দ্বিতীয় অধ্যায় (২)

সেই যাত্রায় আমার দর্জ্জিপাড়ার বাসায় ঠাকুর প্রায় তিন সপ্তাহ কাটাইয়াছিলেন। তাঁহার নির্দেশ মতে বরদাবাবু ঠাকুরের কলিকাতা আসার সংবাদ কাহাকেও না বলার ফলে অত্যন্ত একান্তেই তাঁহাকে পাইলাম।  প্রায় সকল সময়েই ঠাকুরের নিকট বসিয়া থাকিতাম। যেদিন কলেজ থাকিত কোনও প্রকারে সেখানকার কাজ সারিয়া, এক মিনিটও অযথা বিলম্ব না করিয়া বাড়ী ফিরিয়া আসিতাম।  আর যেদিন কলেজ থাকিত না, সেদিন তো কথাই নাই, শুধু খাওয়ার সময় এবং রাত্রিতে ৩/৪ ঘন্টা ছাড়া বাকী সময় ঠাকুরের সঙ্গেই কাটাইতাম।  কি আনন্দে যে দিনগুলি কাটাইয়াছিলাম,  তাহা বলিয়া বুঝাইতে পারিব না।

যেদিন আমি ” নাম “পাইলাম মনে হয় যে তাহার পরের দিন বৈকালে পর পর তিনজন ভদ্রলোক ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন। প্রথমে আসিলেন কবিরাজ ঁজানকীনাথ দাশগুপ্ত। ইনি প্রায় আধঘণ্টা কাল ঠাকুরের সহিত কথাবার্ত্তা বলিলেন,  ফিরিয়া যাইবার সময় আমাকে বলিয়া গেলেন যে, কথাবার্ত্তায় মনে হইল যে ইনি বৈষ্ণব,  আবার কখন মনে হইল যে ইনি শাক্ত,  তবে গলায় যখন তুলসীর মালা রহিয়াছে তখন খুব সম্ভব ইনি বৈষ্ণবই হইবেন। কিছুক্ষণ পরেই আমার বিশিষ্ট বন্ধু শ্রীসত্যেন্দ্রচন্দ্র গুহ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ইনি তখন বোস ইন্‌স্টিটিউটে রিসার্চ স্কলার হিসাবে কাজ করিতেন এবং নিয়মিত বেলুড় মঠে যাতায়াত করিতেন। সত্যেন্দ্রবাবু সেদিন কেন আমার বাসাতে আসিয়াছিলেন ঠিক স্মরণ নাই, যতদূর মনে পড়ে ঠাকুর যে আমার এখানে রহিয়াছেন তাহা তিনি জানিতেন না। তাঁহার নামও বোধ হয় পূর্ব্বে কখন শুনেন নাই। যাহাই হউক,  আমি তাহাকে ঠাকুরের নিকটে লইয়া গেলাম। তিনি প্রণাম করিয়া উপবেশন করিলেন এবং ঠাকুরকে নানাপ্রকার জিজ্ঞাসাবাদ করিতে লাগিলেন। এই সময়টা আমাকে কার্য্যান্তরে অন্যত্র থাকিতে হইয়াছিল,  সুতরাং কি আলোচনা হইয়াছিল তাহা আমার জানা নাই, তবে এই কথাটা আমার বেশ স্পষ্টই মনে আছে যে সত্যেন্দ্রবাবু যাইবার সময় আমাকে বলিলেন যে, ইনি পাতঞ্জল সম্প্রদায়ের লোক।  সত্যেন্দ্রবাবুর পরে আসিলেন আমার সহকর্ম্মী ও বন্ধু ঁনারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। আমিই তাহাকে কথাপ্রসঙ্গে ঠাকুরের কথা বলিয়াছিলাম। নারায়ণবাবু তুলিলেন সেই দ্বৈতবাদ অদ্বৈতবাদের চিরন্তন প্রশ্ন। প্রায় একঘন্টা সেই আলোচনা চলিয়াছিল। আমি সেইখানে আগাগোড়াই উপস্থিত ছিলাম এবং কিছুক্ষণ পরেই আমার মনে হইতেছিল যে, আলোচনাটা যেন ঠিক