বেদবাণী প্রথম খণ্ড

(১) যাহা ভগবান করেন তাহার হাত ছাড়ান জীবের সাধ্য নাই।


(২) প্রারব্ধ সূত্রে যাহা যখন যার উপস্থিত করে তার তাহাই ভোগ হয়, ইহার জন্য অনুতাপ এবং প্রয়াস করিতে নাই।


(৩) সংসারের তরঙ্গে লক্ষ্য রাখিয়াই জীব বদ্ধ হয় তাহাতেই লাভ-লোকসান অনুভূতি হইয়া থাকে, ইহাতেই সুখ-দুঃখকর শান্তি অশান্তির তরঙ্গ চলিয়া থাকে। অতএব, ঐ দিকে লক্ষ্য না রাখিয়া কেবল শূন্যভাবে অর্থাৎ আকাশের দিকে চিন্তাকে ধরিবার জন্য চেষ্টা করিতে করিতে পরম শান্তির উদয় হয়। ভালমন্দ যাহা হয় সেই সকল অতিথির ন্যায় মনে ধারণা করিতে চেষ্টা করিতে হয়।


(৪) ত্যাগং, সত্যং, শৌচ, দয়া পরস্পর উদয় হইতেই হয়, অতএব সর্ব্বদা ত্যাগকে আশ্রয় করিতে চেষ্টা করিতে হয়। সেই ত্যাগকে লাভ করিতে হইলেই ঈশ্বরকে, অর্থাৎ ঐশ্বর্য্যশালীর প্রয়োজন। ক্ষেম, স্থৈর্য্য, আরোগ্য, ঐশ্বর্য্য অতএব ক্ষেম অর্থাৎ সহিষ্ণুতা সহ্য করা; সকল বেগ সহ্য করিতে করিতে ক্ষেম হয়, পরেই স্থৈর্য্য (স্থির) হয়, স্থির হইলেই আরোগ্য হয় অর্থাৎ ব্যাধি বন্ধন থাকে না। পরেই কোন অভাব না থাকিলেই ঐশ্বর্য্য হয়, পরেই ত্যাগ হয়।


(৫) এ সংসারে কোন মাত্র সত্যের বন্ধনে থাকাই পরম তত্ত্ব, পরমপদ, ইহা বই জগতে কিছুই নাই। সংসার নিত্যানিত্যের তরঙ্গ, এই তরঙ্গ হইতে নিষ্কৃতির জন্য অভিমানের সত্ত্বাকে মার্জ্জনা করিতে হয়। “জীবে দয়া, নামে রুচি, বৈষ্ণব সেবন, ইহা বই কিছু নাই শুন সনাতন”। এই শব্দটি সকল জীবের পক্ষেই কণ্ঠহার। ঐহিক সুখ আর দুঃখ সকলই ক্ষণভঙ্গুর। ক্ষমাই দয়ার আধার, ত্যাগই সত্যের সার, পবিত্রতাই ধর্ম্ম। যাহাতে মনের কোন রকম অশান্তি, মলিনত্ব না হয় তদ্বিষয়ে সহিষ্ণুতা দ্বারা মার্জ্জনা করাই উচিত। ক্ষণিক সুখে মজিয়া থাকিলে পরে পরিণাম দুঃখই থাকে, পরিত্রাণের জন্য অবশিষ্ট সুখরূপ সত্যের লেশও থাকে না। ঐহিক সুখে মত্ত হইয়া কৃত ধর্ম্ম নষ্ট করিতে নাই।


(৬) সকল ভার দিয়া প্রারব্ধ চর্য্যায় ব্রতী থাকিলে গুরুই সকল বিষম বিপদ সম্পদ হইতে উদ্ধার করেন।


(৭) যথা সাধ্য ভগবৎ চিন্তা করিতে হয়। সকল ভার গুরুতে ন্যস্ত করিয়া উপস্থিত সংসারের প্রারব্ধ কর্ম্ম যাহা যাহা আছে সাধ্য অনুসারে করিয়া যাইতে হয়। কোন বিষয়ে অধিক হর্ষ বিষাদ করিতে নাই।


(৮) বোঝা এবং না বোঝা দুইই এক, কারণ উভয়েই ভ্রান্ত। এই দুইয়ের অভাবই শান্তি।


(৯) জগতের সকলেই ভুলিতে, ত্যাগ করিতে, দুর্নাম করিতে, অভাব করিতে, ব্যাভিচারী বন্ধনের সামগ্রী দিতে কৃতসঙ্কল্পভাবে অধ্যবসায় হইয়া চেষ্টায় চেষ্টিত আছে। কিন্তু যার যা স্বভাব অত্যন্ত বিকৃতিতে পড়িলেও উদার প্রকৃতিতে তাকে মলিন করে না।


(১০) বিনা ভাড়ায় পরের ঘরে বাস করিতে হইলে ঘরের বেগ সহ্য করিতে হইবেই। লোকের দেহই বন্ধন। এই দেহকেই বাসনাময় বলিয়া থাকে। এই দেহকে মুক্ত করিতে চেষ্টা যাহা করিতে হয় তাহা কেবল ভগবানের শরণ বই আর কিছুই নয়। সাধ্য সাধনে নিষ্কৃতি হয় না। অতএব সর্ব্বদাই বাসনা পূর্ণের চেষ্টা না করিয়া তাহাদের দৌরাত্ম্য যথাসম্ভব ভোগের ভোগ করিতে হয়। প্রারব্ধ বশতঃই লোকে ভোগ হইয়া থাকে। ভাগ্য অনুসারে সুস্থ অসুস্থ দায়ে দায়ী হইতে হয়। প্রারব্ধই তাহার কারণ। আরোগ্য ও আরোগ তাহা হইতেই হইয়া থাকে, নচেৎ জীবের শক্তি নাই।


(১১) ভগবৎ শক্তি দ্বারা ভগবৎ সেবার শক্তি পাওয়া যায়।


(১২) সংসার মায়াময় ভ্রান্তিসূচক। কাহারও কোন কর্ত্তৃত্ব এ জগতে নাই, স্ব স্ব ভাগ্যানুসারে স্ব স্ব ভোগে রত হয়।


(১৩) সত্যধর্ম্ম পরিচর্য্যাই পরমানন্দ উৎপাদন করিয়া থাকে।


(১৪) সত্যকে সেবা করিতে করিতে সতী হয়। পতিব্রতা হইলে কালের হাত হইতে সত্যকে উদ্ধার করা যায়।


(১৫) চিন্তায়, কার্য্যে, শ্বাসপ্রশ্বাসে স্থিরভাব অবলম্বন করিয়া পতিব্রতা বা ভগবন্নিষ্ট হইলে শুচি হয়।


(১৬) সর্ব্বদা স্বকৃত কর্ম্মানুসারে যত্নবান থাকিয়া নিত্য তৃপ্তিকর ভগবৎ সেবার শক্তি আহরণের প্রতিক্ষা করিতে হয়। অর্থাৎ সকল ভার ভগবানে দিয়া ভাগ্যানুযায়ী কর্ম্মক্ষেত্রের আয় অনুসারে ব্যয় করিয়া ধীর ধৈর্য্যশক্তির দ্বারা পরম পদ লাভ করিতে পারা যায়। পথের সহায় সর্ব্বশক্তিমান ভগবান নির্লিপ্ত শক্তি বিতরণ করিয়া থাকেন, তাহার সাহায্যে এ ভবসংসারের আবরণ কাটাইয়া নিষ্কৃতিলাভ করিতে পারা যায়।


(১৭) ভগবৎ চর্চ্চা প্রকৃতির বশে দোদুল্যমান থাকে বলিয়াই বাসনাজালে বদ্ধ করিয়া লয়। তাহাই জীবদ্দশায় কর্ত্তাভিমান দ্বারা ক্রিয়া কর্ম্মতে বদ্ধ করিয়া দেয়। এই ভ্রান্ত মায়া মুগ্ধ জীবদ্দশা মুক্ত লইতে একমাত্র ভগবানের আশ্রয় ভিন্ন অন্য কোন উপায় সৃষ্টি হয় না বলিয়াই ভগবৎ পদ শরণের উদ্বর্ত্তন করিতে হয়, তাহাই কৃপাসাপেক্ষ। অতএব সর্ব্বদা যাহা প্রারব্ধবশে কর্ষণাধি বর্ষণ শক্তির উপভোগ উৎপন্ন পাওয়া যায়, সকল অবস্থায়ই উদ্দেশ্য স্মরণ রাখার দিকে চেষ্টা করিতে হয়।


(১৮) সংসার শব্দটিই অভাবের স্মারক, যাহাতে মনের সুখ দুঃখ উদয় হয়। তাহাই সংসার।


(১৯) নির্ম্মল আকাশে সূর্য্য চন্দ্র নক্ষত্র অমাবস্যা দিন যাহা দেখা যায়, সেই আকাশকেই তাহারা যত্ন করিতেছে। তদ্ অনুগত হইয়া এই প্রকার বৃত্তিগুলিকে মনের সঙ্গে নির্ম্মল আকাশ চিন্তায় যত্ন করিতে হয়। এই নির্ম্মল আকাশকে যত ঘনিষ্ঠ করিয়া সেই আকাশের চন্দ্রাদির ন্যায় নিজ শরীরে অবস্থান করাইতে পারা যায় ততই সাধ্যসাধন পাওয়া যায়। কোন আশা ভরসার দিকে যত্ন করিতে নাই। লাভ লোকসান হউক না হউক যেমন করিয়া সংসারে প্রারব্ধ ভোগ হয় সে সমস্ত কেবল সহ্য করিয়া গেলে পরে সংসারের চেষ্টা সকল আপনিই চলিয়া যাইবে। ভগবৎ চক্র উদয় করিবে, কোন দরকার থাকিবে না। কামনা বাসনা সকলি প্রারব্ধের দণ্ড। সর্ব্বদা নির্ম্মল আকাশে চন্দ্রসূর্য্যাদির ন্যায় মনকে লাগাইয়া রাখিতে চেষ্টা করিতে হয়। ইহাতে যাহা হউক আর না হউক সে দিকে লক্ষ্য রাখিতে নাই।


(২০) শরীরের প্রারব্ধ ঋণ পরিশোধ যে পর্য্যন্ত না করা যায় সেই পর্য্যন্ত ভোগাদির প্রতি কোন হাত নাই। যখন যাহা উপস্থিত হইবে তাহা ভোগ করিতে হইবে।


(২১) কর্ম্মক্ষেত্রের উপস্থিত কর্ম্মসকল, প্রারব্ধে যাহা দেয় তাহাতে বিরক্ত সন্তোষ না হইয়া, কর্ম্ম করিয়া যাইতে হয়। পিছনে গুরু সর্ব্বদাই রক্ষা করিয়া উদ্ধার করিয়া লইবেন। জীব অবস্থায় জীবের কোন কর্ম্ম ইচ্ছার দ্বারা সাধিত হয় না। যাহা ইচ্ছার মতন কর্ম্ম করিয়া ফলভোগ করিতে দেখা যায় তাহাও প্রারব্ধের প্রদত্তই হইয়া থাকে। যদি তাহা না হইবে তবে কোন কোন কর্ম্ম ইচ্ছা করিয়া করিতে গিয়া শক্তি পাই না কেন? যখন যে অবস্থায় গুরু রাখেন সেই অবস্থায়ই তৃপ্ত হইতে চেষ্টা করিতে হয়। কোন চিন্তা নাই, গুরু সকল অভাব হইতে নিষ্কন্টকে উদ্ধার সাধন করিবেন এই গুরুর স্বভাব।


(২২) প্রারব্ধাদি ভোগ ক্ষেত্রে ভোগান্ত অবস্থায় কিছুই থাকে না; সকলি সম হয়। ভাগ্যক্রমেই সকল জোটে এই জ্ঞানে সকল বেগই সমভাবে কাটাইতে হয়।


(২৩) স্থির হইবার চেষ্টা করিতে সকল অবস্থায়ই অনুষ্ঠান করিতে চেষ্টা করিবে। এইরূপ করিতে করিতে নিত্য চরিত্র পবিত্রতা লাভ করিয়া আত্মার বিদিত হইতে পারে।


(২৪) সর্ব্বদাই সহিষ্ণুতার অনুগত থাকিতে চেষ্টা করিতে হয়।


(২৫) সংসার মায়াময় ভ্রান্তিজনক, যাহা কিছু বোধ করা যায় তাহা সকলি ইন্দ্রিয়জাল মাত্র। মনের দ্বারা যাহা লব্ধ হয় সকলই ইন্দ্রিয় ভোগ মাত্র। ইহার সঙ্গে বুদ্ধি জ্ঞান সতত অস্বাভাবিক ভাবে চলিতেছে বলিয়া যাহা মনেতে আশ্রয় পায় তাহা সকলই ভ্রম, অতএব মনের আহরিত বস্তুর জন্য পিপাসিত হইতে নাই। জগতে যাহা কিছু অনুভূতি হয় সকলই ইন্দ্রিয় জানিবেন, ইহাই কেবল সুখ দুঃখ ফল প্রসার করিয়া জীবদ্দশাকে চক্রের ন্যায় ভ্রমণ করাইয়া লয়। সর্ব্বদাই পতিব্রতাচারণ করিয়া গুরোপদ্দিষ্ট কর্ম্মের অনুষ্ঠানে ব্যস্ত থাকিতে চেষ্টা করিবে। লাভ লোকসান, সিদ্ধ অসিদ্ধ গতিতে উপেক্ষা করিয়া মাত্র উপদ্দিষ্ট আশ্রয় কর্ম্মে মজিয়া থাকিতে চেষ্টা করিবে। উদ্ধার গুরুপদেই করিবে। ভাল মন্দের প্রতীক্ষায় থাকিলে পতিব্রত ধর্ম্ম অভিচারী হইয়া সত্ত্বায় মলিনত্ব ঘটে।


(২৬) সংসার মায়াময় ভ্রান্তিজনক, শত ঐশ্বর্য্য লাভেও পরিতৃপ্ত হয় না। পতিব্রত ধর্ম্ম ত্যাগ করিয়া কর্ম্ম করিতে প্রমুখ হইলে অসতী আখ্যা জগতে প্রচার থাকে। যাই হউক ঐহিকের সুখ যাহা কর্ম্মের দ্বারা প্রাপ্ত হয় তাহা কেবল মরীচিকাবৎ, ইন্দ্রিয় ডগার আড়ালে পড়িলে তাহার কিছুই থাকে না। অগ্রে বিষমিব পরিণামে অমৃতোপম এই সুখ সাত্ত্বিক জানিবেন। অতএব সুখের বন্ধনে আশা রাখিয়া বিপন্নদশার গৌরব বাড়াইতে নাই।


(২৭) সংসার মায়াময় ভ্রান্তিমূলক, ক্ষণস্থায়ী সুখ দুঃখ এই সকলই গুণাবতারের প্রবঞ্চনা মাত্র। ক্ষণকাল অস্থায়ী সুখের প্রলোভনে পড়িয়া জীব নিত্য সুখময় নিত্যানন্দ চৈতন্যহারা হইয়া সংসার গারদে ঘুরিয়া বেড়ায়। বঞ্চনার প্রলোভনে পড়িয়া সৎ অসৎ বিচারে অক্ষম হইয়া যাহা তাহা করিয়া মুগ্ধ হয়। ইন্দ্রিয়াদি ব্যাপারে চিরকাল ঘুরিয়া বেড়ায়। এই ভাষাকেই পণ্ডিতগণ নরক সম্ভার বলিয়া থাকেন। এই নরক মুক্তির জন্য গুরু আশ্রিত হইয়া তদাশ্রমে চিরপোষিত হয়। এই গুরুকৃপায় সর্ব্বশক্তি ভক্তির আবরণে অনায়াসে শান্তির বাসভূমি লাভ করিয়া নিত্য স্বরূপ লাভ করিয়া নিত্য সেবার দাস হয়।


(২৮) জগতের স্থূল আবরণে কিছুরই নিত্যত্ব নাই। অনাবৃত বীরের মৃত্যু হয় না, জন্মও হয় না। ভ্রান্তিবশতঃ স্থুল প্রকৃতিতে কর্ত্তৃত্ব জ্ঞান থাকায় অভাবের বোধে জীবগণ সুখ দুঃখ ভোগ করে। দেহের সঙ্গে সম্বন্ধ বলিয়া সত্য ঘাতক বলিয়া থাকে, দেহীর সঙ্গে অবস্থান করিলে দেহ মুক্ত হয়। অতএব, দেহ বিয়োগে শোক তাপের কোনই কারণ দেখা যায় না।


(২৯) বৃথা কর্ত্তৃত্বাভিমান জাগরণ করিতে নাই।


(৩০) এই সংসার মায়ামুগ্ধ মায়ামৃগে আকৃষ্ট হইয়া বাসনা জাগিলে চঞ্চলতা ঘটে। তাঁহার শরণ মাত্রই ভ্রম শোধন হইতে পারে পুনরায় মায়াজালে বন্ধ হয় না।


(৩১) সংসার মায়াময়। বিকৃতি স্বভাবের তরঙ্গ সুখ দুঃখ অনুভূতির প্রশ্রয়; এই সকলই অভাব, ভ্রম বুদ্ধি মাত্র। অতএব পতি সেবাতে সর্ব্বদা বিবৃত থাকিতে চেষ্টা রাখিবেন। ফলাফলের দিকে লক্ষ্য রাখিবেন না। পতিসেবার জন্য স্বর্গ নরক কিম্বা গভীর কালচক্রের ভ্রমণই হউক, তাহাই মঙ্গল সূত জানিবেন।


(৩২) প্রারব্ধের ভোগ শেষ না হইলে কিছুই করিতে শক্তি হয় না। শরীরটি পরের বশে চলিয়া যাইতেছে, নিত্য সর্ব্বত্রেই পরাধীন গাত্র ইন্দ্রিয়াদির দ্বারা বিবর্ণ হইয়া ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়া থাকে। এই শরীরের উপর আধিপত্য কি হইতে পারে? সর্ব্বত্র সমভাবে প্রারব্ধের আকর্ষিত সুখ দুঃখ ভোগ করিতেই হইবে।


(৩৩) সমবুদ্ধির দ্বারা দৈহিক গুণজাত প্রারব্ধ ভোগদণ্ড ক্ষয় করিতে হয়। ভোগ মোক্ষ হইলেই জীবন দশা প্রাকার মুক্ত হইয়া মানবত্ব চলিয়া যায়। ব্রজবাসী যোগে নিত্য সেবাধীকারীর শক্তির সাহায্যে নিত্যসেবার যোগ লাভ করিতে পারিবেন। যখন যে অবস্থায় যে যে বিষয় আধিপত্য করিয়া মন বুদ্ধিকে চঞ্চল করে তাহা ক্রমশঃ সহিষ্ণুতা শক্তির আবরণ করিয়া অভ্যাসবশে রাখিতে চেষ্টা করিবেন, বিফলতা থাকিবে না। মনের শান্তি সুখাদি যাহা যোগদান করেন সকলি অনিত্য, অস্থায়ী, ভ্রান্তিমাত্র জানিবেন। সর্ব্বদা কেবল পতিগত হইয়া তাহারই উন্মুখ পৃষ্ঠভঙ্গ বর্জ্জিত হওয়াই জীবের পরম ধর্ম্ম।


(৩৪) সংসার চক্র উদয় অস্ত গতিভাবে অনবরত ঘুরিতেছে। এই ভ্রম শোধন জন্য ভগবানের অর্থাৎ সহিষ্ণুতার পরিণাম শক্তি শরণ দ্বারা শ্রদ্ধার উদ্বর্দ্ধন করিয়া লইতে হয়। লাভ অলাভ পিপাসা মুক্ত করিতে চেষ্টা করিতে হয়। সংসার প্রার্থনার আবরণে কেবলমাত্র বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়া থাকে। যজনাদি ক্রীড়ার চর্চ্চায় তাহার নিবৃত্তি হয় না। কেবলমাত্র এক পতিব্রত শক্তিপদ আশ্রয় লইয়া অঘাচনা ভাবে প্রতিক্ষা করিয়া যথাসাধ্য গুরোপদিষ্ট সত্য সাধনের জন্য স্থিতিবুদ্ধির আহরণ করিতে পুনঃ পুনঃ চেষ্টা করিতে করিতে নিশ্চয়াত্মিকা শক্তির বৃদ্ধি হইয়া কামনা বাসনা লুপ্ত হইয়া থাকে। তখন সকল অভাবই দূর হইয়া আনন্দ প্রকাশ হইয়া যায়।


(৩৫) প্রারব্ধ ভোগের জন্য কোনরূপে চঞ্চল কি ভয় করিতে নাই। ভাগ্যে যাহা যাহা ভাল মন্দের যোগ হয় তাহা ভোগ করিতে নিশ্চয়ভক্তি অবশিষ্ট ভোগমুক্ত করিয়া সর্ব্বদা আনন্দ বর্দ্ধন করিয়া পরম শান্তি অবিচ্ছেদ রসের তরঙ্গায়িত করিয়া লয়। অতএব সর্ব্বদা যখন যেমনই অবস্থার উদয় হউক না কেন সহিষ্ণুতার দ্বারা সর্ব্বদা সহ্য করিয়া লইবেন। সর্ব্বদাই ভগবৎ সেবার জন্য দৃঢ় আলিঙ্গন শক্তির বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা করিবেন।


(৩৬) এই সংসারে আশ্রয় পাইলে মুক্তির অভাব থাকে না । যথাসাধ্য কৰ্ম্মে সাধ্য সাধন করিয়াই গুরু কৃপার দ্বীপন হইয়া থাকে। উপাদান ভেদে শরীর গঠিত অনুসারে স্বভাব পায়, তৎদ্বারা ক্রীড়া কৰ্ম্ম চলিয়া থাকে। ইহার নিবৃত্তির জন্যই আশ্রয় প্রয়োজন হইয়া থাকে। স্বভাব অনুসারে গুরোপদিষ্ট কার্য্য যথাসাধ্য করিবেন।


(৩৭) সংসার মায়াময়, কেবল কর্ত্তৃত্বাভিমানেই মুগ্ধ। অহংপ্রাণের বৃদ্ধিই মায়াচক্রে ভ্রমণশীলতা লাভ করে। সুখ দুঃখ যাহার যাহার ভাগ্যবশতঃই লাভ হয়। শুভ অশুভ উভয়ই কৈতব প্রধান যাহা হইতে কৃষ্ণভক্তি অন্তর্দ্ধান হইয়া থাকে। শুভ অশুভ কর্ম্মই কৃষ্ণ ভক্তির বাধক হয়। ইচ্ছা, অনিচ্ছা জীবের অধিকার নাই, গুণ চঞ্চলতার বিবর্ণ মাত্র, অবিদ্যা কারখানা। ইচ্ছাময় অর্থাৎ যখন কোন ইচ্ছাই থাকে না সেই অবস্থায় কামগন্ধ বিন্দুমাত্রও ব্রজধামে থাকিতে পারে না, ঐ সকল অহংকারের পরিকর ধরফড়ানি মাত্র।


(৩৮) নিজ শক্তি বলের অভাব জীবের স্বতঃসিদ্ধ। কর্ত্তা হইয়া যে কোন যজ্ঞ করিতে হয় তাহা শিবহীন জানিবেন। ভূতাদিদ্বারা যজ্ঞ ভ্রষ্ট করিয়া থাকে। অতএব পতিব্রত ধৰ্ম্ম পালনই জীবের স্বতঃসিদ্ধ কৰ্ত্তব্য।


(৩৯) পুরুষ অভিমানী যদি সত্য সঙ্গ না করে তবে প্রত্যবায়ী হইতে হয়। জগতে সাহস করিয়া নিত্যমুক্তির জন্য দশবিধ সংস্কার সম্পাদন করিতে হয়। অদৃষ্টকে ভোগে বঞ্চিত করিতে নাই।


(৪০) প্রাক্তন দণ্ড যথাযথানুসারে ভোগের অতিক্রম করা জীবের পক্ষে ক্ষমতা নাই।


(৪১) সংসার মায়াময়, সকলই ভ্রান্তিমূলক, কর্তৃত্বাভিমান দ্বারা জড়িত। পতিপ্রাণা ভক্তিরসে সকল অভাবই মুক্ত হয়।


(৪২) প্রারব্ধ বশে আটক পড়িয়া যাহা করিতে বাধ্য হইবে তাহাতেই মধ্যস্থ থাকিতে চেষ্টা রাখিয়া গুরুর আদেশকর্ম্ম পালনে যত্নশীল হইতে চেষ্টা করিবেন। এই প্রকার করিতে করিতে ভগবানের শক্তি পূর্ণরূপে অধিষ্ঠান হইয়া নিত্যসেবার অধিকারীভাবে দেহবৈগুণ্য পরিহারে সমর্থ হইতে পারিবেন। ভগবান সিদ্ধ অসিদ্ধ, ভাল মন্দ বিচারের অতীত, অতএব সর্ব্বদা গুরুপদ আশ্রয়ে সাধ্যানুসারে পরিচর্য্যা কার্য্যে নিত্যব্রতী থাকিবেন। অচিরেই ভগবান উদ্ধার পদ খোলাসা করিয়া লইবেন।


(৪৩) ভগবৎ সেবা সর্ব্বদা করিতে করিতে নিত্য শক্তির বিকাশ হইয়া থাকে। সকল ইচ্ছার বেগ সহ্য করিতে করিতে সকল অভাব যাইয়া পূর্ণ স্বভাবে পরিণত হয়। পরের দোষ দেখিতে নাই, আপন দোষগুলির অনুসন্ধান করিয়া সর্ব্বদা দোষগুলিকে পবিত্র করিতে হয়। পরের স্বার্থজ্ঞান মলিনের কারণ হইয়া থাকে । যাহা কিছু আবির্ভূত হয় সকলি প্রারব্ধ বৃত্তি মাত্র, কাহারো কোন দোষ নাই। যাহার নিকট যে যে ঋণ পরিশোধ করার যে ভাবে ব্যবস্থা প্রাক্তনে উপস্থিত করে সেই সেই ভাবেই তাহা গ্রহণ হইয়া থাকে ৷


(৪৪) সংসার মায়াময়, ভ্রান্তিসূচক, সুখ দুঃখ প্রকাশক। সৰ্ব্বদা প্রারব্ধ গতির বিরোধী না হইয়া তাহাদের সেবা পরিচর্য্যার বাধা না দিয়া, কেবল ভগবানের সেবা নিষ্ঠায় যত্নবান হইতে চেষ্টা করিবেন। বাসনাদি যাহা রজগুণের তরঙ্গ তাহারা সকলই উদয় হইয়া অস্ত হইবে। তাহাদের তাড়না জালের প্রতি লক্ষ্য না রাখিয়া আপন ইষ্ট সেবায় লক্ষ্য রাখিয়া যাইবেন। অচিরেই ভগবান এই মায়াক্ষেত্রের বিকার হইতে উদ্ধার করিয়া লইবেন সন্দেহ নাই। সাধ্যমতই ভগবানের সেবাচর্য্যা করিয়া যাইবেন। মনের চঞ্চলতার দিকে লক্ষ্য না রাখিয়া কেবল সেবার আশ্রয়ে থাকিবেন। মনের ধর্ম্মই হইয়াছে চঞ্চল। সৰ্ব্বদা সেবাকার্য্যই ব্রজের পরিকর জানিবেন।


(৪৫) ব্রজবধূর কৃষ্ণভক্তি প্রেমের তরঙ্গে চঞ্চলই আকর্ষণ করিয়া থাকে এবং বিষ অমৃত একত্র হইয়া ভগবৎ সেবায় পূর্ণ শক্তিমান হয় বলিয়া শান্তির অভাব থাকিয়াই যায়। শান্তি হয় না। ইহাই ভগবানের প্রেমের লক্ষণ জানিবেন। যেখানে শান্তির তরঙ্গ উদয় আছে সেখানে সমতাভাব হয় মাত্র কিন্তু প্রেমের অভাব থাকিয়া যায়। অতএব ভগবৎভক্ত শান্তিময় অজস্র ঐশ্বর্য্যকে তুচ্ছ করিয়া থাকে। মায়ামুগ্ধ বুদ্ধি কেবল শান্তির তৃপ্তি খোঁজে। ব্রজের পথে ঐহিক প্রারব্ধের কন্টক চৌদিকেতে বিকশিত হয়। কালের ঋণ শোধন জন্যই পতিব্রত আচরণে যত্নশীল হইয়া সতীধর্ম্ম কায়ক্লেশে ভোগান্ত করিয়া নিত্যমুক্ত ভক্তির উর্ব্বান করিয়া পথ রাখিয়া গিয়াছেন।


(৪৬) সংসার মায়ামুগ্ধ ভ্রান্তিজনক। এই সংসারে প্রারব্ধভোগে পরিচালিত হইয়া থাকে। বাসনাকুলে বিব্রত হইয়া সত্য প্রতিষ্ঠার চঞ্চল হয়। কর্ম্মক্ষেত্রে সহিষ্ণুতাই সামর্থ্য প্রকৃতির উদ্বর্ত্তন করিয়া থাকে। প্রলোভনীয় পথে নানা উপসর্গ জুটিয়া চিত্তকে কলুষিত করিয়া লয়, তাহা হইতেই নানা উপায় অবলম্বন করিয়া জগতে অভাবগ্রস্থ হইয়া পড়ে। নানা পথে চালিত হইয়া, নানাগুণের তরঙ্গদ্বারা শান্তির অশান্তির সংঘটন করে। মুক্তি পাবে বলিয়া মায়া অর্থাৎ ভ্রান্তি যোগ আশ্রয় নিয়া যজ্ঞ ভুলিয়া যায়। যজ্ঞ শেষ করিতে পারে না। যজ্ঞ হারাইয়া নানাবিধ কাল দণ্ডের অধীন হইয়া গতাগতিময় পুনঃ পুনঃ জগতে নানারূপে সুখ দুঃখে লাঞ্ছিত হইতে দেখা যায়। স্থির বস্তুর সঙ্গ না পাইয়া, পতিসেবা হারাইয়া নানাবিধ উপায় সৃষ্টিদ্বারা কেহ সন্ন্যাসী, কেহ জাপক, কেহ যোগী, কেহ ভোগীরূপ ধারণ করিয়া আশু সুখ অনুভূতিদ্বারা সর্ব্বতোভাবে ব্যবসায়ী বুদ্ধির আবৃত হইয়া যায়। এই সকল কেবল মায়ামন্ত্র জানিবেন। সকল উদ্দেশ্যবিধান ছাড়িয়া একমাত্র পতিসেবায় নিত্য নিযুক্ত থাকিতে চেষ্টা করিবেন। বর্ত্তমানে পতিসেবাই পরম পুরুষার্থ, ইহা বই আর কিছুই নাই। ভগবৎভক্তিদেবী কোন অভাব প্রবর্ত্তন করান না, সর্ব্বদাই পবিত্র করিয়া দেন।


(৪৭) ভগবান ত্রিজগতে সর্ব্বদাই জাগরণ থাকেন, তাঁহার কোন অঙ্গই ত্রিজগৎ ছাড়িয়া থাকে না। কর্ত্তৃত্বাভিমান প্রকৃতির গুণজাত হইয়া অহঙ্কার দ্বারা তৎপদ লক্ষ্য করিতে পারে না বলিয়াই নানা আশু সুখদায়ক কর্ম্মফল অন্বেষণ করিয়া, হিতাহিত হারাইয়া কর্ত্তব্য ত্রুটিতে পড়ে। তজ্জন্যেই জগতের চর অচর পদে পড়িয়া যায়। অতএব, সর্ব্বদা তৎলক্ষ্য রাখিতে চেষ্টা করিবেন।


(৪৮) সংবৰ্দ্ধন কার্য্য কর্তৃত্বাভিমানীতে সাধ্যসাধনে প্রাপ্ত হয় না বলিয়াই পতিব্রতা ধৰ্ম্ম জগতে বহু নায়ক নায়িকা প্রবণ করিয়া কীর্ত্তিপথ স্থাপন করিয়া রাখিয়াছেন। অতএব পতিব্রত ধৰ্ম্ম ব্যতীত অন্য কোন ধৰ্ম্ম সহায়ে কৃতকাৰ্য্য সম্পাদন হইতে পারে না। মনের সুখ বোধ যাহা হয় তাহা কেবল প্রকৃতির বিকারমাত্র, ক্ষণস্থায়ী।


(৪৯) প্রারব্ধ সংসার না হওয়া পর্যন্ত চিত্তবিনোদ উদয় হয় না। পূর্ব্বাপর মহাশক্তির জীবনীতে সকলই প্রকাশ আছে, চিন্তা নাই।


(৫০) প্রাক্তন সূত্রে যে সকল ভাব মনাদি ইচ্ছার বশ্যতা স্বীকার হয় তাহাই ভ্রান্তি, সকলই মনের জল্পনা কল্পনা মাত্র । সকল অবস্থায় অবিচলে সহিষ্ণুতার দ্বারা ভোগ করিয়া যাইতে যাইতে প্রারন্ধমুক্ত হইয়া নির্ম্মল চৈতন্য লাভ করিয়া থাকে। পুনরায় আর ভ্রান্তিমুগ্ধ গারদ দণ্ডে বন্ধন হয় না।


(৫১) অকাতরে প্রারব্ধ বেগ সহ্য করিয়া সকল অভাব মুক্ত হইতে চেষ্টা করিবে।


(৫২) কৃষ্ণের পুত্রাদি যদু বংশকে তাহাদের প্রকৃতির ভোগের নিমিত্ত নিষেধ বিধান কৃষ্ণ হইতে হয় নাই। তাহাদের প্রবৃত্তির উৎসুকের কর্ম্ম সর্ব্বথাই করিয়াছিল। যথাসময়ে তাহারা মুক্তিলাভ করিয়াছিল। তাহার কারণ যদুবংশীয়গণ নিশ্চয় কৃষ্ণই কর্ত্তা জানিত। এইজন্য তাহাদের কর্ত্তৃত্বাভিমান ছিল না। ইহাই সাধন। আত্মাই দেহের কর্ত্তা, প্রারব্ধ ভোগই দেহের কর্ম্ম, এই জ্ঞানে অভিমানী হইয়া অতি দুরাচারীও নিত্যমুক্তি লাভ করিতে পারে। কর্ত্তৃত্বভাবে অহং বুদ্ধি দ্বারা নিজ ক্ষমতা চারণ দ্বারা যে সমস্ত সৎ অসৎ কর্ম্ম সমাধা করে তাহার দ্বারা কর্ত্তৃত্বাভিমানী হইয়া কর্ম্মপাশে বন্দী হয়, কর্ম্মমুক্ত হয় না। অতএব, এটি করিব, এটি করিব না, করিয়া যে সকল কর্ম্মে নিযুক্ত হইবে, তাহা সফল হয় না। প্রারব্ধে যে আছে তাহার ভোগ সেই ইন্দ্রিয়গণকে দিয়া, লক্ষ্য সহিষ্ণুতার দিকে রাখিয়া গুরুর উপর ন্যস্ত করিয়া নিয়ত প্রাণের নিকট থাকিতে সর্ব্বদা চেষ্টা করিবেন। যখন যে ভোগের বেগ সহ্য না হয়, তাহা করিলেও দোষ থাকে না।


(৫৩) বিবাহ করিলে সংসার বন্ধন হয় না, আসক্তিই বন্ধন করে। ভাগ্যং ফলতি সর্ব্বত্রং এই শ্রুতি বাক্য। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিবাদি সকলেই বিবাহ সংসার পালন করিয়াছেন।


(৫৪) পিতামাতার তৃপ্তির জন্যই লোক সন্তান প্রয়াসী হয় এবং পিতার ইচ্ছা পূর্ণ করাই সন্তানের ধর্ম্ম।


(৫৫) কর্ত্তা কর্ম্ম হইতে লাভ লোকসান দ্বারা ব্যতিব্যস্ত হয়, অকর্ত্তার কোন অভাবই থাকে না।


(৫৬) সংসারের সারই ভগবান, জীব ভাবের এই শক্তি।


(৫৭) পতিব্রতা ধর্ম্ম
অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনা পর্য্যুপাসতে।
তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম॥
এই যে ভাব ইহা ছাড়া আর কিছুই চায় না, জানে না, অন্য কিছুর দরকার নাই। মহা ঐশ্বর্য্য প্রলোভনের আবাহনকেও তুচ্ছ করে। তাহাকেই পতিব্রতা ধর্ম্ম বলে। গুরু ধ্যানং তথা নিত্যং দেহী ব্রহ্মময়ো ভবেৎ ইত্যাদি। গুরু ব্রহ্মা গুরুঃ বিষ্ণু গুরুর্দ্দেব গুরুর্গতিঃ, গুরুরেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরুবে নমঃ ইত্যাদিতে পতিব্রতা জাগাইয়া রাখিয়াছে। অর্থাৎ অদ্বৈত ভাব হৃদয়ে রাখা।


(৫৮) সংসার মায়াময়। যত রকমই চঞ্চল হউক না কেন ততই আনন্দবান আনন্দবর্ষন করিয়া থাকেন।


(৫৯) যে পর্য্যন্ত দেহ থাকে সেই পর্য্যন্ত কষ্ট নিবারণের জন্যই চেষ্টা করা জীবের ধর্ম্ম। প্রত্যেক শরীরের মধ্যে ভগবান সুখময় বিরাজ করেন, ভ্রান্তিবশতঃই কর্ত্তৃত্বাভিমানী সূত্রে নানা রকম দেখিতে পায়। অতএব যাহাতে অন্তকাল পর্য্যন্ত কষ্ট না পায় তাহারই চেষ্টা যথাসাধ্য করিতে হয়।


(৬০) সংসার মায়াময় ভ্রান্তিমুগ্ধ অস্বাভাবিক গতি। ইহাদের হাত চালন হইতে নিষ্কৃতির একমাত্র পতিব্রতা ভগবৎসেবা ভিন্ন অন্য কিছুই নাই। অতএব সর্ব্বদা পতিসেবারয় নিযুক্ত থাকিতে চেষ্টা করিবেন। অচিরে ভগবান কৃপা করিয়া সকল অশান্তি ভ্রান্তি বিবিধ অভাব নাশ করিয়া নিত্যানন্দ আবরণ করিবেন।


(৬১) সংসার মায়াময়, ভাগ্যবশতঃ জীবের গতাগতি কর্ম্ম অকর্ম্ম, লাভ হইয়া সুখী দুঃখী হইয়া থাকে। ভগবানের নিত্য সেবার বাসনার আশ্রয়ে জীব ভাবের নিত্যতৃপ্ততা হেতু জন্ম কর্ম্ম সমাপ্ত হইয়া নিত্যমুক্তির আশ্রয় পায়। গুণাদি তারতম্যতা হেতু অভিমানী বশতঃ কর্ম্মানুগামী হয়। অহঙ্কারাদি সূত্রে পতন হইয়া পরাত্মিকা বুদ্ধির মলিনত্ব হয়, তাহা নিবারণের জন্য ভগবানের স্থল হইতে কর্ম্ম লইয়া কর্ম্ম তদুদ্দেশে সমাপ্ত করিতে চেষ্টা করাই জীবের কর্তব্য কর্ম্ম।


(৬২) সম্বন্ধ, বৈধেয় প্রয়োজন। সম্বন্ধ করিলে বিয়োগ ঘটে না। কর্ত্তৃত্বাভিমানীর কর্ম্ম চেষ্টার দ্বারা শক্তিহীন(জরা) সম্বন্ধ ঘটিয়া ক্ষরত্ব ফল ভোগ করিয়া থাকে। গতাগতি কামকাম্য লাভ মাত্র প্রাপ্ত হয়। অদ্বৈত চেতা হইয়া অকর্ত্তাবুদ্ধির দাসত্ব পরমানন্দ প্রসব করিয়া থাকে। ভগবৎ কৃপা ব্যতীত কিছুই হইতে পারে না। অতএব সর্ব্বদা ভগবৎ কৃপার প্রতিক্ষায় অবহিত হইয়া ভগবৎ কুল স্বভাব মাতৃপদ আশ্রয় করিয়া থাকিতে হয়, ইহাই স্বধর্ম। মাতা স্বভাব, পিতা ধর্ম্ম এই দুই মিলনকে স্বধর্ম্ম বলে। এই অবস্থায় থাকিলে আনন্দের আনন্দ উৎপন্ন হয়। ইহাই নন্দের নন্দন লাভ করা। ব্রহ্ম, আত্মা, ভগবান উপাধি হয়। অতএব সর্ব্বদা সৎসঙ্গ করিতে করিতে নিত্যানন্দ স্বরূপ ভগবৎ পদ লাভ করিতে পারিবেন। অহংকার চিন্তা করিবেন না, বাসনাই বন্ধনের কারণ।


(৬৩) পুরুষকারটি পরমশক্তি, তাহাকে অজ্ঞনান্ধ জীব নানাবিধ উপচারে বিভক্ত করিয়া অভাবগ্রস্থ হইয়া পড়ে। তদ্বারা জন্ম মৃত্যু সুখ দুঃখের ফলপ্রাপ্ত লোভের বন্ধন হইতে উদ্ধার পাইতে পারে না বলিয়াই পুনঃ পুনঃ জরা ব্যাধি জন্ম মৃত্যুর কবলে পতিত হয়। সুখের পিপাসায় ষড়রসে মুগ্ধ হইয়া পড়ে, শান্তির জন্য লালায়িত হইয়া কর্তব্য পথ পতিব্রত পতির আশ্রয়চ্যুত হইয়া অভাবগ্রস্থ হয়। অতএব সর্ব্বধর্ম্ম পরিহারের দ্বারা পতিস্বরূপ সদাচারী অনন্য ভক্তির শরণাপন্ন হইবেন।


(৬৪) মনের স্থির করিবার বিশেষ কোন প্রয়োজন নাই। মনের স্বভাবই স্থির, কর্ত্তৃত্বাভিমান সূত্রে চঞ্চল বাসনায় আলোড়িত হইয়া নানান উপসর্গ এ বন্টন করিয়া দেয়, তাতেই লোক বিমুগ্ধ হইয়া সুখ লাভের প্রত্যাশায় নানাবিধ চেষ্টা করে বলিয়াই আরো চঞ্চল ও উপদ্রব সংযোগ হয়। পতিব্রতা ধর্ম্মকে আশ্রয় করিয়া শরণে নিমগ্ন থাকিতে অভ্যাস করিতে করিতে এবং পতি প্রতি রসের নিমিত্ত স্বীয় কর্ম্মজনিত অপরাধ ক্ষমা প্রার্থনা করিতে করিতে চঞ্চল কার্য্য যে সকল প্রকৃতির সঙ্গ হয় সেই প্রকৃতির ভাবের নিকট হইতে দূরে থাকিবার চেষ্টা করিতে করিতে চিত্ত সঙ্কোচ হয়, পরে মন স্বস্থানে প্রতিষ্ঠা হইয়া থাকে। তাহাতে সুযোগ সুখ অপেক্ষা বেশী সুখ হয়।


(৬৫) সংসারের পথ বহুবিধ রকমে মুক্তির কারণ হয়। তন্মধ্যে দুইটি প্রধান, যাহা দ্বারা উদ্ধার হয়। সকলই অনন্য চিন্তার দ্বারা পরিপুষ্ট হইয়া থাকে। প্রথমটি অকর্ত্তা হইয়া চিন্তা ভাবনা বর্জ্জনে যখন যে অবস্থা উপস্থিত তাহার বেগ সহ্য করা। দ্বিতীয়টি সর্ব্বদা ভগবানকে সখ্য, দাস্য বাৎসল্য কি মধুর ভাবের যে কোন ভাবের একটিতে মুগ্ধ হইয়া তাহাকে পাবার ঐকান্তিক বাসনায় দিবানিশি সর্ব্বত্রে সকল অবস্থায়ই পাবার লালসা করিয়া থাকিতে হয়। সকল দেবতা প্রভৃতি জীবগণের নিকট অপরাধ ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া ভগবৎ কৃপা ভিক্ষা করিতে হয়। এই দুইটি পথই উদ্ধার করিয়া ভগবৎ সাক্ষাৎ প্রাপ্ত হয়। জন্ম মৃত্যু যায়।


(৬৬) ধীর সমীরে যমুনা তীরে বসতি সতত বনমালী।
ধীরভাবে নাম পুনঃ পুনঃ উচ্চারণ করিতে করিতে ক্রমশঃ বায়ুর স্থিরবর্ত্তী উপস্থিত হয়। তৎপর প্রকাশ পায়, পরে জীতেন্দ্রিয় হয়। ইন্দ্রিয়গণ যে দিকে মনকে কর্ষণ করে সেই দিক হইতে অন্তরালে থাকিবার সতত চেষ্টা করিয়া পুনঃ পুনঃ মনকে ধীর সমীরে রাখার চেষ্টা করিতে হয়। যতই মন চঞ্চল হউক না কেন ততই মনকে ধীর স্থানে রাখিবার চেষ্টা করাই প্রয়োজন। যে সকল বিষয়ে ইন্দ্রিয়গণ প্রলুব্ধ হয় তাহাতে যতই মন আকৃষ্ট হউক না কেন ততই আস্তে আস্তে ধীরের যোগে বশ রাখিবার চেষ্টা করিতে হয়। নির্জ্জন স্থানে বসিয়া ঐ যোগ না করিলে কার্য্য সিদ্ধি হয় না। আর বেশী বাজে আলাপ ব্যবহার করিলেও বাধক অনেক উৎপন্ন হইয়া থাকে। যে পর্য্যন্ত নিদ্রা আকৃষ্ট না হয়, সেই পর্য্যন্ত ধীর সমীরে থাকিতে পুনঃ পুনঃ চেষ্টা করিবেন। কূটস্থ চৈতন্যের আবির্ভাবে নিত্যানন্দের যোগ হয়। ধীর সমীরে যাওয়ার ব্যবস্থাটুকুকে অদ্বৈতভাব বলিয়া থাকে। এখানে প্রতিষ্ঠা রুচি জন্মিলে যে ভাব হয় তাহাকে গদাধর বলে। সতত এই স্থানে আবেগবৃত্তি বর্দ্ধন শক্তিকে শ্রীবাস বলে। এই স্থান ছাড়িয়া অন্য কোন স্থানে মনের গতি এবং কোন কামনা বাসনা না আসে তাহাকে যোগস্থ বলে। এই পরিচর্য্যার প্রতি যে পিপাসা এবং পাওয়ার জন্য যে ব্যগ্রতা অধিক হয় তাহাকে বৈষ্ণব বলে। সতত ইহারই পরিচর্য্যাকারী চিত্তকে ভক্ত বলিয়া জানিবেন।


(৬৭) আলস্য করিয়া হেলা করিতে নাই।


(৬৮) সংসারে নিত্যযজ্ঞ করাই প্রয়োজন। শ্বাস প্রশ্বাস না টানা না ফেলার অবস্থায় হাপ না হয় কষ্ট না হওয়া পর্য্যন্ত যতটুকু পর্য্যন্ত রাখা যায় ততটুকু সময় রাখিয়া পুনঃ পুনঃ মাথা হইতে মূলগুহ্য পর্য্যন্ত মেরুদন্ডের মধ্যে বিদ্যুতের লটার মতন চিন্তা করিয়া নিত্য কার্য্য করিতে অভ্যাস করিবেন। এতৎ চিন্তাই মনকে সুস্থ করিয়া নিবেন।


(৬৯) ভগবানের উপর সকল ভার দিয়া কার্য্য করিয়া যাইবেন, প্রারব্ধ কেটে যাবে।


(৭০) সংসার মমতাজালে বদ্ধ থাকায় জীবগণ কার্য্যকারণ স্মরণ করে।


(৭১) জীবগণ অনর্থক আশঙ্কার অধীনে যাইয়া চিন্তার তরঙ্গে কষ্ট পায়। সংসারে যতই অভাব ততই শান্তি পরিণামে উদয় হয়। যাহাতে সমস্ত ভার ভগবৎপদে ন্যস্ত করিতে পারা যায় তাহাই করিবেন। উপস্থিত সংসারের কর্ম্ম যথাসাধ্য শেষ করিতে চেষ্টা করিবেন। অন্য কোন চিন্তা না করিয়া যখন যেমনভাবে পারিবেন ভগবৎ চিন্তা করিবেন। অহঙ্কার বশতঃ কর্ত্তৃত্বাভিমান যত ত্যাগ করিয়া ভগবানের অভিমানে উঠিতে পারেন তাহাই করিবেন।


(৭২) বাজে চিন্তা করিবেন না, সকল বেগই সহ্য করিবেন। লোভাদির অধীন হইয়া সংসারের বন্ধন ঘোচে না। জয়, পরাজয়, লাভ লোকসান, সুখদুঃখ, ভালমন্দ, ন্যায় অন্যায় দিকে লক্ষ্য না রাখিয়া উপস্থিত যখন যে যে কর্ম্ম উপস্থিত হয় তাহা সম্পাদন করিয়া বাকি সময় নিজের কর্ত্তৃত্বের অভিমান যে ভুল ইহা জানিবার চেষ্টা করিবেন। শরীরের উপরই যখন কাহারো কোন কর্ত্তৃত্ব নাই তখন স্ত্রী পুত্র ভাই বন্ধুর উপর কর্ত্তৃত্ব কি করিয়া হইতে পারে ? এই সকল বিচার করিয়া সর্ব্বদা প্রাণ, যাহা শরীরের মধ্যে আছে, তাহার দিকে লক্ষ্য রাখিয়া নাম করিবেন। নাক দিয়া যে শ্বাস প্রশ্বাস যায় তাহার প্রতি লক্ষ্য করিবেন না। ধীর হইয়া বসিয়া যতটুকু সময় পারা যায় বাজে কথা না বলিয়া ঐ নাম মনে মনে উচ্চারণ করিতে করিতে প্রাণের স্বরূপ জানিতে পারিবেন।


(৭৩) সংসার মায়াময়। বাজে চিন্তা করিয়া সময় কাটায়, তাহাই বন্ধন। নিরপেক্ষতার সহচর হইলে শোক দুঃখ প্রারব্ধের দন্ডাদি ও ভোগের যন্ত্রণা হইতে নিষ্কৃতি পায়।


(৭৪) সর্ব্বদা স্বভাবকে ঐহিক সুখের বিষম বিষ হইতে স্থানান্তর করিয়া ভাবি কালের পথ পরিষ্কার করিবেন। ঘরের সম্বন্ধই পরম বল, তা ছাড়া যা কিছু তা ইহকাল পরকাল ত্রিকালেই দুঃখের গারদ সংশয় নাই। ‘স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্ম্মো ভয়াবহঃ’, গীতার বাক্য মিথ্যা নয়। ধর্ম্মই পরম বল, একটু সহ্য করিয়া গেলে অপার আনন্দ উপস্থিত হয়।


(৭৫) সংসার মায়াময়, মিছা ভাবেই মুগ্ধ করে, তজ্জন্য চিন্তা করিতে নাই।


(৭৬) সর্ব্বদাই বুদ্ধি স্থির করিয়া সমস্ত ভারের ভার গুরুর উপর রাখিয়া উপস্থিত কর্ম্ম সকল সাহসের উপর নির্ভর রাখিয়া করিবেন। গুরু মঙ্গল করিবেন সন্দেহ নাই।


(৭৭) যত আড়ম্বর কমান যায় ততই শান্তির উদযাপনা হইতে থাকে। ভগবান নির্জ্জন,নিভৃত অনাবৃতেই উদয় থাকেন, আবরণ মায়া।


(৭৮) গুরুর কার্য্য সর্ব্বদা করিতে চেষ্টা রাখিবেন। গুরুই বিপদ ভঞ্জন করিয়া সম্পদ দিবেন।


(৭৯) সংসার মায়াময়। যাহাতে মমতা অর্থাৎ অহংজ্ঞান কর্ত্তৃত্বাভিমান হৃদয়ের অন্তরে থাকে তাহাই ভজনা। এই জন্যই গুরু প্রকরণ আশ্রয় করিয়া সকল ভার ভগবানকে দিয়া সংসারের বাধা অর্থাৎ সকল ঋণ যাহাতে শোধ করিতে পারা যায় তাহারই অনুষ্ঠানে ব্রতী থাকিবেন। ভগবান সংসারের আবরণ সকল অচিরেই নাশ করিয়া কুরুবদ্ধ পাণ্ডবের ন্যায় মুক্ত করিয়া নির্ম্মল করিবেন এবং শান্তিভোগ দ্বারা পরমানন্দ প্রদান করিবেন, চিন্তা নাই।


(৮০) মনকে ঠিক করিতে হইলে এক অভ্যাসের দ্বারা ক্রমশঃ চেষ্টায় হয়। ইহা অপেক্ষা গুরুর ভরসায় নিজের কর্ত্তব্য অকর্ত্তব্য ছাড়িয়া থাকিতে হয়। এই দুই সম্বন্ধই ফল দেয়, গুরু সর্ব্বদা রক্ষা করেন সন্দেহ নাই।


(৮১) সকলি গুরুর কৃপাহি কেবলম। সর্ব্বদাই সহিষ্ণুতার আশ্রয় নিয়া থাকিতে চেষ্টা করিবেন।


(৮২) সহিষ্ণুতার ধর্ম্ম পরম পদার্থ, তাহা লাভ করা বহু ভাগ্যের তপস্যা। যদি সহ্য শক্তির অভাব হয় তবে যাহাতে শান্তির অধিষ্ঠান করিতে পারা যায় তাহাই করিবেন। কর্ম্ম ত্যাগ করিয়া মনের মধ্যে সর্ব্বদা কর্ম্ম বিশয় ইন্দ্রিয় দ্বারা হৃদয়ে উপস্থিত করিলে কি পৌরুষ তাহাতে হইবে ? এই সংসার মায়াময়, সুখদুঃখ প্রলোভন শাসন ইত্যাদি দ্বন্দ্বজরূপে প্রতিপন্ন হইয়া থাকে। ইহা হইতে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যই বেদ বিধির প্রকাশ করিয়া জগতে বিশিষ্ট রূপে ক্রিয়া করিতেছে। তাঁহারা ক্ষেম, স্থৈর্য্য, আরোগ্য, ঐশ্বর্য্য বাক্যময় গ্রন্থ দ্বারা গ্রন্থি বন্ধন করিয়া জগতকে সর্ব্বদা চৈতন্য করিয়া দিতেছেন।


(৮৩) মায়াময় সংসারের তাড়না যত সহিষ্ণুতার দ্বারা সহ্য করিতে পারে, ততই মঙ্গলময় নিত্য পথ ভগবৎ কৃপার স্থান অধিকারী হইতে পারে। সংসারের যাহা কিছু করা যায় সকলি অনিত্য, তাহার পরিহার করাই ভগবৎ ভজন। চিন্তা ভাবনা না করিয়া সকল বিষয়েই স্থৈর্য্য দ্বারা ভোগ দিয়া যাইবেন। সকল ভার গুরুতে অর্পণ করিয়া যথাসাধ্য তাহার পথ ধরিয়া থাকিতে চেষ্টা করিবেন।


(৮৪) গুরু ভিন্ন এ জগতে আত্মীয় আর কেহ নাই। গুরু সর্ব্বদা রক্ষা করেন, অতএব গুরুর প্রতিপোষক হইয়া শুচি থাকিবেন। অন্যথা করিবেন না। সংসার মায়া জালে ব্যাপ্ত, চরাচরে মোহপাশ ঘুরিতেছে, আপাততঃ মধুর পরিণামে বিষোপম হইয়া থাকে।
সত্য হইতে বল নাই।
ত্যাগ বই আর ধর্ম্ম নাই।
গুরু বাক্য বই আর বেদ নাই।
গুরুর বাক্য পালন বই আর কর্ম্ম নাই।
গুরুর দয়া বই আর ধন নাই, মুক্তিও নাই।
(স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্ম্মো ভয়াবহঃ – ভগবৎ বাক্য)
মুনিভিঃ পন্নগৈর্ব্বাপি সুরৈর্ব্বা শাপিতো যদি, কালমৃত্যুভয়াদ্বাপি গুরু রক্ষতি পার্ব্বতি।
এই কথাটি মনে রাখিলে কোন কুহক প্রলোভনে পড়ে না, ঘরে বসিয়া সমস্তই পায়।


(৮৫) সর্ব্বদা নাম করিবে, নামেই সকল অভাব দূর করে, মনকে স্থির করিয়া দেয়।


(৮৬) সর্ব্বদাই গুরুর নিকটে থাকিতে লালসা রাখিয়া, তাহারই নিকটে তাহারই বাঞ্ছিত অবস্থায়, তাহারই কোলে ছোট ছেলেটির মত সর্ব্বদা বসিয়া আছেন এরূপ কল্পনা করিতে চেষ্টা করিবেন। তাহার রক্ষিত জনের ভয় কি ?


(৮৭) সর্ব্বদাই ভগবানের দিকে লক্ষ্য রাখিবেন এবং নাম করিবেন।


(৮৮) সর্ব্বদা অনাসক্ত হইয়া উপস্থিত কার্য্য কর্ম্মাদি সম্পাদন করিবার চেষ্টা করিবেন। বাজে অনিত্য, ক্ষণস্থায়ী সুখজনক গোলমাল না করিয়া গুরুর কার্য্যে রত থাকিবার জন্য নিয়ত চেষ্টা করিবেন। পবিত্র আত্মাকে ছাড়িয়া অনিত্য অসুখকর ক্ষণসুখের দিকে লক্ষ্য রাখিবেন না। সকল বেগ সতত সহ্য করিয়া থাকিতে চেষ্টা করিবেন। কাহারো দোষ গুণ লইবেন না, পক্ষপাত দোষে আত্মার মলিন জন্মে অহংজ্ঞান কর্ত্তৃত্বহেতু হইয়া থাকে। কর্ত্তৃত্বাভিমান ছাড়িবার জন্য মনে বিচার করিয়া আত্মার সঙ্গে নির্ম্মলভাবে আত্মারই কর্ত্তার অধীন হইয়া থাকিলে নিত্যমুক্ত হইয়া পরিণামে শ্রীগুরুর পদ পাওয়া যায়। হৃদয়ের সংশয় ছেদন করিয়া সবল হইয়া থাকিলে অপার আনন্দ তাহাকে অধিকার করে।


(৮৯) মনকে সর্ব্বদা সবল রাখিবেন। মন স্থির হওয়া মাত্রই ভগবৎ পদ সাক্ষাৎ হয়। বাসনায় মনকে চঞ্চল করিয়া ফেলে, শান্তি অশান্তি তাহাতেই হয়। সর্ব্বদা গুরুর উপর ভার দিয়া সংসার চালন কার্য্যেতে থাকিবেন। সময় করিয়া গুরুই উদ্ধার করিবেন।


(৯০) কর্ম্মফল কখনো নষ্ট হয়না। সংসার মায়ার দ্বারা বিবর্ত্তন হইলেও কর্ম্মফল ভোগ করিতেই হইবে। এমন কোন স্থান নাই যে পুন্ডরীক চক্ষে প্রকাশ নাই। মন বুদ্ধি জ্ঞানাদি ভাবের দ্বারায় সেই চক্ষু প্রকাশমান হইয়া থাকায় তাকে ছাড়া কোথায় স্থান পাইতে পারে যে তাহার অগোচর হইবে? ধর্ম্ম, কর্ম্ম সম্পদ যাহা জগতে উদয় অস্ত হইতেছে সম্বন্ধন দ্বারা বিশিষ্ট রূপে দেদীপ্যমান থাকিতে কোনরূপ মলিন হইবে না। এই সংসার মায়ার চক্রে যে যেভাবেই বুঝুক সে সে ভাবেই প্রত্যক্ষতা লাভ করিবে সন্দেহ নাই। সত্যং সত্যমেকং ভগবানস্তু।


(৯১) সকল ভারই গুরু বহন করিতেছেন, করিবেন। তজ্জন্য চিন্তা করিবেন না। যাহা পারেন করিবেন, যাহা পারেন না করিবেন। সর্ব্বদা তাঁহার পদে অনন্য মতি রাখিবার চেষ্টা করিবেন।


(৯২) মনের সুখদুঃখ দুইই বন্ধন, হিতাহিত শক্তি আবৃত থাকে। মনের নাশে ইন্দ্রিয় সুখের ভোগ হইতে অনন্ত সুখের উদয় করে, কস্মিনকালেও তাঁহার পরিবর্ত্তন হয় না। অতএব অতীন্দ্রিয় সুখের জন্য মনের(ইন্দ্রিয়ের) সুখ দুঃখ বেগ সহ্য করিতে চেষ্টা সর্ব্বদা করিতে ভুলিবেন না। ভালমন্দ, সুখ দুঃখ, শান্তিঅশান্তি কেবল ভ্রান্তি মনেরই গোচর। সকল ভার গুরুর উপর ন্যস্ত করিয়া হর্ষ, মর্ষ, পাপ তাপ, সংশয়াদি ক্রিয়া দ্বারা যথোৎপত্তি ভোগ সহ্য করিয়া সংসারের কার্য্য নিরপেক্ষ ভাবে সম্পাদন করিতে থাকিবেন, গুরুই সকল অভাব তরঙ্গ হইতে উদ্ধার করিবেন।


(৯৩) সর্ব্বদা ধীর হইতে হয়। ধীরের অভ্যাসেই সংসার ত্রাণ পায়।


(৯৪) কোন চিন্তা নাই। অভ্যাস যোগে থাকিতে থাকিতে মনের গ্লানি দূর হইয়া দেহ, মন, চিত্ত ভাব সকল পবিত্র লাভ করিয়া পরম শান্তি পাওয়া যায়। নাম চিন্তামণিঃ কৃষ্ণ চৈতন্য রস বিগ্রহঃ, নিত্য শুদ্ধঃ নিত্য মুক্তঃ অভিন্নাত্মা নাম নামিনোঃ


(৯৫) ভগবৎ যাহাতে কৃত ক্রিয়া হয়, তাহার সম্বরণের শক্তি নাই। সংসার মায়াময় বরাবরই চলিতেছে, মমতাতেই সকল অভাব ঘটে।


(৯৬) সর্ব্বদা সকল ভার ভগবানের উপর রাখিয়া নাম করিতে থাকিবেন, নামেই শুচি করিয়া উদ্ধার করেন। ভাগ্যবশতঃ সুখ দুঃখাদি ভোগ করিয়া থাকে। তাহার জন্য উদ্বিগ্ন হইতে নাই। সংসারে স্বধর্ম্মই অকর্ত্তা বুদ্ধি, এই বুদ্ধির আহরণে সকল পাপ মুক্ত হইয়া কৃতকর্ম্ম স্থির করে। বুদ্ধিস্থির করিয়া নিত্যানন্দ ধাম প্রাপ্ত দেয়। সুখে দুঃখে সমান করিয়া নিত্য আনন্দ থাকে।


(৯৭) সহ্য করিয়া থাকাই স্বধর্ম্ম। প্রারব্ধেই সকল করিয়া থাকে। সহ্যই মহৎ সুখকর পরিণাম মঙ্গল করিয়া থাকে।


(৯৮) ভগবানের শরণ নিয়া থাকিলেই পরিণামে শান্তির উপর স্থান প্রাপ্ত হয়। ইহ জগতে দেহের সঙ্গেই ভাগ্য অনুসারে ফলাফল ভোগ হইয়া থাকে। পরশ্রীতে কাতরতা কেবল মূর্খের সম্পদ বলিয়া জানিতে হয়। ভাগ্য অনুসারে শারীরিক, মানসিক সুখ দুঃখাদি আবর্ত্তন হইয়া জীবভাবে মন্ডিত থাকে। জ্ঞান অজ্ঞানের বশবর্ত্তী হয়। সংসার মায়াময়, ভগবৎ শরণে কেবল দেহ নাশেই দৈহিক, মানসিক সন্তাপাদি ভোগের দ্বারা মুক্ত হইয়া থাকে। দেহে গুণের হ্রাস বৃদ্ধি অনুসারে দেহে সহ অসহ যাতনা, সুখ দুঃখ, পাপ পুন্য, ধর্ম্ম অধর্ম্মাদি ইত্যেকার জ্ঞান জন্মে। ইহাকেই প্রারব্ধ বলে, এই প্রারব্ধ ভোগ ভিন্ন শেষ হয়না বলিয়া ঈশ্বরের শরণ নিয়া পড়িয়া থাকিতে হয়। পাপ পুণ্য ধর্ম্মাধর্ম্মে লক্ষ্য রাখিতে নাই। প্রাক্তনে যাহা হয় আছে তাহা ভোগ করিবে, দেহান্তে ভগবৎ পদ, গুরুবাক্য যাহা নির্দ্দেশ করিয়াছে তাহা পাইবে, সন্দেহ নাই। মনের শান্তি অশান্তির ধার না নিয়া অকর্ত্তা হওয়ার চেষ্টা করিবে।


(৯৯) সকল ভার ভগবানের উপর রাখিয়া সংসারের প্রাক্তন যথাসাধ্য ভোগ করিতে হয়। ভাগ্যের দ্বারে সর্ব্বদা থাকিয়া সুখ দুঃখ অন্ত করিতে চেষ্টা করিতে করিতে ভগবানের প্রতি মন নিবিষ্ট হয়। সর্ব্বদা তাঁহার চিন্তাই, অর্থাৎ ভগবানের নাম করাই জীবের ধর্ম্ম। নাম করিতে করিতে জীবের পরমত্ব থাকে না, নামেই মুক্তিপদ অঙ্ক করিয়া স্থান দেন।


(১০০) যাহা করিবে একটা স্থিরভাবে করিবে। অব্যবস্থিত চিত্তে কোনটাই হয় না, একটা ধরিয়া থাকিলেই ভাল হয়।


(১০১) সংসারোদ্ধারই ভগবানের সেবা, অনন্যভাবের দ্বারাই সেবাকার্য্য সাধিত হয়। এই সেবায় বেদবিধি লাগে না, মনের তৃপ্তিজনক উপচারে সম্পাদন হয়। এই প্রকার ঐকান্তিকভাবে নির্ভরাদি স্নেহ উপচারে সংমার্জ্জন করিতে করিতে অকৃত্রিমভাবের উদয় হয়। পরে শ্রদ্ধা, পরে ভক্তি, পরে বিশুদ্ধভক্তি, পরে প্রেমের উদয় হয়, তারপরে বিশুদ্ধ প্রেম হয়। তারপরে সেবার প্রত্যক্ষ প্রমাণ দর্শকে অনুভব করে। সেবাচারীর কোন বিশেষ জ্ঞান থাকে না, স্বভাবের তরঙ্গ খেলিয়া প্রেমের লহর উল্লাস স্ফুটিয়া চলে, এই প্রেম তরঙ্গের অবধি নাই। ইহাই ভগবৎ ভক্ত, মুক্তি সর্ব্বদা তার সেবার সাহায্য করিয়া সেবা সহিষ্ণুতা সম্পাদন করে। সর্ব্বদা সেবা করিয়া চলিতে থাক, গুরু সকল শক্তি সঞ্চারে সদানন্দ প্রকাশ করিবেন চিন্তা নাই, উদ্ধার তিনিই করিবেন।


(১০২) সংসার মায়াময়, সংসারের সকল রকম গঞ্জনা সহ্য করিয়া ভাগ্যানুসারে আয় ব্যয় স্থিতি করিয়া যায়, ইহাই পুরুষকার। দুঃখ হইবে বলিয়াই যে কর্ম্ম ত্যাগ করিবে, সুখ হইবে বলিয়াই যে কর্ম্ম করিবে, কি করিবে না, ইহা নয়। পিতা মাতা, ভাই ভগ্নী, খুড়া জ্যেঠা, মাসী পিসি, বাড়ীঘর, গ্রামবাসী, দেশবাসী, আত্মীয়, বন্ধু বান্ধব, শত্রু মিত্র, সৎ অসৎ সঙ্গ সকল ঋণগত কর্ম্মফল, ইহা সকলি ভাগ্যক্রমে প্রাপ্ত হয়। ইহাদের মধ্যে কাহার কোন দোষ নাই। ভাগ্যবশতঃ ফলাফল ভাল মন্দ ব্যবস্থা যা থাকে ইহাই ঋণবদ্ধ। এই সকলের গঞ্জনা যথাশক্তি সহ্য করিবে। যাহার যে প্রাপ্ত অংশ আছে তাহারা যে যে ভাবে আদায় করিতে পারে, সেই আদায়ের চেষ্টা করে। ইহাদিগকে ফাঁকি দিয়া বনে গিয়া কি ফল হইবে, কিংবা দেহ ছাড়িলেই বা কি হইবে? এদের ঋণ ত শোধ হইবেই না, দফে দফে চিরজন্মই ভোগ করিতে হইবে। এই গঞ্জনা সহ্য করিতে পারিবে না ভয়ে যদি জপ তপস্যা যোগ যাগ প্রবন্ধন করে তাহাতে ঋণ মুক্ত হয় না, বরং কর্ম্ম বৃদ্ধি হইয়া বন্ধনই হয়। অতএব ভাগ্যচক্রের অধীন হইয়া দিবানিশি কালোচিৎ প্রয়োজনীয় সংসারের আয় ব্যয় যথাসাধ্য ভাবে করিতে চেষ্টা করিতে ত্রুটি না করিয়া, ফল অফলে লক্ষ্য না করিয়া কর্ম্ম করিতে থাকিবে। এর মধ্যে যে কোন সময় পার ইষ্ট দেবতার মন্ত্রাদি নাম যথাসাধ্য করিবে, ইহাতেই ভজন সাধন সিদ্ধ হইয়া নিত্য মুক্ত হয়। এই যে বেগ সহ্য করিতে চেষ্টা করা ইহাকেই নিত্য তপস্যা বলে। এই ভাবে নিরপেক্ষতা করিয়া দেহ ত্যাগ করে। ইহাই সাধু, সন্ন্যাসী, ত্যাগী বলিয়া শাস্ত্রকারেরা বলিয়াছেন। সর্ব্ব শক্তিমান ভগবান সকলই সহ্য করিতে পারেন বলিয়া এবং কাহাকেও কোনরূপ উপেক্ষা করেন না, বিরক্তও হন না বলিয়া লোকে ভগবান বলে। তাঁহার ভক্তও তাঁহার কাছ হইতে শক্তি আহরণ এই ভাবেই করে। পক্ষে গেলে ভূত দ্বন্দন মায়ার বিপর্য্যয় তরঙ্গে পড়িয়া লাঞ্ছনা পাইয়া, ভাগ্যক্রমে সুখ দুঃখাদি শুভ অশুভ ভোগ করে। ভগবৎ প্রাপ্ত হয় না।


(১০৩) সর্ব্বদাই সকল ভার ভগবানে রাখিয়া সংসার তরঙ্গের অতিক্রম করিতে যে কোন একটা কর্ম্ম কার্যেরই হউক, কিংবা একটা দোকানপাঠই হউক, উপায়ের একটা পন্থা সৃষ্টি করিয়া থাকিবার চেষ্টা না করিলে বিশেষ ভাবে সংসার চলে না। কাহারো মুখাপেক্ষা না করিয়া কর্ম্মক্ষেত্রে কর্ম্ম করিতে করিতে দেহত্যাগের পর আর দেহ পাইতে হয় না, ভগবানের নিকট নিত্য পরিষদ হইয়া থাকা যায়।


(১০৪) ভগবৎ দাস সমীপে সর্ব্বদাই ভগবান থাকেন। (পাদমেকং ন গচ্ছতু) ক্ষণকাল ও ত্যাগ করিয়া যান না।


