পঞ্চম অধ্যায় (১)

আমার অগ্রজ ঁফণীভূষণ বন্দোপাধ্যায় এই সময়ে আমতায় মুন্সেফ্ ছিলেন।  আমার নিকট ঠাকুরের কথা শুনিয়া তিনি কিছুদিন যাবত আগ্রহ প্রকাশ করিতেছিলেন যে, একবার যেন সুযোগ মত তাঁহাকে আমতায় লইয়া যাই। বৌদিও ঠাকুরকে একবার দেখিবার জন্য অত্যান্ত উৎসুক হইয়া উঠিয়াছিলেন এবং মনে মনে স্থির করিয়া রাখিয়াছিলাম যে, এবার ঠাকুর কলিকাতায় আসিলে তাঁহাকে একবার আমতায় যাইবার জন্য অনুরোধ করিব। যতদূর স্মরণ হয়, ১৯২২ খ্রীস্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসের গোড়ার দিকে ঠাকুর কলিকাতায় আসিলেন এবং মতিবাবুর ডিক্সন লেনের বাসায় উঠিলেন। সংবাদ পাইয়া সেদিন বৈকালেই ঠাকুর দর্শনে আসিলাম। আসিয়া দেখিলাম যে, আসর বেশ গুলজার, মতিবাবু, প্রভাতবাবু, বরদাবাবু প্রভৃতি অনেকেই উপস্থিত আছেন কিন্তু বিশেষ করিয়া আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিলেন একজন অপরিচিত ভদ্রলোক।  তিনি যুক্তাসনে মেরুদণ্ড টান করিয়া ঠাকুরের সম্মুখে বসিয়া রহিয়াছেন। কথাবার্ত্তা যাহা কিছু তিনিই বলিতেছেন, ঠাকুর মাঝে মাঝে শুধু এক আধবার “হ্যাঁ, না,” করিতেছেন মাত্র।  অনুসন্ধানে জানিলাম যে, তিনি বহুদিন হইতেই ঠাকুরের সঙ্গে পরিচিত, ছুটি লইয়া বায়ু পরিবর্ত্তনে গিয়াছিলেন, কর্ম্মস্থলে ফিরিবার পথে ২/৪ দিনের জন্য কলিকাতায় আছেন এবং ঠাকুরের সংবাদ পাইয়া তাহার সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছেন। ভদ্রলোকের কথাবার্ত্তায় ধরণটা কিন্তু আমার মোটেই পছন্দ হইল না।  তিনি বলিতেছিলেন যে, বায়ু পরিবর্ত্তনে যাইয়া তাহার একজন সাধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হইয়াছিল, অতি উঁচু দরের লোক, এবং তাহার উপদেশাবলীও তেমনই সারগর্ভ। এই উপদেশের কিছু কিছু তিনি উদ্ধৃত করিতেছিলেন এবং চারিদিকে তাকাইতেছিলেন,  ভাবটা যেন এই যে, এই সকল অতি উচ্চস্তরের কথা, তোমাদের জন্য নয়, একমাত্র ঠাকুরই যদি কিছুটা বুজিয়া উঠিতে পারেন। শীঘ্রই অতিষ্ঠ হইয়া উঠিলাম এবং এক সুযোগে বাহিরে চলিয়া গেলাম। বরদাবাবুও আমার সঙ্গে আাসিলেন, সিগারেট ধরাইয়া ছাদের এক কোণে যাইয়া বসিলাম। বরদাবাবু বলিলেনঃ “দেখলেন লোকটার অবস্থা, অহংকারে এত ফুলিয়াছে যে এখন ফাটিলেই হয়। কিন্তু আমি ভাবিতেছিলাম অন্য কথা। এই ভদ্রলোক ঠাকুর ও আমাদের সম্মুখে তাহার সেই নবপরিচিত সাধুটির এবং তৎসঙ্গে আরও দু’চার জনের এত উচ্ছ্বসিত প্রসংশা করিতেছিলেন কেন ? আমার সেই উকীলবাবুর কথা মনে পড়িয়া গেল; তবে তফাৎ এই যে, উকীলবাবু আমার সহিত আলাপ আলোচনায় অন্যান্য সাধুদের কথা তুলিয়া প্রকারান্তরে ঠাকুরকে হেয় প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করিতেন, আর ইনি ঠাকুরের সম্মুখেই অনুরূপ প্রকাশ পাইলেন। কথাটা অত্যান্ত রূঢ় শুনাইতেছে এবং কেহ কেহ মনে করিতে পারেন যে, আমি মনগড়া একটা কিছু ধরিয়া লইয়া তিলকে তাল করিয়া অযথা ভদ্রলোকের উপর দোষারোপ করিতেছি। কিন্তু কথাটা আমার জ্ঞান বিশ্বাস মতে সত্য এবং সেই জন্যই ইহা প্রকাশ করিতে দ্বিধা করিলাম না। পরে এই ভদ্রলোকের অদ্ভুত পরিবর্ত্তন লক্ষ্য করিয়াছিলাম এবং তিনি ঠাকুরের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন। একবার বলিয়াছি, আবারও বলি যে, অহংকারাত্মিকা বুদ্ধি লইয়া ঠাকুরকে যাচাই করিতে আসিয়া কাহারও কোন লাভ হইতে দেখি নাই, বরং কেহ কেহ ঠাকুরের প্রতি একটা অশ্রদ্ধার ভাব লইয়া ফিরিয়া গিয়াছেন। তিনি ছিলেন কাচের আয়নার মত। যেরূপ ভাব লইয়া তাঁহার নিকট যাওয়া যাইত, সেরূপ ভাবই তাঁহাতে প্রকাশ পাইত।

সেদিন আর ঠাকুরের সঙ্গে কথা বলিবার সুযোগ হইল না। পরের দিন ছুটি ছিল, প্রাতঃকালেই আসিয়া ঠাকুরের নিকট উপস্থিত হইলাম, বঁরদাবাবু পূর্ব্বেই আসিয়া জুটিয়াছিলেন। একবার আমতায় আমার দাদার বাসায় যাইবার কথা বলিতে ঠাকুর অতি সহজেই সম্মত হইয়া গেলেন এবং তখনই স্থির হইল যে, পরেরদিন প্রাতঃকালে ৭ টার ট্রেনে মতিবাবু,  বরদাবাবু ও আমি ঠাকুরকে লইয়া আমতা রওনা হইব। নিদ্দির্ষ্ট সময়ে উটরাম ঘাট হইতে খেয়ায় গঙ্গা পার হইয়া তেলকলঘাট স্টেশনে আসিয়া গাড়িতে চাপিলাম। বর্ত্তমান হাওড়া -আমতা লাইনে তেলকলঘাট ও হাওড়া ময়দান, এই দুটি স্টেসন উঠিয়া গিয়াছে, কদমতলা যাইয়া ট্রেনে উঠিতে হয়। এই লাইনে কোন দ্বিতীয় শ্রেণী ছিল না। মধ্যম শ্রেণীতে অত্যন্ত ভিড় দেখিয়া আমারা প্রথম শ্রেণীর কামরাখানাই অধিকার করিয়া বসিলাম। ছোট লাইন এবং তদপযোগী ছোট্ট একখানা প্রথম শ্রেণীর কামরা। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্যক্রমে আর কোন যাত্রী না থাকায় আমরা আরামেই বসিলাম। দাদা আমতা থাকাকালীন এই গাড়ীতে আমি বহুবার যাতায়াত করিয়াছি এবং সেই ছোট লাইনের অভিনবত্ব এখনো মনে দাগ কাটিয়া রহিয়াছে। গতি ৫ হইতে ১০ মাইলের মধ্যে, হেলিয়া দুলিয়া গাড়ী খানা চলিয়াছে। মাঝে মাঝে অসম্ভব ঝাঁকানি, সকালে-বিকেলে ডেলি প্যাসেন্জারের ভিড় এবং তাহাদের সেই মামুলি কথাবার্ত্তা, সকল কথাই মনে পড়িতেছে। রেলের রাস্তাটিও অভিনব, কাহারও বৈঠকখানার দ্বার দিয়া, কাহারও রান্না ঘরের পিছন দিয়া, কখনও বা কাহারও বাহিরের উঠানের মধ্য দিয়াই আঁকিয়া বাঁকিয়া চলিতেছে। একটা জায়গার কথা আমার বিশেষ ভাবে মনে আছে। রাস্তাটা সেখানে দুইটা ময়রার দোকানের একেবারে কোল ঘেঁষিয়া গিয়াছে, যখনই গাড়ীটা সেই জায়গাটা অতিক্রম করিয়া যাইত, তখনই মনে হইত যে, হাত বাড়ালেই বোধহয় একটা রসগোল্লা বা দুইখানা জিলাপি তুলিয়া লওয়া যায়। আর একটা কথাও স্পষ্ট মনে আছে। মুন্সীরহাট স্টেসনে আসিলেই ফেরিওয়ালার ডাক শুনিতাম, “রম্ভা, চাই রম্ভা” ; এখানে আসিলেই চলতি “কলা” কথাটা হঠাৎ কি করিয়া বিশুদ্ধ “রম্ভায়” পরিণত হইয়া যাইত, তাহা বলিতে পারিব না।

যাহা হউক, গাড়ী চলিতে লাগিল এবং আমি ও মতিবাবু প্রায় প্রতি স্টেসনেই প্ল্যাটফরমে নামিতে লাগিলাম। কিন্তু অধিকাংশ স্টেসনেই গাড়ী দু’এক মিনিটের বেশি না থামায় আরাম করিয়া সিগারেট খাওয়া হইল না। দু’চারটি টান দেই, আবার নিভাইয়া ফেলি, এইরূপই চলিতে লাগিল। হঠাৎ ঠাকুর বলিয়া বসিলেনঃ “বার বার উঠা নামা করার দরকার কি, ঐদিকে মুখ ফিরাইয়া গাড়িতেই সিগারেট খান।“ আমরা উভয়েই অত্যান্ত লজ্জিত হইলাম এবং ঠাকুর আরও দু’এক বার বলা সত্ত্বেও দাদার বাসায় পৌঁছিবার পূর্ব্বে আর সিগারেট খাইলাম না। ব্যাপারটা সামান্য মনে হইতে পারে কিন্তু ঠাকুর যে আমাদের সঙ্গে কিভাবে চলিতে চাহিতেন তাহার কতকটা আভাস এই ক্ষুদ্র ঘটনা হইতেই পাওয়া যাইতে পারে। পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, কচিৎ কখনও ইহার ব্যতিক্রম হইলেও সাধারণতঃ ঠাকুরের সঙ্গে নিজের একটা উল্লেখযোগ্য দুরত্ব কখনও অনুভব করি নাই। গুরু-শিষ্য বলিতে যাহা বুজা যায়, তাঁহার সহিত সেরূপ একটা সম্মন্ধ অন্ততঃ আমার কোন দিনই গড়িয়া উঠে নাই। এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়িতেছে। তখন ঠাকুর আমার ৫৭সি, বিডন স্ট্রীটের বাসায় ছিলেন।একদিন সকাল বেলা আমি ও ঠাকুর আমার বাহিরের ঘরে বসিয়া রহিয়াছি এমন সময় আমার বিশেষ পরিচিত এক ভদ্রলোক সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।তিনি ঠাকুরকে চিনিতেন না, আমাকে জিজ্ঞেসা করিলেনঃ “ইনি কে?” আমি হঠাৎ কিছুই বলিতে না পাড়িয়া কি করিব ভাবিতেছি, “ইতিমধ্যে ঠাকুর নিজেই বলিলেন, “ইন্দুবাবু আমার আত্মীয়।” এই কথার উপর ভদ্রলোক আর কিছু বলিলেন না।আমার নিকট যে কাজে আসায়াছিলেন তাহা সমাধা করিয়া চলিয়া গেলেন।আমাদের সম্পর্কে ঠাকুরের মুখে শিষ্য কথাটা কখনও শুনিয়াছি বলিয়া মনে পড়ে না। তিনি আমাকে আত্মীয় বলিয়া পরিচিত করিলেন, ইহা অপেক্ষা আর কি সৌভাগ্য হইতে পারে আমি জানি না।পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, তাঁহার সহিত আমার যে-সম্মন্ধ গড়িয়া উঠিতেছিল তাহার মূলে ছিল প্রীতি এবং এই প্রীতিকে ভিত্তি করিয়া তিনি কখনও পিতা, কখনও সখা এবং কখনও বা পুত্রের মত ব্যবহার করিতেন; আমার বিশ্বাস যে, নিতান্ত বন্ধুভাবেই তিনি আমাদিগকে গাড়ীর মধ্যেই সিগারেট খাইতে বলিয়াছিলেন। কিন্তু আমাদের নিজেদের দূর্ব্বলতার দরুন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁহার সহিত অনুরূপ ব্যবহার করিয়া উঠিতে পারি নাই। জীবনে এমন দু’চার বার হইয়াছে যে, স্থানাভাবে ঠাকুরের সঙ্গেই এক বিছানায় শুইয়াছি। তাঁহার গায়ে পা লাগিয়া যাইবে—– এই আপত্তি তুলিয়া অন্যত্র শুইতে চাহিয়াছি, “ওতে কোন দোষ হয় না” বলিয়া ঠাকুর আমাকে নিরস্ত করিয়াছেন। কিন্তু ভাল ঘুমাইতে পারি নাই, মনে মনে একটা শংঙ্কা থাকিয়াই গিয়াছে। এই প্রসঙ্গে কত কথাই না মনে পড়িতেছে। একদিন ঠাকুরের সঙ্গে হেদোতে একখানি বেঞ্চে বসিয়া আছি, এক চিনেবাদামওয়ালা যাইতেছে দেখিয়া ঠাকুর আমাকে দুই পয়সার চিনেবাদাম কিনিতে বলিলেন, পরে ঠোঙ্গাটি আমাদের দুই জনের মাঝখানে রাখিয়া নিজেও দুইটি একটি খোসা ছাড়াইয়া খাইতে লাগিলেন এবং আমাকেও খাইতে বলিলেন। তাঁহার নির্দ্দেশ মত আমিও খাইতে লাগিলাম, তবু কেন জানি না, ঠাকুরের সঙ্গে এক পাত্র হইতে খাইতে কেমন যেন বাধ বাধ ঠেকিতে লাগিল। ঠাকুরের যে চিনেবাদাম খাওয়ার কোন প্রয়োজন হইয়াছিল এমন কথা উঠিতেই পারে না, শুধু আমাকে একটু নিকটে টানিবার জন্যই ঠাকুর এই অভিনয় করিয়াছিলেন। সেই জন্যই বলিতেছিলাম যে, ঠাকুর যেরূপ ব্যবহার করিতেন এবং যেরূপ ব্যবহার চাহিতেন নিজের দূর্ব্বলতা ও সংশয়ের জন্য সেরূপ ব্যবহার করিয়া উঠিতে পারিতাম না। একটা কাহিনী মনে পড়িতেছে। একদিন ভাগবত পাঠ শুনিতে গিয়াছিলাম, পাঠক মহাশয় বলিতেছিলেন যে, শ্রীকৃষ্ণ তখন মথুরায় রুক্মিণী, সত্যভামা ইত্যাদিকে লইয়া রাজত্ব করিতেছেন। একদিন সত্যভামা আসিয়া শ্রীকৃষ্ণকে বলিলেনঃ “শুনিয়াছি যে তুমি বৃন্দাবনে ব্রজগোপীদিগকে লইয়া রাসনৃত্য করিয়াছিলে। আমাদেরও নিত্যন্ত ইচ্ছা যে আমাদের লইয়া এখানেও তুমি সেই রাসনৃত্য কর।” শ্রীকৃষ্ণ বলিলেনঃ “বেশ, তাহাই হইবে”, এবং একটি রাত্রি স্থির করিয়া নৃত্যোপযোগী ব্যবস্থা করিবার আদেশ জারি করিলেন। নিদিষ্ট রাত্রিতে নৃত্য আরম্ভ হইল কিন্তু অধিক দূর অগ্রসর হইতে পারিল না। একটু পরেই মহিষীরা বলিতে লাগিলেনঃ “এ কেমন নৃত্য ! তোমার গায়ে পা লাগে যে।” শ্রীকৃষ্ণ বলিলেনঃ “তাহা তো লাগিবেই, এই নৃত্যের উহাই বিধি।” এই কথা শুনিয়া মহিষীরা সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিলেন এবং “তাহা হইলে এই হতচ্ছাড়া নৃত্যে আমাদের প্রয়োজন নাই” এই কথা বলিয়া নৃত্য থামাইয়া দিলেন। ঠাকুরও আমাকে নানাভাবে তাঁহার অতি নিকটে টানিয়া লইতে চাহিয়াছেন কিন্তু কৃষ্ণমহিষীদিগের যেমন হইয়াছিল সেরূপ সংস্কার ও সঙ্কোচ  আসিয়া বাধা দিয়াছে, আমি ঠাকুরের অভিপ্রেত পথে অগ্রসর হইতে পারি নাই।

      এই বিষয়টিকে আরও সবিস্তারে আলোচনা করিবার যথেষ্ট উপকরণ আমার কাছে আছে কিন্তু আপাততঃ শুধু আর একটি ঘটনার উল্লেখ করিয়াই ইহার উপসংহার করিব। এই সময়ের সম্ভবতঃ প্রায় বাৎসরাধিক পরের ঘটনা, একদিন বৈকালে পঞ্চুবাবু ঠাকুরকে লইয়া আমার সেই বিডন স্ট্রিটের বাসায় আসিয়া উপস্থিত। পঞ্চুবাবুর বাড়ী ছিল হুগলী জেলার জিরাট নামক গ্রামে কিন্তু তিনি মানুষ হইয়াছিলেন ধুবড়ীতে। সেখানে তাহার পিতা একজন লব্ধপ্রতিষ্ট উকিল ছিলেন। তিনি যখন দ্বিতীয় শ্রেণীতে (বর্তমানের নবম শ্রেণি) পড়িতেন তখন সন্ত্রাসবাদীদিগের সহিত তাহার সংযোগ আছে সন্দেহে পুলিশ তাহার পিছনে লাগে। তাহাকে দেশে পাঠাইয়া দেওয়া হয় এবং সেখানেই তাহার লেখাপড়ার ইতি হইয়া যায়। ইতিমধ্যে তাহার পিতৃবিয়োগ হয় এবং তিনিও অনেকটা স্বাধীন ভাবে বিচরণ আরম্ভ করেন। কালক্রমে তিনি এক তান্ত্রিক সাধুর সহিত সংশ্লিষ্ট হ’ন এবং তাহার উপদেশ মত যোগাদি অভ্যাস করিতে থাকেন। কিন্তু ইহাতে হিতে বিপরীত হইয়া তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত  হ’ন। খুব সম্ভব ১৯১৪ খ্রীস্টাব্দের কোন এক সময়ে  পঞ্চুবাবু তাহার মাকে লইয়া কাশী গিয়াছিলেন, সেখানেই ঘটনাচক্রে ঠাকুরের সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইয়া যায়। ঠাকুরের নির্দ্দেশ মত কিছুকাল চলিবার পরই তাহার রোগ সারিয়া যায় এবং তিনিও ঠাকুরের একজন ঐকান্তিক সেবক হইয়া পড়েন। আমার ঠাকুরের সহিত পরিচয়ের প্রথমাবস্থায় পঞ্চুবাবুকে কিছুদিন ঠাকুরের তল্পিবাহকরূপে দেখিয়াছিলাম। ঠাকুর যেখানেই যাইতেন পঞ্চুবাবুও পিছনে পিছনে ঠাকুরের গাঁটরিটি লইয়া সঙ্গে সঙ্গে যাইতেন।

      আমি জানিতাম যে, পঞ্চুবাবু ঠাকুরকে লইয়া নৈনিতাল গিয়াছেন, এখন বলিলেন যে বৃন্দাবন হইতে ফিরিতেছেন। এই দুরন্ত গরমে বৃন্দাবন গিয়াছিলেন কেন জিজ্ঞেসা করাতে পঞ্চুবাবু বলিলেন যে, প্রথমে তিনি ঠাকুরকে লইয়া নৈনিতালই গিয়াছিলেন, সোহং স্বামীর আশ্রমে উঠিয়াছিলেন। কিন্তু ২/৩ দিন পরেই ঠাকুর আর সেখানে থাকিতে সম্মত না হওয়ায় অন্য একটি ঘর ভাড়া করিয়া সেখানে চলিয়া যান। মধ্য ভারতের কোন এক করদরাজ্যের রাজা এই সময়ে সস্ত্রীক নৈনিতালে অবস্থান করিতেছিলেন, ইহারা স্বামী স্ত্রী, কি জানি কেন, ঠাকুরের প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট হইয়া পড়িলেন। রানী নিয়মিত দুইবার এবং রাজা অন্ততঃ একবার ঠাকুর দর্শনে আসিতে লাগিলেন। ফলমূলাদির উপটৌকনও নিয়মিতই আসিত, ঠাকুর তাহা স্পর্শও করিতেন না। পঞ্চুবাবু সারাদিন বারে বারে আকন্ঠ খাইতেন কিন্তু তথাপি বেশীর ভাগই পড়িয়া থাকিত এবং সেগুলো বিলাইয়া দেওয়া হইত। কিছুদিন এভাবে চলিবার পর রাণী একদিন ঠাকুরকে বলিলেনঃ “আভি আপ বুড্ঢা হো গায়া, ইধার উধার ঢুঁড়নেকা বক্ত ই নেহি হ্যায়। মেরা রাজ্যমে চলিয়ে, একঠো বঢ়িয়া আশ্রম বনা দুঙ্গি, মজেমে রহ্ যায়েঙ্গে।” উত্তরে ঠাকুর নিজের বুকের দিকে অঙ্গুলী নির্দ্দেশ করিয়া বলিলেনঃ “আশ্রম তো হিহেই হ্যায়।” সেই দিনই ঠাকুর পঞ্চুবাবুকে বলিলেনঃ “রাণী কানী দিয়া আমাগো কাম নাই, কালই চলেন অন্যখানে যাই।” ঠাকুরের নির্দ্দেশ মত ইহার পরের দিনই পঞ্চুবাবু তাঁহাকে লইয়া বৃন্দাবন রওয়ানা হইয়া আসিলেন।

বৈশাখ মাসের শেষাশেষি, বৃন্দাবনে দূরন্ত গরম। নৈনিতালের ঠান্ডা আবহাওয়া হইতে আসিয়া পঞ্চুবাবুর পক্ষে এই গরম অসহনীয় হইয়া উঠিল। ঠাকুর কিন্তু যেমন তেমনেই আছেন, নৈনিতালেও যা, আর বৈশাখ মাসের বৃন্দাবনেও তা। একতলার একখানি ঘর ভাড়া লওয়া হইয়াছিল। সঙ্গেই একটি ছোট রান্নাঘর ছিল। রান্নাঘরের পাশেই কূয়া, জল তুলিবার জন্য একটি লোক নিযুক্ত হইয়াছিল। পঞ্চুবাবু বলিলেন যে, ভোরবেলা শৌচাদি সমাপন হইয়া গেলেই ঠাকুর তাহাকে যমুনায় স্নান করিতে পাঠাইয়া দিতেন। পঞ্চুবাবুরও ইহাতে আপত্তি করিবার উপায় ছিল না ; কারণ একটু বেলা হইলেই বালু এমন তাতিয়া যাইত যে ঘরের বাহির হওয়া সম্ভব হইত না, মনে হইত যেন আগুনের ঝলকা বহিয়া যাইতেছে। যমুনা হইতে ফিরিয়া পঞ্চুবাবু দেখিতেন যে, ঠাকুর ইতিমধ্যে উনান ধরাইয়া তরকারি রাঁধিয়াছেন, শাখ ভাজিয়াছেন, এবং হাড়িতে ভাত চড়াইয়া দিয়াছেন। চালের সঙ্গে কিছু ডালও পুঁটলি বাঁধিয়া হাড়িতে ফেলিয়া দিয়াছেন। এইরূপ প্রত্যহই হইত, ঠাকুর পঞ্চুবাবুর কোন আপত্তি আমলেই আনিতেন না। পাছে তাহার কোন অসুবিধা হয় এই জন্যই ঠাকুর নিজের তাঁহার আহারটি অত্যন্ত সরল করিয়া লইয়াছিলেন, ৪টি খেজুর, ৪টি মনক্কা ও তিন-চার গ্লাস জল খাইয়াই খাটাইয়া দিতেন। গরমের দরুন ৮টা-৮.৩০’টার ভিতরেই স্নানাহার শেষ করিয়া দরজা জানালা বন্ধ করিয়া ভিতরে বসিয়া বা শুইয়া থাকিতে হইত। রাত্রি ৮ টার পৃর্ব্বে বাহিরে যাওয়া সম্ভব হইত না। পঞ্চুবাবু কখনও বা বসিয়া, কখনও বা শুইয়া, কখনও বা ঠাকুরের সঙ্গে কথা বলিয়া সময়টা কাটাইয়া দিতেন। ঘুম বড় একটা হইত না, মাঝে মাঝে তন্দ্রা আসিত। কিন্তু যখনই তন্দ্রা ভাঙ্গিয়া যাইত তখনই দেখিতেন যে, ঠাকুর পাখা লইয়া তাহাকে হাওয়া করিতেছেন, অথবা ভিজা গামছা দিয়া সযত্নে তাহার ঘা মুছাইয়া দিতেছেন। পঞ্চুবাবু উভয় সংকটে পড়িলেন, ঠাকুরের এই সেবাও তিনি বরদাস্ত করিতে পারেন না, অথচ ঠাকুরকে ফেলিয়া চলিয়াও যাইতে পারেন না, নিত্যন্ত অস্বস্তিতে তাহার দিন কাটিতে লাগিল। পঞ্চুবাবু আমাকে বলিলেন যে, বসিয়া বসিয়া তিনি তাহার দূর্ভাগ্যের কথা ভাবিতেন। ঠাকুরকে এমন নিঃসঙ্গ অবস্থায় একাকী অনেক সুকৃতিবলেই তিনি পাইয়াছিলেন কিন্তু তাহার ভাগ্যদোষে কিছুই হইল না। একদিন কিন্তু ঠাকুরের আচরণ পঞ্চুবাবুর ধৈর্য্যের সীমা অতিক্রম করিয়া গেল। যে ভৃত্যটিকে নিযুক্ত করা হইয়াছিল সে সকালে তিন বালতি ও সন্ধ্যার পর তিন বালতি জল তুলিয়া দিয়া যাইত। ইহাতেই সব কাজ সমাধা হইয়া যাইত। সেদিন সন্ধ্যাবেলা বাড়ীওয়ালার পুত্র আসিয়া সংবাদ দিল যে, ভৃত্যটি অসুস্থ, সে আসিতে পারিবে না, সুতরাং জল তোলার ব্যবস্থা নিজেদেরই করিয়া লইতে হইবে। রাত্রিতে রান্নার হাঙ্গামা ছিল না, বাজার হইতে পুরী তরকারী ও কিছু মিস্টি আনিয়াই পঞ্চুবাবু চালাইয়া দিতেন। অনুসন্ধানে দেখিলেন যে, তখনও কলসীতে ও একটা বালতিতে যে পরিমাণ জল আছে তাহাতে রাত্রিটা অনায়াসে কাটাইয়া দেওয়া যাইবে। সুতরাং স্থির করিলেন যে, রাত্রিতে আর জল তুলিবেন না, প্রাতঃকালে ভৃত্য আসে ভাল, নতুবা নিজেই যাহা হয় করিবেন, ঠাকুরকেও এই কথা জানাইলেন। ইহার খানিক পরে পঞ্চুবাবু বাহির হইয়া গেলেন এবং যমুনার তীরে কিছুক্ষণ বেড়াইয়া, রাত্রির খাবার কিনিয়া ঘন্টাখানেক পরে ফিরিয়া আসিলেন। একটু পরেই হঠাৎ তাহার বালতিগুলোর দিকে নজর পড়িল, তিনি দেখিলেন যে, তিনটি বালতিই জলে ভর্তি হইয়া আছে। কর্ম্মটি যে ঠাকুরের তাহা বুজিতে পঞ্চুবাবুর কোন কষ্ট হইল না। ঠাকুরের দিকে তাকাইতেই তিনি যেন কাঁচুমাচু হইয়া গেলেন। পঞ্চুবাবু আমাকে বলিলেন যে, কোন বালক দুস্কর্ম করিয়া ধরা পড়িয়া গেলে শাস্তির ভয়ে যেভাবে তাকাইয়া থাকে ঠাকুরও যেন ঠিক সেভাবেই তাহার দিকে চাহিয়া রহিলেন। কিন্তু পঞ্চুবাবুর তখন মাথা গরম, এই মধুর ভাবটি তিনি দেখিয়াও দেখিলেন না। ঠাকুরকে বলিলেনঃ “এই জল কোন কাজে লাগবে, আমার শ্রাদ্ধে, না আপনার শ্রাদ্ধে?” এই বলিয়া বালতির জল ফেলিয়া দিয়া পুনরায় নিজে জল তুলিয়া রাখিলেন। পরের দিনই ঠাকুরকে লইয়া কলিকাতা রওয়ানা হইলেন, এবং হাওড়া পৌ্ঁছিয়া আমার বাসায় উঠিলেন।

     রাত্রিতে খাইতে বসিয়া পঞ্চুবাবু এই ঘটনাটি আমাকে জানাইয়াছিলেন। তিনি আরও বলিয়াছিলেন যে, প্রথমে তিনি ঠাকুরের হাতের রান্না খাইতে কিছুতেই সম্মত হ’ন নাই কিন্তু ঠাকুর তাহাকে বুজাইয়াছিলেন যে, তিনি স্নান সারিয়া আসিয়া রান্না করিতে সঙ্কীর্ণ সময়ের মধ্যে উহা সমাধা করিয়া উঠা সম্ভব হইবে না। ঠাকুর নিজে তো বসিয়াই থাকেন, সুতরাং রান্নার কাজটা তিনি যদি খানিকটা আগাইয়া রাখেন, তাহা হইলে সকল দিকেই সুব্যবস্থা হয়। পঞ্চুবাবু মনে মনে সংকল্প করিলেন যে, শীঘ্রই পাচক নিযুক্ত করিবেন। কোনও ফল হইবে না বুজিয়া প্রকাশ্য আর বিশেষ কোনও প্রতিবাদ করিলেন না, কিন্তু জল তোলাটা তিনি কিছুতেই বরদাস্ত করিতে পারিলেন না। বৈশাখ মাসের শেষে বৃন্দাবনের কূয়া হইতে জল তোলা যে কি ভয়াবহ ব্যাপার, তাহা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যে সহজে বুজিবেন না। সে কথা ছাড়িয়া দিলেও ঠাকুরের নিজের হাতের তোলা জলে হাত পা ধোয়া, বা শৌচাদি কর্ম্ম করার কথা ভাবিতেও গা শিহরিয়া উঠে। এইজন্যই পঞ্চুবাবু ঠাকুরকে লইয়া আর বৃন্দাবন থাকিতে পারিলেন না।

    খাওয়া দাওয়ার পর ঠাকুরের নিকটে আসিয়া বসিলাম। সেখানে তখন আর কেহই ছিলেন না, পঞ্চুবাবুর ইঙ্গিতে আমি কথাটা ঠাকুরের সম্মুখে উত্থাপন করিলাম। ঠাকুরের সেই এক কথা শুধু বলিলেনঃ “এতে কোন দোষ হয় না”, অর্থাৎ ঠাকুরের অভিমত হইল এই যে, তাঁহার হাতের তোলা জলে পা ধুইলে বা শৌচাদি কর্ম্ম করিলে কোন দোষ হয় না। কথাটা মানিয়া লওয়া সহজ নহে, এই বিষয়ে আমাদের সংস্কার এত বদ্ধমূল যে তাহা কাটাইয়া উঠা একপ্রকার অসাধ্য বলিলেও চলে।  কিন্তু ঠাকুরের কথাটাও ছাড়িয়া দেওয়াও চলে না, যত্ন সহকারে বুজিয়া লওয়া  কর্ত্তব্য। এ বিষয়ে পূর্ব্বে আমি যাহা বলিয়াছি পাঠক-পাঠিকাদিগকে তাহা স্মরণ করিতে অনুরোধ করি। কয়েকটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিয়া আমি বলিয়াছিলাম যে, ঠাকুর নানাভাবে আমাকে আপনার করিয়া লইতে চাহিয়াছেন কিন্তু তাহার সেই আহ্বানে আমি সাড়া দিতে পারি নাই। পঞ্চুবাবুর ব্যাপারটাও যে ঠিক ঐ জাতীয় সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই। এখানে একটা অবান্তর কথার অবতারণা করিব। ইহা বোধ হয় আর বলিয়া দিতে হইবে না যে, প্রভাতবাবু আমার আবাল্য সুহৃদ্ ছিলেন। আমরা স্কুলে ও কলেজে একত্রে পড়াশুনা করিয়াছিলাম, এবং পরে একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, একই কর্ম্মে নিযুক্ত হইয়াছিলাম। দুই জনেই ঠাকুরের সংস্পর্শে আসায় এই সম্মন্ধ আরও দূঢ় ও মধুর হইয়াছিল। আমাদের একটা অভ্যাস ছিল এই যে, আমরা দুইজনে সুযোগমত কখনও অন্যত্র চলিয়া যাইতাম এবং সেখানে দু’চার দিন নিরিবিলি থাকিয়া বাড়ী ফিরিয়া আসিতাম। সাধারণ একটু বিছানা, কাপড়, গামছা এবং সামান্য কিছু তৈজসপত্র সঙ্গে থাকিত। হঠাৎ খেয়াল হইল যে, নবদ্বীপ যাইব, সুযোগমত চলিয়া গেলাম, ছোট একটি ঘর ভাড়া করিলাম, নিজেদের সামান্য কাজকর্ম্ম নিজেরাই চালাইয়া লইলাম। হয়তো আমি বাজারে গেলাম, ইত্যবসরে প্রভাতবাবু চায়ের জল চাপাইয়া দিলেন, আমি বাজার হইতে ফিরিয়া চা তৈয়ার করিলাম, প্রভাতবাবু ভাত চাপাইয়া দিলেন, আমি তরকারি কাটিয়া ফেলিলাম, এই ভাবে দুইজনে মিলিয়া কাজগুলো করিয়া ফেলিতাম।  অবশ্য কাজ প্রভাতবাবু অনেক বেশী করিতেন, তাহার মত একজন সুদক্ষ কমবাইন্ড হ্যান্ড অতি অল্পই দেখিয়াছি।  কিন্তু প্রভাতবাবু কাজ বেশী করিতেছেন, দু’বেলা একটানা রান্না করিতেছেন, আমারও এক আধ বেলা করা উচিত, রোজ রোজ আমিই বা বাজার যাইব কেন, প্রভাতবাবুও তো গেলে পারেন, এই জাতীয় কোন চিন্তা ঘূর্ণাক্ষরেও আমাদের দু’জনের কাহারও মনে উদয় হইত না। কাজগুলো হইয়া গেলেই হইল,  কে কি করিল, না করিল, এমন কোন প্রশ্ন উঠিতেই পারিত না।  ঠাকুরও বৃন্দাবনে পঞ্চুবাবুর সহিত ঠিক এই ভাবে কাটাইতে চাহিয়াছিলেন।  দুই অন্তরঙ্গ বন্ধু একত্রে রহিয়াছেন, হাসিয়া খেলিয়া দিন যাইতেছে, কোন সঙ্কোচ নাই, কোন দ্বিধা নাই।  দু’য়ে মিলিয়া যেন একই হইয়া গিয়াছেন।  ঠাকুর আমাদের সঙ্গে প্রীতির সম্মন্ধই পাতাইতে চাহিয়াছেন, কিন্তু দূর্ভাগ্য আমাদের যে আমরা বুজিয়াও তাহা বুজি নাই। সংস্কারজাত সঙ্কোচ আসিয়া মাঝখানে মহীরুহের মত দাঁড়াইয়াছে,  ঠাকুরের নিকটে যাইতে পারি নাই।

           কোনমতেই ধারাবাহিক ভাবে কিছু বলিয়া উঠিতে  পারিতেছি না।  এক কথা বলিতে অন্যকথা আসিয়া পড়িতেছে,  পাঠক-পাঠিকাদের বিরাজভাজন হইতেছি কিনা জানি না। যাহাই হউক, বেলা ১১টার সময় দাদার বাসায় আসিয়া পৌঁছিলাম। দাদা ও বৌদি ঠাকুরকে পাইয়া অত্যন্ত আনন্দিত হইলেন এবং দিনটি অতি সুন্দরভাবে কাটিয়া গেল।  আমার বৌদি রন্ধন কার্য্যে অত্যন্ত নিপুণা ছিলেন এবং লোকজন খাওয়াইতে তাহার আনন্দের সীমা ছিল না, সুতরাং  আহারাদির ব্যাবস্থা যে বেশ সুখপ্রদই হইয়াছিল তাহা বলাই বাহুল্য। বৈকালে বৌদির সঙ্গে ঠাকুরের কিছুক্ষণই কথাবার্ত্তা হইয়াছিল কিন্তু আমি সেখানে অতি অল্পক্ষণই উপস্থিত ছিলাম,  সুতরাং সে বিষয়ে বিশেষ কিছুই বলিতে পারিলাম না।  সন্ধ্যার প্রাক্কালে স্থানীয় একজন ভদ্রলোক ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে আসিলেন। ইহাকে পূর্ব্বেও কয়েকবার দাদার বাসায় দেখিয়াছিলাম এবং ইনি হয়তো সংবাদ পাইয়াই ঠাকুরের নিকট আসিয়াছিলেন। কথাবার্ত্তা কি হইয়াছিল স্মরণ নাই কিন্তু বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করিয়াছিলাম যে, ভদ্রলোকের যেন কেমন একটা আত্মম্ভরি ভাব এবং তিনি যেন নিত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সহিত ঠাকুরের কথাগুলো শুনিতেছেন।  যাইবার সময় তিনি একান্তে দাদাকে বলিয়া গিয়াছিলেন যে, তাহার বিবেচনায় ঠাকুর অত্যন্ত সাধারণ লোক, তাঁহার মধ্যে কোন বিশেষত্বই নাই এবং তিনি যে নামমাত্র আহার করেন,  কি একটা রোগ থাকিলে নাকি এই রকম অতি সামান্য আহার করিয়াও বাঁচিয়া থাকা যায়। দাদার নিকটেই তাহার এই মন্তব্যের কথা শুনিতাম। শুনিয়াই মাথাটা গরম হইয়া উঠিল এবং ভাবিলাম যে তখনই যাইয়া ভদ্রলোকের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করিয়া আসিব। কিন্তু মতিবাবু ও বরদাবাবুকে কথাটা বলিতে তাহারা এমন ভাবে হাসিয়া উঠিলেন যে, ব্যাপারটা নিত্যন্ত লঘু হইয়া উড়িয়া গেল, আমি মনে মনে একটু লজ্জিতই হইলাম।

    এখন ভাবি যে, অযথাই ভদ্রলোকের উপর বিরক্ত হইয়াছিলাম। ঠাকুরের নিকট কত লোক আসিল, কত লোক গেল, কেহ আকৃষ্ট হইল, কেহ হইল না, ইহা তো দীর্ঘ ৩০ বৎসর ধরিয়া দেখিলাম। যে আকৃষ্ট হইল না তাহার অপরাধ কি ? তাহার চোখে ঠাকুরের কোন মাধুর্য্যই ধরা পড়িল না, না পড়িল নাই, তাহাতে আমার কি ? এমনও অনেক ক্ষেত্রে দেখিয়াছি যে, ঠাকুরের প্রতি সামান্য আকৃষ্ট হইয়া পাই পাই করিয়াও শেষ পর্যন্ত ঠাকুরকে পায় নাই। একটা দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিতেছি। আমার এক বন্ধু আমার বিডন স্ট্রিটের মেসে ঠাকুরের কাছে কয়েকবার যাতায়াত করিয়াছিলেন। তাহার কথাবার্ত্তায় ও হাবভাবে আমার মনে হইয়াছিল যে, তিনি ঠাকুরকে শ্রদ্ধার চক্ষেই দেখিতে আরম্ভ করিয়াছেন এবং বোধ হয় শীঘ্রই ঠাকুরের কৃপালাভ সমর্থ হইবেন। কিন্তু একটা গোলযোগ হইয়া গেল। ঐ ভদ্রলোকের স্ত্রী তখন এক মারাত্মক অসুখে ভুগিতেছিলেন, ঠাকুরের নিকট একদিন ঐ রোগের কথাটা উত্থাপন করিলাম। প্রশ্নটা ঠিক কি ভাবে হইয়াছিল মনে নাই কিন্তু ঠাকুরের উত্তরটা বেশ স্পষ্ট মনে আছে। ঠাকুর বলিয়াছিলেনঃ “অষুধ তো খুঁইজা পাইলাম না।” আমি ও ঐ ভদ্রলোক দুজনেই ঠাকুরের কথাতে ইহাই বুজিয়াছিলাম যে, রোগিণীর জীবনের আর কোন আশা নাই। পরে এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসায় রোগিণী ভাল হইয়া যাওয়ায় ঐ ভদ্রলোকের মনে একটা খটকা বাঁধিয়া গেল এবং তিনি ঠাকুরের নিকট যাতায়াত ছাড়িয়া দিলেন। পরে ভাবিয়া দেখিয়াছি যে, ঠাকুরের কথাটার যে অর্থ আমরা করিয়াছিলাম তাহা হয়তো সমীচীন না-ও হইতে পারে। ঠাকুরের নিকট কেহ রোগোপশমের উপায়ের জন্য আসিলে তিনি সাধারণতঃ গাছ-গাছড়ার এবং কচিৎ কখন ধাতু ঘটিত ঔষধের ব্যবস্থা করিতেন এবং তাঁহার জানিত এই সকল ঔষধের মধ্যে ঐ রোগিণীর উপযুক্ত কোন ঔষধ নাই, শুধু এই কথাটাই হয়তো তিনি বলিয়াছিলেন। ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। এখনও যে নাই এমন কথা বলি না, তবে দেখাসাক্ষাৎ আর বড় একটা হয় না। আমি বহুবার ভাবিয়াছি যে, ভদ্রলোকের কি দুর্ভাগ্য, এমন একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় পাইয়াও পাইলেন না। পরে অবশ্য ঠাকুরের মুখে শুনিয়াছি যে, কে আসিবে না আসিবে তাহা নিদিষ্ট আছে, কোন ব্যতিক্রম হইবার উপায় নাই।

      যাহাই হউক, পরের দিন প্রাতঃকালে আমি দামোদর নদীর দিকে রওনা হইলাম। মতিবাবু ও বরদাবাবুর তখনও চা-পর্ব্ব সম্পূর্ণ সমাধা হয় নাই, সুতরাং তাহারা বাসাতেই রহিলেন। ঠাকুর মতিবাবুর স্ত্রীর জন্য লাটার ডগা সহযোগে একটা ঔষধের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। গাড়ীতে মতিবাবু আমাকে বলিয়াছিলেন যে, কলিকাতায় টাটকা ডগা দূর্ঘট, সুতরাং আমতায় একবার খোঁজ করিয়া দেখিতে হইবে। দাদার আরদালী আমাকে বলিয়াছিল যে, দামোদর নদীর তীরে অনেক লাটাগাছ আছে। এই অনুসন্ধানেই আমি বাহির হইয়াছিলাম, কিছুদূর যাইয়া লক্ষ্য করিলাম যে, ঠাকুরও আমার পিছনে পিছনে আসিতেছেন। “আপনি আবার কেন আসিলেন” জিজ্ঞেসা করাতে ঠাকুর আমাকে বলিলেনঃ “আপনে কি লাটাগাছ চেনেন ?” ঠাকুরের কথায় আমার চৈতন্য হইল, বাস্তবিকই তো, আমি তো লাটাগাছ চিনি না, অথচ একাকী সেই গাছের সন্ধানে বাহির হইয়াছি। একটু যাইতেই লাটাগাছের সন্ধান মিলিল, ঠাকুর কয়েকটি গাছ আমাকে চিনাইয়া দিলেন এবং আমিও পছন্দমত অনেকগুলি ডগা সংগ্রহ করিলাম। কিন্তু একটা গাছের উপরের দিকে কয়েকটি অত্যন্ত হাউসনাগী ডগা ছিল, সেগুলি আমি অনেক চেষ্টা করিয়াও পারিতে পারিলাম না। ডগাগুলি এত মনোরম যে, এই কয়টিকে ছাড়িয়া যাইতে মোটেই ইচ্ছা হইতেছিল না, বাসায় ফিরিয়া আকশি গোছের একটা কিছু লইয়া আসিব কিনা ভাবিতেছি, এমন সময় ঠাকুর আমাকে বলিলেনঃ “এই ডগাগুলি নেন।” গাছের দিকে চাহিয়া দেখি যে, সেই ডগাগুলি নাই। ঠাকুর আমার চেয়েও খাটো ছিলেন, কি করিয়া যে চক্ষের নিমিষে ডগাগুলি পারিয়া ফেলিলেন, তাহা আমি আজও বুজিতে পারি নাই ।

      বাসায় ফিরিয়া আসিয়া ঠাকুর বলিলেন যে, ৯টার গাড়ীতেই তিনি কলিকাতাই ফিরিয়া যাইবেন। দাদা ও বৌদির ভরসা ছিল যে, ঠাকুর সেই দিনটাও আমতাতেই থাকিবেন। সুতরাং তাহারা একটু মনঃক্ষুণ্ন হইলেন। কিন্তু আমি জানিতাম যে, একবার ‘যাইব’ বলিলে ঠাকুরকে ফেরানো অসম্ভব, কাজেই সেরূপ কোন চেষ্টাই করিলাম না। বরদাবাবু ও মতিবাবু ঠাকুরকে লইয়া চলিয়া গেলেন, আমি সেই দিনের জন্য আমতাতেই থাকিয়া গেলাম ।