– সম্পাদকীয়

“বেদবাণী”র দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হইল। আমার ভরসা ছিল যে, প্রথম খণ্ড বাহির হইবার ছয় মাসের মধ্যেই দ্বিতীয় খণ্ড ছাপাইয়া বাহির করিতে পারিব। কিন্তু নানাবিধ কৰ্ম্মব্যস্ততা ও শারীরিক অসুস্থতার জন্য কিঞ্চিৎ বিলম্ব হইয়া গেল। এই বিলম্বের জন্য আমাকে অনেকের সস্নেহ তাগাদা সহ্য করিতে হইয়াছে সত্য, কিন্তু তাঁহাদের এই ঐকান্তিক আগ্রহ আমাকে এই কার্য্যে যথেষ্ট উৎসাহ প্রদান করিয়াছে এবং এইজন্য আমি তাঁহাদের নিকট কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিতেছি।

“বেদবাণী”র প্রথম খণ্ড বাহির হইবার পর যে সকল মতামত আমার গোচরে আসিয়াছে, সে সম্বন্ধে এখানে কিছু বলিয়া রাখা প্রয়োজন মনে হইতেছে। প্রথমতঃ আমি যাহা আশঙ্কা করিয়াছিলাম তাহাই হইয়াছে। আমার লিখিত ঠাকুরের পরিচিতি পড়িয়া কেহই সন্তুষ্ট হইতে পারেন নাই এবং আমার কৈফিয়ৎ মোটেই আমলে আনিতে চাহেন নাই। কেহ কেহ আমার বাড়ী আসিয়া আমার সহিত আপোষে ঝগড়াও করিয়া গিয়াছেন। সুতরাং অনেক ইতস্ততের পর এই খণ্ডে ঠাকুরের জীবন কথা আরও একটু বিস্তৃতভাবে আলোচিত হইল। কবিবর ँনবীনচন্দ্র সেনের “আমার জীবন” গ্রন্থ বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য; সেই গ্রন্থে ঠাকুর সম্বন্ধে যে বিবরণটি আছে তাহা উদ্ধৃত করিয়া দিলাম এবং আমার নিজ অভিজ্ঞতা হইতে জানা অথবা ঠাকুরের শ্রীমুখে শুনা কয়েকটি ঘটনার বিবরণ সন্নিবেশিত করিয়া পাঠকবর্গের কৌতূহল কথঞ্চিৎ নিরসনের প্রয়াস পাইলাম। বহুদিন পূর্ব্বে বন্ধুবর ँপ্রভাতচন্দ্র চক্রবর্তী মহাশয় “তাঁহার কথা” নাম দিয়া ঠাকুরের সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ ছাপাইয়াছিলেন। এই প্রবন্ধে ঠাকুরের জীবনী সম্বন্ধে বিশেষ কিছু না থাকিলেও প্রভাতবাবু ঠাকুরকে কি ভাবে দেখিয়াছিলেন তাহার একটি মনোরম চিত্র ইহাতে আছে। ঠাকুরের আশ্রিতবর্গের অবগতির জন্য সেই প্রবন্ধটিও এতৎ সঙ্গে জুড়িয়া দিলাম। কিন্তু ইহাতেও যে পাঠকবর্গ সন্তুষ্ট হইবেন না, তাহা আমি নিশ্চিতই জানি।

দ্বিতীয়তঃ শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাষার শুদ্ধি অশুদ্ধির প্রশ্ন উত্থাপন করায় কেহ কেহ আমার উপর বিরক্ত হইয়াছেন। হঠাৎ কথাটা শুনিলে যে একটা বিরক্তি আসা স্বাভাবিক, একথা আমি অস্বীকার করি না। কিন্তু বিষয়টা একটু নিবিষ্ট মনে চিন্তা করিয়া দেখিলে তাঁহারা বোধ হয় এমন কথা তুলিতেন না। চিঠিগুলি যতদিন আমাদের নিজেদের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল এবং আমরা স্থানে স্থানে ইহাদের বিষয়বস্তু লইয়া আলাপ আলোচনা করিতাম ততদিন কোন কথাই উঠে নাই। কিন্তু এ কথা স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, একবার ছাপা হইয়া বাহির হইয়া গেলেই চিঠিগুলি সাধারণের বিবেচনাধীনে আসিয়া গেল। কাজেই আমার সম্মুখে এক সমস্যা উপস্থিত হইল — চিঠিগুলি অবিকৃত রাখিব, না প্রয়োজনানুরূপ পরিবর্তন করিয়া দিব। মূল বস্তু যথাসম্ভব অবিকৃত রাখাই সম্পাদকের কর্তব্য এবং তাহাই সমীচীন মনে হওয়ায় আমাকে একটা কৈফিয়ৎ লিখিয়া দিতে হইল। পত্রগুলি শ্রীশ্রীঠাকুরের আশ্রিত বর্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকিলে ইহার কোন প্রয়োজন হইত না।

তৃতীয় প্রশ্ন উঠিয়াছে এই পত্রাংশগুলির সারবত্তা লইয়া। অবশ্য ঠাকুরের আশ্রিতবর্গের এই প্রশ্নের সহিত কোন সম্পর্ক নাই, থাকিতেও পারে না। এ কথা বলাই বাহুল্য যে, আমাদের পক্ষে এই পত্রগুলি এক পরম সান্ত্বনা ও আশ্রয়ের স্থল হইয়া দাঁড়াইয়াছে। কেহ কেহ এমন কথাও বলিয়াছেন যে, এই পত্রগুলি পড়িতে পড়িতে মনে হইয়াছে যে, ইহাদের ভিতর দিয়া ঠাকুর নিজেই যেন মূর্ত হইয়া উঠিয়াছেন। কিন্তু যাঁহারা ঠাকুরকে কখনও দেখেন নাই, অথবা তাঁহার সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানেন না, তাঁহাদের মধ্যেও অনেকে এই পত্রগুলি পড়িয়াছেন এবং তাঁহাদের মতামত সম্পর্কেই কথাটা উঠিয়াছে। ইহাদের মধ্যে এক শ্রেণী এই পত্রগুলি পাইয়া অত্যন্ত আনন্দিত হইয়াছেন এবং যাঁহারা বৃদ্ধ তাঁহাদের কেহ কেহ আরও ২০/২৫ বৎসর পূর্ব্বে এই পত্রগুলি পান নাই বলিয়া আক্ষেপ করিয়াছেন। একজন অতি সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক দুঃখ করিয়া বলিয়াছেন যে, এমন একজন মহাপুরুষ চোখের সম্মুখ দিয়া চলিয়া গেলেন অথচ তিনি তাঁহার কোন সন্ধানই পাইলেন না। কিন্তু এই প্রসঙ্গে এক ধর্মপ্রাণ, অশীতিপর বৃদ্ধের কথাই আমার বিশেষভাবে মনে হইতেছে। সুদূর এক পল্লীগ্রাম হইতে তিনি আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন এবং “বেদবাণী”র সম্পাদনার জন্য আমাকে আন্তরিক আশীর্ব্বাদ করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার সেই আশীর্ব্বাদ আমার জীবনের এক পরম সৌভাগ্য বলিয়া চিরদিন স্মরণ থাকিবে। আবার কেহ কেহ ইহাও বলিয়াছেন যে, ঠাকুরের ভাষায় এমন একটা স্বতন্ত্রতা আছে যে, উহার সহিত পরিচয় না থাকিলে তাঁহার বক্তব্য অনেক সময়েই বুঝিয়া উঠা কষ্টসাধ্য হয়। কথাটা অত্যন্ত সত্য এবং আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা হইতে ইহার সাক্ষ্য দিতে পারি। প্রথমে যখন ঠাকুরের সংস্পর্শে আসি তখন তাঁহার কথা মোটেই বুঝিতে পারিতাম না। ক্রমে শুনিতে শুনিতে অনেকটা সড়গড় হইয়া আসিয়াছিল কিন্তু সম্যক বুঝিতে কোনদিনই পারি নাই। প্রত্যেক মহাপুরুষেরই কথা বলিবার একটা বিশিষ্ট ভঙ্গী থাকে এবং এই ভঙ্গীটি আয়ত্ত করিতে না পারিলে তাঁহাদের বক্তব্য বুঝিয়া উঠা যায় না। শ্রদ্ধা সহকারে পুনঃ পুনঃ আলোচনাই এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায়। ঐকান্তিক আগ্রহ সহকারে বুঝিতে চেষ্টা করিলে ঠাকুরই যাহা হউক একটা ব্যবস্থা করিয়া দিবেন, ইহা নিশ্চিত।