(১০৫) স্বভাবে প্রাক্তন যাহা আছে সর্ব্বদা ভোগ করিতে কুন্ঠিত হইতে নাই। (ভাগ্যং সর্ব্বত্র বলবর্ত্ততে) চিন্তার অসীম শক্তি। যাহা যতদূর চেষ্টার সাহায্যে লাভ করিতে পার তাহাই সন্তোষ লাভে বঞ্চিত হইবে না। যাহাতে কপাল ঠুকিয়া সহিষ্ণুতা আনিতে পার তাহাই ভাল।


(১০৬) যত সময় পার আপ্ত চিন্তায় মগ্ন হইবে। তারপর যখন যে কর্ম্মের দরকার উপস্থিত হইবে, যথাসাধ্য করিবে। সর্ব্বদা নামে নির্ভর করিয়া থাকিবে, নামই সকল পাপ হইতে নিষ্কৃতি করিবেন। ধৈর্য্য ধারণ করিয়া স্থির বুদ্ধির আশ্রয় করিতে হয়। চঞ্চলতা করিলে বুদ্ধি চিন্তাদিতে বিক্ষেপণ থাকে, নানান উৎপাত উপস্থিত হয়। সর্ব্বদাই স্থির হইয়া থাকিতে চেষ্টা করিবে।


(১০৭) যখন তাঁর উদ্দেশ্য যাহা দেওয়া যায়, তৃপ্তির সহিত গ্রহণ করিয়া থাকেন সন্দেহ নাই। কালচক্রে আচ্ছন্ন থাকা প্রযুক্তই দেখিতে এবং প্রত্যক্ষানুভূতি করিতে কর্তৃত্ত্বদশায় হয় না। এজন্যই অকর্ত্তা, অনাথা, অনাশ্রয়, আর্ত্তবুদ্ধি জন্মিলে ইহা সম্যকরূপ প্রতিফলিত হয়। প্রেমের ভাবে অনন্য ঔদাসিন্য প্রযুক্ত ভগবানের সমস্ত বিশেষ তত্ত্ব জানিতে পারে। অতএব, শ্রদ্ধা পূর্ব্বক ভক্ত যাহা দেয় তাহাতেই ভগবানের প্রীতি ঘটে।


(১০৮) ভগবান পদ পাইবার জন্য কর্ত্তৃত্বাভিমান মতে কোন প্রার্থনা রাখিতে হয় না। অদৃষ্টক্রমে কর্ম্মসূত্র দ্বারা যে রকম সমাজেই যে অবস্থা আবরণে পড়িয়া জন্ম পাইতে হয় তাহাতে বিরক্ত না হইয়া, সহিষ্ণুতা দ্বারা সর্ব্বদা ভগবৎ চরণে মতি রাখিয়া লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, পিতা মাতা সম্বন্ধীয় যাবতীয় বেগ সহ্য করিতে করিতে, ভগবানের নাম করিতে করিতে দেহরূপ হইতে মনের সকল অভাব মোচন হইয়া যাইবে। তারপর আর কোন বাঁধা থাকিবে না, তখন পরম আনন্দরসে ভাসিতে থাকিবে। ভগবান কৃপা করিলেই তাহার উপর নানা ঝঞ্ঝাট উপস্থিত হইয়া থাকে। ইহাই মঙ্গল জানিবে। যথাসাধ্য আত্মীয় স্বজনের আচারে দ্বারা বিরক্ত না হইয়া তাঁহাদের তৃপ্তির জন্য চেষ্টা করিবে। যাহা যখন সময় পাইবে, নাম করিবে। এতৎভিন্ন যত পারিবে মনে মনে ভগবান নিকটে আছে এই চিন্তা করিয়া নাম করিবে। ইহাতেই ভগবানের নিকটে যাইবে।


(১০৯) কৃষ্ণ কেমন ? যার মন যেমন। কাঁচের আয়না যারে দর্পণ বলিয়া জান, সেই আর্শির নিকট যে যে ভাবের প্রকাশ হয় সেই ভাবেই ভাল মন্দ প্রকাশ হইয়া থাকে। সূর্য্যকে মেঘে আচ্ছন্ন করে তাহাতে সূর্য্যের কি হয় ? যদি কাহারো প্রতি রুষ্টতা বর্ষণ হইয়া থাকে, তাহা তাহার চশমার কাঁচের রঙ্গের তারতম্যতা হেতু জানিবে। যেমন ভাবিবে সেই রকমই প্রকাশ হইবে, ইহাতে ভয়ের বিষয় কি হইতে পারে ? একমাত্র ভগবানের নিকট নিরপেক্ষ ঘর, সহিষ্ণুতার দ্বার। এই ভিন্ন সংসারের তাড়নার দায় হইতে মুক্তির আর উপায় নাই। অতএব ভগবানের দাসত্ব করিতে থাক। সমান জ্ঞান করিয়া লইতে হইবে।


(১১০) প্রারব্ধের কর্ম্ম যাহা ভাগ্যে ফলিত হয় তাহার দিকে লক্ষ্য করিয়া বিশেষ ফল নাই। দিবানিশি হরির নামে রত থাকিলে আপনা হইতেই তিনি উদ্ধার করিয়া থাকেন। ন্যায় অন্যায় লোকের দেখিবে না। আপনার ভাগ্যেই সকল ভাল মন্দ জুটিতেছে। কাহারো ভালো মন্দ কেহ দিতে পারে না, সকলি ভাগ্য, অতএব দিবানিশি হরির নামই সত্য।


(১১১) মূল দেবতার অর্চ্চনা করিলে তাহার সাঙ্গপাঙ্গ সকলি তৃপ্ত হইয়া থাকে। আড়ম্বরাদি কার্য্যে অখুত সম্পাদন হয় না। কেবল বিশুদ্ধ ভক্তি দ্বারাই ভগবানের তৃপ্তি হয়, ঐশর্য্যাদি অহঙ্কারের বাধ্য নয়। মায়াময় সংসারে ঐহিক বৈভবেই মত্ত মাধুর্য্য রসের অভাব থাকায় ভজন সাধনে কৃপা উপলব্ধি হয় না, বিশুদ্ধ ভক্তির প্রয়োজন। মাধুর্য্য রস ভিন্ন ভগবান লাভ করিতে পারে না। ভগবৎ প্রেমই পরমপদ, কর্ত্তৃত্বাভিমানে জীব সকল সংসার সাগরে ভাসিয়া বেড়ায়। দিবানিশি নাম করিবে। ভগবানের নাম রূপ সতত চিন্তা করিলে দেহ, মন, বুদ্ধি বিশুদ্ধ হইয়া ভক্তি প্রকট হয়। বিশুদ্ধ ভক্তি লাভ হইলেই প্রেম লাভ হয়, সেই প্রেমেই কৃষ্ণচন্দ্র মিলন ঘটে। উৎসব কি সভার মধ্যে তিনি থাকেন না।


(১১২) সংসারের চেষ্টাই পরম ধর্ম্ম, অহঙ্কারের জন্য মুগ্ধ হইতে নাই। নিরপেক্ষভাবে ভাগ্য বলবতী করিয়া যে কোন কার্য্যই হউক একটা উপায় উপজীবিকাবাহনের জন্য করিতেই হইবে। মনোযোগের সহিত যাহা করিতে পার করিবে, চঞ্চলতা করিলে হইবে না। সত্য সংসারের দিকে যথাশক্তি লক্ষ্য রাখাই উচিৎ। “লেগে থাকলে মেগে খায় না।” মনোযোগের সহিত সকল কর্ম্ম করিয়া যথাসাধ্য সময় পাইলে হরিনাম করিবে। আর নচেৎ, এক প্রকার সমস্ত ছাড়িয়া, লেগে পড়ে দিনরাত খেটে অনুরাগ বাড়াইয়া হরিনাম করিতে থাকিবে। সেবাপরায়ণ হইয়া ইহাতে খাওয়া জুটিতে পারে। সাধুমন্ডলী নিয়া থাকিলেও হয়। এই প্রকার একদিকে ঝুঁকিয়া পড়িলেই সংসার মুক্ত হইয়া থাকে। যখন যে রকম পারিবে ভগবানের নাম করিবে, তাঁহার চিন্তাই সর্ব্বদা করিবে এবং যথাশক্তি চেষ্টার দ্বারায় সংসারের সেবার জন্য কিছু অর্থের পথ করিয়া লইবে।


(১১৩) একূল ছাড়িয়া সুখের ঘর,
দুঃখের সাগরে করিতে সাঁতার,
তরঙ্গ চারিতে ভাসিতে ভাসিতে,
ডুবিয়া ডুবিয়া লইল দুঃখের বোঝা।


(১১৪) সংসার মায়াময়, সকলি অস্থায়ী সম্পদে মাতিয়া হিতাহিত পরিচর্য্যাশালী হইয়া নানান অভাবের সৃষ্টি করিয়া তোলে, সর্ব্বদাই অভিমানের দ্বারা আহত কন্টক গলায় বান্ধিয়া লয়।


(১১৫) স্বভাবেই সকল শান্তি দিবে। দুঃখ হইবে বলিয়া কর্ম্ম ত্যাগ করিতে, কি লাভের জন্য কর্ম্ম করিতে হইলে কর্ম্ম ছাড়ে না। উভয় বেগ বহন করিতে করিতে কর্ম্ম ক্ষয় হয়। সকল বেগ সহিষ্ণুতাই ধর্ম্ম কর্ম্ম সমাধি হয়।


(১১৬) ভগবানের উদ্দেশে থাকিয়া নির্ভর সূত্রে সকল শান্তিই পাওয়া যাইতে পারে।


(১১৭) “ভাগ্যং ফলতি সর্ব্বত্র” – শ্রুতি বাক্য।


(১১৮) পতিব্রতা ধর্ম্ম আচরণে সকল অভাব দূর হইয়া থাকে, পতিসেবার ভগবানের প্রকাশ হইতে পারে।


(১১৯) ভগবানের উপর সকল ভার রাখিয়া কার্য্যক্ষেত্রে কার্য্য করিতে থাক। তাঁহার বিচার সুক্ষ্ম।


(১২০) ইচ্ছা করিলে কি হইবে, প্রাক্তন ভাগ্যফলকে কে খন্ডন করে ?


(১২১) এ সংসার মায়াময়, কেবল ভ্রান্তিমূলক। সর্ব্বদা ভগবানের উপর নির্ভর করিয়া ভাগ্যফল ভোগের দ্বারা ভোগ ত্যাগ করিয়া নিত্যানন্দ পদ লাভ কর। ভগবান ব্যতীত এ জগতে আর আত্মীয় দ্বিতীয় কেহ নাই। এই চিন্তা হৃদয়ে উৎকর্ষণ করিয়া সর্ব্বদা ভগবৎ সেবায় যত্ন শিক্ষা করিতে করিতে নিত্যশক্তির উদয় করিয়া ভক্তি গাঢ় হইতে পারিবে।


(১২২) সংসার মায়াময়, সুখ দুঃখের আবরণ, প্রারব্ধ ভোগের গতাগতি। সর্ব্বত্র সমবুদ্ধি রস সাগর পূর্ণ হয়। প্রারব্ধে যাহা করেন তাহার প্রতিবন্ধক জগতে কি আছে? ভগবানের উপর সকল ভার রাখিয়া উপস্থিত কর্ম্ম সকল উপভোগে নির্লিপ্ত থাকিয়া কর্ম্ম করিয়া যাইবে, ভগবান সকল ভাল মন্দ তরঙ্গ হইতে উদ্ধার করিয়া লইবেন।


(১২৩) পিতাপুত্রাদির প্রতিপোষণে আত্মীয় প্রতি মমতার সম্পাদনের জন্য দৈহিক কি মানসিক কষ্ট আসিতে পারে না।


(১২৪) প্রারব্ধের দাস হইয়া থাকিতে হইলে ভাগ্যের ফলাফল ত্যাগ করা যায় না।


(১২৫) নাম আর রূপ ভিন্ন হইতে পারে না। যেখানে নাম উদয় হয় সেখানেই রূপের উপস্থিত জানিবেন।


(১২৬) স্বভাবই ভাল থাকা, অভাবই মন্দ। অভাব পূরণ জন্যই যাওয়া আসা বর্ত্তিয়া থাকে।


(১২৭) পত্রদ্বারা সংবাদ প্রতিলব্ধ হয় না। ভ্রান্তিঃবশত পত্রের প্রতিক্ষা করিয়া থাকে, মনে থাকিলেই সতত সংবাদ পাইয়া থাকে।


(১২৮) হরি নামই সত্য, হরি নামে সকল আনন্দ বিতরণ হয়।


(১২৯) অদৃষ্ট চক্রের উৎপন্ন দেহ, ইহার উপর কোনই কর্ত্তৃত্ব নাই। প্রারব্ধ সূত্রে আকৃষ্ট থাকে, তাদের যাহা ধর্ম্ম তাহাই করে।


(১৩০) ভগবানের রাজ্যে সুখ দুঃখ, শান্তি অশান্তির তরঙ্গ নাই। অনুভূতি যাহা লোকে সাধনাদি সূত্রে লাভ করে তাহা কেবল গুণের বন্টন অবস্থা, তরঙ্গ মাত্র। সত্ত্বগুণের আধিক্যে সুখ অনুভূতি, রজগুণের আধিক্যে চঞ্চল নানান চেষ্টা কর্ম্ম করার ইচ্ছা, তমগুণের আধিক্যে নানান অভাব বিষাদ প্রমাদ নানান অশান্তির উৎকর্ষণ করিয়া থাকে। অতএব সর্ব্বদা নির্ধূত গুণাতীত গুরুবাক্যে আস্থা করিয়া থাকিলে ক্রমে ক্রমে গুণ সকল আপন বশবর্ত্তীতে আসিয়া পরমপদ ভক্তির সঞ্চার করিয়া থাকে। ভগবানের নিকটেও অভাবাদি গুণ হইতে যাহা হয় তাহা ভগবানকে নিয়াই খেলা করে।


(১৩১) মন্ত্রাদির প্রতীক্ষা করে না, ভক্তি প্রেম শ্রদ্ধা হইতেই সেবাকার্য্য সম্পাদন হইয়া থাকে। ঐশ্বর্য্যাদির উপচারদিগকে প্রয়োজন করে না। গুরুর কৃপা ভিন্ন আনন্দ হৃদয়ে সঞ্চালন হয় না। স্বয়ং কর্ত্তৃত্বাভিমান সমস্যা পূরণ করিয়া দক্ষ প্রজাপতিও কোন যজ্ঞ সমাধান করিয়া উঠিতে পারেন নাই, মানবের কথা কি? জপাদি কর্ম্ম করিতে হইলেও ত কর্ত্তৃত্বভাবের পোষণ হয় না। সংসার নাটের তরঙ্গ হইতে মুক্তি লাভের জন্য সদ্ অসদ্ বিচার রহিত একাদেশ দৃঢ়তার রঞ্জনে পরিপক্কতা হয়। এই মাত্র শরণ নিয়া থাকাই পরমানন্দের গর্ভে ক্ষেপণ করিয়া থাকে। যাহা যখন পার করিবে, মনে রাখিবে আমার একজন উদ্ধারের কর্ত্তা এই প্রাণরূপে সর্ব্বঘটে সমান সত্ত্বায় বাস করেন।


(১৩২) ভগবান আপনার পরিণাম নিত্যমুক্তের বিধান স্থাপন করিয়াই নিত্য সত্ত্বা লাভের আশীর্ব্বাদযুক্ত ভক্তি প্রদান করেন। তাহাই সর্ব্বদা জাগিয়া থাকে এবং নিত্যলক্ষ্যে রাখে। প্রাক্তনীয় শরীরের ঋণগত ভগবানের উদয়াস্ত যজ্ঞভাগ ভোগ করিতে কোন বাধ দেয় না তাতেই মনের বুদ্ধির চাঞ্চল্য ঘটিয়া থাকে।


(১৩৩) এই শরীরটি যাদের, তাহারা যেমন ভাবে সাজাইয়া সুখী হয় সেই রকমেই রাখে। যতদিন তাদের ঘরে থাকা যায় ততদিন তাদের কর্ত্তৃত্ব লুপ্ত করিবার ক্ষমতা নাই।


(১৩৪) সকলি প্রারব্ধ জানিবে। প্রারব্ধকে মান্য করিতে হয়। ইচ্ছার দ্বারা কিছুই হইতে পারে না। কামাদি রজগুণের তরঙ্গ মাত্র, স্থির বুদ্ধির সাহায্যে সেই গুণের চঞ্চলতা কমাইয়া পরমানন্দময় নিত্যধাম প্রাপ্ত হইতে পারে। সর্ব্বদা ভগবানের সেবার অনুসরণে থাকিতে চেষ্টা করিবে।


(১৩৫) পতিব্রতা ধর্ম্মে পূর্ব্বাপর ভাল মন্দ বোধ রাখা ঘটে না। জগতে সকলি ভাল মন্দ দুইটি ভাব মাত্র। ইহাই দেবাসুরত্ব, জীবের উপর আধিপত্যে নিত্য নিযুক্ত হইয়া রহিয়াছে। সুখ দুঃখ মনেতে খেলে বলিয়াই আশঙ্কার উৎপন্ন হয়, তদ্বারাই ভয় অভয় প্রদানের প্রচলন হইয়া থাকে। এক কথায় দুঃখ পায়, অপর কথায় সুখ হয়, ইহা একই ভাব। ঘুমাইলে বোধ থাকে না, জাগিলে সকলি বোধ হয়, বোধ আর অবোধ একই।


(১৩৬) সংসার মায়াময়, অনন্ত শক্তির পরিচর্য্যায় চালিত হয়। স্বাধীনতা কিছুই নাই।


(১৩৭) এ সংসারের শাস্ত্রাদিতে সকলি ব্রহ্ম সূত্রকে ধারণ করাই যে কর্ত্তব্য তাহাই প্রকাশ করিয়াছে। এমতাবস্থায় জীবভাবে কোন কর্ত্তৃত্বাধীনে কোন কার্য্যক্ষম হইতে পারে না বলিয়াই অকর্ত্তা হইতে সকল শাস্ত্রেই প্রকাশ করিতেছেন। তবে চিন্তার কারণ কি? কর্ম্মানুসারে যাহা ফল উৎপন্ন হয় তাহাতে বিরক্ত কি হর্ষ করিতে নাই, কারণ কর্ম্মফলেই বৃদ্ধি জন্মায়। গুণের দায়িত্ব শেষ হয় না, কেবল উপর্য্যুপরি বৃদ্ধিই হইতে থাকে। অতএব নিঃসংশয়ের সহিত যথাসাধ্য অনন্য হওয়ার জন্য সর্ব্বদা ভগবানের উপর নির্ভর রাখিতে চেষ্টা করিবে। এই ভগবানের সঙ্গে থাকিতে থাকিতে হৃদয় নির্ম্মল হইয়া আনন্দ পাইবে। কর্ম্মফল যাহা সুখ দুঃখ শান্তি অশান্তি ভালমন্দাদি যে সকল দ্বন্দ্বর্জ প্রকৃতিগুণের দ্বারা সমাবৃত হয় তাহা ক্ষয় হইয়া যাইবে। ভগবানই নিত্য, তাঁহার সঙ্গীও নিত্য সংশয় নাই। যখন যার সঙ্গ পাওয়া যায় নিত্য অনিত্য ভাবে তাহাই যখন নিত্য অনিত্য ভোগ হইতেছে তবে কেন নিত্য সঙ্গে নিত্য হইবে না? দ্বন্দ্ব বুদ্ধির দ্বারাই নিত্যানিত্য বিবেক অবিবেক বিচার ঘটে, নির্দ্বন্দ্বজে তাহা থাকে না। যাহা হউক, কোন চিন্তা না করিয়া প্রারব্ধ দন্ড ভোগের দ্বারা ভোগ সহিষ্ণুতা করিয়া দন্ডহীন হইয়া পরম শান্তিময় পরাভক্তির পরম সাধ্যপদ লাভ করিবেন। যাহা কিছু লাভ লোকসান সংযোগ হয় তাহা সকলি প্রারব্ধ মাত্র।


(১৩৮) হৃদয়ের অনুভূতি যাহ সকল সুখ বোধ হয় তাহাও ভ্রান্তি। অনন্য কর্ম্মের দ্বারাই ভগবৎ পরাভক্তি লাভ করে, অনুভূতির মধ্যে নাই।


(১৩৯) প্রকৃতির গুণ হইতে জাত কর্ম্ম দ্বারা ভাগ্যবশতঃ লাভ লোকসানাদি শুভাশুভ আবরণে সুখ দুঃখ ভোগ করিয়া থাকে। সে সকলি অনিত্য প্রারব্ধের দ্বারায় সকল সময়ে সম্ভব হইয়া থাকে। ভবিতব্য বশতঃ যোগ মিলনাদি কর্ম্ম সম্পাদন হয়, ইহা কাহারো কোন চেষ্টায় সম্ভব হয় না।


(১৪০) অচিন্ত্য সত্ত্বার আশ্রয়ই পরম ধর্ম্ম।


(১৪১) উপস্থিত সময়ে যে যে ভাবের আবরণে পড়ে, সেই সেই ভাবেই তৃপ্ত থাকিয়া কর্ম্ম সকল সম্পাদন করিতে হয়। কর্ত্তা অভিমানী হইলেই পাপ পুন্যের ভাগী হইতে হয়।


(১৪২) ভগবানের কর্ম্ম করিতে কোন চেষ্টা করিবার দরকার হয় না। তাঁহাকে পাওয়াই দরকার এই ভাব হৃদয়ে জন্মিলেই প্রাপ্ত হইয়া থাকে, বেদ বিধিতে পায় না।


(১৪৩) সংসারের কার্য্য রীতিমত করিতে করিতে অনাশক্ত ভাবের দ্বারা শান্তিময় কর্ম্ম শেষ করিয়া পরমানন্দ নিত্যধাম পাইয়া থাকে। ইহার সাধন ভজন আর কিছুই নাই, কেবল মাত্র প্রারব্ধ ভোগ সহ্য করিয়া যাইতে হয়।


(১৪৪) সর্ব্বদা যথাসাধ্য সত্যভাবকে আনয়ন করিবে, কঠোর করিবে না।


(১৪৫) শরীর সুস্থ না রাখিলে চিন্তাশক্তির অভাব হয়। মনের স্থির করিতেও অশক্ত ঘটে। শান্তির অভাব হয়। নিয়ম লঙ্ঘনই পাপ, সর্ব্বদা ভগবানের নিকট থাকাই শান্তি।


(১৪৬) প্রারব্ধের জন্য উৎকণ্ঠা রাখিতেে নাই, সকল অবস্থার ভোগ গ্রহণ করাই পরমপদ।


(১৪৭) অদৃষ্ট চক্রে যখন যাহা উপস্থিত হয় তাহাতেই অকাতরে সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি করাকেই মহাত্মাগণ ভগবৎ উপাসনা বলিয়া নিশ্চয় করিয়াছেন। যজ্ঞ, ব্রত, তপ, দান একমাত্র সহিষ্ণুতা ধৈর্য্য শক্তিতেই সম্পাদন হইয়া থাকে। সমোহহং সর্ব্বভূতানাং ন মে দ্বেষ্যঃ ন প্রিয়ঃ, সকল অবস্থায়ই যে সমান জ্ঞান তাহাই ভগবান। এই অবস্থা যখন উদয় হয় তখন জীব মুক্তি লাভ করিয়া স্বরূপত্ব ধারণ করিয়া থাকে। ইহ ব্যতীত কর্ত্তৃত্বাভিমানীর সঙ্কল্প বিকল্পাদি দ্বারা সাধন ভজন করিয়া নিত্য সুখের আশা অবতারণ করিয়া পরিণাম কেবল অভাব(অমিল) অভিযোগ ঘটিয়া থাকে। তাতে আশু যে শান্তি লাভ করিতে পারে তাহা কেবল হারাইয়া দুঃখেরই কারণ হইয়া থাকে। উভয়ই প্রাক্তন দত্ত জানিবে। অতএব সর্ব্বদা ধর্ম্ম ধারণের চেষ্টা করাই উচিৎ।


(১৪৮) জীবের জন্য কর্ত্তৃত্ব, কর্ম্ম, কর্ম্মজনিত ফলাফল, কি পাপ, কি পূণ্য কিছুই সৃষ্টি হয় নাই। অজ্ঞানতাবশতঃ এই সকল কার্য্যে প্রবৃত্ত হয়। এই ভ্রান্তিই সংসারে বদ্ধ হওয়ার কারণ হয়। নিরপেক্ষ, অচিন্ত্য, অকর্ত্তা হইয়া থাকিতে থাকিতে নিত্যমুক্ত হইয়া যায়। অতএব সুখ দুঃখরূপ কর্ম্মফল যাহা উদয় হয় তাহা সহিষ্ণুতার দ্বারায় নিত্য ভোগের চেষ্টা করিতে করিতে সহিষ্ণু শক্তি পরিবর্দ্ধন হইয়া পরমানন্দ শান্তির আশ্রয় লাভ হয়। নচেৎ কর্ম্ম করিয়া যাহা লাভ, লোকসান, সুখ দুঃখাদি প্রাপ্ত হয় তাহাতে কেবল বন্ধনই হইয়া থাকে, মুক্তি হইতে পারে না, কারণ বাসনা থাকিয়া যায়। যজ্ঞ, ব্রত, তপ, দান জপাদি তীর্থ সেবন হইয়া থাকে তাহাতে কর্ম্ম সমাধা হয় না, অবশিষ্ট থাকিয়া যায়। যাহা হউক, দিবা নিশি নিরপেক্ষ, নির্দ্বন্দ্বজের সমাশ্রয়ে থাকিয়া সর্ব্বদা উপস্থিত কর্ম্মজনিত ফলাদির বেগ সহ্য করিয়া যাইতে থাক, তাহা হইলেই কালেতে আত্মস্বরূপ প্রাপ্ত হইবে সন্দেহ নাই। ভ্রান্তিবুদ্ধির সাহায্যে যাহা লাভ হয় তাহাও ভ্রান্তই হইয়া থাকে। যেমন বৃক্ষ তেমনই ফল হইয়া থাকে তাহার ব্যতিক্রম হয় না।


(১৪৯) জগতের কিছুই প্রয়োজন ঘটাইতে চেষ্টা করিতে নাই, কোন প্রার্থনা করিতে নাই। সকলি ভগবান প্রত্যক্ষরূপ সর্ব্বদা দৃষ্টিগোচর করিয়া রাখিতেছেন, এমতাবস্থায় প্রয়োজন যাহা যাহার উপস্থিত হয় তিনিই তাহা করিয়া লন, কোন অভাবই রাখেন না, এই ভগবানের স্বভাব। অতএব, তাঁহার শরণে সর্ব্বদা লিপ্ত থাকাই প্রয়োজন করিতে হয়।


(১৫০) ভগবানের নিকট বুদ্ধি থাকিলেই সমস্ত কার্য্য পূর্ণ হয়। মন বিষয়ে লিপ্ত থাকে, তাকে স্থির করিবার চেষ্টা অনর্থক। মনকে স্থির করিলে মাত্র দেবতাদির সঙ্গ সিদ্ধি হয়, আত্মার উদ্ধার হয়না, কারণ মনের দ্বারাই কল্পনা জল্পনা হইয়া থাকে। গতাগতিই স্বভাব, কাজেই গতাগতি ঘ‌োচে না। এই জন্যই জ্ঞানের সঙ্গে থাকিতে চেষ্টা করিতে হয়। জ্ঞানেই পাপ পূণ্য সুখ দুঃখ হইতে মুক্ত করে। আত্মার উদ্ধার হয়। সংসার আসা-যাওয়া হয় না। অতএব, অচিন্ত্য অব্যক্ত রূপ স্থির অবস্থাকে সর্ব্বদা শরণ পথে রাখিতে হয়।


(১৫১) কালচক্রের প্রাক্তনাদি ভোগের অবসানে দেহ বিচ্ছেদ সাধন হইয়া থাকে। কালক্রমে সংসারের যোগ বিয়োগ ঘটে, কালই সংসারের ভার বহন করিতেছে। ভাগ্যবশতঃই সকল বিষয় উপস্থিত করিয়া পুনরায় অবসারণ করিয়া থাকে। কালই সকল করিবে, জীবের কোনও শক্তি নাই, ভোগ দন্ডই জীব পক্ষের অধিকার। এই জন্য চিন্তা করিবে না। আপনার কর্ত্তৃত্বের দ্বারা দুঃখই ঘটিয়া থাকে। এমতাবস্থায় ভাবনার কি আছে ? নিমিত্তমাত্র হইয়া থাকিবেন, কালই সমস্ত করিবে।


(১৫২) পতিব্রতার সত্যতা প্রভাবে কোনটারই অভাব থাকিতে পারেনা। সত্য ধর্ম্ম সত্য পরা ভগবান নিত্য নিকটস্থ থাকিয়া অকপট শক্তি দান করিয়া পতিব্রতার রক্ষা সাধন করিয়া থাকেন ইহা বেদজ্ঞ ঋষিগণের আঢ্য প্রতিজ্ঞা, সন্দেহ নাই। পতিব্রতার স্বধর্ম্মপালনে নিত্য উন্মুখ থাকিয়া কাল যাপন করেন। এক সত্যং পরম ধীমহি। পতিব্রতা ধর্ম্ম সামান্য সুখের লোভে নাশ করিয়া অভাব সাগরে ভাসিতে নাই। সত্যই সকল অভাব নাশ করিয়া থাকে, ঐশ্বর্য্য বৈভব ধনজন রত্নাদি কেবলমাত্র পতি ধর্ম্মের ব্যাঘাত কারণ।


(১৫৩) অদৃষ্টের চক্রেই ফলাফলে সুখ দুঃখ লাভ লোকসান প্রতিপন্ন করায়।
নিত্য মুক্তের জন্য সততই ব্যস্ত থাকা উচিৎ। যখন আপন বলিতে আপন শরীরেরই অস্তিত্ব দেখা যায় না, তখন মিছামিছি কায়ার সম্বন্ধে পিতা পুত্র স্বামী সম্পদ কিছুরই অস্তিত্ব থাকিতে পারে না। কেবল মাত্র আপনাকে অর্থ নির্ব্বাসনা সূত্রেই মুক্ত করিতে পারে। তজ্জন্য কর্ম্মকান্ড প্রভৃতির প্রতি মনোযোগী না হইয়া আত্মার উদ্ধার চেষ্টা করিলেই ভব তরঙ্গ মুক্ত হইতে পারিবে।


(১৫৪) সর্ব্ব অবস্থায়ই অচিন্ত্যরূপ প্রাণের শরণ নিয়া থাকিলে সর্ব্ব সঙ্কটকর সংসার হইতে মুক্তি পায়। প্রকৃতি গুণের বশবর্ত্তী হইলে গতাগতি ঘুচে না। অতএব, সর্ব্বরকম সাধন কর্ম্মে না লোভ রাখিয়া শুদ্ধ গুরুর বাক্য পালনে যত্নশীল হইতে চেষ্টা করিবে, পরিশিষ্ট শান্তিই ভোগ হইবে, অন্য চিন্তা করিবে না, উপস্থিত বাসনার বেগ সহ্য করাই ধর্ম্ম। বাসনার অনুশীলন করিতে নাই, মাত্র গুরুর আদেশ পালনই করিবে।


(১৫৫) জগতে হ্রাস বৃদ্ধির তরঙ্গ দ্বারা ভ্রান্তিমূলক অসত্য অস্থায়ী চিহ্ন দ্বারা মায়াজাল বিস্তার করিয়া জীবগণকে মোহগর্ত্তে আকৃষ্ট করিয়া থাকে। ইহাকেই বদ্ধজীব বলে। এই জন্য ভগবান নিত্যস্বরূপ সহ্য ভাবকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করিয়া “বলং বলং বাহু বলং” ধ্বনি সঞ্চার করিতেছেন একমাত্র ভগবানই সত্য ও স্থায়ীরূপে ত্রিলোক ও লোকাতীতে বিচরণ করিতেছেন। জাগ্রতরূপে সর্ব্বতোভাবে চৈতন্যদান করিয়া থাকেন। কর্ত্তৃত্বাভিমান বশতঃ তৎ প্রকৃতির বিনাশ থাকে না বলিয়াই সুখ-দুঃখাদির দ্বারা পরম চেষ্টার বৈগুণ্য করিয়া তোলে। যাহা হউক পতিব্রত ধর্ম্ম পরমানন্দ আচ্ছন্ন করিয়া রাখে, পরিশেষ পবিত্র করিয়া দেয়। চিন্তা নাই।


(১৫৬) গতস্য শোচনা নাস্তি। যখন যে অবস্থায় প্রাক্তনে ফেলে তাহার ভোগ শেষ হইলে থাকে না। তদ্বিষয়ে প্রারব্ধই চঞ্চল করিয়া শোকাচ্ছন্ন দন্ড দ্বারা ব্যতিক্রম করিয়া তোলে। এই সম্বন্ধে পূর্ব্ব পুরুষগণ যুধিষ্ঠির প্রভৃতি রামসীতাদি কুরু পান্ডবাদির পক্ষ অপক্ষতা পরিহার করাইয়া মধ্যস্থ কৃষ্ণশরণে পঞ্চ প্রকৃতির পরের প্রকৃতি যুধিষ্ঠির ভগবৎ সমীপে স্বরূপলাভ করিয়াছেন। তাহার প্রধান কারণ স্বধর্ম্ম পালনে বিচলিত হন নাই।


(১৫৭) সত্যং পরম ধীমহি। এই সত্যই পরম ধ্যান নিশ্চয় জানিতে হয়। ভগবান ভিন্ন জগতে কর্ত্তৃত্বযোগে যাহা কিছু চর অচর, সুখ দুঃখ, ধর্ম্ম অধর্ম্ম, পাপ পূণ্য, ভাল মন্দ, জ্ঞান অজ্ঞান, শুভ অশুভ, সিদ্ধ অসিদ্ধ, দেনা পাওনা ইত্যদি যত রকম দ্বন্দ্ব জীবলোকে সংযোগ হয় সকলি রাক্ষস অসুরের কারবার ভিন্ন কিছুই নয়। ইহাদিগকেই ভ্রম বলে, দ্বন্দ্বজই দেব দানব বলিয়া দুইটি ভূত জীবলোকে জানিয়া থাকে। এদের স্বভাবই উদয় অস্ত, স্থিতি নাই, সর্ব্বদাই ক্ষয়শীল। উহারাই জীবের প্রজ্ঞাকে হরণ করিয়া প্রলোভন, শাসন, উৎপাত ঘটাইয়া থাকে। এই সকল রজগুণ হইতে সৃষ্ট হয় বলিয়াই সর্ব্বদা জীব ইহার দ্বারা প্রলোভিত হইয়া বন্দী হয়, বন্দী হইয়া ধর্ম্মাধর্ম্মে ভুল হইয়া তাহাদের অধীন হইয়া কিংকর্ত্তব্য হারাইয়া ফেলে। এই জন্যই অনিত্য পদার্থের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তিতে শান্তি অশান্তি নিয়া দ্বন্দ্বজ করিয়া সত্য যে খাঁটি বস্তু তাহা একেবারে বিস্মৃত হইয়া যায়। এই সকল বেগ সহ্য করিতে করিতে সত্যবস্তু প্রকাশ হইয়া সকল ভ্রান্তিই দূর করিয়া পরম অপার শান্তিতে নিয়া যায়, বিচ্ছেদ হয় না।


(১৫৮) সংসার শব্দই ভ্রান্তিজনক বাক্য, সুখে দুঃখে, পাপে পূণ্যে জড়সড়। শান্তি খুঁজিয়া ইহার হাত হইতে ত্রাণ পাওয়া দুষ্কর। অগ্রে বিষ পরে অমৃত ইহাই সাত্ত্বিক সুখ, নচেৎ অগ্রে সুখ পরে দুঃখ ইহা রাজসিক সুখ। কাজেই নিত্য সুখ লাভ করিতে হইলে অগ্রে সুখের স্পৃহা ছাড়িয়া দিতে হয়। সত্যকে ধরিয়া থাকিলে পরিণামে আনন্দ ফল ফুল রসে মুগ্ধা হইতে পারে।


(১৫৯) সকল ভার ভগবানে রাখিয়া প্রারব্ধের কার্য্য সকল ভোগে দান করিতে চেষ্টা করিবে, ভগবান সকল পাপ হইতে মুক্ত করিয়া নিত্যধামে প্রতিষ্ঠান করিবেন সন্দেহ নাই। সংসার মায়াময়, ভ্রান্তিজালে বন্ধ হইয়া কর্ত্তা সাজিয়া হিতাহিত বিবেচনা রহিত হইয়া সহিষ্ণুতার লাঘব হইয়া যায়। তদ্বারায় জীব বাসনায় প্রতিবন্ধক করিয়া নানান অভাবের তরঙ্গে ডুবিয়া কষ্ট পায়। আপন কর্ত্তব্য কর্ম্ম ভুলিয়া যায়। অতএব, এই সকল প্রলোভনীয় শাসন হইতে সহিষ্ণুতা দ্বারা উপেক্ষা করিয়া সহ্য করিতে করিতে কাম ক্রোধোদ্বেগ তিরোহিত হইয়া পবিত্র হৃদয়ে ভগবান আধিপত্য স্থাপন করিয়া লন। দিবানিশি কামক্রোধোদ্ভব বেগকে সহ্য করিতে করিতে পরমানন্দ দাঁড়াইবে, তখন শান্তি পাইবে।


(১৬০) মনের চঞ্চলতার জন্য অনুতাপ করিবেন না, কারণ তাহার স্বভাবই ঐ রকম। সকল ভার গুরুতে ন্যস্ত রাখিয়া উপস্থিত সকল কার্য্য যথাসাধ্য করিয়া যাইবে। তাহাতে সিদ্ধ অসিদ্ধ লাভ লোকসানের দিকে লক্ষ্য রাখিবে না। কর্ম্ম করিতে করিতেই সকল কর্ম্ম শেষ হইয়া যাইবে, তখন আর মনের দরকার হইবে না। সকলি আপনার বাধ্য থাকিবে। কর্ম্ম হাতে থাকিলেই সুখ দুঃখজনক বাসনায় উৎপীড়ন করিয়া থাকে। বিবেকবুদ্ধি উৎপন্ন হইলে আপনি আপনিই সকল অভাব নাশ করিবে। চেষ্টা করিয়া বিবেকতা আসে না। কোন চিন্তা ভাবনা করিবে না। স্ত্রী পুত্র পরিজন যাহারা মুখাপেক্ষী হইয়া আছে তাহাদিগকে যথাসাধ্য ভরণ পোষণ করাই ধর্ম্ম, ইহাতেও ভগবানের সেবা হয়। অনাশক্ত ভাবে এদের সঙ্গ লাভ হইলে মঙ্গলই হয়।


(১৬১) ভগবানের স্বভাব জীবত্ত নিত্যদাস অভিমান। কর্ত্তৃত্বাভিমান আবরণে সেই নির্ম্মল স্বভাব ভুলিয়া যায়, এই দরুণেই জীবের জন্ম মৃত্যুর অধীন ছাড়িতে পারে না। এই জন্য সহিষ্ণুতাকেই আশ্রয় করিতে হয়। সংসারের সাধন ভজন সিদ্ধাসিদ্ধ মন্ত্রাদির দ্বারায় কর্ত্তৃত্বপদ ভুল হয় না, বরং ভূয়ঃ ভূয়ঃ বন্ধনই ঘটে। এইজন্য যখন যে অবস্থাই উপস্থিত হইক তাহা সহন করিয়া যাইবে, নিজে কিছুই চেষ্টা করিবে না। যখন যে কার্য্য উপস্থিত যে ভাবে সমাধা হউক সেই ভাবকেই সহ্য করিয়া কর্ম্ম করিয়া যাইবে, ইহাতে সুখী দুঃখী হইবে না। ভক্ত জীবন অধ্যয়নে এই সকল বুদ্ধির মার্জ্জনা হয়।


(১৬২) ভগবান সর্ব্বজ্ঞ সমভাব নিরপেক্ষ শক্তি । তাঁহার বিচার সুক্ষ্ম, জীবের বুঝিবার শক্তি নাই। তিনি মঙ্গলময়, তাঁহার কর্ম্মও মঙ্গল। তিনি যাহা বিধান করেন সকলই জীবের পক্ষে কল্যাণ আর শান্তিই জানিবে। নিজের কোন কর্ত্তৃত্ববিধান রাখিয়া ভগবান তোমাকে চালাইতে দিবেন ইহা হইতেই পারে না। তটস্থ থাকিয়া সংসারের বন্ধন ভোগদান করিতে থাকিলে তিনি সকল অভাবই মুক্ত করিয়া শান্তি দিবেন। তিনি শান্তিময়, শান্তি বৈ আর কিছুই তাঁহাতে নাই। তাঁহাকে ভুলিয়াই কর্ত্তৃত্বাভিমানে নানান অভাব ভোগদন্ড ভোগ করিয়া থাকে। অতএব সর্ব্বদা ভগবানের উপরই ন্যস্ত করিয়া তাঁহার সংসার আহরণ স্থিতি করিবে, তিনি মঙ্গল করিবেন। চিন্তা করিবে না।


(১৬৩) সংসার মায়াময়, অস্থায়ী ক্ষর প্রকৃতি দ্বারা গঠিত গতাগতি। পুনঃ পুনঃ অদৃষ্টানুসারে জীবের সুখ দুঃখ ভোগ হইয়া থাকে, কাহারো কোন শক্তি নাই এই ভোগ খণ্ড করে। একমাত্র ভগবানই সংসার মুক্তের আশ্রয়। অতএব অনিত্য সুখ দুঃখময় ভোগ আয়তন দেহের জন্য চিন্তা ভাবনা করিতে নাই।


(১৬৪) সংসার (সত্য উদ্ধার)। সত্যসঙ্গ করিতে করিতে সংসার হইয়া যায়, আর বৃথা আশা প্রতিযোগ থাকে না। কর্ত্তৃত্বাভিমানিত্ব রসে মুগ্ধ হইয়া ইদং মিদং চিন্তায় রত হয়। এই কর্ত্তৃত্বাভিমানকেই ভ্রম বলিয়া নির্দ্দেশ করে, ভগবৎ শক্তির স্মৃতি লোপ করিয়া দেয়। প্রতিক্ষণেই কোন বিষয়ে কর্ত্তৃত্ব স্থাপন থাকে না দেখিয়াও ভ্রান্তি হইতে বিরত হইতে চেষ্টা করে না। কেবল ভ্রান্ত বস্তুর স্মরণ ও তল্লোভে বিমুগ্ধ হইয়া তারই চেষ্টা করে, কিছুতেই স্বভাব (স্বধর্ম্ম) কে ধরিতে কি তাকে আশ্রয় নিতে প্রবৃত্তি হয় না। ইহাই মায়ার মহা উৎকট মোহশক্তি।


(১৬৫) অদৃষ্টচক্রে যাহা যুটিবে তাহার দ্বারাই সন্তোষ থাকিতে হয়, ভ্রান্তিবশতঃ হা হুতাশ করিতে নাই। প্রারব্ধ সূত্রেই জীবে পরিচালন করিয়া থাকে। তাহা হইতেই ভাগ্যলক্ষ্মী ভাব ভক্তি, প্রিয় অপ্রিয়তা ভোগ হইয়া থাকে। ইহার নিবারণ করিতে চেষ্টা করিবেও না এবং নিবারণ করিবেও না, যথা যথা প্রাক্তন ভোগ গ্রহণই করিতে হয়। একমাত্র সহিষ্ণুতাতে সম্বল করিয়া দেখিয়া যাইবে। বিশেষতঃ ভোগের নিবারণ করিতে গেলেও ভোগ বৃদ্ধি ছাড়া হ্রাস কিছুই হয় না; আর চুপ করিয়া থাকিতে দিবে না, প্রকৃতিই চঞ্চল করিয়া তুলিবে। কাজেই এই দুইয়ের মধ্যে সহ্যশক্তি আহরণ করাই উচিৎ।


(১৬৬) বড়লোকের সাহায্য ভিন্ন অবস্থার মার্জ্জন কি করিয়া হইবে? এই জন্য ন্যূনতা স্বীকার করিয়া শরণ লইবে।


(১৬৭) জীবগণের প্রারব্ধ বশতঃ কর্ম্মানুসার মনের গতির তারতম্য ভোগ হইয়া থাকে এবং স্ত্রীপুত্র কলত্রাদি ভাই ভগ্নী ইষ্ট কুটুম্ব সহায় সম্পদ যোগ বিয়োগাদি রূপে সম্বন্ধ ঘটিয়া থাকে। এই নিমিত্ত সুখ দুঃখাদি কার্য্য অকার্য্য সম্পাদন করিয়া জীবের ভৌতিক সঙ্গতা হেতু বাসনায় দাসত্ব করিয়া দুষ্পুরণীয় আশা ভরসা কামনার পরিচর্য্যা করিতে প্রস্তুত হয় (ধর্মবিরোধী ভূতেষু কামোহস্মি ভরতর্ষভঃ) গীতায় প্রকাশ করিতেছেন, অর্থাৎ ধর্ম্ম যাজকের ধর্ম্মসিদ্ধির বাধা করিবার জন্য আমি কামস্বরূপ জীবের নিকট বাস করি। কামনা বাসনা শূন্য জীবের নিকট আমি দৃঢ়তা বল হইয়া থাকি। এমতাবস্থায় কোন বিষয়েরই অর্থাৎ সুখ দুঃখাদি যাহা অদৃষ্টচক্রে আনিয়া দেয় তাহা ভোগে দেওয়াই ভগবৎ সেবা জানিবে। এই সেবা করিতে করিতে মনের চঞ্চলতায় যাহা আবর্ত্তন করে তাহা সকল ভোগে প্রারব্ধসূত্রে কাটাইয়া দিতে দিতে ভগবানের স্বরূপ নিত্যানন্দ দয়াপূর্ণ হইয়া যায়। পুনরায় জন্ম মৃত্যু জগতে আসা যাওয়া বাসনামূলক মায়ার গ্রহচক্রে আবদ্ধ হইতে হয় না।


(১৬৮) এই জগতের মধ্যে এমন জীব নাই যে ভগবানের সেবা না করে এবং এমন বস্তু ও অবস্থা নাই যে ভগবানের আশ্রয় না করিয়া থাকিতে পারে। এমন কোন শক্তি নাই যে ভগবৎ কৃপা ভিন্ন চালনা করিতে পারে। ভগবৎ শক্তিতে স্ব স্ব স্বভাবের চঞ্চলাদি দ্বারা ভগবানের সেবাকর্ম্ম সমাধি হইয়া থাকে। এই ভগবৎ প্রীতি অনুষ্ঠানকারী শাস্ত্রীকগণ বেদ বেদান্তে পুরাণে সকল প্রমাণ করিয়া দিতেছেন। কেবল কর্ত্তৃত্বাভিমানের দ্বারা ভগবৎ পদ ভুলিয়া কর্ম্ম কার্য্য হইতে সুখ দুঃখ উদ্বর্ত্তন করিয়া জগতে গতাগতি দ্বারা সুখ দুঃখাদি সম্বন্ধ করিয়া লয়। সকল ভাব ভগবানে রাখিয়া পরমানন্দে ভগবৎ সেবাকার্য্য স্ব স্ব স্বভাবের দ্বারা সম্পাদন করিতে চাহে না।


(১৬৯) সংসার কেবল ভ্রান্তিপাশে বন্ধন হইয়া সত্যব্রত পতিব্রতা ধর্ম্মচ্যুত হইয়া ত্রিলোকে চরাচর প্রকৃতির দাসত্ব করিয়া চিরকূপে ডুবিতে থাকে।


(১৭০) ভগবৎশক্তির আবরণ বিশেষণে স্থানে স্থানে নানান বিকাশ হইয়া থাকে। জগতে কাহারো কোন দোষগুণের দ্বারা প্রশংসা পাইতে পারে না। যাহা হউক, ভগবান মঙ্গলময়, তিনি সকলই মঙ্গল করেন। তাঁহার আশ্রয়ই মঙ্গল জানিবে। সময়ের অর্থাৎ কালের তরঙ্গ সমাহিত দ্বারা নানান ভাব পৃথক পৃথক প্রকাশ হইয়া থাকে। সকল অভাবই দূর হইবে। সংসার বন্ধন মুক্তরাজ মুক্ত করিবেন সন্দেহ নাই।


(১৭১) না লইবে কারো দোষ, না করিবে কারে রোষ। সততঃই কৃষ্ণব্রত লক্ষ্য রাখিবে। কৃষ্ণদাস নিত্যমুক্ত।


(১৭২) জীবের কোন শক্তিদ্বারা কোনরূপ কার্য্যক্ষম হয় না। কেবলমাত্র ভগবৎশক্তিতেই জগৎ চলিতেছে। ইহাই প্রারব্ধ; অজ্ঞানতাবশতঃ জীবের কর্ত্তৃত্বাদি সংস্কার প্রবর্ত্তন হইয়া থাকে। প্রারব্ধ হইতে যাহা উপস্থিত ঘটনা ঘটিত হয় তাহা ভোগমাত্র। ফলাফলের তরঙ্গে বিচলিত না হইয়া সর্ব্বদা প্রাক্তন কর্ম্মে প্রবাহন দিতে থাক, ভগবান কৃপা করিয়া সংসার তরঙ্গ হইতে উদ্ধার করিয়া লইবেন।


(১৭৩) সংসার মায়াময়, ইহা মনের বৃত্তি, সুখ দুঃখ সংঘাত চেতনাকৃতি।


(১৭৪) সর্ব্বদা ভগবৎ স্মরণ করিতে চেষ্টা কর, তাহাতেই মলিন সঙ্গ মার্জ্জনা করিবে। নিত্যকর্ম্মের অনুষ্ঠান যাহাতে করিতে পার তাহার প্রতি যত্ন করিতে ভুলিবে না। গুরুই সকল অভাব মুক্ত করিয়া উদ্ধার করিবেন।


(১৭৫) গুরুর কার্য্য সর্ব্বদা অনুষ্ঠান করিবে। শরীর উদ্ধারের কারণই এই, আর কিছুই নাই। সংসার মায়াময়, কেবল যোগ বিয়োগের গঞ্জনা। শান্তি যাহা বোধ হয় স্বপ্ন তুল্য। কেবল সুখ দুঃখের খনি অনবরত পরিক্রম করিতেছে।


(১৭৬) গুরুর কৃপাই সত্য। সর্ব্বদা সত্যকে আশ্রয় করিয়া সত্য অনুশীলনে থাকিবার চেষ্টা করাই ধর্ম্ম। মায়ের পুত্র হইয়া থাকিতে অভিমানী হইবে। মাতাই সকল অভাব দূর করিয়া সংসার সঙ্কট হইতে উদ্ধার করিবেন, সংশয় নাই। (বলং বলং ধর্ম্ম বলং) পূর্ণানন্দময়ী মাতার কটাক্ষ পাইতে তাহারই অনুগত থাকিতে হয়।


(১৭৭) এই শরীর গুরুর। তিনি যাহা করিবেন তাহার অন্যথা কে করিবে? সংসার মায়াময় ভ্রান্তিজনক। যাহাতে এই সংসার সমুদ্র হইতে নিষ্কৃতি লাভের উপায় হয় তাহাই করা প্রয়োজন।


(১৭৮) সংসার মায়াময়, কালচক্রেই ভ্রমিতেছে, কাহারও কিছু করিবার শক্তি নাই।


(১৭৯) সর্ব্বদা ভগবানের নিকটে রতি রাখিতে চেষ্টা করিবে।


(১৮০) ভগবান যাহা করেন কোন ভাবনা করিবে না। সত্যই পরমপদ, সত্যকে ত্যাগ করিবে না। সর্ব্বদা মনকে সত্য পথে রাখিতে চেষ্টা করিবে।


(১৮১) ভগবানের প্রতি নির্ভর স্থাপনে চঞ্চল হইবে না। নল রাজাদির ব্যাপার স্মরণ রাখিতে ভুলিবে না। প্রথমেই আবর্জ্জন উৎপন্ন হয়, পরিশেষে পবিত্র শান্তির বিধান ভগবান করেন।


(১৮২) সংসার সততই লাঞ্ছনার আকর।


(১৮৩) কোন চিন্তা করিবে না, সর্ব্বদাই গুরুর চিন্তা করিবে।


(১৮৪) বিপদগ্রস্থ লোকের পূর্ব্বাবস্থা মানের চিন্তা করিতে নাই। সময় গতিকেই সকল প্রারব্ধ ভোগের ভোগে পড়িয়া থাকে, তাতে মানাপমানের চিন্তা করা দরকার হয় না। উন্নতি অবনতি এ জগতে মহারাজা প্রভৃতি সকলেরই পরিবর্ত্তন দেখা যায়, ইহাতে লজ্জা সঙ্কোচের কারণ কি হইতে পারে?


(১৮৫) ভগবানের উপর ভার রাখিয়া চলিতে থাক, তিনিই বিপদের বন্ধু। শুভাশুভ কর্ম্মবন্ধন মুক্ত করিয়া উদ্ধার করেন। সংসারের জীব মান অপমান জ্ঞানেই বন্দী হইয়া থাকে, সময় অনুসারে সকলি সহ্য করাই কর্ত্তব্য। ধৈর্য্য হইতেই সকল অভাব নাশ হয়। স্রষ্টা যে ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন তিনি তাহারই কুলন করিয়া লইবেন।


(১৮৬) অভিমান না রাখিয়া সমবুদ্ধির সঞ্চয় করিবে।


(১৮৭) যথাসাধ্য সময় সময় কিছু কিছু আত্মার কর্ম্ম করিলে মনের অনেক শান্তি হয়।


(১৮৮) গর্ব্বহারী ভগবান কার গর্ব্ব অভিমান থাকতে দেন না। জীবের ইচ্ছা কোটি বাঞ্ছা করে, কৃষ্ণের যে ইচ্ছা সেই ফল ফলে। এই মহাজনের বাক্য, ইহা অভ্রান্ত।


(১৮৯) সততঃ সকল ভার গুরুর উপর দিয়া সংসারের কার্য্য যখন যাহা উপস্থিত হয় করিয়া যাইবে। তাহাতেই পরিণামে গুরুই উদ্ধার করিবেন। গুরু ভরসা ব্যতীত বর্ত্তমানে তপস্যাদির দ্বারা শক্তি আহরণ করিতে ক্ষমতা কাহারই নাই।


(১৯০) সংসার মায়ামুগ্ধ, কিছুরই স্থিরত্ব নাই।


(১৯১) সংসার মায়াময়। যাহা হউক, সকলি অদৃষ্টচক্রে ভ্রমণ করিয়া থাকে। রাজা ধনী সকলি ফকীর হইয়া থাকে এবং ফকীরও রাজত্ব ও ধন পাইয়া থাকে। সকলি ভগবানের ভুল হইয়া এই সকল গতি লাভ করিয়া লয়।


(১৯২) সংসার মায়াময়। মায়ামুগ্ধতাবশতঃ ভ্রান্তিসাগরে নিমগ্ন হইয়া জীবভাব নানারূপে তরঙ্গ খেলিয়া বিভোর থাকে। সুখ দুঃখ নিয়া সততঃই কালতরঙ্গে ভাসিয়া থাকে। অদৃষ্টচক্রের খেলায় চঞ্চলতা দ্বারা নানা ভাবের উদয় অস্ত হইয়া কর্তব্যপথকে রোধ করিয়া দেয়। ইহার হাত হইতে নিস্তার পাইবার পথ একমাত্র সহিষ্ণুতা। কর্তৃত্বাভিমানে জঞ্জাল উদগম করিয়া নানামতে লাঞ্চনা জন্মায়। অতএব যতদূর পার অকর্ত্তা কর্তব্য বৃদ্ধি করিবার চেষ্টা করিবে।


(১৯৩) লৌকিক প্রাকার সংসারের বন্ধন বৃদ্ধি করে। গুরুভক্তিই সুদুর্লভ সকল বন্ধন ক্ষয় করে। অভাব স্বভাব, ভাল মন্দ প্রভৃতি সংসারের বন্ধন। (শুভাশুভ কর্ম্ম যত কৈতব প্রধান, যাহা হইতে কৃষ্ণভক্তি হয় অন্তর্দ্ধান। কৃষ্ণভক্তির বাধক যত শুভাশুভ কর্ম্ম, এও জীবের অজ্ঞান তমোধর্ম্ম)। এইটি মহাজনের বাক্য।


(১৯৪) সংসার মায়াময়। সত্যই পরম ধর্ম্ম, সত্যকেই সর্ব্বদা আশ্রয় করিয়া থাকিলে সত্যই আপন শক্তি দ্বারা সুখ দুঃখময় সংসার হইতে পরিত্রাণ করিয়া লয়। (সত্যং পরম ধীমহি, সত্যমেব কেবলম) সর্ব্বদা ভগবানের উপর নির্ভর করিয়া থাকিবার চেষ্টাই পরম পবিত্র যোগ। ধর্ম্মই পরম পবিত্র রসবিন্দ।


(১৯৫) পরের কথায় কি স্বচক্ষে ব্যক্ত হইলেও তাহা বিশ্বাস না করিয়া কেবল আপন ভাগ্য ভোগ কল্পনা করিয়া লইবে। যখন ভাগ্য প্রসন্ন হইবে তখন চতুর্দিক হইতে সকল বাধা, অভিযোগ মুক্ত হইয়া পরম শান্তি প্রকট হইবে। কারো দোষ লইতে নাই। ভগবানের স্মরণ ভুলিবে না।


(১৯৬) সত্যধর্ম্ম পরাভক্তি নিত্য অকর্ত্তৃত্ব। ইহা নির্ম্মলভাবে সভয়যুক্ত হইয়া সর্ব্বদা সেবা করিতে হয়। সততঃ চিন্তার দ্বারা ভগবানের সেবা করিয়া নিত্যানন্দশক্তি লাভ করে।


(১৯৭) সংসারের চিন্তা না করিয়া উপস্থিত যাহা যখন কর্ম্ম হয় তাহা যথাসাধ্য আয় অনুসারে কুলন করিতে ব্যবস্থা করিয়া যথা সময় যাহা পারা যায় স্থীর চিত্তে গুরুর কার্য্য করিবে। যখন মন চঞ্চল থাকে তখন না করিয়া স্থীর সময়ে ক্রিয়া করিতে হয়। ইহাই ইষ্টসাধ্য হয়। মন ইষ্টের উদ্দেশে রাখাই পবিত্র। চিন্তার করিয়া কোন ফল ভোগ করিবার লোক ত কাহাকেও দেখা যায় না। ভগবৎ চিন্তা যাহা যখন পারা যায় তাহাই ভাল।


(১৯৮) নলরাজা হরিশ্চন্দ্র প্রভৃতির বিষয় চিন্তা করিয়া দেখিবে। তাঁহারা কতই না সহ্য করিয়া ধর্ম্ম রক্ষা করিয়াছেন। মহাত্মাগণ সহিষ্ণুতা দ্বারা সকল বিপদ ভোগ করিয়া পরিশেষে পুনরায় সম্পদ ভোগ করিয়াছেন। গত বিষয় চিন্তা করিতে নাই। ধর্ম্মের পর আর কিছুই সম্পদ নাই। স্ত্রীপুত্র কলত্রাদি ধন জন সকলি দুঃখের আকর। ইহাদের ভাবিতে গেলে সুখ কিছুই নাই, ভ্রান্তি বশতঃ সুখবোধ হয়। তাহাও ক্ষণস্থায়ী, দুঃখই বেশী। অনিত্যকর বিষয় জন্য দুঃখ করা সকলি ভুল। কোন চিন্তা করিবে না। কেবল গুরুর উপর সমস্ত ভার দিয়া খাঁটি হইয়া স্থীরভাবে গুরুবাক্য পালনে যত্নশীল হইবে।


(১৯৯) সত্যব্রতই ধর্ম্ম, ইহাই নিরংশ পদ দিয়া থাকে। ধ্যান জ্ঞান বিহীন হইলেও উত্তমগতি লাভ হয়। সংসার মায়াময়, বাসনাই তাহার আবরণ ও শাসক। সরলতাই পরম পবিত্র ধর্ম্ম, ইহা হইতে কৃষ্ণভক্তি উদ্দীপন হইয়া থাকে। ভক্তি গাঢ় হইলে সংসারের কোন অভাব থাকে না, প্রেমলহরী আনন্দ রস বিতরণ হয়। ইহা সর্ব্বদা মনের দ্বারা সৎ অসৎ বিভাগ করিয়া সত্যকে বিভাগ করিয়া সত্যের অধীন থাকিতে সততঃ চেষ্টা করাই প্রয়োজন। ইহা হইতে সত্যই পাইয়া থাকে। বিষয় ধ্যান করিতে করিতে বিষয়(বিষম) বুদ্ধি হইয়া বিষ ঘর্ষণে তাপ উদ্গম হইয়া বিপথস্থ হইয়া পড়ে এবং তদ্বারা বাসনা সংকুলনে ব্যস্ত হইয়া সুখ দুঃখকর স্বর্গ নরকপ্রদ মায়া শক্তির আবরণই বৃদ্ধি হইয়া থাকে। জন্ম মৃত্যু পুনঃ পুনঃ গতাগতি ভোগ করিয়া লাঞ্ছিত হয়। অহঙ্কার দ্বারাই বন্দী থাকে। ভগবৎ শরণ হয় না, ভুলিয়া যায়। অতএব এই মায়াবন্ধন মুক্তির জন্য মনের দ্বারা বিচার করিয়া মনকে শান্তির পথে ইন্দ্রিয় হইতে আলগা সতত করিবে। ইন্দ্রিয়গণেতে মন থাকিলে জাতি মান কুল রক্ষা করিতে গিয়া অকূল সমুদ্রে গাঢ় তরঙ্গে পড়িয়া চির দুঃখকর বিষম পদ লাভ করিয়া থাকে। নিষ্কৃতির উপায় নাই।


(২০০) সত্যকে সর্ব্বদা আহরণ করিবে।


(২০১) সংসার মায়াময়, সময় দুর্দ্দিন, নানান ভাবেরই অভাব। এইজন্য ভগবানের শরণ নিয়া সর্ব্বদা মনকে, বুদ্ধিকে বাসনাকে শোধন করিতে যত্ন থাকাই জীবভাবের কর্ত্তব্য কর্ম্ম। সর্ব্বদাই ভগবানের অধীন হইতে চেষ্টা করিবে।


(২০২) পরের বুদ্ধিতে অধিক চলিলে মলিন হয়। আপন বুদ্ধিই সমাদরের যোগ্য। কাঁচের আদরে রত্নের মলিন হয়। কোন চিন্তা করিবে না, সর্ব্বদা ভগবানের দিকে লক্ষ্য রাখিবে।


(২০৩) চিন্তা ভাবনা করিয়া ফল নাই। অদৃষ্টে যাহা হইতেছে তাহাই হইবে। সত্য করিয়া লইতে হয়।


(২০৪) প্রারব্ধের চক্রে সবই ঘটিয়া থাকে, কাহারো কোন দোষ নাই।


(২০৫) চিন্তার কিছুই নাই। কেবল গুণের তরঙ্গ হইতে নানান ভাবে বিক্ষেপ করিয়া মনের নানান রকম অশান্তি জন্মায়। ইহার কারণই মহামায়া। এই মহামায়ার শরণ নিয়া থাকিলেই এই মহামায়া হইতে মহামায়ায় মুক্ত করিয়া পরম শান্তিতে আপন সন্তানগণকে রাখেন। অতএব সর্ব্বদা ভগবানের শরণ লইবে।


(২০৬) চিন্তা করিবে না। প্রারব্ধের ভোগ শেষ করিয়া দিতে পারিলেই সংসারের গতাগতি ঘুচিয়া যাইবে।


(২০৭) চিন্তা করিয়া ফল কি হইতে পারে? অদৃষ্টচক্রে সকলই ভোগের পাশে বদ্ধ থাকিয়া শান্তি অশান্তির তরঙ্গে ঘুরিয়া বেড়ায়। কেবল চেষ্টা করিয়া যাইতে হয়। ফলাফল অদৃষ্ট।


(২০৮) সততই ভগবানের উপর নির্ভর রাখাই উচিত। এই সংসার মায়ারই তরঙ্গ।


(২০৯) ভগবানকে আশ্রয় করিয়া থাকিবে, ভগবান সকল মঙ্গল করিবেন।


(২১০) চিন্তা করিবে না। ভগবান কালচক্রের তাড়না হইতে রক্ষা করিতে বর্তমান আছেন। প্রাক্তনে সকলি করিয়া থাকে। বিপদ সম্পদ সকলি প্রাক্তনের কর্ম্ম। ভগবান ব্যতীত ইহার হাত হইতে ত্রাণের অন্য কাহারও শক্তি নাই। সময় ফিরিয়া পড়িলে সকলি সূর্য্য উদয়ের ভাবে বিঘ্ন কাটিয়া আনন্দ প্রকাশ করিয়া দেয়।


(২১১) সংসার মায়াময়, ভ্রান্তিজনক, প্রারব্ধ দ্বারা পরিচালিত হইয়া থাকে। ইহাতে ভাগ্যই বলবান ভাবিয়া ভাগ্যফল প্রতিক্ষায় সর্ব্বদা সর্ব্বতোভাবে সহিষ্ণুতা শক্তিকে সম্মুখে রাখিয়া কাল কাটাইতে হয়। যখন যে অবস্থার সহিত ভগবানের সেবার কার্য্যে সংযোগ হইবে তাহাতে চঞ্চল না হইয়া অনন্যমনে ভগবৎ সেবায় নিত্য নিত্য নিমগ্ন থাকিতে চেষ্টা করিবে। চিন্তায় অধীর হইতে নাই, সর্ব্বদা মনের বল রাখিতে পারিলে কিছুতেই হরণ করিয়া লইতে পারে না।


(২১২) ভগবান মঙ্গলময়। সময়চক্রে নানান উপসর্গ জুটিয়া থাকে। আবার সময়ে সকলি চলিয়া যায়। এইজন্য কালচক্রের আগম নিগমকে তিতিক্ষা করিতে হয়।


(২১৩) সংসারে মান অভিমান ছাড়িয়া সকলের সহিত বন্ধুত্ব, আপ্যায়তা, সরলতাভাব রক্ষা করাই পরম হিতকারী। সহিষ্ণুতা শক্তির দ্বারা সকলেরই সকল দোষ মার্জ্জনা করিয়া নিরপেক্ষ, নির্জ্জন, চিন্তা ভাবনা রহিত হইয়া থাকিতে থাকিতে জগতের ঋণ মুক্ত হইয়া পরম শান্তির চিরকাল থাকিতে পারা যায়। কাহারো দোষ যদি কোনরূপে বুদ্ধির গোচর হয় তবে সেই দোষকে নিজের ভাগ্যলব্ধ বলিয়া জ্ঞান করিয়া লইতে হয়। যেমন আপন দন্তের দ্বারা আপন জিভ কাটিলে কষ্ট হয়, অথচ কাহারো দোষ দেওয়া যায় না, সেইরূপে এই সকল উপস্থিত মিত্র অমিত্র দোষাদি বহন করিয়া লইয়া পরম শান্তি পাইয়া থাকে।


(২১৪) ভোগের তাড়না সহ্য করাই ধর্ম্ম। সহ্য করিতে করিতে আরোগ্য হইয়া থাকে।


(২১৫) ভগবানের শক্তি গুণের দ্বারা নানান রকম অবস্থা হয়। সেই গুণ হইতে মনের গতি বিশেষে বুদ্ধি চঞ্চল হইয়া কুপথ সুপথগামী হয়। তাহা হইতেই জীব সকল সুখী দুঃখী হইয়া থাকে। ঐ গুণের চালিত অবস্থার বেগ সততই সহ্য করিয়া থাকিবার চেষ্টা করিতে করিতে গুণ মার্জ্জিত হইয়া ভগবানের পরমানন্দ লাভ করিয়া জীব সত্য মুক্ত হইয়া থাকে। মনের স্বভাবই চঞ্চল, যে যে বিষয়ে মন যায় সেই সেই বিষয় হইতে মনকে বলপূর্ব্বক ফিরাইয়া নিয়া প্রাণের নিকট কিছুকাল রাখিতে রাখিতে মনস্থির হইয়া শান্তিরূপ ধারণ করে। ধৈর্য্যই সহায় সম্পদ জানিতে হয়।


(২১৬) সংসার মায়াজালে মুগ্ধা হইয়াই বন্ধন করিতেছে। অদৃষ্টকে বলবান করিয়া সংসার যাত্রা নির্ব্বাহ করিতে হয়। যখন যাহা ভাগ্যবশতঃ ঘটিবে তাহাই শির পাতিয়া বহন করিতে হইবে। নচেৎ এ সংসারের মায়ানাট হইতে উদ্ধার হইতে পারে না।


(২১৭) এই সংসার মায়াময়, প্রাক্তনের হাত ছাড়াইবার যো নাই।


(২১৮) এত আসক্তি কেন? যখন যাহা প্রারব্ধে আছে তাহা ভোগ করিয়া যাইবে। এই সংসারে মমতার দাস হইয়া ঘুরিয়া বেড়াইলে লাভ কি? সর্ব্বদা সহ্য করিয়া যাওয়ার চেষ্টা দেখিবে। ভগবৎ যাহা দিবেন তাহা খন্ডন করিতে সাধ্য কি?


(২১৯) সর্ব্বদাই সহ্যকে প্রতিপালন করিতে ভালবাসিবে। সহ্যই পরম ধর্ম্ম।


(২২০) ভগবান যাহা করেন তাহাই হইবে। ভগবানের উপর নির্ভব রাখিয়া যথাসাধ্য চেষ্টা করিবে।


(২২১) সংসারের বন্ধনে মুক্তির জন্য একমাত্র ধৈর্য্য ধরাই পরম তীর্থ। মাতার সমান আর জগতে কিছুই নাই, এই মাতা কত কষ্ট করিয়া থাকে পুত্রের জন্য, তাহার দায় শোধনের শক্তি এ জগতে কিছুই নাই। একমাত্র তাঁরই প্রসন্নতা, পিতামাতাকে প্রসন্ন করিতে পারিলেই পরম ধর্ম্ম। পত্নীকে সর্ব্বদা বাৎসল্য ভাবের দ্বারা আবদ্ধ করিয়া রাখিতে হয়, তাহারও যাতে মনের কষ্ট না আসে তাহাই করিবে। ছেলেপিলের প্রতিও সুশিক্ষাদি যত্ন করিতে হয়। ভগবান প্রতি অবয়বের মধ্যে থাকিয়া জগতকে পালনাদি সম্পাদন করিতে হয়? ভাগ্য অনুসারে আয় ব্যয়, আপদ বিপদাদি নানান অবস্থায় পড়িয়া থাকে, তাহা হইতে এক সত্যধর্ম্ম অর্থাৎ ধৈর্য্য ধরিয়া যাইতে পারিলেই পরমানন্দে দিন কাটাইতে পারে। এ সংসার ত্রাণ ইহা হইতেই হইতে পারে। পুরুষই সমস্ত অবস্থায় আবদ্ধ হইয়া থাকে, ইহাতে বিচলন হইতে হয় না।


(২২২) সকলই সময়ে হইয়া থাকে। জন্ম, মৃত্যু, জরা ব্যাধি, সুখ দুঃখ সকলি এ সংসারে ভোগ করিতেছে। ইহা অস্বাভাবিক গতিতে কালের দ্বারা জীবদ্দশায় ভোগদন্ড ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। এই দেহেতে যতকাল থাকিতে হইবে জীব কালের দন্ড এড়াইতে পারে না। সর্ব্বদাই সকলকেই ভোগ করিতে হইতেছে। এগুলির বেগ যখন যেমন অবস্থা হয় সমস্তই ধৈর্য্য ধরিয়া থাকিবার চেষ্টা করিতে হয়। আর ধৈর্য্য না ধরিয়া ও তো কোন সুসার নাই। জন্ম হইলেই মৃত্যু হইবে, সেই মৃত্যুর পরে আর তাহার জন্য শোক করিতে হয় না। অর্জ্জুনের পুত্র অভিমন্যু স্বয়ং কৃষ্ণ অভিমন্যুর মাতুল, এ সত্ত্বেও অকালে কালের হাত এড়াইতে পারে নাই। ইহা জানিয়া সকল শোক ত্যাগ করিবে।


(২২৩) সংসার মায়াময়, ভ্রান্তসূচক চঞ্চল। সর্ব্বদা ইহা হইতে ত্রাণের জন্য ভগবৎ শরণের প্রার্থী হইয়া বিচরণে যত্নশীল হইতে চেষ্টা করাই মহতী কর্ম্ম।


(২২৪) সকলি প্রারব্ধ। যখন যাহার যে অবস্থায় মরণ হইয়া থাকে, তাহা জন্ম সময়ই আসিয়া থাকে। তবে এই অস্থায়ী জাত মরণ জন্য দুঃখ কষ্ট করা কেবল ভ্রম। যখন যা হইবার তাহা হইবেই। সর্ব্বদা ভগবানের আশ্রয় করিয়া থাকিতে ভুলিবে না। ভাগ্যগতিকে কতই উৎপাত উপসর্গ লোকের ঘটিয়া যায়, সে কেবল ভগবৎ বিস্মৃতি অবস্থায়ই হইয়া থাকে। ভগবানের অধীনস্থ লোকের কোন অভাব হয় না। বিদুরের ক্ষুদ কুড়াও তৃপ্তি সম্পাদন করিয়া থাকে।


(২২৫) সংসার মায়াময়, হিতাহিতের তরঙ্গ বুঝিয়া উঠা যায় না। এমতাবস্থায় ধৈর্য্য ধরিয়া থাকাই পরম পবিত্র এবং সুখী হইয়া থাকে। ভাল মন্দ, সৎ অসৎ বিচার করার ক্ষমতা জীবের নাই। সংসারে পিতামাতা, পুত্র, কন্যা, স্ত্রী, ভ্রাতা, ভগ্নী ইষ্ট কুটুম্বরূপে নিত্য বিরাজ করেন। অতএব সকলের সঙ্গে প্রণয় প্রীতিলাভ না হইলে ভগবৎপদ পাওয়া যায় না। ভগবানকে লাভ করিতে না পারিলে সংসারের ভাগ্যফল শেষ করিবার কোন শক্তি নাই। এ জগতে সকলের ভালবাসা লাভ করিতে হইলে সকলের দোষ উপেক্ষা করিতে সহিষ্ণুতা আহরণ করিতে হয়। কাহারই কোন দোষ লইতে নাই।


(২২৬) কোন চিন্তা করিবেন না। সংসার মায়াময় চঞ্চলই বহন করে।


(২২৭) একপাত্রে বসিয়া খাইতে কেহই শিখে নাই।


(২২৮) সংসার মায়াময়, যাহা যখন ঘটিবে সকলি প্রাক্তন ফলমাত্র জানিবে। তাহাদের বেগ ধৈর্য্য ধরিয়া নিত্য সেবায় যত্নবান থাকিবে।


(২২৯) সংসার মায়াময়, মোহবশতঃ ভুল প্রার্থনায় আটক হয়। এই মায়ার বন্ধন মুক্তির একমাত্র [উপায়] শরণ লওয়া।


(২৩০) সংসার মায়াময়, সকলি প্রাক্তনে সম্পাদন করিয়া থাকে।


(২৩১) যাহা হয় প্রারব্ধ ভোগ, তজ্জন্য কোন চিন্তা করিতে নাই। সততঃই সহিষ্ণুশক্তির আহরণ করিবে। সাধ্য অনুসারে কার্য্য করিয়া যাইবে, গোলমালের কোন বন্ধনের কার্য্য করিবে না। অনর্থক উৎপাত টানিয়া নিমন্ত্রণ করিয়া আনিবে না। ধার করিতে অভ্যাস করিবে না। ধার করা বড় দোষ। কষ্টে সৃষ্টে সহ্য করিয়া অঋণী থাকাই ভাল।


(২৩২) সত্যং পরম ধীমহি। সংসারের শুভ অশুভরূপে নানাবিধ উৎপাত উপস্থিত হইয়া জীবগণকে মোহিত করে। এই মোহ নিবারণের জন্য সততঃই অকর্ত্তা হইয়া প্রতিনিয়ত সহ্য করিতে চেষ্টা রাখিবে। সংসারের ভালমন্দ স্ব স্ব ভাগ্য অনুসারে যুটিয়া থাকে, অতএব কাহারো কোন দোষ নাই। কাহারো কোন দোষ না দেখিয়া যথাসাধ্য শান্তিতে রাখার চেষ্টা করিতে হয়, শেষে ভাগ্যে যাহা আছে ফলিবে।


(২৩৩) “প্রারব্ধ ভুঞ্জমানানানি গীতা ধ্যান পরায়ণা” অতএব ভাগ্যে যখন যাহা ঘটিবে তাহা ভোগ ভিন্ন ক্ষয় হইতে পারে না।


(২৩৪) সংসারের বিবরে প্রবেশ করিলে সর্ব্বদাই ধৈর্য্যবান ধারণ করিতে হয়। এইক্ষেত্রে কেবল অহংকারাদি বিবর্তন রসে বর্দ্ধন হইয়া পড়ে। নানান উপদ্রব সহ্য করিতে চেষ্টা করাই ধর্ম্ম। জপ তপস্যাদি কিছুই করিতে হয় না। স্ত্রী পুত্রাদি ভরণ পোষণে যত্নশীল হইয়া অনাসক্তভাবে নির্ম্মল জ্ঞান লাভ করিতে পারে। স্ত্রী পুত্রাদির মধ্যে ও ভগবান সম্যকরূপে বিরাজমান। কেবল বর্ত্তমানে মর্কট বৈরাগ্য লালসায় পন্থহারা হইয়া বিপথ গতিতে সুখদুঃখকর সমুদ্রপারবর্ত্তী রাবণের পুরী অশোক বনে বন্দী হয়। কোন কিছুরই প্রতি দৃকপাত না করিয়া নিরপেক্ষ ভাবে স্ত্রী পুত্রাদির ভরণ পোষণে তৃপ্তিদানে তৃপ্তিলাভে ভগবানকে প্রাপ্ত হয়।


(২৩৫) ভগবানের ভক্ত কখনও পতন হয় না। স্বভাবেই উদ্ধার সাধন করিয়া থাকে। যথাশক্তি নিত্যকর্ম্ম অনুষ্ঠান করিয়া যাইতে যাইতে পরমদেবী প্রণয়সূত্রে ভগবানে বদ্ধ হইয়া যায়, সংশয় নাই।


(২৩৬) প্রারব্ধকাল ভোগেই মুক্ত হয়। যথাসাধ্য সহিষ্ণুতাদি সংগ্রহ করিতে চেষ্টাই পরম ধর্ম্ম। “সত্যং পরম ধীমহি”, তত্ত্বমসি বাক্য। সর্ব্বদা ধৈর্য্য অবলম্বন করিয়া যাইবে। ভয় নাই, পরিণাম পথে ভগবান শান্তিই বিধান করিয়াছেন।


(২৩৭) সংসার মায়াভ্রান্তরসে মগ্ন হইয়া অহংকারাদি অভিমান যোগে নানান অশান্তিই স্ব স্ব স্বভাবের ভাগ্যফল ভোগ করিতে হয়। তজ্জনিত হর্ষবিষাদী কর্ষণ বর্ষণের বেগ সহিষ্ণুতা করিতে করিতে অভ্যাসবশে পরিণাম শান্তির স্থাপন হয়। আত্মীয় বন্ধু বান্ধবাদি হইতেই নানান অশান্তিকারক বিপ্লব সংঘটিত হইয়া জীবদ্দশাকে উৎপীড়ন করিয়া তোলে। এই সকল স্ব স্ব ভাগ্যেই হইয়া থাকে মনে করিয়া কেবল তিতিক্ষা করিবার চেষ্টা করিতে করিতে সকল ভাবগুলিই মার্জ্জিত হইয়া পরম পবিত্র নিত্য সুখকর আনন্দ তরঙ্গে ভাসিয়া বেড়াইতে সক্ষম হয়। কাহারো কোন দোষ নাই, স্ব স্ব ভাগ্যবশে এই সকল সংযোগ হয় ইহা নিশ্চয় ধারণ করিয়া সহ্য করিবার চেষ্টা করিতে হয়।


(২৩৮) ভগবানের কৃপা অক্ষুন্ন রাখাই জগতে প্রার্থনীয়।


(২৩৯) সংসারের আবল্য চিরকালই কালচক্রের সাহায্যে বিচরণ করিতেছে। তদ্দারায় ভাল মন্দ, সুখ দুঃখ, শান্তি অশান্তি, আপন পর, শত্রু মিত্রাদি দ্বন্দ্বরূপে সম্বন্ধ হইয়া থাকে। এই সকল বুদ্ধির যোগ হইতে সততঃই সমজ্ঞান করিয়া এবং ঐ সকল অসার অনিত্য পদার্থ জানিয়া মনকে শুদ্ধভক্তি, অর্থাৎ মান অপমানের বেগ তুচ্ছ করিয়া সমভাবে মনকে উভয় কূলের মধ্যে ধৈর্য্যাবলম্বন শক্তি দ্বারা স্থির করিয়া রাখিতে সর্ব্বতোভাবে চেষ্টা করিয়া প্রাক্তন দন্ডগুলিকে পরিহারের জন্য ধৈর্য্য শক্তির আহরণ করিবে। ভগবান সকল শান্তির দ্বার খুলিয়া পরমানন্দ দিবেন। কাহারো কোন দোষ না লইবারই চেষ্টা করিয়া স্বকীয় ভাগ্যলব্ধ মনে করিয়া রাখিবে।


(২৪০) প্রাক্তনবশে শরীরস্থ ইন্দ্রিয়াদি আবর্ত্তনে জীবের সুখ দুঃখ উৎপন্ন হইয়া সংসারে নানান উপায় উৎপন্ন হইয়া থাকে সেই সুখের কি দুঃখের অভাবে বিচলন না হইয়া ইন্দ্রিয় বেগ ধৈর্য্য ধরিতে চেষ্টা করাই ধর্ম্ম। সর্ব্বদা নামের প্রতি লিপ্সা রাখিয়া দেহযাত্রা মুক্তির চেষ্টা রাখাই কর্ম্ম। অদৃষ্টচক্রে লোকের নানান অবস্থা ঘুরিতে থাকে, তাহাতেই পাপ তাপ সংঘটন হয়। এই পাপ তাপ মোচনের জন্য সর্ব্বদা কর্ত্তৃত্ব ভগবানের নামের উপর রাখিয়া সংসারের স্ব স্ব প্রাক্তন ভোগের ভোগ কালচক্রকে দিতে হয়। কেবল নাম নিয়া পড়িয়া থাকিলেই ভগবান কালের হাত হইতে উদ্ধার করিয়া নিত্যধামে নিয়া যান। সেখানে কালের গতি নাই। সংসারে দেহের অবস্থিতি আনন্দ লোকে পায়, সে সকলি বিষয় ভোগ হইতে হয়। তাহাও অস্থায়ী বন্ধন বৈ আর কিছুই নয়। অতএব সর্ব্বদা ভাগ্যবশে যে অবস্থা ঘটে তাহার জন্য সুখী দুঃখী না হইয়া কেবল নাম করিয়া যাইবে। তাহাতেই চির মুক্তিপদ শান্তিধাম পাইবে।


(২৪১) গুরু গীতাই জগতের অভাব নাশ করিয়া পরম শান্তি দিয়া থাকেন। গীতার তুল্য আর জগতে কিছুই নাই।


(২৪২) সংসার মায়াময়, ভাল মন্দ, সুখ দুঃখে গঠিত। এই সকল তরঙ্গের আবরণ মুক্তির জন্য একমাত্র ধৈর্য্য ধরা বৈ আর কিছুই নাই। ভাগ্যং ফলতি সর্ব্বত্র। ধর্ম্ম কর্ম্ম সহায় একমাত্র সত্যনারায়ণ, তাঁহার আশ্রয় নিতে সর্ব্বদা চেষ্টা করিবে। এ সংসারে অহঙ্কার অভিযুক্ত থাকিতে ত্রাণ পায় না, অতএব সর্ব্বদা সত্যসঙ্গ করিবে। অস্থায়ী প্রকৃতির প্রতিষ্ঠা করিতে গেলে সত্য সরিয়া যায়।


(২৪৩) সংসার আধিব্যাধি যোগে পরিচালন হইতেছে। সকলই মায়ার দ্বারা গঠিত, চিত্তেতে চঞ্চলতা অধিষ্ঠান হইয়া জীবগণকে কর্ত্তৃত্বাভিমানে জড়াইয়া সুখ দুঃখের ভাগী করিয়া রাখে। ইহা হইতে ত্রাণের একমাত্র ভগবান বৈ আর কিছুই নাই। সহিষ্ণুতা শক্তির আশ্রয় নিয়া সর্ব্বদা নাম করিবে। ধীর হইয়া যদি ধৈর্য্য ধরিতে না পার তবে নাম নিয়া পড়িয়া থাকিবে। যাহা যাহা কর্ত্তব্য বোধ কর করিয়া যাইবে, অচিরেই ভগবান পবিত্র সম্পদে অধিরূঢ় করিবেন, সন্দেহ নাই। নামই সত্য, এই বৈ আর কিছুই নাই।


(২৪৪) সংসার বিচিত্র শক্তি। কখন কি ঘটে কেহই জানিতে পারে না। ধৈর্য্যই সম্পদ, ধৈর্য্যকে কোন রকমে অন্য হস্তে নিতে দিবে না। সর্ব্বদাই সকল বাধা বিসম্বাদকে উপেক্ষা করিয়া ধৈর্য্যের সহায় ভোগ করিতে চেষ্টা করিবে।


(২৪৫) সরলতাই আনন্দ উৎপন্ন করিয়া লয়।


(২৪৬) নিরপেক্ষ থাকাই মঙ্গল। যে যেমনই করুক তাহার দোষ লইতে নাই। যে যা করে সকলি গুণের দ্বারা পরিচালিত হইয়া করে, কাহারোও কোন শক্তি নাই।


(২৪৭) “প্রারব্ধ ভুঞ্জমানানি গীতাধ্যান পরায়ণা”। সর্ব্বদা নামে পড়িয়া থাকিবে, নামই সত্য। যেই নাম সেই কৃষ্ণ। নাম বই আর কিছুই নাই। সর্ব্বদা নাম করিবে, প্রারব্ধে যাহা আছে হইবে। যাহা ভগবান করেন তাহাই হইবে, চিন্তা করিয়া ফল নাই।


(২৪৮) প্রারব্ধ দ্বারা যাহা হইবে তাহা ঘাড় পাতিয়া ভোগ লইতেই হইবে। তজ্জন্য চিন্তা ভাবনা করিয়া ফল নাই। ভগবান যখন যাহা করেন মঙ্গলেরই কারণ হইয়া থাকে, যেহেতু ভগবান মঙ্গলময়।


(২৪৯) যাহা ভগবান করেন তাহাই হইবে। সর্ব্বদা নাম করিবে। নামের দাস হইলে কোন অভাব থাকে না। নামই স্বভাব বলিয়া আখ্যা প্রকাশ আছে।


(২৫০) জগতে কাহারও দোষ দেখিতে হয় না। প্রাক্তনলব্ধ হইতে স্বভাব হইয়া থাকে। পরের দোষ দেখিয়া নিজের সত্যতাকে নাশ করিতে নাই।


(২৫১) বদন ভরিয়া বলিতে বলিতে হরি উঠিবে জাগিয়া
ভাবিতে ভাবিতে সুধা ক্ষরণে,
পরণে পরণে লইবে মিষিয়া।


(২৫২) “সহজ ভজন, করহ যাজন, ইহা বৈ কিছু নাই”।
নামের দাসের ধ্বংস হয় না। নামের নামে তান মিলাইয়া যোগী ভাবসাগরে ডুবিয়া পড়ে, সুধা সমুদ্র গোপাল গোবিন্দ মধুর মধুর সরে।


(২৫৩) সংসারের মায়ামোহ জ্বালায় জ্বালাতন হইতেই হইয়া থাকে।


(২৫৪) সংসারের কালের চক্রেতে সততঃই ক্ষয় হইতেছে। ইহা স্বাভাবিক, এইজন্য শোক সন্তাপ না করিয়া কেবল মাত্র নাম করিয়া সংসারের কালের হাত হইতে ত্রাণ পাইবার চেষ্টা করিবে। এই নাম ছাড়া এই পুত্র কলত্রাদি যাহা সকলি প্রারব্ধ। এই ভোগ শেষের একমাত্র নামই সত্য, কেবল ধৈর্য্য ধরিয়া ঐ নামে পড়িয়া থাকিবে।


(২৫৫) সংসার মায়াময়, কেবল অনন্ত তরঙ্গ, স্থিরত্ব, রাখা ও থাকা সুকঠিন। একমাত্র ভগবান নিরপেক্ষ স্বরূপে প্রতি পদে পদে বিচরণ করিয়া থাকেন। সেই ভগবৎপদ লাভ করিতে হইলে তাঁহারাই শরণ নিয়া থাকিতে হয়। এই প্রকার নিরপেক্ষতার আহরণ সহিষ্ণুতার দ্বারা করিয়া লইয়া ভগবৎ প্রেমে মুগ্ধা হইয়া যায়। ভগবান মাতা পিতা, ভাই ভগ্নী, পতি পত্নী প্রভৃতি রূপে জগতে প্রকাশ হইয়া থাকেন। অতএব এই প্রকার সকল লোকের সহিতই প্রেম প্রতিভ হইবার চেষ্টা করাই ধর্ম্ম। জগতে যথাসাধ্য সকলকে সমভাবে প্রীতি করিতে হইলে সহিষ্ণুতার আবশ্যক। যাহাতে সকলের দোষ গুণে লক্ষ্য না রাখিয়া নিরপেক্ষভাবে সকল কর্ম্ম যাহা প্রাক্তন সূত্রে উপস্থিত করিয়া দেয় তাহার বেগ ভোগ করিতে করিতে ভোগমুক্ত হইয়া দন্ডমুক্ত করে, পরম শান্তিধাম শ্রীভগবানের নিকটস্থ হইয়া থাকে। এই ধর্ম্মই সত্যরূপা।


(২৫৬) সর্ব্বতোভাবে সত্যলোকে সত্যপরায়ণ হইয়া সত্যভাবে থাকিতে সততঃ চেষ্টা করিবে।


(২৫৭) সেবা ভিন্ন সিদ্ধবস্তু কখনও মিলে না। সেবা করিতে গেলে মনের সুখ দুঃখের বোঝার লালসা ছাড়িয়া অদৃষ্ট চক্রের ভোগ বহন করিয়া যাইতে হয়। কামনা থাকতে প্রেম হয় না, প্রেম ভিন্ন রুচিও হয় না। প্রেম উৎপন্ন হইলে পর নামে শ্রদ্ধা ও আনন্দরুচি তৃপ্তি ঘটন হয়। যে পর্য্যন্ত কামনা থাকে কিছুও মাত্র, তাহাতেও প্রেমের বাধক থাকিয়া যায়। অনবরত হেলায় শ্রদ্ধায় যখন যে ভাবের বশে পড়িয়া যায় সেই ভাবেই সেবা করিতে না পারার জন্য যে অনুতাপ হৃদয়ে লক্ষ্য রাখিয়া যাইতে হইবে।
মনের সুখের জন্য, কি হৃদয়ে পরের ঘরে বাস করিয়া আনন্দ লাভের জন্য এই জগতে কেবল অভাবেরই কর্ম্ম করিয়া থাকে। অহৈতুকী প্রেম আচরণের দ্বারা পরদেহ ত্যাগ করিয়া স্বদেহ লাভ হইলে তখন ভগবানের নামে রুচি সংঘটন হইয়া থাকে। সাধনসাধ্য আহরণের দ্বারা কৃষ্ণভক্তি প্রেম লাভ হয় না। যদি কেহ সাধ্য সাধন করিয়া আনন্দ উপভোগ করে সে দেহ বিবরেই আবদ্ধ থাকিবে, কিছুতেই মায়া বন্ধন ছিন্ন করিতে পারিবে না। সকলি অভাব ভোজের বাজী বলিয়া লইতে হয়। স্বভাব বিকৃতিতে যে সকল কর্ম্ম উদ্ভাসন করে তাহার বেগ সহ্য করা ভিন্ন কর্ত্তা হইয়া মুক্ত করিতে পারে না। অতএব সর্ব্বদা সেবার প্রতি লক্ষ্য রাখিতে রাখিতে প্রেম উৎপন্ন আপনিই হইবে।


(২৫৮) যাহা হয় হইবে, ভবিষ্যৎ চিন্তা করিয়া কি হইবে ? তবে প্রারব্ধের বশে চেষ্টা না করিয়া বসিয়া থাকিতে পারে না।


(২৫৯) সংসারচক্রে পড়িয়া কেবল তরঙ্গে খেলিতে হয়। ভগবান সেবার চর্চ্চা ফলে ঘটে বিরল, তাই কেবল ঘুড়িয়া বেড়াইতে হয়।


(২৬০) সংসার অচির, অস্থায়ী, এই দেহ পরিগ্রহকেই সংসার উপাধি বলিয়া থাকে। ইহাই অনিত্য অস্থায়ী জরা প্রকৃতির দ্বারা সংমিলনী শক্তি, এই সংসার মুক্তির ব্যবস্থা করিতে একমাত্র পতিভক্তি পতি অনুশীলন ভিন্ন ভোগ নিবৃত্তি ঘটিতে পারে না। কর্ত্তৃত্বাভিমানী সূত্রে জগতকে ভ্রান্তি জমাইয়া আকর্ষণ বিকর্ষণ করিয়া থাকে বলিয়াই ইহার ব্যবস্থাকে মায়ামৃগ বলিয়া জানে। এই সংসারে শুভ অশুভ উভয়ই কৃষ্ণ ভক্তির বাধক জানিয়া তাহাদের উদয় অস্ততে উদ্বিগ্ন কি হর্ষ করিবে না। এই জন্যই সর্ব্বদা অদৃষ্ট ভোগের দায় জন্য সহিষ্ণু হইয়া নিত্য সেবায় যত্নবান হইতে চেষ্টা করাই পরম আশ্রয়। স্বভাবে যেমন ভাগ্য উল্লাস উপস্থিত করিবে তাহাই বাধ্য হইয়া নির্বিচারে ভোগ স্বীকার করিতে চেষ্টা করিবে। তুমি কর্ত্তা নও ইহাই তোমার জানিবার প্রয়োজন। তাহারই উদ্ধার জন্য ব্যবস্থা করিবে। নয় মন কি বুদ্ধির উদ্ধার করিবার তোমার কি শক্তি বর্ত্তমান আছে? ভগবান যাহা ব্যবস্থা করিয়া দেন তাহাতেই সন্তোষ থাকিতে চেষ্টা করিবে।


(২৬১) সংসার ক্ষণভঙ্গুর, উদয় অস্ত গতি। স্থিতির অভাব থাকয়া গুণ কর্ষণে নানান ভাবে জড়িত হইয়া জীবের সুখ দুঃখ ভোগ করিতে হয়। এই সমস্ত অস্থায়ী ব্যাপারে ধৈর্য্যেই পরম সহায় হইয়া থাকে। ভগবান মঙ্গলময়, তিনি যাহা ব্যবস্থা করেন তাহা সকলি মঙ্গলজনক হয়।


(২৬২) সংসার চক্রেতে বৈভবাদি ঐশ্বর্য্য প্রকৃতি হইতে কোনরূপেই মুক্তিলাভের উপায় নাই। রজগুণ উদ্ভবাদি অহংকার যুক্তে অভিমানী যোগে নানান উপাধি লাভের প্রত্যাশিত হইয়া জীবের অনন্ত ফলভোগের দ্বারা দন্ডী হইয়া পড়ে। তাহাতে হিতাহিত বর্জ্জিত হইয়া বাসনা পূর্ণের জন্য পতিভক্তি সত্যরূপ ছাড়িয়া অসত্য অভাব পূজা প্রার্থনা করিয়া থাকে। ইহাই ভ্রমান্ধ বলিয়া অভিহিত করিয়াছে। জগতে জীবের কোন কর্ত্তৃত্ব কর্ম্ম নাই। সহিষ্ণুতার দ্বারায় সমস্ত প্রাক্তন বেগ অপসারণ করিতে করিতে দেহমুক্ত হইয়া কালের গতির পার হইয়া যাইতে পারে। সর্ব্বদা যাহাতে সত্যধর্ম্মের সেবা সুচারু রূপে বলবান থাকে তাহার প্রতি যত্ন ও লক্ষ্য রাখাই পতিসেবা। ইহাই পতিব্রতা ধর্ম্ম বলিয়া কথিত হইয়া থাকে।


(২৬৩) সংসার মায়ামুগ্ধ হইয়া সর্ব্বতোভাবে জীব পরমানন্দ ভোগের লালসা করিয়া থাকে। ভগবানের শরণ ভিন্ন সেই আনন্দ পাইতে কোন উপায় নাই।


(২৬৪) প্রারব্ধ ভোগের দন্ড ভোগদান করিয়া যাইতে থাক।


(২৬৫) অদৃষ্টে যাহা দিবে তাহাতেই সন্তোষ থাকিতে চেষ্টা রাখাই ভাল।


(২৬৬) ভাগ্যগতিকে সকলি সংমিলন হইয়া থাকে তাহাতে ধৈর্য্যই পরম বন্ধু, কাহারো কোন দোষ ও গুণ নাই।


(২৬৭) চিন্তা করিবার কি আছে? সর্ব্বদা সকল সময়, সকল অবস্থায় সহ্য করিয়া যাইতে চেষ্টা করিতে থাকাই উচিৎ। প্রারব্ধভোগ দেহের সঙ্গেই যাইবে।


(২৬৮) অদৃষ্টগত ভোগ জীবেরই স্বভাব সিদ্ধ। এই ভোগ দ্বারা দন্ড হইয়া থাকে। ইহার জন্য দুর্ব্বল হৃদয়ে প্রার্থনার প্রয়োজনেই ভগবৎ ভক্তির পদচ্যুত হইয়া যায়। মায়ামৃগে জড়িত সীতা রাবণের কবলে আটক হইয়া রাবণের হিত উপদেশ দ্বারা তুষ্টি সাধনে চেষ্টা করিয়াছিল। কিন্তু স্বভাবজাত রজঃ প্রকৃতি তাহার তত্ত্ব বুঝিয়াছিল না বলিয়াই অধৈর্য্যদ্বারা সীতার ধর্ম্মচ্যুতিতে চেষ্টিত ছিল। তৎপর আর সীতা তাহাকে কোন উপদেশ না দিয়া ধৈর্য্য নিয়াই প্রারব্ধ (অদৃষ্ট) ভোগদানে কৃতসঙ্কল্প হইয়া রাবণের সমস্ত দৌরাত্ম্যই অকাতরে বহন করিয়াছিল। ভগবান শক্তিতে সেই সকল আবরণ মুক্ত করিয়া সীতাকে উদ্ধার করিয়াছিল। অতএব, ধৈর্য্য ধর্ম্মই পরম ধর্ম্ম। অদৃষ্টভোগ কল্পিত কল্পক্ষয়েই মুক্ত হইয়া যাইবে। অতএব অদৃষ্ট ভোগই কর্ম্ম, প্রার্থনার কিছুই নাই।


(২৬৯) ভগবৎ সেবার শক্তিকে ক্ষেমঙ্করী বলে। অতএব প্রারব্ধ দন্ডের সকল বেগকে সহিষ্ণুতার দ্বারা ক্ষয় করিয়া থাকে। ইহার প্রথম আদর্শ প্রহ্লাদ, দ্বিতীয় আদর্শ হনুমান, অহঙ্কার দান করিতে করিতে অক্ষম, অকর্ত্তা হইয়া পড়া যায়। তৃতীয় আদর্শ দ্রৌপদী, চেষ্টা করিতে করিতে কোন সাহায্য না পাইয়া অকর্ত্তা হইয়া পড়ে, দুঃশাসন দুর্ব্বল হয়। চতুর্থ আদর্শ জগাই মাধাই, ভালমন্দ, জাতিমান শুন্যদ্বারা নিত্যানন্দকে সকল শক্তি দিয়া শান্তপদ লাভ করিতে পারে। শান্ত হওয়ার সিদ্ধ অসিদ্ধ, আবাহন বিসর্জ্জন শুণ্য হইয়া কর্ম্ম প্রারব্ধের ভোগের দন্ডানুসারে করিতে করিতে সমস্ত ভোগদন্ড মুক্ত হইতে পারে। অতএব সর্ব্বদা উপস্থিত কর্ম্মকে সমাপ্ত করিতে চেষ্টা করাই দরকার।


(২৭০) ভগবানকে ঋষিগণ প্রত্যক্ষ স্বরূপ দয়ার্দ্র [বলিয়াছেন] দয়াই তাঁহার স্বভাব। এমন কি হইতে পারে এ জগতে ভগবানের আশ্রয় ভিন্ন থাকিতে পারে? যেহেতুক [তিনি] সকল বস্তুর প্রাণ ও সত্ত্বা। অতএব কর্ম্ম প্রারব্ধবশেই গুণের তারতম্য যোগে চলিয়া যাইতেছে, কেবলমাত্র প্রাণের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া সকল ভার বিগ্রহ প্রদান করিয়া সকল কর্ম্ম সত্যের সঙ্গদান করিতে চেষ্টা রাখিবে। ভগবান অচিরেই শান্তপদ দিয়া পরম শান্তিতে নিয়া যাইবেন।


(২৭১) পতিব্রত ধর্ম্ম প্রারব্ধ ভোগের দ্বারা নষ্ট হয় না, প্রারব্ধ ভোগেই ধর্ম্মানুরাগ অনুশীলন হইয়া থাকে। কোন ভয় নাই।


(২৭২) প্রারব্ধ দন্ডের হাত ছাড়াইবার সাধ্য কাহারো নাই। মহা মহা প্রজ্ঞান ব্যক্তিকে ও প্রাক্তন দন্ডে হিতাহিত শুণ্য হইতে হয়।


(২৭৩) সংসার মায়াময়, দুস্তর তরঙ্গ। ইহার উদ্ধারের একমাত্র ভেলা পতিব্রত ধর্ম্ম, সত্যনারায়ণ ব্রত।


(২৭৪) সততঃ ধৈর্য্যশীল হইতে যত্নশীল হইবে। সংসার বিচিত্র, প্রারব্ধদন্ডমতে লোকের বুদ্ধি উৎপন্ন হয়। লোকে বলে বলং বলং বাহুবলং। অদৃষ্টচক্রে সমস্তই ঘটিয়া থাকে। মায়ার নাটের পরাবৃত্তি ভাব সকল কোন পরামর্শে কি কোন সাহায্যে ফিরাইতে পারে না। যাহা হইবার হইবেই, বেদে পুরাণে নায়ক নায়িকাদের জীবনীতে প্রকাশ হইয়া রহিয়াছে।


(২৭৫) সকল বেগই ধৈর্য্যদ্বারা সম্বরণ করিতে হয়। রাগ, দ্বেষ, হিংসায় কেবল বন্ধনই বাড়ে।


(২৭৬) সংসার তরণ করিতে একমাত্র ভক্তি শ্রদ্ধাই পরম সেতু। জগতে একমাত্র ধর্ম্মই সত্য, অসার আত্মীয়তা পথের পরিচয় মাত্র জানিবে।


(২৭৭) অদৃষ্টচক্রে যাহার যাহা ঘটিবে তাহার ভোগ এড়াইতে পারে না, তথাপি শরীরের স্বাস্থ্য জন্য সতর্ক থাকিতে চেষ্টা করিতে হয়।


(২৭৮) কেবল নাম করিবে। নামেই সকল অবস্থা স্থির করিয়া নিবে। চিন্তা করিবে না।


(২৭৯) সংসারকে কর্ত্তাভিমানীর আবরণে আখ্যা জানিয়া নিত্যকর্ম্ম প্রারব্ধ দ্বারা সম্পাদন করিয়া সমাপ্ত করিবে। ভগবান দরূণ ভিন্ন কোন কর্ম্ম সৃষ্টি করেন নাই। স্বভাব মোচন করাই ধর্ম্ম। এই অনুষ্ঠানকে যজ্ঞ বলে।


(২৮০) সংসার কালচক্রের নিয়তিতে এই জগৎ চালাইতেছে। খেলার মাঠের ন্যায় এই জগতের প্রারব্ধযোগে খেলার ন্যায় জয় পরাজয়, সুখ দুঃখ, শান্তি অশান্তি, আয় ব্যয় জনিত ভাব সকলকে সততই সহিষ্ণুতার দ্বারা বহন করিয়া যাইতে হইবে। ভগবৎ সমীপে এই সকল প্রারব্ধ দন্ড উপস্থিত হইতে পারে না বলিয়াই নামের অধীন হইয়া থাকিতে চেষ্টা করার জন্য সর্ব্বদাই জাগিয়া থাকিবে। কোনরূপেই চঞ্চল হইবে না। ভাগ্য মানিয়া চলিবে।


(২৮১) চিন্তা করিয়া নিজের সতীধর্ম্মকে নাশ করিয়া কোনই ফল নাই। যাহা হইবার তাহার বাধক কিছুই নাই। সর্ব্বদা ভগবানের নিকট থাকাই ধর্ম্ম। ভগবান ভিন্ন আর কিছুতেই শান্তি দিতে পারে না।


(২৮২) পরনিন্দা, পরদ্রোহী দানবী স্বভাব, দেবতার নয়। নিন্দুকের জন্য ভগবৎ সত্তার মলিন হয় না। নিন্দার কর্ত্তারই ঘটিয়া উঠে। সূর্য্য মেঘাচ্ছন্নে পড়িলেও সূর্য্য মলিন হয় না। মেঘই মলিন হয়।


(২৮৩) প্রারব্ধ বশতঃ জীবের গতাগতি স্থিতির যোগ বিয়োগ উৎপন্ন হয়। সংসার চক্রের দেব দানবেরই তরঙ্গ জানিবে।


(২৮৪) পরাধীনভাবের উদয় অস্ত কি করিয়া বলা যায় ?


(২৮৫) জগতে যাহা কিছু সংযোগ বিয়োগ হইয়া থাকে সকলি রাক্ষসী, আসুরী মায়া জানিয়া সকল অবস্থাকে তুচ্ছ করিয়া ফেলিতে চেষ্টা করিবে। এ জগতে কত লোকের কত রকম অবস্থা, দুরবস্থা ঘটে তাহা দেখিয়া শুনিয়া ধৈর্য্য ধরিতে চেষ্টা রাখাই উচিৎ।


(২৮৬) সংসার বিষয়ানলে দিবানিশি হিয়া জ্বলে। ভগবানের শরণ নিয়া থাকিতে হয়, উদয় অস্ত সকলি অসার। সার কি, অসার কি, জানিতে পারিলে মোহ হয় না।


(২৮৭) লোক সকল ভগবানের দাস, অর্থাৎ প্রাণের অধীন। প্রাণ না হইলে কাহারো কোন কর্ম্ম সম্পাদন হয় না। যে ইন্দ্রিয় প্রাণের সাহায্য না পায় সেই ইন্দ্রিয়েই অভাব হয়। গুণের দ্বারাই ইন্দ্রিয়াদির অহংকার মর্য্যাদার জন্য প্রাণকে ভুলিয়া কর্ত্তা হইয়া ইন্দ্রিয় প্রসূত সুখের আশায় এবং দুঃখের বিয়োগ জন্য ব্যস্ত হইয়া আপাততঃ মধুর পরিণাম বিষমিব যে সকল অস্থায়ী, অনিত্য সেই প্রকৃতির বশ হইয়া যোগমুক্ত হয়। ইহাই মায়া। এই দৈবী মায়ামুগ্ধ জীবের কি যে ভাল, কি যে মন্দ বুঝিতে পারে না বলিয়াই নানান আপাততঃ ক্ষণিক সুখের দায়ে পড়িয়া আত্মস্মৃতিহারা হয়। যাহা হউক, ধৈর্য্যই এই মায়ারর নাটের তরঙ্গ হইতে উদ্ধার করে। নামই সত্য, রূপের নিত্যতা নাই, কারণ রূপ গুণের আভাস মাত্র। রূপে মুগ্ধা হইলে পরে দুঃখ অনিবার্য্য। নাম আর ভগবান অভিন্ন। যদি তাই হয় তবে নাম নিয়া পড়িয়া থাকিলেই ভগবানের নিকট থাকা হয়। ভগবানের নিকট থাকিতেই যদি হইল তবে সুখের লালসা ভুল হয় না?? অতএব সুখের প্রত্যাশী না হইয়া কেবল নাম করিয়া চলিতে থাক, নামেই ব্রজবাসী করিয়া আপন করিয়া নিবে। পরশ্রীতে কাতরতা দুর্ব্বলের ধর্ম্ম। পরের ঐশ্বর্য্যের প্রতি লোভ করিতে নাই। নিজের যেটুকু ভক্তি শ্রদ্ধা ভগবান দেন সেই টুক নিয়াই সন্তোষ থাকিতে হয়। ইহাকেই পতিব্রত বলে। আপন পতি দরিদ্রই হউক, মূর্খই হউক, রোগীই হউক, পতি হইতে সুখই পাই, দুঃখই পাই, সকলি অমৃত বলিয়া ব্রজবাসীগণ ধারণা করেন। অতএব প্রাণকে সর্ব্বদা মনে রাখিতে ভুলিতে নাই। নাম পাইলে নাম কখন ত্যাগ করিবে না নিশ্চয়।


(২৮৮) কেবল নামের আশ্রয়ে থাকিয়া প্রাক্তন কর্ম্ম ঋণ শোধ করিয়া যাইতে থাক, ভগবান মঙ্গল করিবেন।


(২৮৯) সত্যং পরম ধীমহি। পরশ্রীকাতরতা হৃদয়ের উপসর্গ। নিরপেক্ষ থাকিয়া অদৃষ্ট চক্রের দেনা পাওনা যাহা আছে পরিশোধ করিয়া নিত্যের সম্ভারে যাইতে চেষ্টা রাখাই পরম পথ। পরের কথা গ্রাম্যবার্ত্তার যোগ ঘোর ব্যভিচার। পূর্ব্বাদিক্রমে মহাজনপুঞ্জের পথই পথ। পরের পথে খুঁজিয়া কন্টকই পরে। ধৈর্য্য কাহাকে বলে? কর্ত্তৃত্বাভিমানের ধৈরজশক্তি মেঘের সূর্য্য আচ্ছাদনের ন্যায় প্রতিফলন হয়।


(২৯০) চরাচর জগতের স্বভাবই যোগ বিয়োগ। এই যোগ বিয়োগ হইতে মুক্তির জন্য পতিরই চিন্তা সর্ব্বদা করাই উচিৎ।


(২৯১) ভগবানের কৃপাচারীপদে অধিষ্ঠান থাকিতে ভগবানের কৃপা ছাড়া কর্ত্তাভিমানে নির্ব্বিন্নতা হইতে পারে না। নাম নিয়া পড়িয়া থাকিতে পারিলে কোন বিষম বিষয়ের মায়ামৃত খুঁজিতে হয় না। পতিব্রত ধর্ম্মই সত্যব্রত। সত্যব্রত ছাড়া দক্ষব্রতের পাশে বন্ধন বই আর কিছুই ফল হয় না। মনের সুখের জন্য লালসার দ্বারা দুঃখের বোঝাই লাভ হয়। তাই হয় অভাব, ভাব থাকে না। পতিত জমিতে পতন পদার্থই উৎপন্ন হয়। কিছু কিছু করিয়া ধৈর্য্যের অভ্যাস করাই দরকার। ভগবান বিষম নয়, সম পদ। তারতম্য খুঁজিয়া ফল কি? মনের বৃত্তি চঞ্চলতার আকর। অতএব সর্ব্বদাই প্রাণের সঙ্গে থাকিতে চেষ্টা করিয়া নাম উচ্চারণ করিয়া যাইবে। ফলাফলরূপ সুখের দুঃখের আকর খুঁজিবে না।


(২৯২) সদাচারীর দরকার কি হইবে? জগতের পরিণাম কেবল সুখ সাগর অশোক বন মাত্র। অভ্যাস ভিন্ন কিছুই হইতে পারে না, অভ্যাসে পঙ্গুভিঃ লঙ্ঘয়তে গিরিম্। হাই ছাড়িয়া বসিতে পারে কে? সংসার ঋণ তো ছাড়ে না। সত্যই কিনা জগতের পরিহারের জিনিস, অশোকের সম্ভারই রাবণের সম্বল। সীতাঠাকুরাণী সেই খানেই সরমার দয়ায় ঘেরা ছিল। পরম সুখ রাবণের ঘরেই ঘুরিয়া বেড়ায়, গোপালের ঘরে থাকেন রাম, রাম, সত্ রাম।


(২৯৩) ভগবৎভক্তি ভিন্ন আর সংসার ত্রাণের অন্য কোন উপায় নাই। ইহাই সর্ব্বদা হৃদয়ের মধ্যে জাগাইয়া রাখিবে। বাসনা সকল বন্ধনের মূল, অতএব কোন বাসনার অধীন না হইয়া প্রারব্ধ দন্ডভোগে অকারতা দিয়া সহ্য করিবে।


(২৯৪) সংসারে স্ত্রী পুত্রাদি বৈভবদ্বারা জীবের নানাবিধ ভোগ ঐশ্বর্য্যে প্রলোভনে মায়াময় শক্তিতে জীবের বন্ধন সাধন করিয়া থাকে। এর উৎপন্নাদি অনুপন্ন বিষয়ের দাসত্ব ভার মুক্ত করিতে কামনা ইচ্ছাদি রজগুণ সমুদ্ভব উপচারের শৃঙ্খল হইতে মুক্ত পাওয়ার কারণই ভগবৎ নিরপক্ষের শরণ নিয়া থাকিবার চেষ্টা করিতে করিতে অদৃষ্টভোগ কাটিয়া যাইয়া সদয় মুক্তলাভ করিতে সক্ষম হইয়া থাকে। ভগবানের স্থান নিত্য, পুত্র কলত্রাদির স্থান অনিত্য। গত বিষয় চিন্তা করিয়া কোন লাভ হইতে পারে না। ভগবৎ চিন্তায়ই ব্যাপ্ত থাকিতে সততঃ চিন্তা করার অভ্যাস করিবে।


(২৯৫) প্রারব্ধ ভোগের অন্ত ভিন্ন সংসারের কর্ম্মত্যাগ হইতে পারে না। ভবিতব্য না থাকিলে পুরুষকারের দ্বারা কিছুই হইতে পারে না। [যখন] সময় হইবে তখন সকলি মিলিবে।


(২৯৬) ঐহিক শান্তির জন্য সকল প্রারব্ধ কেবল সহিষ্ণুতাতেই পরম মঙ্গল করে। সকল অবস্থায়, সকল কর্ম্মে নাম করিয়া নিযুক্ত রাখিবে।


(২৯৭) প্রারব্ধসূত্রে যাহা যাহা সংসারের সুখ দুঃখ, আধিব্যাধি উৎকর্ষণ হয় তাহা জীবের মঙ্গল করিয়া থাকে। ভগবান সর্ব্বমঙ্গলময়, সততই জীবের পরিত্রাণের জন্য তিনি সর্ব্বদা জীবের নিকট প্রকাশ হইয়া থাকেন। বাসনা সঙ্কুলে জীবের আবদ্ধ থাকায় দেখিতে পারে না। সর্ব্বদা ভগবানের শরণ করিতে করিতে চিত্ত শোধন হইয়া দিব্য চক্ষুর বিকাশ হয়, পরে ভগবানের স্বরূপ দর্শন হইয়া আর এই ভ্রান্তিমূলক সংসার বন্ধন জন্ম মৃত্যু, সুখ দুঃখাদি থাকে না। এই জন্যই ভগবানকে দয়াময় বলিয়া বেদে প্রকাশ করিয়াছে।


(২৯৮) জীবের মুক্তদেহ লাভ করিবার জন্যই এ জগতে জীবের ভোগদেহ ধারণ করিতে বাধ্য হয়। এই তো সাধুমুখের বাক্য। সংসারের জীবদেহ নিয়া থাকিবার জন্য কাহারো ভোগে ইচ্ছা থাকে না। যাহা হউক, ভাগ্যবশে সকলি ঘটিয়া থাকে। যাহা অদৃষ্টে আছে তাহা কেহই ছাড়াইতে পারে না, সকলি ভোগ নিয়া যাইতেছে। দেহের পরিপুষ্টির জন্য চিকিৎসকের শরণ লইতে হয়, ভগবৎ চর্চ্চার জন্য চিকিৎসক রোগী হয় না, কেবল ভোগীর জন্যই হইয়া থাকে।


(২৯৯) দিবানিশি ভগবৎ সমীপে চিত্তকে জাগাইয়া রাখিবার চেষ্টা করিবে। কালে তিনি প্রকাশ হইবেন, তখন সকল প্রকার মনের মালিন্যময় কর্ত্তৃত্বাভিমান দুর হইয়া তার দাসত্ব বুদ্ধির জ্ঞান প্রস্ফুটন হইবে।


(৩০০) সংসার মায়াময়, প্রারব্ধের বশে চলিয়া বেড়ায়, অদৃষ্টের দ্বারা ফলাফল ভোগ হইয়া থাকে। কেবল বাসনাময় কর্ত্তৃত্বাভিমানী বুদ্ধির দ্বারা জীবের ভ্রান্ত কর্ম্ম প্রয়াস পাইয়া লাভ লোকসানাদি, সুখ দুঃখ দ্বারা প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া তাপ অনুভোগ করে। যদি ভগবান বুদ্ধি ঘটে অধিষ্ঠান করিয়া লইতে পারে তাহা হইলে নির্ম্মঞ্ছন শক্তিতে তাপাদি পীড়ন ব্যাপার হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিতে পারে। এই জন্যই সততঃ শান্তির উপায় পাওয়ার জন্যই মন্ত্রাদি লাভ করিয়া তার অধীন হইয়া অকর্ত্তা বুদ্ধির উপলব্ধি করিয়া লইয়া অদৃষ্টচক্রের তাড়না হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া গুরুর প্রত্যক্ষতা লাভ করিয়া থাকে।


(৩০১) যদি নিজের হয় তবে অন্য কেহই নিতে পারে না। যদি নিজের না হয় তবে কি করিয়া রাখিবে? পরের বস্তুর প্রতি কর্ত্তৃত্ব রাখায় ফল কি?


(৩০২) সর্ব্বদা নাম করিবে, তাহাতে গ্রহবৈগুণ্য মুক্ত হইবে।