রাস্তায় চলিতেছে না, এক কথাই যেন দুইজনে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করিতেছেন। কিছুক্ষণ পরে নারায়ণবাবু উঠিলেন,  আমি তাহাকে রাস্তা পর্য্যন্ত আগাইয়া দিয়া আসিলাম। নারায়ণবাবু বলিলেন : “সকল কথা বুঝিতে না পারিলেও ইনি একজন বৈদান্তিক এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ, কিন্তু কোন সম্প্রদায়ের ঠিক বোঝা গেল না। ” তখন ঠাকুরের সঙ্গে আমার সবে মাত্র পরিচয়,  সুতরাং এই সকল বিভিন্ন অভিমত আমার মনে একটা কৌতুহলের সৃষ্টি করিয়াছিল, মনে আছে। পরেও এরূপ বিভিন্ন মন্তব্য বহুবার শুনিয়াছি এবং আমার ধারণা এই যে, ঠাকুরের মধ্যে যে যাহা খুঁজিয়াছে, তাহাই পাইয়াছে। তিনি এর সবই ছিলেন,  অথচ কোনটাই ছিলেন না। 

নারায়ণবাবুর সহিত ঠাকুরের আলোচনার সময় আমি লক্ষ্য করিতেছিলাম যে, নারায়ণবাবু বলিতেছিলেন অদ্বৈত-“বাদে”র কথা,  আর ঠাকুর বলিতেছিলেন অদ্বৈত- আচরণের কথা। বস্ত্ততঃ অদ্বৈতবাদ, দ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ইত্যাদি “বাদে”র কথা ঠাকুরের মুখে বড় একটা শুনি নাই। অনন্যচিন্তা, অনন্যশরণ ইত্যাদি বুঝাইতে তিনি “অদ্বৈত” কথাটা অনেক সময়ে ব্যবহার করিতেন।  “দ্বৈত” কথাটাও তাঁহার মুখে প্রায় শুনি নাই বলিলেও চলে, তিনি বলিতেন “দ্বন্দ্বজ” বা “দ্বন্দ্বজ প্রকৃতি”। যাহাই হউক,  আমি যে-কথাটা বলিতে চাহিতেছি তাহা হইল এই যে, কে কোন্ “বাদী” ইহাই বড় কথা নহে, কে কি ভাবে আছেন, অথবা কাহার কি আচরণ,  ইহাই মূখ্য কথা। একটু চিন্তা করিলেই বুঝিতে পারা যায় যে, অদ্বৈতবাদী হইয়াও দ্বৈতভাবাপন্ন হওয়া যাইতে পারে। একটা দৃষ্টান্ত মনে পড়িতেছে। এই সময়ের প্রায় ৫ বৎসর পরে ঢাকায় ঁবীরেন্দ্রকুমার মজুমদার মহাশয়ের বাসাবাড়ী লেনের বাড়ীতে এক ভদ্রলোক ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন,  আমিও তখন সেখানে উপস্থিত ছিলাম। ভদ্রলোক একজন ঘোরতর অদ্বৈতবাদী,  কথাবার্ত্তায় পরিষ্কার বুঝাইয়া দিলেন যে, তাহাদের মতই প্রকৃষ্ট মত এবং অন্য মতাবলম্বীরা নিতান্তই কৃপার পাত্র। ঠাকুর ও আমরা সকলে কিছু না বলায় ভদ্রলোকের উৎসাহ যেন আরও বাড়িয়া গেল এবং তিনি একের পর এক, নানা কথার অবতারণা করিতে লাগিলেন। ঠাকুরও এমন ভাব দেখাইতে লাগিলেন যে, ভদ্রলোকের কথাগুলি যেন অত্যন্ত সারগর্ভ,  তিনি যেন কথাগুলি শুনিয়া একেবারে মুগ্ধ হইয়া গিয়াছেন। আমার কিন্তু অত্যন্ত অসহ্য বোধ হইতেছিল,  ভাবিতেছি যে একবার বাহিরে গিয়া তামাক খাইয়া আসিব কিনা, ঠিক সেই সময়েই ভদ্রলোক এক গল্প ফাঁদিয়া বসিলেন। কবে কোথায় কোন্ প্রকৃত অদ্বৈতবাদী দেখিয়াছেন তাহার এক ফিরিস্তি দিয়া অবশেষে বলিলেন যে, একবার কাশীতে তিনি এক অত্যাশ্চর্য্য অদ্বৈতবাদীর সন্ধান পাইয়াছিলেন। একদিন নারদ ঘাটে গঙ্গাস্নানে যাইয়া তিনি দেখিলেন যে,  একজন ভদ্রলোক সপরিবারে অন্নপূর্ণা বিশ্বনাথ দর্শনে গিয়াছিলেন,  ফিরিবার পথে, ঘাটে সাধুবাবাকে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া নিকটে আসিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিলেন,  তাহার স্ত্রী ও পুত্রকন্যারাও তাহার অনুকরণ করিল। ভদ্রলোকের হাতে একটি ঠোঙায় কিছু প্রসাদ ছিল,  তিনি তাহার খানিকটা লইয়া সাধুসেবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। ইহাতে সাধুবাবা যেন একেবারে ক্ষেপিয়া উঠিলেন। “কেয়া?প্রসাদ!দরিয়ামে ফিক্ দেও। “অদ্বৈতবাদী সেই পূর্ব্বোক্ত ভদ্রলোক মন্তব্য করিলেন: ” দেখিলেন তো দেবদেবীর ধার ধারেন না, প্রসাদ গ্রাহ্য করেন না, কিরূপ ব্রহ্মনিষ্ঠ, কিরূপ অব্যভিচারী অদ্বৈতবাদী সাধু!” কথা কয়টি বলিয়া তিনি এমনভাবে চারিদিকে তাকাইতে লাগিলেন যেন একেবারে কিস্তিমাত করিয়াছেন। ঠাকুর সন্মুখে রহিয়াছেন বলিয়াই এতক্ষণ অতি কষ্টে ধৈর্য্যধারণ করিয়াছিলাম,  কিন্তু আর সহ্য করিতে পারিলাম না। ভদ্রলোককে বলিলাম: “দেখুন, একটা কথা বলি, কিছু মনে করিবেন না। আপনার সাধুবাবা প্রসাদ গ্রাহ্য করিলেন,  কি করিলেন না, সে বিষয়ে আমার বলিবার কিছুই নাই। কিন্তু প্রসাদ ও অ-প্রসাদে তাহার এতটা ভেদবুদ্ধি কেন বলুন তো, এটা কি ব্রহ্মনিষ্ঠের লক্ষণ?”ভদ্রলোক সহসা আমার কথার কোনও জবাব দিতে পারিলেন না এবং যেন কতকটা অসহায় ভাবে ঠাকুরের দিকে তাকাইতে লাগিলেন। ঠাকুর “ধরি মাছ না ছুই পানি” গোছ কিছু বলিয়া ভদ্রলোকের মুখ রক্ষা করিলেন এবং আমার দিকে এমন ভাবে তাকাইলেন যে, ” আমিই ঠিক বলিয়াছি” ইহা বুঝিতে আমার কোন কষ্টই হাইল না। ভদ্রলোকটিও কয়েক মিনিট পরেই ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া চলিয়া গেলেন। এই জন্যেই বলিতেছিলাম যে, কাহার কি মতবাদ সেটাই মূখ্য কথা নয়, আচরণই হইল মূখ্য কথা।

সে যাহাই হউক, আমার মনে হয় যে প্রভাতবাবুকে সংবাদ দিতে ৩/৪ দিন বিলম্ব হইয়াছিল, কারণটা ঠিক স্মরণ হইতেছে না। যেদিন সংবাদ পাইলেন,  সেইদিনই বৈকালে কলেজের পর প্রভাতবাবু হন্তদন্ত হইয়া ঠাকুর দর্শনে আসিলেন। তেতলার যে ঘরখানিতে ঠাকুর থাকিতেন তারই গায়ে ছোট একটু খোলা ছাদ ছিল,  ঠাকুর তখন সেই ছাদে একখানা চেয়ারে বসিয়াছিলেন,  আমি ও বরদাবাবু নিকটেই ছিলাম। প্রভাতবাবু আসিয়াই গায়ের জামা খুলিয়া ফেলিলেন এবং তাহাকে আরও পূর্ব্বে কেন সংবাদ দেওয়া হয় নাই, সেজন্য আমাকে ও বরদাবাবুকে খুব একচোট গালাগালি করিলেন। পরে ঠাকুরের সঙ্গে সামান্য দুই একটি কথা বলিয়াই হঠাৎ তাঁহার সন্মুখে হাঁটু গাড়িয়া বসিলেন এবং তাঁহার শ্রীচরণ দুইখানি দুই হাতে বুকের উপর চাপিয়া ধরিয়া অপলক দৃষ্টিতে ঠাকুরের দিকে চাহিয়া গীতার একাদশ অধ্যায় আগাগোড়া আবৃত্তি করিয়া গেলেন। ঠাকুর স্থির,  নিষ্পলক,  নিষ্পন্দ, মনে হইল তিনি যেন এই জগতে নাই। ঠাকুরের তখনকার সেই মূর্ত্তি আমি বর্ণনা করিয়া বুঝাইতে পারিব না,  পরে কখন কখন মনে হইয়াছে যে, তিনি যেন গীতার একাদশ অধ্যায়ে বর্ণিত ভগবানের সেই ভয়াবহ বিশ্বরূপ নিজ মাধুর্য্যে আবরণ করিয়া স্থির হইয়া বসিয়াছিলেন।

আবৃত্তি শেষ হইয়া গেলে প্রভাতবাবু ঠাকুরের চরণযুগল ছাড়িয়া দিয়া স্থির হইয়া বসিলেন এবং গলদশ্রুলোচনে অনেক কাকুতি-মিনতি করিয়া ঠাকুরকে একবার তাহার বাড়ীতে পদধূলি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করিলেন। ঠাকুর বলিলেন যে, এ যাত্রায় যাওয়া সম্ভব হইবে না কিন্তু ভবিষ্যতে যাইবেন এরূপ প্রতিশ্রুতি দিলেন। ইহার কিছুক্ষণ পরে ঠাকুর একাকীই বাহির হইয়া গেলেন,  প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বরদাবাবুও চলিয়া গেলেন। তখন প্রভাতবাবুকে নিরিবিলি পাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম যে, হঠাৎ ঠাকুরের প্রতি তাহার এই অনুরাগ কি করিয়া হইল। প্রথম দর্শনের পর আমাদের মধ্যে যে আলাপ আলোচনা হইয়াছিল তাহাতে তো এতটা কিছুই বুঝিতে পারি নাই। প্রভাতবাবু বলিলেন যে, ইতিমধ্যে এমন কিছু ঘটিয়াছে যাহাতে তিনি স্পষ্টই বুঝিতে পারিয়াছেন যে, ঠাকুর ভিন্ন তাহার অন্য গতি নাই। কথাটা তিনি আমাকে খুলিয়া বলিয়াছিলেন কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অনুরোধ করিয়াছিলেন যে, আমি যেন কখনও প্রকাশ না করি। সুতরাং এ বিষয়ে আর বেশী কিছু বলিতে পারিলাম না। প্রভাতবাবু ঠাকুরের ফিরিয়া আসার প্রতীক্ষায় আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিলেন এবং তৈল ও লঙ্কা সহযোগে ছোট এক ধামা মুড়ি ( ইহা তাহার অত্যন্ত প্রিয় খাদ্য ছিল) , কয়েকটি সন্দেশ, দুই পেয়ালা চা,  ৪/৫ ছিলিম তামাক ও প্রায় এক প্যাকেট সিগারেট ধ্বংস করিয়া বাড়ী ফিরিয়া গেলেন। ইহার কিছুদিন পরে তাহার মলঙ্গা লেনের বাসায় প্রভাতবাবু সস্ত্রীক ঠাকুরের আশ্রয় পাইয়াছিলেন।

সেদিন ঠাকুর রাত্রি প্রায় দশটার সময় ফিরিয়া আসিলেন। দেখিলাম যে, তাঁহার সেই অতি সাধারণ উড়ানিখানার পরিবর্ত্তে তিনি একখানি উৎকৃষ্ট মটকার চাদর গায়ে দিয়া ফিরিয়াছেন। চাদরখানি খুলিয়া ঝাড়িয়া, পুঁছিয়া, অতি নিখুঁতভাবে ভাঁজ করিয়া আলনায় তুলিয়া রাখিলেন। ইহার পর তিন দিন ধরিয়া চলিল এই চাদরের সেবা। দিনের মধ্যে অন্ততঃ ৫/৭ বার চাদরখানা খুলিতেন, আবার পরিপাটি রূপে ভাঁজ করিয়া আলনায় তুলিয়া রাখিতেন। যত্নের আর সীমা নাই। আমার মনে হইত যে, শিশুরা খেলনা হাতে পাইলে যেমন প্রথম প্রথম তাহা লইয়া মত্ত থাকে,  অথবা শিক্ষার্থী বালক যেমন প্রমোশনের পর নূতন বই পাইলে কয়েক দিন কিছুতেই আর সেগুলি ছাড়িতে চাহে না, এও যেন ঠিক সেই রকমই। এ যে কি মধুর ভাব তাহা বলিয়া বুঝান যাইবে না,  পাঠক-পাঠিকারা নিজেরাই কল্পনা করিয়া লইবেন। এই কয় দিন ঠাকুর কিছুক্ষণের জন্য সন্ধ্যার পর একাকী বাহির হইয়া যাইতেন,  তৃতীয় দিন দেখিলাম যে তিনি কাপড়ের খুঁট গায়ে জড়াইয়া ফিরিয়া আসিয়াছেন,  সেই মটকার চাদরখানি নাই। জিজ্ঞাসা করিতে বলিলেন : “যার চাদর তার কাছেই গেছে। ” আরও খুঁটিয়া প্রশ্ন করিয়া জানিলাম রে, জনৈক ভক্ত চাদরখানি ঠাকুরকে দিয়াছিলেন এবং তিনি আজ ঐটি অন্য একজনকে দিয়া আসিয়াছেন। চাদরখানি যেন এই দ্বিতীয় ব্যক্তিরই প্রাপ্য এবং ঠাকুরের কাছে জিনিসটি এই তিন দিন শুধু গচ্ছিত ছিল মাত্র। আমার মনে হইল যে, সেই জন্যই বুঝি চাদরখানির এত যত্ন এই তিন দিন ধরিয়া ঠাকুর করিয়াছেন। নিজের জিনিষ অপেক্ষা পরের গচ্ছিত জিনিষের দায়িত্ব যে অনেক বেশী। 

ইহার পরের দিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে বাহির হইয়া যাইবার সময় ঠাকুর আমাকে সঙ্গে লইয়া গেলেন। দুই চারিটি গলি ঘুরিয়া আমরা এক কালীবাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। ঠাকুর আমাকে সেখানে অপেক্ষা করিতে বলিয়া আবার একাকী বাহির হইয়া গেলেন। একজন সাধু গোছের ভদ্রলোক হারমোনিয়াম বাজাইয়া শ্যামা সঙ্গীত গাহিতেছিলেন। তিনি একটি একটি করিয়া ৪টি গান গাহিলেন, পরে আরতি আরম্ভ হইল। আরতির শেষে দুইখানা লুচি ও কয়েকটি ক্ষীরের নাড়ু প্রসাদ পাইয়াছিলাম মনে আছে। কিন্তু আমি এ সকল কিছুই ভালো করিয়া উপভোগ করিতে পারিতেছিলাম না, কারণ আমার মন ঠাকুরের দিকেই পড়িয়াছিল। আরও কিছুক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করিবার পর তিনি ফিরিয়া আসিলেন এবং আমাকে লইয়া বাহির হইয়া গেলেন। এই কালীবাড়ি পরে আমি অনেক অনুসন্ধান