তৃতীয়তঃ দুই চারিজন ইহাও বলিয়াছেন যে, এই পত্রগুলি না ছাপাইলেও বিশেষ কোন ক্ষতি হইত না। এই মতাবলম্বী এক ভদ্রলোক একদিন প্রাতঃকালে আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন। লোকটি আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত। আসন গ্রহণ করিয়াই তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনিই কি “বেদবাণী”র সম্পাদনা করিয়াছেন?” আমি বলিলাম, “আজ্ঞে হ্যাঁ।” তখন তিনি আমাকে বলিলেন যে, আমার রচিত আরও দুই একখানা বই তিনি পড়িয়াছেন এবং আমাকে একজন দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন লেখক বলিয়াই ধারণা করিয়াছিলেন কিন্তু সে ধারণা তিনি বদলাইতে বাধ্য হইয়াছেন। আমি কিছুই বলিলাম না, নীরবে তাঁহার দিকে তাকাইয়া রহিলাম। আমাকে মৌন দেখিয়া ভদ্রলোক পুনরায় বলিলেন যে, নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটি অপ্রিয় কথা তাঁহাকে বলিতে হইতেছে; তিনি “বেদবাণী” বইখানা ৩/৪ বার পড়িয়াছেন কিন্তু কিছুই পান নাই। আমি আর মৌন থাকিতে পারিলাম না, ভদ্রলোককে বলিলাম যে, তিনি কি চাহিয়াছিলেন তাহা জানিতে পারিলে, কেন কিছুই পান নাই, এ কথার একটা জবাব দিতে চেষ্টা করিতে পারি। আমার কথায় ভদ্রলোক যেন একটু অসুবিধায় পড়িলেন মনে হইল। কি চাই, এ কথার সরাসরি জবাব দেওয়া মোটেই সহজ নহে; ভদ্রলোক প্রথমটা একটু আমতা আমতা করিয়া শেষে অনেক কথাই বলিলেন। সবটা আমার স্মরণ নাই কিন্তু তাঁহার বক্তব্যের সার দাঁড়াইল এই যে, যে কোন বাণী, বা বাদ, বা শিক্ষা, বা প্রকল্প সমাজ-চেতনার দ্বারা উদ্বুদ্ধ নহে এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর সহিত যাহার সামঞ্জস্য নাই, তাহাকে কোন মূল্য দিতে তিনি প্রস্তুত নহেন। এই কথার পর আমি ঐ ভদ্রলোকের সহিত একটা বিতর্ক বাধাইবার প্রলোভন ত্যাগ করিতে পারিলাম না। আমি সরাসরি উল্টা রাস্তা ধরিলাম। ভদ্রলোককে বলিলাম যে, সমাজ-চেতনা ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিসম্পন্ন বুদ্ধিই সত্যোপলব্ধির প্রধান অন্তরায়। বুদ্ধি পারে শুধু কতকগুলি “মতবাদ” সৃষ্টি করিতে, প্রকৃত সত্যে পৌঁছাইবার শক্তি তাহার নাই। একটা সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রেই তাহার গতাগতি; দেশ, কাল, কার্য্যকারণ, ইত্যাদি অনেক কিছুই তাহাকে একটা শক্ত নিগড়ে বাঁধিয়া রাখিয়াছে, এই সীমা অতিক্রম করিবার শক্তি তাহার নাই। সত্যকে পাইতে হইলে মন, বুদ্ধি ইত্যাদিকে পিছনে ফেলিয়া যাইতে হইবে। অতীন্দ্রিয় প্রত্যক্ষই প্রকৃত প্রত্যক্ষ, মন বুদ্ধির কোন ক্রিয়া সেখানে নাই। তুমুল তর্ক বাধিয়া গেল। তর্ক বলা বোধ হয় সঙ্গত হইল না, বিতণ্ডা বলাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। যেখানে উভয়েই সত্যান্বেষী, যুক্তি ও প্রতিযুক্তির সাহায্যে সমাহিত চিত্তে, ধীরে ধীরে সমস্যার সমাধানে অগ্রসর হয়, প্রকৃত তথ্যনিরূপণই যেখানে একমাত্র উদ্দেশ্য, হার জিতের কোন প্রশ্নই নাই, সেইখানেই তর্ক শব্দটি প্রযোজ্য। কিন্তু যেখানে যেন-তেন প্রকারেণ আত্মমত প্রতিষ্ঠাই একমাত্র উদ্দেশ্য, প্রতিপক্ষকে নিরস্ত ও অপ্রস্তুত করার মধ্যেই যেখানে বেশী আনন্দ, তাহা প্রকৃত প্রস্তাবে তর্ক নহে, তাহা বিতণ্ডা। আমরা এই বিতণ্ডাই করিতেছিলাম।

কিছুক্ষণ পরে ভদ্রলোক যেন পরিশ্রান্ত হইয়াই থামিলেন। আমি তাঁহাকে এক পেয়ালা চা আনাইয়া দিলাম, সিগারেট দিলাম এবং তিনি একটু সুস্থ হইলে তাঁহাকে বলিলাম, “দেখুন, আমগাছে উঠিয়া নারিকেল না পাওয়া গেলে দোষটা গাছের নহে যিনি ভুল গাছে উঠিয়াছেন, অপরাধ তাঁহারই। এই চিঠিগুলির মধ্যে যাহা আছে তাহা আপনি খোঁজেন নাই, অথবা তাহাতে আপনার কোন প্রয়োজন নাই; যাহা নাই তাহাই খুঁজিয়াছেন এবং তাহা পান নাই বলিয়া ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিয়াছেন। স্থির মনে একটু চিন্তা করিলেই বুঝিবেন যে, ত্রুটি এই চিঠিগুলির নহে ত্রুটি আপনার নিজের”। এবার কিন্তু ভদ্রলোক আর ক্ষেপিয়া উঠিলেন না, বরং শান্তভাবেই বলিলেন, “আচ্ছা, আমার কথা না হয় আপাততঃ স্থগিতই থাকুক, আপনি যাহা বুঝিয়াছেন তাহাই বলুন।” একটুকাল নীরব থাকিয়া আমি তাঁহাকে বলিলাম যে, একথা স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, এই চিঠিগুলি প্রধানতঃ ব্যষ্টিগত সমস্যা লইয়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে লিখিত হইয়াছে। ব্যষ্টিই এখানে মূল প্রশ্ন, সমষ্টি গৌণ, সুতরাং ইহাদের মধ্যে সমাজচেতনার অনুসন্ধান পণ্ডশ্রম মাত্র। দ্বিতীয়তঃ এই পত্রগুলি প্রকৃত জিজ্ঞাসুর জন্য লিখিত। বুদ্ধিবিলাসীর খেয়ালী কৌতুহলের (Intellectual Curiosity) কথা বলিতেছি না, আত্তাবস্থা হইতে যে জিজ্ঞাসার উৎপত্তি তাহাই আমার লক্ষ্য। একখানি পত্রে ঠাকুর লিখিয়াছিলেনঃ “সংসার তরঙ্গে জীবের বাসনাদি দ্বারা বিবৃত থাকায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়চেতা হইয়া পড়িলে কর্তৃত্বাভিমানী হইয়া নানান অশান্তিজালে আবৃত হইয়া পড়িলে তাহা হইতে নিষ্কৃতি হইতে চেষ্টা আপনা হইতেই আসে, এবং সেই চেষ্টার জন্য সততঃ কীভাবে কি করিলে কি অবস্থায় কি আশ্রয় নিলে কিসে ত্রাণ হয়, ইত্যাকার নানান জল্পনা কল্পনায় চিত্তকে বিকল করিয়া ছট্‌ফটানি উপস্থিত হয়। সেই অবস্থার নাম আর্ত্ত … জিজ্ঞাসু বলে।” (বেদবাণী, প্রথম খণ্ড, ৩২৬ নং)। যিনি এরূপ অবস্থা কখনও অনুভব করেন নাই, এমন কি আভাসেও যিনি ইহার ইঙ্গিত পান নাই, তিনি এই পত্রগুলির ভিতরে বিশেষ কিছুই পাইবেন না এবং তাঁহার পক্ষে এই পুস্তক সংগ্রহ না করাই শ্রেয়। ভদ্রলোক নীরবেই শুনিয়া গেলেন, বিশেষ কোন উচ্চবাচ্য করিলেন না, কিন্তু পরিশেষে এক গুরুতর প্রশ্নের উত্থাপন করিয়া বসিলেন। তিনি জানিতে চাহিলেন যে, আধ্যাত্মবাদের মূলে বাস্তবিক কোন যুক্তি আছে কি না। প্রায় চার ঘণ্টা ধরিয়া বাদানুবাদ চলিল কিন্তু ঠাকুরের কথা বলিতে বসিয়া সেই নীরস কচকচির অবতারণা করিতে ইচ্ছা হইতেছে না। সম্ভব হইলে স্থানান্তরে কথাটার আলোচনা করিব।

ঠাকুরের আশ্রিতবর্গকে উপলক্ষ্য করিয়া এইখানে একটা কথা বলিতে ইচ্ছা হইতেছে। ইহা অত্যন্ত সত্য যে ঠাকুরের কথার তাৎপর্য্য বুঝিয়া উঠা নিতান্ত সহজসাধ্য নহে এবং যখন ভাবি যে বুঝিয়াছি তখনও যেন একটু রহস্য থাকিয়াই যায়। কিন্তু আমার মনে হয় যে, ইহাতে দুঃখ করিবার বিশেষ কোনও কারণ নাই। একবার আমি তিন মাসকাল একাধিক্রমে ভাগবত পাঠ শুনিয়াছিলাম, পাঠের বিষয় ছিল রাসলীলা। পাঠ শুনিতে শুনিতে কয়েকটি প্রশ্ন আমার মনে দানা বাঁধিয়া উঠিল, অনেক চেষ্টা করিয়াও তাহাদের সমাধান করিতে পারিলাম না। ইহাকে উহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া, বন্ধুবান্ধবদের সহিত আলোচনা করিয়া টীকা-টিপ্পনীর সাহায্য লইয়া অনেক চেষ্টা করিলাম কিন্তু কার্য্যতঃ কিছুই হইল না। প্রশ্নগুলি যেন আমাকে পাইয়া বসিয়াছিল, সুতরাং কেমন একটা অস্বস্তিতে দিন কাটাইতে লাগিলাম। এমন সময় হঠাৎ একদিন প্রাতঃকালে ঠাকুর আমার বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আমি অত্যন্ত উৎফুল্ল হইয়া উঠিলাম, ঠাকুর আসিয়াছেন আর ভাবনা নাই, এবারে আমার প্রশ্ন কয়টির অনায়াসেই মীমাংসা হইয়া যাইবে। ঠাকুর আসিবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অনেকেই আসিয়া জুটিলেন এবং শীঘ্রই আমার বৈঠকখানা ঘরে আলোচনা জমিয়া উঠিল। উপস্থিত এক ভদ্রলোকের প্রশ্নের উত্তর প্রসঙ্গে ঠাকুর বলিলেনঃ “বুঝতে চাইলে বুঝতে পারে না, বুঝতে না চাইলে বুঝাইয়া দেয়” এবং এই কথা কয়টি বলিবার সময় এমনভাবে আমার দিকে তাকাইলেন যে, আমার বুঝিতে মোটেই কষ্ট হইল না যে, ইহা তিনি আমাকেই বলিলেন। মনটা অনেকটা ঠাণ্ডা হইয়া গেল এবং ঐ প্রশ্নগুলির হাত হইতেও যেন অব্যাহতি পাইলাম। ইহার প্রায় একমাস পরে দুপুর বেলা শুইয়া আছি, অর্দ্ধ-জাগ্রত, অর্দ্ধ-নিদ্রিত অবস্থা, হঠাৎ এক অত্যাশ্চর্য্য উপায়ে আমার প্রশ্ন কয়টির সমাধান হইয়া গেল। কথাটা পরিস্ফুট করা সম্ভব হইবে না, সুতরাং সে চেষ্টা থেকে বিরত হইলাম। আমার জীবনে এরূপ ব্যাপার কয়েকবার ঘটিয়াছে এবং এই জন্যই বলিয়াছিলাম যে, ঠাকুরের উপর নির্ভর করিয়া থাকিলে তিনি নিশ্চিতই যাহা হউক একটা ব্যবস্থা করিয়া দেন। আর বুঝা লইয়াই বা এত কেন? ঠাকুর নিজেই ত লিখিয়াছেনঃ “বোঝা এবং না বোঝা দুইই এক, কারণ উভয়েই ভ্রান্ত। দুইয়ের অভাবই শান্তি।” (বেদবাণী, প্রথম খণ্ড ৮নং)। আমার মনে হয় যে, কোন কিছু বুঝিলেই তাহা পুরানো হইয়া গেল, এবং তাহার রসও নিঃশেষ হইয়া গেল। “বুঝি অথচ বুঝি না” ইহাতেই বোধ হয় বেশী আনন্দ।

পত্রাংশগুলি সম্পাদনায় প্রথম খণ্ডে যে প্রণালী অবলম্বিত হইয়াছিল, এখানেও তাহাই হইয়াছে, সুতরাং সে সম্বন্ধে নুতন কিছু বলিবার নাই। পরিশেষে বক্তব্য এই যে, কবিবর ँনবীনচন্দ্র সেনের উত্তরাধিকারিণী, তাঁহার পৌত্রীগণ, কবিবর লিখিত ঠাকুর সম্বন্ধীয় বিবরণটি এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত করিতে অনুমতি দিয়া আমাদিগকে চির কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করিয়াছেন এবং এই অনুগ্রহের জন্য ঠাকুরের আশ্রিতবর্গের পক্ষ হইতে আমি তাঁহাদিগকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিতেছি।