেন। ঋষভ নববর্ষের কর্ত্তা হইয়াও নানারুপ লাঞ্চনা ভোগান্তে দেহ মুক্ত করিয়াছেন। ঐ সকল ইতিহাসীয় নায়ক নায়িকার চরিত্রের বিষয় চিন্তা করিয়া নিজের ভাগ্য ভোগ দান (ত্যাগ) করিয়া পুনরায় এইরুপ ভাগ্যবশের দ্বারা প্রলোভিত না হইয়া নিত্যানন্দরুপ স্বভাব অর্থাৎ অবিচ্ছেদ ভাবে সত্যের কোলে (কিনারে) থাকিয়া পরমানন্দ ভোগ করিতে পারেন। এ অবস্থায় পুনরায় অদৃষ্টরুপ ভোগের দেহ ভোগ করিতে হয় না জানিবেন। ভাগ্যে যাহা যার আছে তাহা কেহই ন্যুনাতীত করিতে ক্ষমতা রাখে না। পাণ্ডবদের বিষয় চিন্তা করিলে জানা যায় যে স্বয়ং ভগবান আশ্রয় দিয়াও পাণ্ডবদের ভাগ্যফল অপসারণ করিতে পারেন নাই। স্ব স্ব ভাগ্যফল উপভোগ করিতে হইয়াছে। যা’র ভাগ্যে যাহা আছে তাহাই ইচ্ছায় অনিচ্ছায় ভোগ করিতে হইবে। যাহাদের কর্ত্তা আপনি হইয়াছেন তাহাদেরও ভাগ্য একটা আছে। তবে আপনি কর্ত্তা হইয়াছেন বলিয়া তা’দের শান্তি বিধান করিতে পারেন না বলিয়া দুঃখ  পাইতেছেন। সর্ব্বদাই সকল অবস্থায় সহ্য করিতে চেষ্টা করিবেন। ভাগ্য যদি থাকে তবে আপনি বাডী ঘর করিতে পারিবেন, না থাকিলে কি করিয়া করিবেন। ইহাকে বৃথা চিন্তা বলিয়া জানিবেন। আপনি তো সাধ্যানুসারে সকলকে সুখে রাখিয়া থাকিতে পারেন, ভাগ্যে না থাকিলে কি করিয়া করিবেন? সকল ভোগের ঔষধই নাম ধর্ম্ম সেই নাম ধর্ম্মের জন্য কর্ত্তৃত্ব করিয়া করিতে গেলে নাম করিতে পারে না; কারণ কর্ত্তারই অনেক বাধক, নামের দাসের বাধক নাই। অতএব নামের অধীন হইয়া থাকিতে সর্ব্বতোভাবে চেষ্টা করিবেন। কোন লোকের কোন ইন্দ্রিয়ের অধিকার নাই, ভাগ্য হইতেই ফল পাইয়া থাকে জানিবেন। সত্যের অধীন থাকিতে চেষ্টা করুন।


(১৪৯) জীবের ক্ষমতা ব্যাষ্টি সীমাবদ্ধ; অসীম ক্ষমতাশালী গুরু। তাঁর অধীনে থাকিলে পুত্র যেমন পিতৃধনের মালিক স্বত:সিদ্ধ হয়, এও তাই। আর নিজের ক্ষমতার আহরণ করিয়া সীমাবদ্ধই হয়। কেহ ক্রোড়াধিপতিত্ব, কেহ সহস্রাধিপতিত্ব লাভ করে, কেহ দরিদ্র থাকে। ধনীর অভাবের শেষ নাই। দরিদ্রের কোন অভাব থাকিলে নিত্য নৈমিত্তিক গুজরাণের জন্য গুরুই যথাসময় যাহা দরকার হয়, তাহা দেন, কাজেই দরিদের কোন অভাব নাই। কাঙ্গাল হইয়া থাকা ভাল, সকল সময় গুরু চালক হ’ন। ধনীর চালক শয়তান। কাজেই গুরুতত্ত্ব যে অসীমপদ তাহার কাছে যাইতে প্রতিবন্ধক নানা বাসনা, অহংকার, অভিমান, রাগ-দ্বেষ, হিংসা লোভাদি নানা ভাবে চালনা করিয়া কুপথে বাসনা বা ধনমান দিয়া বন্ধ করে। অতএব সকল ভার গুরুকে দিয়া [গুরুর] কার্য্য যথাযোগ্য মতে করিতে থাকুন। গুরুই সময় করিয়া বন্ধন মুক্ত করিয়া লইবেন, ভাবনা নাই।


(১৫০) আপনি আপনাকে হতভাগ্য বোধ করেন কেন? গুরুর আশ্রয় পেলে আর কি আপন বলতে কিছু থাকে? গুরুরই সকল হয়। যে পর্য্যন্ত গুরুর আশ্রয় না পায় সেই পর্য্যন্তই ভাগ্যাভাগ্য বিচার থাকে।  চিন্তাশূন্য, ইচ্ছাশূন্য, অনুভূতিশূন্যকেই ভগবদ্ভক্তি বলে। অতএব শূন্যভাবকে পিছনে মগজ [?],  যাহা মাথা হইতে মেরুদণ্ডের মধ্য দিয়া মূলাধার পর্য্যন্ত নামিয়াছে, তাহাতে মন রাখিয়া মন্ত্র উচ্চারণ করিতে করিতে গুরুধ্যান হয়। তদ্দ্বারা প্রাণের তৃপ্তি লাভ করিতে পারে।


(১৫১) জীব কখন বন্দী থাকিবে না, তবে প্রারব্ধের ভোগ ভোগের দ্বারা জীবের কাটাইয়া নেয় এই গুরুর নিত্য স্বভাব, অবশিষ্ট ভোগ থাকিতে দেয় না।


(১৫২) কেবল দিবানিশি ভগবানের দিকে লক্ষ্য রাখিয়া সংসারের উপস্থিত মতে কার্য্য করিয়া যাইতে চেষ্টা করুন। পরিবারকে ঘৃণা করিতে নাই। সকলি গুরুর শক্তি। গুরুর ইচ্ছায়ই সকল সংযোগ হইতেছে। অহংকারের দ্বারা অভিমানী হইয়া আমার স্ত্রী, আমার পুত্র, আমার ধন, আমার শরীর জ্ঞান করিয়া জীব কর্ম্মপাশে বদ্ধ হয়।  “স্বদেহমিন্দ্রিয় ভার্য্যা অর্থ স্বজন বান্ধবা:।  পিতা মাতা কুলং দেবী গুরুরেব ন সংশয়:। । ” এই শ্লোকটিতে বুঝিতে পারেন যে আমার জ্ঞানই মিথ্যা, ভগবৎ জ্ঞানই সত্য, সকলি গুরুর, যদি আমারই আমি না হই আমার কি হইবে? সকলি ভ্রান্তি।


(১৫৩) পুরুষকার দ্বারা যাহা যাহার শক্তি আছে সে তাহার উপরে কিছুই করিতে পারে না। শরণাগত জনেরা অসীম শক্তি পাইয়া থাকে, যেমন প্রহলাদ শরণাগত হইয়া অসুরের তাড়না হইতে রক্ষা পাইয়া পরমানন্দ ভোগদ্বারা অসীমপদ অমরত্ব লাভ করিয়াছিল। কিন্তু দৈত্যেরা পুরুষকার অর্থাৎ নিজ চেষ্টাদ্বারা শরণাগতের কিছুই হানি করিতে ত পারিলই না, নিজেরাই শক্তিহীন হইয়া নানান ভাবে ক্ষয় হইয়া গেল। অতএব পুরুষকার কেবল বন্ধনেরই প্রলোভন, আপাতত: সুখ, পরিণামে দুঃখ।


(১৫৪) শরণাগতের স্বভাবই প্রেমভক্তি জানিবেন। প্রেমভক্তি সাধ্য সাধনের জিনিস নয়, আর প্রার্থনা দ্বারা লাভ করিতে পারে না। যেহেতু প্রার্থনাই অভাব বলিয়া জানা হয়। ভগবৎ পদে বাসনা বিনিময় করিতে হইলে ভোগ ঐশ্বর্য্যের পরিণাম হয়। প্রেমভক্তি পায় না। অতএব নাম নিয়া পড়িয়া থাকুন। জীবদ্দশা পরিহারে নিরময় প্রেমের আবরণে অবিচ্ছেদে জাগিয়া থাকিবেন। ভগবানের অন্তরঙ্গ হইতে হইলে মনের এবং বুদ্ধির এবং শরীরের প্রলোভনের বেগ সহ্য করিতে হয়, নচেৎ ভগবানকে পাইতে পারে না। যদি কেহ প্রার্থনার বশে কর্ত্তাভিমানে সাধন সাধ্য চেষ্টা করিয়া কিছু উপলব্ধি করিয়া থাকে তাহা ভগবানের বিভূতি মাত্র জানিবেন। শ্রীধাম বৃন্দাবনে “বরজগণে” প্রবিষ্ট ব্যতীত এই প্রেম আগে জানে না। সর্ব্বদাই নাম নিয়া পড়িয়া থাকিবেন। সুখের কামে মুগ্ধ হইবেন না। প্রাক্তন দণ্ড ভোগ করিয়া সেই পদে যাইতে পারিবেন। 


(১৫৫) সংসার মায়াময় প্রারব্ধের দাস। এই দাসত্বনাসের জন্য সর্ব্বদাই আকর্ত্তা হইয়া উপস্থিত সুখ দুঃখ  ভালমন্দ আপনপর যাহা উৎপন্ন প্রাক্তনে দেয়, তাহাই ভোগ। এই ভোগের শেষ হইলেই ভোগ-মুক্ত বলে। এই ভোগের ক্ষয়ের জন্য সুখ দু:খাদি সমান জ্ঞান অর্থাৎ তাহার দিকে লক্ষ্য না রাখিয়া যাহা উপস্থিত হইবে ভোগ সহিষ্ণুতাকে আশ্রয় করিয়া গুরু ভরসায় সমস্ত নির্ভর করিয়া থাকিয়া চেষ্টা করিতে করিতে প্রারব্ধ ঋণ শোধ হইয়া দেহমুক্ত ভগবান দাসত্ব পাওয়া যাইবে আনন্দ হইবে। 


(১৫৬) আত্মার উদ্ধারের সঙ্গেই প্রারব্ধজনিত পাপ তাপ ভোগ ক্ষয় হইয়া যায়। যে যাহা বলুক শুনিয়াও শুনিবেন না, দেখিয়াও দেখিবেন না। আপনি নিরাপদে থাকিয়া সর্ব্বদা গুরুর কর্ম্মে চেষ্টা করুন। সকল বেগ সহ্য করিয়া যাইবেন। 


(১৫৭) প্রাক্তনসূত্রে যাহা যাহা করেন তাহাই আনন্দের সহিত ভোগ করিতে হয়। ইহাই ভগবানে ভোগদান করা হয়। ভগবান মঙ্গলময়, তাঁহার নামে পড়িয়া থাকিলে মঙ্গলই হয়। ভাগ্যবশত:ই আয় ব্যয় হইয়া থাকে। রাগ দ্বেষ হিংসার নিকট থাকিতে হয় না। 


(১৫৮) সত্যের ধর্ম্ম কি? সত্য হইয়াছে নিত্য অর্থাৎ যাহা কখন হ্রাসপ্রাপ্ত হয় না, পরিবর্তিত হয় না, এক রকম থাকে-তাহাই সত্য। মিথ্যা হয় অনিত্য, অর্থাৎ যাহা থাকে না, পরিবর্ত্তিত হয়, এক রকম থাকে না। অতএব সংসারে যাহা কিছু দেখি, যাহা কিছু বোধ করি, সকলি অনিত্য। অতএব অনিত্যের জন্য প্রয়াসের কোন প্রয়োজন নাই। মায়াচক্রে অনিত্যেই সংসার বন্ধন করিয়া রাখিয়াছে। ইহা হইতে মুক্তির জন্যই স্থিরকে আশ্রয় করিতে হয়। স্থিরকে পাওয়ার জন্য সকল বেগ সহ্য করিবার জন্য চেষ্টা করিতে হয়। ইহা করিতে করিতে ক্রমে স্থৈর্য্য গুণ হয়, তারপর আরোগ্য হয় অর্থাৎ কোন বাধা বন্ধন থাকে না, ইহাকে মুক্তি বলে। এই অবস্থাই ঈশ্বরপদ প্রাপ্ত এবং ইহাই ধর্ম্ম। এই সত্য সংসারে আসক্তি হেতু ঋণ হয়, সেই ঋণ ক্রমে স্থিরভাব প্রাপ্ত অনুযায়ীই শোধ হয়। যত স্থির হইবে ততই ঋণ শোধ হইবে, যত ঋণ যায় ততই বন্ধন মুক্ত হয়। সৎ অসৎ বিচার করিয়া সংসারে চলিতে গেলে বন্দীদের চলে না, কারণ জীবগণ সর্ব্বদাই ঋণদায়ে বদ্ধ থাকে। সুখ দুঃখ , ক্ষুধা তৃষ্ণা, শান্তি অশান্তি, ভাল মন্দ, আপন পর, শত্রু মিত্র, ধর্ম্ম অধর্ম্ম, ঘৃণা লজ্জা, ভয়, শোক তাপ প্রভৃতি সকলের দ্বারাই ঋণ ”খতে” বদ্ধ।  এই সকল ঋণ শোধ হইতে এক ঈশ্বরপদ না পাওয়া পর্য্যন্ত জীবের কোন ক্ষমতা নাই। 


(১৫৯) এ জগতে যাহা কিছু দেখা যায় চন্দ্র সূর্য্য নক্ষত্রাদি এবং অব্যক্তরুপ অগ্নি প্রভৃতি দেব দানব, যক্ষ, রাক্ষস, মানব উপাধিগ্রস্ত কালি, কৃষ্ণ, বিষ্ণু, বৈষ্ণবগণ, শাক্ত শৈবাদি ভিন্ন ভিন্ন উপাসক, ভক্তি মুক্তি প্রভৃতি যাহা লোকের অনুভূতি হয়, সকলি এই স্থির আকাশে মধ্যে অবস্থিতি করিতেছে। এই সকল সত্ত্ব, রজ:,  তমোগুণের চাঞ্চল্য শক্তি হইতে প্রকাশিত হইয়া থাকে। সুখ-দুঃখ , ভাব-অভাব, শান্তি-অশান্তি, ভাল-মন্দাদি দ্বন্দ্ব বিকার মাত্র। ইহাই দেবাসুর বলিয়া দুই কুলজাত মানব সম্প্রদায় হইয়া থাকে। ইহাদের জানিত বিদ্যা অভ্যাস করিতে করিতে ঐ শক্তি দ্বারা ভ্রমাত্মক, অনিত্য ‘রাক্ষসী’ ‘আসুরী’ রসে ভুলিয়া বন্ধন হইয়া থাকে। দ্বন্দ্বমুক্ত হইতে পারে না। অতএব “সাম্প্রদায়িক” দ্বন্দ্বগত না হইয়া সর্ব্বদা শান্তি অশান্তির তাড়নায় না থাকিয়া সর্ব্বদা, সর্ব্বতোভাবে সর্ব্ব রকমে অসহ্য তাড়না বেগ সহ্য করিয়া থাকাই পরম পবিত্র সত্যাযুগ ধর্ম্ম, উপস্থিত স্থায়ী ভাবে বিমুগ্ধ থাকে। গুণের প্রলোভনে সীমাবদ্ধ ব্যতীত অন্য কোন উপলব্ধি থাকে না। পতিব্রত ধর্ম্ম মায়ামৃগে আসক্তি জন্মিলে হানি হইয়া যায়। সত্যনারায়ণ পদ লাভ হইতে পারে না। বুজরুকি করিয়া ভ্রমশক্তিকেই মোহিত করিতে পারে। তাহাতে উদ্ধার হইতে পারে না। পতিসেবার বাধকই শুভ অশুভ কর্ম্ম। যাহা হউক যতই স্বপ্নে কি জাগ্রতে যাহা কিছু লাভ হয় সকলি অভাব জানিবেন।


(১৬০) ”নাম চিন্তামণি: কৃষ্ণশ্চৈতন্য রস বিগ্রহ:।  নিত্যশুদ্ধো নিত্যমুক্তোহভিন্নাত্মা নাম নামিনো:। । ” নাম সত্য, সত্যের অধীনস্থ হইলে সতী হয়। সতীত্ব নষ্ট করিলে অভাব হইয়া থাকে। নাম সত্যজাত স্থায়ী, কাম ঋণজাত [?] অস্থায়ী কৌমার, যৌবন, জরা-লোভে পাপ পাপে মৃত্যু-কালের খেলা। গুণ হইতে উৎকর্ষ হয় মাত্র, থাকে না।


(১৬১) নিজ নিজ অধিকারের দাবী না করিয়া কর্ত্তব্য বিষয়ে সচেতন থাকিবার চেষ্টা করিবেন। ভাগ্যং ফলতি সর্ব্বত্র। সত্য যাকে শ্রীবলে, মনের চঞ্চলতা দ্বারা আকৃষ্ট হইয়া সত্য বিয়োগ হইয়া প্রকৃতির তারতম্যভাবে পতিত হয় এবং প্রকৃতি গুণের দ্বারা হ্রস্ব দীর্ঘভাবে জীবসকলকে পরিচালিত করিয়া থাকে, তাহাতে জগৎ বিপরীত হয়। এই দোষ কাহারো নাই। স্ব স্ব ভাগ্যানুসারেই হইয়া থাকে। সীমাবদ্ধজ্ঞানকে “মন” বলে এবং “বোধ” বলে জানিবেন। স্বীয় ভাগ্য হইতে সন্তোষ না হইতে পারিয়া পরের ভাগ, যাহা আপন নয়, তাহা পাইতে গেলে, কি ইচ্ছা করিলেই ঋণপাশে আবদ্ধ হইয়া জন্ম, মৃত্যু, জরা ব্যাধিতে বন্ধন হইয়া দুঃখ  (দুস্তর) পাইয়া অনুতাপে তাপিত হয়। এই অবস্থাকে যমদণ্ড, কালদণ্ড বলে। মা শব্দটি স্বভাব, পিতা শব্দটি ধর্ম্ম, ধরা ধার্য্য করা [?] আমি কে?, আমার কর্ত্তব্য কি, আমার তাপের কারণ কি?এই অনুসন্ধানের দ্বারা পিতৃলোক সত্য, মাতৃলোক ধৈর্য্য সহিষ্ণুতাকে লাভ করিয়া সকল বন্ধন অর্থাৎ সকল ঋণদায় হইতে মুক্ত হইয়া সত্যকে পাইতে পারে। ইহাই সত্যের সেবা, মনের দ্বারা কেবল পাশবদ্ধই হয়, ত্রাণ পাইতে পারে না। যেমন গাঢ় ঘুমের ঘরে মন, বুদ্ধি, দেহ, গেহ, জাতি মান, অহংকারাদি কেহই থাকে না, তখন যেই অবস্থা সেইটি সত্যের সেবা করিয়া পায়। অতএব মনের দ্বারা, কি বুদ্ধির দ্বারা, কি বিদ্যা জ্ঞানাদির দ্বারা সত্য পায় না, কারণ মনের,  বুদ্ধির ভালমন্দরুপ অংশ আছে কিন্তু সত্যের অংশ নাই। জীবগণ যাহা চায় তাহা মনের কামনা জানিবেন। সত্যের সেবায় সকলি পায়, মনের সেবায় সকলি হারায়। ভাগ্যের বেশী কিছু মনে দিতে পারে না। স্ব স্ব ভাগ্যেই ভোগ হইয়া থাকে।  প্রকৃতের্গুণ সংমূঢ়া: সজ্জন্তে গুণ কর্ম্মসু।  তানকৃৎস্নবিদো মন্দান কৃৎস্ন বিন্ন বিচালয়েৎ। ।  “জোযয়েৎ সর্ব্বকর্ম্মাণি মুক্তসঙ্গ সমাচরেৎ” অর্থাৎ মনের সুখ দু:খের অধীন হইতে আলগ [?] থাকিতে অভ্যাস করিতে করিতে সত্যলোকে বসতি হইবে। …সত্যের আশ্রয়কে অয়ন বলে,  এই অবস্থাকেই সত্যনারায়ণ বলিয়া থাকে। অতএব অন্যের ভাগ্যের প্রতি লুব্ধ না হইয়া স্বীয় ভাগ্যের মানে সন্তোষ থাকিতে অভ্যাস করুন, তিনিই সকল কণ্টক হইতে উদ্ধার করিয়া নিবেন।


(১৬২) এই সংসারে স্ব স্ব ভাগ্যবশে লুব্ধ হইয়া সত্যের সঙ্গ (অংশ) ছাড়িয়া মনের চঞ্চলতা হেতু এই জন্মমৃত্যুরুপ মরভূমে প্রকৃতিগত হইয়া বন্দী হইয়া থাকে। সেই মনকে প্রকৃতির গুণের দ্বারায় চালিত মন হ্রস্ব দীর্ঘ প্রাপ্তি [?] ভাবে গতি হওয়ার দরুন লোকসকল সুখ দুঃখ  উপভোগ করিয়া, জন্ম, মৃত্যু ঘটে বিভক্ত হইয়া, অহং কর্ত্তা হইয়া দিশা হারাইয়া, অস্থায়ী, অনিত্য রোগের তাড়না উপভোগ করে বলিয়াই সত্যপদ, যে স্থিতি, ধৃতি, গভীর, তাকে জানতে দেয় না। জানতে না পারায় মনের অর্থাৎ সীমাবদ্ধ যে সুখ তাহাকেই পাওয়ার প্রয়োজন করিয়া থাকে। এই প্রকার সত্যকে সর্ব্বদা ভুলিয়া যায়। মনের দ্বারা শত চেষ্টা করিলেও ভাগ্যে যাহা আছে তাহার [বেশী] পাইতে পারে না, কারণ ফলদাতা একমাত্র ভগবান জানিবেন। দেহ, গেহ, সমাজ, ধনজন বৈভবাদি বিদ্যা বুদ্ধি যাহা লোকে পায় তাহা সমস্তই ভগবানের দত্ত। তাকেই ভাগ্য বলে। অতএব সত্যের সেবা করিবেন, তিনিই ভাগ্য মুক্ত করিয়া সৌভাগ্য দিয়া পালন করিবেন।  ন কর্ত্তৃত্বং ন কর্ম্মাণি লোকস্য সৃজতি প্রভু:।  নাদত্তে কস্যচিৎ পাপং ন চৈব সুকৃতং বিভু:।  অজ্ঞানেনাবৃতং জ্ঞানং তেন মুহ্যন্তি জন্তব:।।


(১৬৩) লোকসকল স্ব স্ব প্রকৃতির তারতম্যদ্বারা দেহ, গেহ, জাতি, মান, বিদ্যাবুদ্ধি, দেশ ঐশ্বর্য্য লাভ করিয়া পূর্ব্বাপার ব্যাসকাশীতে পড়িয়া সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু দেহী সীমাবদ্ধ নয়। তিনি সকল প্রকৃতির দেহে থাকিয়াও দেহেতে মিশেন না, আলগ থাকেন। অহংকারের দ্বারায় দেহ অভিমানী হইয়া দেহেরই তারতম্য অনুভূতি করিয়া, শোক, তাপ, দুঃখ , কষ্ট অনুভূতি করিয়া সত্যরুপ যে দেহী, অচ্ছেদ্য, অক্লেদ্য, অশোষ্য, অদাহ্যাদি বিশুদ্ধ প্রকৃতি জানতে পারে না। দেহীর সাহায্য ভিন্ন যে একচুলও ইন্দ্রিয়াদি ক্রিয়া পায় না তাহা জানিতে পারে না বলিয়া সম্বন্ধ দেহেরই আধিপত্য স্বীকার করিয়া কর্ত্তা ভোগ করেন। 


(১৬৪) লোকসমস্ত ভাগ্যানুসারে এই ত্রিজগতে পিতা প্রভৃতি আত্মীয়-স্বজন শত্রু মিত্রাদিরুপে আবৃত করিয়া থাকে। প্রকৃতির তারতম্য অনুসারে দেহাদি উৎপন্ন ঘটে, দেহী নিত্যং, তাহার জন্মও নাই, মিত্রও নাই শত্রুও নাই মৃত্যুও নাই। তিনি সত্য, তাঁহাকে ভুলিয়াই ভাগ্যফলের তাড়নায় লাঞ্চিত হইয়া পড়ে। এই লাঞ্চনা হইতে ত্রাণের উপায় একমাত্র সত্যের সেবা ছাড়া আর কিছুই নাই। ইনিই জীবভাব মুক্ত করিয়া থাকেন।  অতএব, পিতার সেবা করিতেছেন এই সেবায়ই ধন্য হইবেন। পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম্ম, পিতাই পরম তপস্যা জানিবেন। এই পিতৃসেবা করিতে হইলে কর্ত্তাভিমান ত্যাগ করিতে হয়। ইহাই নামই সত্যব্রত, পতিব্রত, গৌরীব্রত, সীতাব্রত, সাবিত্রীব্রত বলিয়া জানিবেন। অতএব সত্যনারায়ণের সেবা করুন, তিনিই এই প্রকৃতির গুণের সম্ভার হইতে উদ্ধার করিয়া সত্যের দেশে নিয়া যাইবেন, সন্দেহ নাই। 


(১৬৫) এজগতে জন্ম, মৃত্যু, জরা ব্যাধির দ্বারা জীবের ভোগ উৎপন্ন হয়। এই ভোগ সমস্তই তুলসী পত্রের সহিত দান করিয়া জীব সত্য-ধন স্বরুপ ভগবানকে পাইয়া থাকে। যাহা হউক প্রারব্ধ যাহা যাহার আছে তাহাই সকলে পাইয়া থাকে। ভগবানের স্মরণ মননই কর্ম্ম, ফলাফল কর্ম্মফলদাতা ভগবানই, জীবের নাই। অতএব, যাহা ভাগ্যবশে ঘটিবে, তাহাই জীবের প্রাপ্ত, অতিরিক্ত আশাকে দুরাশা বলে। সর্ব্বদা ভগবানের সঙ্গে থাকিবার জন্য যত্ন করিবেন।


(১৬৬) মনের যে সকল ক্রিয়া কর্ম্ম সুখ দুঃখ  দাতা তাহার সকল শংকর জগতেই থাকে। যজ্ঞের জন্য কর্ম্ম উৎপন্ন হয়, মনের জন্য নয়। অতএব, যাহা যাহা হৃদয়ে উদয় হয় তাহার দিকে লক্ষ্য না করিয়া নাম করিয়া যাইবেন। ভাগ্যফল ভোগদায় মুক্ত হইয়া নির্ম্মল সত্যলোক গতি হইবে। কেহই আকর্ষণ করিবে না। ঋণ সকল মুক্ত হইয়া অঋণে, অপ্রবাসে বিশুদ্ধতা শক্তিতে নামরুপ সত্যের নিকট থাকিতে পারিবেন। 


(১৬৭) সকল অবস্থায়ই ভগবানের নামের প্রাধান্য করিয়া থাকাই জীবের কর্ত্তব্য কর্ম্ম বলিয়া মহাত্মাগণ উপদেশ করিয়া গিয়াছেন। 


(১৬৮) ভাগ্যং ফলতি সর্ব্বত্রং। ভগবান সকলকেই সমান দেখেন, কাহার কোন দোষ গুণ দেখেন না। প্রারব্ধই ভোগের উদয় অস্ত করিয়া থাকেন। সত্যনারায়ণকে সর্ব্বদা সঙ্গে রাখিতে চেষ্টা করিবেন। তিনি ছাড়া জগতে বন্ধু বান্ধব কেহই নয়। 


(১৬৯) ভাগ্যং ফলতি সর্ব্বত্রং। জননী জন্মভূমি স্বর্গ হইতেও শ্রেষ্ঠ। ভয় শোকে আতুর হইয়া পালাবার স্থান একমাত্র “সত্য”,  আর নাই। সকল লোকই মরুভূমের অধীন। সত্য সব ভূমের অতীত জানিবেন। অতএব, সত্য আশ্রয় করিয়া থাকিতে চেষ্টা করাই জীবের স্বধর্ম্ম।


(১৭০) ভাগ্যবশে ত্রিলোকের ফলাফল ভোগ ঘটিয়া থাকে। তাই যখন যাহা ভগবানের যে ভাগ পাওয়া যায় তাহাই সন্তোষ থাকিয়া সত্যরুপ যাহা নামরুপে এই ত্রিলোকে বিরাজ করেন তাহারই সঙ্গ হইতে ঐ ভোগ মুক্ত ঘটিয়া থাকে জানিবেন।


(১৭১) লোক সকল কর্ত্তৃত্বাভিমানী মনের সহচরে চঞ্চল হইয়া সত্যপদ ভুলিয়া ভাগ্যানুসারে অস্থায়ী মরভূমে প্রকৃতিগত হইয়া গুণের দ্বারা পরিচালিত হইয়া নানাবিধ ঋণজালে বন্দী হইয়া সুখ দুঃখ  ভোগ করিতে থাকে। সুখের লালসাই এইরুপ বন্ধ জানিবেন।  নামকেই সত্য বলে। নামই রুচি, নামই শান্তিধাম, নামকে ভুলিয়া অস্থায়ী যে বিনাম তাহার প্রার্থনা করিয়া মনের সংকল্পনাজনিত ভ্রান্তিপাশে ঘুরিতে থাকে। এই ভ্রান্তলোক পরিহারের জন্যই নাম লয়। নামের সেবক হইয়া নাম পায়। এখন [?] নামে সুখ দু:খের জন্য প্রার্থনা করিলে নাম তো বিনাম হইয়া বহু খন্ড বিখন্ড হইয়া পড়ে, নাম ত রইল না। অতএব নামের অধীন হইবার জন্য মনের সঙ্গে না যাইয়া নামের সঙ্গে থাকিতে চেষ্টা করিলে নামের সেবা হয়।  নাম করিতে কিছু লাগে না। ভেদবুদ্ধিই বন্ধন জানিয়া নামের অধীন থাকিতে চেষ্টা করাকেই নাম বলে। এই অবস্থা অচল হইলে অর্থাৎ ঘুমাইয়া পড়িলে যে অবস্থা হয়, সেই অবস্থাকেই প্রাপ্ত বলে। নামেই উদ্ধার করিয়া থাকে, এই মরভূম হইতে জানিবেন। …কর্ম্মফলদাতা ভগবান। কর্ম্মকর্ত্তা লোকেরই আছে, ফলের নাই।


(১৭২) ভাগ্যকে মানিয়া ভাগ্যরথে চলিলে সকল ঋণ মুক্ত হইয়া পরমানন্দ অবিমুক্ত পদ লাভ করিতে সক্ষম হইয়া থাকে।


(১৭৩) ভাগ্যং ফলতি সর্ব্বত্র। ধর্ম্ম সকল কর্ম্মপাশ মুক্ত করেন। সহায় বিশুদ্ধ ভক্তি জানিবেন। যেখানে ভাগ্যবশে চালনা করেন সেখানে ভাগ্য সঙ্গে থাকিবে জানিবেন। যাহা করেন সত্যের সঙ্গে থাকিয়া করিবেন। সত্যই আনন্দ দিবে।


(১৭৪) সত্যনারায়ণকে ভুলিয়া যাওয়ায় লোকসকল স্ব স্ব ভাগ্যানুসারে স্থান, সমাজ, স্বজন, শত্রুমিত্রদ্বারা বিদ্যাবুদ্ধির ধনাদির সম্পত্তি লাভ করিয়া থাকে। এই সকল সংঘটন ভাগ্যের দ্বারাই মিল অমিল, যোগবিয়োগ সাধিত হইয়া থাকে। তাহা হইতে এক চুলের অংশও কেহ ব্যতিক্রম করিতে পারে না। এই ভাগ্য মনের দ্বারাই লাভ হইয়া জীব সকল সুখী দু:খী হইয়া থাকে। জীব যখন ঘুমায় তখন এই মন থাকে না। দেহ গেহ, স্বামী পুত্রাদি ধন জন বাড়ি ঘর ঐশ্বর্য্যাদি কেহ থাকে না এবং দেহ বোধও থাকে না জানিতেছেন। তবে কেন এই কাল করালের শাসনের অধীনে থাকিতে ইচ্ছা করেন। এই নশ্বর দেহ এবং তাহার সম্মিলনী সম্পদের লালসায় বিভ্রান্ত [?] না হইয়া নামরুপ সত্যদেবের আশ্রয় লইয়া থাকিতে থাকিতে যখন কর্ত্তৃত্ব বোধ থাকিবে না, সত্যের দাসত্ব অভিমান উদয় হইবে, তখন সত্যকে পাইবেন। অভিসম্পাত মুক্ত হইয়া পরীক্ষিতের ন্যায় ব্রহ্মশাপ মুক্ত করিয়া মহাপ্রসাদ লাভ করিতে পারিবেন। ইহাকেই সিদ্ধদাস [?] বলে। ভাগ্যে অর্থাৎ ভাগে যাহা যখন পাওনা আছে পাইবেন। অতএব সর্ব্বদা সহ্য করিয়া আতঙ্ক অধীন না যাইয়া সত্যের দাসত্বলাভের চেষ্টা করিবেন। সত্যই সকল ঋণ (দায়) হইতে উদ্ধার করিবেন।


(১৭৫) লোক সকল স্বকীয় অপরাধের দ্বারা প্রকৃতির তারতম্য অনুসারে এই অস্থায়ী কালের কবলে পড়িয়া ভিন্ন বুদ্ধির দ্বারা কলুষিত হইয়া শান্তি অশান্তি উপভোগ করে। ইহার [?] কর্ত্তা হই বলিয়া আমি জ্ঞান বন্দী হইয়া পড়ি এবং কর্ত্তৃত্বদ্বারা আমার জ্ঞানে বিমোহিত হই। সত্যকে জানিতে না পারিয়া আমার স্ত্রী, আমার পুত্র, আমার জাতি, মান, ধর্ম্ম, অধর্ম্ম ভাবে প্রমত্ত হইয়া পড়ি। কিন্তু ঘুমাইলে ইহার কেহই থাকে না। তখন সত্যই থাকে। যখন কর্ত্তা হইয়া জাগি তখন আমি ভাগে ভাগে দ্বিধা হইয়া পড়ি। অতএব এই কর্ত্তৃত্ব ছাড়িয়া যাহার যাহা ভাগ্য ভোগে আটক আছে তাহাতে বাধা না দিয়া সত্যকে আশ্রয় করিয়া থাকিলে সকলি আপনার হইয়া যায়। অবিচ্ছেদে সত্যকে পায়, ইহাই অভিসম্পাদ মুক্ত বলিয়া জানিবেন। এই ভাবকে আশির্ব্বাদ জানিবেন। অভিসম্পাতের দরুনই এই সকল বৈষম্য সম্বন্ধ জ্ঞান হয়। নিজ নিজ অধিকারের দাবী না করিয়া কর্ত্তব্য সম্বন্ধে সচেতন থাকাই ধর্ম্ম।


(১৭৬) সত্যং পরম ধীমহি। সত্যের কম্প নাই, অসত্যের অর্থাৎ অস্থায়ীর স্থিতি নাই। সত্য ধীরা, স্থিরা, গম্ভীরা, তাঁহার স্মরণে ত্রিলোকের ঋণ পরিশোধিত হয় জানিবেন। 


(১৭৭) লোক সকল মনের চঞ্চলাদির দ্বারা পরিচালিত হইয়া স্ব স্ব ভাগ্যানুসারে দেহ, গেহ, স্ত্রী পুত্রাদি স্বজন, শত্রু মিত্র, ধন জন, বিদ্যা বুদ্ধির বৈভবাদি অনুপ্রেত হইয়া ভোগের দণ্ডে দণ্ডিত হয়। এই জন্যই ইহাকে মরভূম বলিয়া লোকে বলে। এই মরভূমে যাহা কিছু লাভ হয় সকলি মনের দ্বারা হইয়া থাকে এবং সকলি জন্ম মৃত্যু। ইহার হাত হইতে ত্রাণ হইবার ক্ষমতা এক ভাগ্যই দিয়া থাকে জানিবেন। তাহা ছাড়া আর কাহারও কর্ত্তৃত্বের অধীন নয়। অতএব সত্যনারায়ণ সেবা করিতে অভ্যাস করুন। তিনিই জন্ম কর্ম্ম ফলদাতা, তিনিই ব্যবস্থাপক জানিবেন।  কর্ত্তা হইয়া যে যাহা করে তাহা সকলি দক্ষযজ্ঞ বলিয়া জানিবেন, ইহা পূর্ণ হয় না। এক মাত্র ধর্ম্মই অর্থাৎ ধৈর্য্যই ইহার সহায় সম্পদ জানিবেন।  না লইবে কা’রো দোষ না করিবে কারে রোষ কায়মনে আপনাকে করিবে সাবধান।  অর্থাৎ সঙ্কোচ হইয়া থাকিবে। কর্ম্মের অধিকার জীবের, ফলের অধিকার নাই, ফলদাতা ভগবান।


(১৭৮) অহংকার হইতে সীমাবদ্ধ জীব হইয়া শিবত্ব ভুলিয়া মন বুদ্ধির তারতম্য বিকারে পড়িয়া প্রকৃতির গুণের দ্বারা পরিচালিত হয়। (প্রকৃতের্গুণসংমূঢ়া: সজ্জন্তে গুণকর্ম্মসু) অতএব,  প্রকৃতি গুণের তরঙ্গে না যাইয়া শান্তির নিকেতনে বাস করিতে চেষ্টা করাই বুদ্ধিমানের কর্ম্ম। স্ব স্ব অধিকারের দাবী না করিয়া কর্ত্তব্য সম্বন্ধে যত্ন [?] করাই ধর্ম্ম।  ‘দেখবে শুনবে কইবে না।  সার [?] বস্তু ছাড়বে না। ।  সাপ – স্বপন পনা।  যে না বলে সে একজনা। । ‘ জানিবেন।  সত্যনারায়ণের সেবা করিয়া চলিতে চলিতে যখন সত্যের দাস অভিমানের অংশে পড়বেন তখনই সত্যের প্রসাদ অবিয়োগ পাইবেন। এই ব্যবস্থাকেই অভ্যাস যোগ বলিয়া থাকে। ধৈর্য্য ধরিয়াই সত্যের দাস হইতে পারে, জন্মকে জয় করিতে পারে। অধৈর্য্যের অধীন হইতে হইলে জন্ম মৃত্যুর আশ্রয় ত্যাগ করিতে পারে না জানিবেন।  লব্ধং বাথ ন লব্ধং বা স্বল্পং বা বহুলং তথা নিষ্কামে নৈব ভোক্তব্যং সদাসন্তোষ্টমানসাৎ।। 


(১৭৯) দেহেতে আবৃত হইলেই পতিসেবার প্রয়োজন হয়। কারণ দেহই হইয়াছে অভাবযোগ। যাহা কিছু প্রয়োজন সকলি দেহের যোগেতে হইয়া থাকে। জীবগণকে জন্মকালেই দীক্ষা করিয়া সৃষ্টিদেবতা মন্ত্র দিয়া দেয়। গুণের চঞ্চলতায় পড়িয়া সেই উপদেশ ভুলিয়া যায়।  পুনরায় সেই ভ্রমশোধনের জন্য গুরুজন হইতে উপদেশ পাইয়া সেই পতিদেবতার সেবা পরিচর্য্যায় তৎপর হইলে ক্রমে ক্রমে জ্ঞান স্ফুরণ হইয়া পরম স্মৃতি উদয় হয়। তখনই পরম দেবতার প্রকাশ পাইয়া পরম আনন্দেতে চিত্ত উল্লাস হইয়া পরে। সঙ্গে সঙ্গে পতিচরিত্র প্রকাশ পাইয়া সকল অভাবাদি অশান্তি দূরীভূত হয় এবং আত্মাকে জানিয়া আর মায়ামুগ্ধ হয় না। অতএব পতিসেবা করিতে সর্ব্বতোভাবে লিপ্ত থাকিতে চেষ্টা করিবেন। সকল বাসনা (বন্ধন) মুক্ত হইয়া পরম শান্তি লাভ করিতে পারিবেন। শ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গ লাভ হইয়া থাকে।  শ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গের অর্থ এইঃ- নাশার পথ এবং মুখের পথের দ্বারা যে বাতাস (বায়ু) চলা ফিরা করে অর্থাৎ বাহির হয় আবার শরীরের মধ্যে যায়,  ঐ বাতাস অনুসন্ধান করিতে করিতে ঐ বায়ুর তত্ত্ব বোধ হয়।  বোধ হইলেই পূর্ব্বের সৃষ্টিকর্ত্তার উপদেশ মনে পড়িয়া যায় (ইহাকেই পূর্ব্বস্মৃতি বলে)। তখন আমি কে, আমার কর্ত্তব্য কি?আমি কেন তাপত্রয় যন্ত্রণা সংসারে ভোগ করিয়া থাকি এই সকল জানিতে পারে। ইহা জানিলে পর আর অনিত্যবিষয়গত ইন্দ্রিয় সুখের দাসত্ব ভুলিয়া পতিদেবতার দাসের দয়াও উপস্থিত ঘটিয়া যায়। আত্মস্মৃতি জন্মিয়া যখন ধৈর্য্য ধরিতে চেষ্টা অবিচ্ছেদ হয় তখন যে অবস্থা দাঁড়ায় সেই অবস্থাই [?] “মন্ত্র” অর্থাৎ জন্মকালের উপদেশ পতিসেবার শক্তি জাগিয়া পড়ে। আত্মস্মৃতি অভাবে যে সকল মন্ত্রতন্ত্রাদি যোগ হয় তাহা সকলি মায়া, ভুল। কাজেই মন্ত্রতন্ত্রাদি সাধু মহাত্মার উপদেশ স্থির করিতে পারা যায় না। এই সকল ক্রিয়া কর্ম্ম যাগ-যজ্ঞাদিকে মায়ামুগ্ধ অর্থাৎ ভ্রমমুগ্ধা “মরভূম” বলিয়া থাকে।  ইহা দ্বারা ভগবৎ তত্ত্ব জানা দূরে থাকুক ঐহিকের ও সুখভোগের অভাব ঘটিয়া পরে। যে পর্য্যন্ত আত্মবোধ না হয় সেই পর্য্যন্ত যে পতিকে পতি বলিয়া অভিমান করা যায় সেই পতিকেই অনন্যদেবতা জ্ঞানে ভগবানের স্বরূপ জানিয়া এবং ঐ পতিসেবাই মন্ত্রতন্ত্র বুঝিয়া পরিচর্য্যা করিতে করিতে অনাবরণ বিদেহীপদ ব্রহ্মতত্ত্ব সত্যবানকে অনাবরণ দ্বারা লাভ করিতে পারে। অতএব, দিবানিশি যে পর্য্যন্ত কর্ত্তৃত্বাভিমান থাকে, যে পর্য্যন্ত পতিদেবতার কৃপা প্রকাশ না হয়, সেই পর্য্যন্ত ভগবৎস্বরূপ এই পতিদেবতার পরিচর্য্যা এবং পতিমুক্তের জন্য লালসা প্রদান করিয়া, অন্য অভিলাষ ছাড়িয়া, পতিদেবের ছায়া স্বরূপ হইয়া তাঁহাকে প্রধান মনে করিয়া তাঁহারই প্রীতির জন্য সর্ব্বদা সতর্কভাবে তাঁহার অনুগ্রহের আশ্রয়ের জন্য প্রতীক্ষা করিয়া থাকিতে চেষ্টা করিবেন। ইহাই সাধনা জানিবেন। ইহাকেই অভ্যাস যোগ বলিয়া জানিবেন। এই কর্ম্মের নামই ওঙ্কার ব্রহ্ম জানিবেন। অথবা শ্বাস টানিয়া নেওয়া এবং হৃদয়ে যতক্ষণ পারা যায় রাখা, যে যে মহাজনের নিকট যে যে উপদেশ লাভ হইয়াছে, তাহাই এই পতিদেবতার সেবার দ্বারায় দেহ ত্যাগ করা যায়,  সেই বিদেহী অবস্থায় ইহার মর্ম্ম একই পদার্থ জানিতে পারে। ঐ পতিসেবা করিতে করিতে এই পতিই সাবিত্রীর ন্যায় কালের বিকৃতি তরঙ্গমালা অবিদ্যাজাল হইতে উদ্ধার করিয়া পরম শান্তিপথে লইয়া যায়।  বেদপুরাণাদিতে ইহারই প্রহসন দেখাইয়া জীব মুক্তপথ খোলার উপায় দর্শন হইয়াছে জানিবেন।  (“সর্ব্ব ধর্ম্মান পরিত্যাজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।  অহং ত্বাং সর্ব্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচ:। । “) এই শ্লোক উপনিষদ জানিবেন। ভগবৎ পদ হারা হইয়াই অহংকার কর্ত্তৃক অপহৃত হইয়া অশোকবনে বাসস্থান হয়। এখানে চেরীর অত্যাচার আবরণ সততই থাকে। অর্থাৎ সুখের জন্য যাহা কিছু চেষ্টা করা হয় তাহা পরিণামেই দুঃখ জানিতে পারেন। লোকের সুখই প্রার্থনা,  দুঃখ কেহই চায় না। তবে দুঃখ কেন হয়? ইহাতে বুঝিতে পারেন সুখের সঙ্গে দুঃখ আছেই। সর্ব্বদা সুখে দুঃখে সমান বোধ করিলেই মন্ত্রাদি যাগযজ্ঞ উপাসনাদি প্রকাশ পাইয়া থাকে।  পতিসেবা ছাড়া জগত উদ্ধারের উপায় আর কিছুই নাই। সুখ দুঃখ সমান করিবার জন্য একমাত্র পতিসেবা দুর্ল্লভ [?] হইয়া যায়।  পতিসেবায়ই সুখ দুঃখ  থাকে না– তাহার প্রমাণ দেখা যায় সাবিত্রী, বেহুলা, সীতা, শৈব্যা, চিন্তা, দময়ন্তী প্রভৃতির পতিসেবাই দ্বন্দ্ব মুক্ত করিয়া বিদেহীর আশ্রয় লাভ করিয়া অবিচ্ছেদ পতি ঈশ্বরের শ্রীসম্পদ ভগবানের আশ্রয় পাইয়া থাকে।  এতদভিন্ন কর্ত্তাভিমানে দক্ষযজ্ঞ অর্থাৎ শিব (শুভ) হীন যজ্ঞ হইয়া যায়।  পতিদেবতাকে কর্ত্তৃত্বাভিমানসহ যাহা কিছু ইচ্ছাদির দ্বারা মনের বোধ হয় সকলই পতিকে দান করিতে করিতে অর্থাৎ ইচ্ছাদি পতিসেবায় নিযুক্ত করিতে করিতে সকল ঋণ মুক্ত হইয়া তাপময় দেহ সংসার ছাড়িয়া নির্ম্মল সত্যলোক অচলাভক্তি বিশুদ্ধ ভাবযোগে পরম আনন্দ চিরকাল অবিচ্ছেদ ভাবে ভোগ করিতে পারে। ইহাই সনাতন ধর্ম্ম, হিন্দু চর্চা জানিবেন।


(১৮০) মনের অস্থায়ী জল্পনা কল্পনা পরিহারে, সাবিত্রীর ন্যায় সত্যবানের পশ্চাতে থাকিয়া, সত্য অর্থাৎ স্থায়ী অক্ষুণ্ণ রসেতে ডুবিয়া, মনের অধীন মুক্ত হইয়া শান্তি লাভ [করিতে পারে]।  মনটাকে জরা প্রকৃতি বলে, আবরণের দ্বারা মনের চেতনা হয়। তাহাতেই লোকে চঞ্চলতা হইয়া শান্তিময় যে সত্যবান, যার অংশ নাই, তাহাকে ভুলিয়া সীমাবদ্ধ অহংকারের দ্বারা আবদ্ধ হয়, জন্ম মৃত্যু দুঃখ সাগর ত্যাগ করিতে পারে না। ধৈর্য্যহারা হইয়া দুশ্চিন্তাতে ব্যস্ত হইয়া থাকে। সত্যের অধীন হইলে এই কর্ত্তাভিমান ত্যাগ হইয়া জন্ম মৃত্যু, দুঃখ  কষ্ট সকলি ত্যাগ হইয়া থাকে। লোক ঘুমাইলে কেহ থাকে না, জাগিলে বহুরুপ [?] হইয়া নানান উপসর্গের অধীন হইয়া কষ্ট পায়।


(১৮১) মনের স্থিরতায় দু:খের অবসান ঘটে না, কারণ [?] মনের গতি পরিবর্ত্তনশীল, সীমাবদ্ধ। মনের দ্বারায় কেবল পাপপূণ্য, সুখ দু:খের ভোগ উৎপন্ন হইয়া থাকে। জন্ম মৃত্যুর গতি বৃদ্ধি হইয়া থাকে। অতএব, মনের বেগ ধৈর্য্য ধরিতে ধরিতে এ দেহের ঋণ শোধন হয়, মনের দ্বারায় ঋণ মুক্ত হয় না। মাতৃকোলে আছেন ভয়ের কারণ নাই। মাতৃপদ সর্ব্বমুক্তি সম্পত্তি। ইহারর আশ্রয়ে সকল ঋণ শোধ হইয়া থাকে।  ……ভবিতব্য ইহার মিল স্থান। কাহারো কোন হাত নাই, যেখানে ভবিতব্য নির্ব্বন্ধন রহিয়াছে সেখানেই বিবাহ, জন্ম, মৃত্যু ঘটিয়া থাকে। ইহাদের স্থিতি নাই।  সর্ব্ব সত্যলোকে, যেখানে উদয় অস্ত নাই, অথবা [?] যেখানে মন থাকে না, বুদ্ধি থাকে না, তাহাকে নিত্য সত্যরুপ বলিয়া থাকে। ভাগ্যানুসারে জীবের গতাগতি হইয়া থাকে। ভাগ্য মুক্ত হইলে সত্যলোক প্রকাশ পায়। ভাগ্যানুসারে আয় ব্যয় হয়, ভাগ্য মুক্ত হইলে নিত্যানন্দ ভোগ পায়। 


(১৮২) লোক সকল স্ব স্ব ভাগ্যবলে আটক পড়িয়া নানারুপ সুখের দু:খের দ্বারা পীড়ন পাইয়া থাকে। ইহা হইতে একমাত্র ত্রাণের উপায় সত্যের সেবা ভিন্ন আর কিছুই নাই। কারণ ভাগ্যই ফলদাতা, ভাগ্যে যাহা পাইবে তাহার অতিরিক্ত কাহারো কিছুই পাইবার শক্তি নাই জানিবেন। …… ভক্তিভাবে শ্রদ্ধা করিয়া যে যাহা দান করে তাহা সকলই ভগবান পাইয়া থাকেন, সন্দেহ নাই। 


(১৮৩) জাতিগত ভাষায় সীমানা [পার করিতে] পারে না। ভাগ্যই সকল দিয়া থাকে জানিবেন। এই ভাষা পাশ দ্বারা বন্ধন মুক্ত হয় না, কেবল বৃদ্ধিরই যোগ হইয়া থাকে। অরেখ জাতি [?] পাশ করিলে জাতিয়া ভাষা থাকে না, বন্ধনও থাকে না। অতএব, ভাগ্যফল ত্যাগ করিয়া সত্যের সেবায় যত্নবান থাকুন। 


(১৮৪) সত্য কিছু ফল দেয় না জানিবেন। ভাগ্য হইতে প্রকৃতির গুণের দ্বারা জীবসকল পরিচালিত হইয়া কর্ম্ম ক্ষেত্রে নানান ব্যাধিজালে আবদ্ধ হয়। আবার ভাগ্য হইতেই মুক্তিলাভ করিয়া থাকে। সকল বিষয়েই ব্যস্ত হইলে ভোগ ত্যাগ করিতে পারে না, ধৈর্য্য হইতে পারে।


(১৮৫) মনেতে যাহা ভাল লাগে তাহা সর্ব্বৈব বিভূতি, মন হইতে উৎপন্ন সৃষ্টি প্রকাশ হইয়া সীমাবদ্ধ হইয়া বহুপ্রকার তরঙ্গের আবরণে পড়িয়া থাকে বলিয়াই ঋষিগণ ইহাকে মনের সঞ্চারিত বিপদ বুদ্ধিতে মায়া (ভ্রান্তি) বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন —— মনঃ করোতি পাপানি মনো লিপ্যতে পাতকৈঃ অতএব, মনের সুখের জন্য যাহা কিছু অনুষ্ঠান করেন তাহা সকলই অভাব জানিয়া ঋষিগণ সত্যকে ত্যাগ করিতে পারে না।  ভগবান নিত্য, শ্বাশ্বত, পুরাণ, আদি, অনাদি প্রভৃতি উপাক্ষং ঋষিগণ হইতেই প্রকট হইয়া থাকে এই সকলই একমাত্র নাম। ভগবান নামরূপ, এই নামের অনুশীলনকে ভক্তি, নামে জাগ্রত থাকাকে ভক্তিরূপ বলে। এই নাম ভিন্ন জগতের ত্রাণে প্রাপ্ত আর কিছুই নাই।  এই জ্ঞানকেই নাম সংকীর্ত্তন বলে।  এই অবস্থাই নিত্যানন্দ বলিয়া জানিতে হয়। এই ভাবের অবতীর্ণতাকে অদ্বৈত আচার বলিয়া জানিবেন। এই নাম ছাড়া অন্য কোন শাসনে, প্রলোভনে, উৎপাতেও নাম ত্যাগ করিবেন না। ইহাই শক্তি বলিয়া জানিবেন। এই নামের যে আশ্রয় সেই অবস্থাকে শ্রীসম্পদ বলিয়া থাকে। ঐশ্বর্য্য অর্থাৎ ভগবান ষড়ৈশ্বর্য্যময় বলিয়া থাকে। সেই ঈশ্বর স্বরূপ অর্থ প্রকাশ হয়। ইতি নাম প্রকাশ ইহাকে বেদ বলিয়া থাকে। এই বেদের আশ্রয় নিলেই জানা যায়,  ইহাকেই মন্ত্র বলে। এই বেদরূপ ভগবান।  এই নামের সঙ্গে সর্ব্বদা থাকিতে থাকিতে অবতার শক্তি সমভাব প্রকট হয়। ইহাই অবতার শক্তি।  এই শক্তিকে সামর্থ্য বলে। ইহার অর্থ নামের বিস্তীর্ণ অবস্থাই চৈতন্য (রূপ)। এই নামের প্রকাশ শক্তিই নিত্যানন্দ বলিয়া জানা হয়।  নামই সত্য, সত্যই ধ্যান (চিন্তা),  ধ্যানই ভগবান অর্থাৎ ধীর বলিয়া জানিতে হয়।  অচ্যুতং কেশবং বিষ্ণুং, হরি সত্যম্ জনার্দ্দনম্।  হংসং নারায়ণঞ্চৈব এতন্নামাষ্টকম্ শুভম্। ।  (শিব) মঙ্গল কল্যাণ সদানন্দ পর্য্যায়ক্রমে বুদ্ধিযুক্ত বিশেষ হইয়া থাকে।  এক বই দ্বিতীয় নাই।  “হংসং” ই বেদ অর্থাৎ ভগবানকে জানে। ভগবৎ জানিলেই ভগবানের শরণ লয়। ভগবৎ শরণ লইলেই ভগবৎপদে আত্ম নিবেদন করিয়া কর্ত্তৃত্ব যোগ বিয়োগ হইয়া ভগবৎ দাস হয়। ভগবানের দাস হইলেই স্বভাব পায়, অর্থাৎ স্বরূপ প্রকাশ হয়।  বিরূপ অবস্থা থাকে না। ভগবানই সত্য বলিয়া জানিতে পারিলে সকল অবস্থায় ভগবান ভিন্ন অন্য কিছু গোচরে আসিতে পারে না। যাহাদ্বারা মোহকারী ভ্রমপূর্ণ মায়া সকল উদ্ধার হইয়া সকলই অগণ্য হইয়া এক ব্রজরাজের সেবা পাইয়া পরম পবিত্র প্রেমরস ভোগ পায়। ইহার উৎপন্ন ভাবকেই কৃষ্ণমূর্ত্তি, মুরলীবদন, বংশীধারী রাধাকৃষ্ণ প্রভৃতি আখ্যা বেদের প্রকট হইয়া যায়।  এই ” হংস:” হইতেই সর্ব্বপ্রকাশ ভগবান জানে।  যো মাং পশ্যতি সর্ব্বত্র সর্ব্বঞ্চ ময়ি পশ্যতি।  তস্যাহং ন প্রণশ্যামি স চ মে ন প্রণশ্যতি। ।  সর্ব্বদা সকল অবস্থাতে নামের চিন্তার নামকে জ্ঞান বলে। অভ্যাস করিতে করিতে নামের জ্ঞান জন্মে। জ্ঞানের ধ্যান আসে, অর্থাৎ নামের উদয় হয়। নামের উদয় হইলে বুদ্ধি অন্যত্র যায় না। তখন যে অবস্থা তাকে প্রাপ্ত বলে। প্রাপ্ত হইলে পর সকল অভাব যায়।  যেমন কচি ডাসা পাকা রসাল হইয়া থাকে। সেইরূপ দেহমুক্ত লাভ হয়। এই অবস্থাকেই ব্রজ প্রাপ্ত রসাল হইয়া থাকে। এইরূপ দেহমুক্ত লাভ হয়। এই অবস্থাকেই ব্রজ প্রাপ্ত বলে।  শয়নে, স্বপনে, ভোজনে, দানে সকল কর্ম্মানুষ্ঠানে, সকল, অবস্থায়ই এই নাম করিতে নাম জাগিয়া উঠে। নাম ছাড়িবেন না।  যাহা যাহা ভাল লাগে তাহা সকলই প্রলোভন,  মায়ামৃগ, মরুভূমির ভ্রম মাত্র জানিবেন। সর্ব্বতোভাবে ভগবান সর্ব্বশক্তিরূপ জানিবেন। এই বই আর কিছুই নাই।


(১৮৬) ভাগ্যকে মানিয়া ভাগ্যরথে চলিলে সত্যনারায়ণকে পায়। যাকে পাইলে আর বিয়োগ যন্ত্রণা উপভোগ করিতে হয় না। 


(১৮৭) কালচক্রে যে খন্ড খন্ড ভাবে প্রবাহ হইতেছে, তাহার নিকট হইতে উদ্ধার করিয়া অখন্ড, অব্যয় সত্যকে উদ্ধার করিয়া ত্রিকুল [পবিত্র করিতে হয়], এই অবস্থাকেই সংসার বলে, অর্থাৎ সত্যকে সার করা। সত্যনারায়ণ অর্থাৎ সত্যের আশ্রয়। সত্যং পরং ধীমহি জানিবেন।  লোক সকল স্ব: স্ব: ভাগ্যানুসারেই দেহাদি লাভ করিয়া ভোগ আয়তনী শক্তির দ্বারা বিবৃত হইয়া পরে, তাহার কর্ত্তাভিমানে মনের দ্বারা শান্তি অশান্তি ভোগের দ্বারা বন্ধন হইয়া থাকে। এই জন্যই ভোগমুক্তির জন্যই সত্যের সেবক হইতে হয়। 


(১৮৮) ধৈর্য্যই লোকের পরম ধন; এই ধনকে সর্ব্বদা  যত্ন করিবে। 


(১৮৯) গুরু বলতে নামই গুরু। গুরুর সঙ্গে সম্বন্ধ পরমানন্দ ভাব; নামের অর্থ চিন্তামণি। নাম প্রতিষ্ঠা করিয়া থাকিলে এবং সর্ব্বদা নামের পরিচর্য্যা করিতে করিতে নামে রুচি হয়। নামের রুচি হইতে নাম সংকীর্ত্তন হয়, ইহাকেই নিত্যনন্দ বলে। সেই নাম আর রুপ, ভাব ভক্তি একই জিনিষ। যেখানে নাম প্রতিষ্ঠা করা হয় সেখানেই বৃন্দাবন, নিভৃত স্থান। সেই স্থান ছাড়া কোথাও ঐশ্বর্য্যাদি বৈভব আকর্ষণ করিতে পারে না। ঐ নামই গুরু, ভাই ভগিনী, পিতা মাতা, আত্মীয়, বন্ধু বান্ধবাদি সকল। নাম বৈ জগতে কোন প্রকৃতিই স্থির থাকে না। নামই থাকিয়া যায়। গুরুর সঙ্গে সম্বন্ধ প্রেমানন্দ;শিষ্য আর গুরু প্রেমরতি, ভাবরতি, মুগ্ধারতি একবশে মগ্ন হইয়া যায়।  প্রাণাদি যত তত্ত্ব উদ্ভব হয় সকলি ভগবানের বিভুতি মাত্র। যুগল ভজন করিতে করিতে ভবঋণ শোধ হয় অর্থাৎ নামের সঙ্গে প্রেম করিতে করিতে ভাব হয়, এই ভাবেই সকল বিভাব হরণ করিয়া পরমানন্দ ধামে আকর্ষণ করিয়া লয়। এতদ্ভিন্ন অন্যান্য সাধন ভজন কোনরুপ উপাদানে তাঁহার গোচরে যাইতে পারে না। বাসনাজালে কর্ত্তা হইয়া পতিপরা হারাইয়া অগাধ মায়াজালে আবদ্ধ হয়। এই মায়া হইতেই নানান প্রলোভনে পড়িয়া নানাবিধ জল্পনা কল্পনায় দেবাসুরের তরঙ্গে পড়িয়া হাবীডুবী খায়। নামের উদয় থাকে না। অতএব সুখের জন্য দুঃখ  সর্ব্বদাই প্রহরী জানিবে। কেবল নাম করিয়া যাইবে।


(১৯০) সংসার অবিদ্যা অর্থাৎ অজ্ঞান দ্বারা জীবের কালচক্রের গতি হইতেছে। সেই গতির যে অংশে যে ভাব মিলন হয় তাহাই ভোগ হয়। এই ভোগ দান (ত্যাগ) করা জীবের কর্ম্ম। তুলসীপত্রের দ্বারা ভোগদান করিতে হয় অর্থাৎ সহ্য করিয়া থাকিবার চেষ্টা করা। যখন ভোগ দান শেষ হইয়া যায় তখনই স্বরুপ আনন্দ (স্বভাব) প্রাপ্ত হয়। কর্ত্তা হইয়াই অস্থায়ী চক্রে পড়িতে হয়; ইহা সকল শাস্ত্রের মধ্যেই উল্লেখ করিয়াছে।