করিয়াও বাহির করিতে পারি নাই। ঠাকুর আমাকে গলিঘুঁজির মধ্য দিয়া তথায় লইয়া গিয়াছিলেন এবং সেন্ট্রাল এভেনিউ রাস্তা বাহির হওয়ার দরুণ ঐ অঞ্চলে ভাঙ্গাচুরাও অনেক হইয়াছে,  বোধ হয় সেই জন্যই আমার চেষ্টা সফল হয় নাই। আমার মনে হয় যে, সেন্ট্রাল এভেনিউ ও গ্রে স্ট্রিটের মোড়ের কিঞ্চিৎ উত্তরে রাস্তার উপর যে কালীবাড়ীটি বর্ত্তমানে আছে, ইহাই সেই কালীবাড়ী।

যাহাই হউক,  ঠাকুর আমাকে সেখান হইতে হেদুয়ায় লইয়া আসিলেন, তখন রাত্রি প্রায় ৯-৩০টা।  বৈকালিক বায়ুসেবনকারীরা তখন প্রায় সকলেই চলিয়া গিয়াছেন,  পার্কটি অনেকটা নির্জ্জন। এখানে সেখানে বেঞ্চের উপর কেউ কেউ একক বা সঙ্গী সমভিব্যাহারে বসিয়া রহিয়াছেন দেখিলাম কিন্তু পথচারী একপ্রকার ছিল না বলিলেই চলে। ঠাকুর আমাকে লইয়া একখানি খালি বেঞ্চে বসিলেন। সামান্য দু’একটি কথাবার্ত্তার পর ঠাকুর আকাশের দিকে তাকাইয়া রহিলেন,  আমিও তাহাই করিলাম। কতক্ষণ এভাবে কাটিয়াছিল জানি না, হঠাৎ এক সময় ঠাকুরের দিকে তাকাইয়া দেখি যে, তাঁহার মুখশ্রী একেবারেই বদলাইয়া গিয়াছে। দেখিলাম যেন একটি ১৫/১৬ বৎসরের কিশোর আমার পাশে বসিয়া রহিয়াছেন। কি অপূর্ব্ব সেই মূর্ত্তি,  ভাষার সাধ্য নাই যে তাহাকে চিত্রিত করিতে পারে। সেই আকর্ণ-বিস্তৃত চক্ষুযুগল, সেই স্থির প্রশান্ত দৃষ্টি,  মুখশ্রীর সেই অপার্থিব মধুরিমা, বহু সুকৃতি বলেই সেদিন আমার দৃষ্টিগোচর হইয়াছিল। দেখিতে দেখিতে সেই মূর্ত্তি মিলাইয়া গেল এবং ঠাকুরের মুখাবয়ব আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়া আসিল। মনে মনে তর্কবিতর্কের পর কথাটা এখানে প্রকাশ করিয়া ফেলিলাম। স্থির করিয়াছিলাম যে, ঘটনাটা গোপন করিয়াই যাইব। কিন্তু একটু চিন্তা করিতেই মনে হইল যে তাহা হইলে একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কথাই কতকটা অপ্রকাশ থাকিয়া যাইবে। ঠাকুরের সংস্পর্শে আসিয়া আমি প্রতিনিয়তই উপলব্ধি করিয়াছি তাঁহার এক দুর্নিবার আকর্ষণ। আমি তাঁহাকে চাহি নাই, বিষয়কর্ম্ম, বাজে আমোদ-প্রমোদ,  বন্ধু-বান্ধব,  ধনজনবৈভবাদি লইয়াই মাতিয়া থাকিতে চাহিয়াছি, কিন্তু অহৈতুকী কৃপাসিন্ধু তিনি,  জোর করিয়াই আমার হৃদয়ে একটু স্থান করিয়া লইয়াছেন। ঠাকুরের সংস্পর্শে আসিবার পর এরূপ ছোট ছোট ঘটনা আমার জীবনে আরও কয়েকবার ঘটিয়াছে এবং নিঃসন্দেহে বুঝিতে পারিয়াছি যে, এগুলি তাঁহারই অনুগ্রহ। তাঁহার প্রতি আমার আকর্ষণ অটুট রাখিতে ইহারা যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছে।