ঠাকুর সে যাত্রায় সম্পূর্ণ সুস্থ হইবার ৩-৪ দিন পরে একদিন প্রাতঃকালে আবার আমার সেই বিডন ষ্ট্রীটের বাসায় আসিলেন । আমার স্ত্রী তখন এখানেই ছিলেন, সুতরাং এবার ঠাকুরের পরিচর্য্যার ব্যাপারে আমি নিরুদ্বেগই রহিলাম। পূর্ব্বে একাধিকবার বলিয়াছি যে, ঠাকুরের বস্তুতঃ কোন দরকারই ছিল না এবং তাঁহার সেবা একজন বালকও চালাইয়া দিতে পারিত কিন্তু এই সম্পর্কে আমি নিজে এত অপটু ছিলাম যে, ঠাকুর আমার বাসায় আসিলেই তাঁহার সেবা সম্বন্ধে একটু দুশ্চিন্তা আমার লাগিয়াই থাকিত। সে যাহাই হউক, ঠাকুর আসিয়াছেন খবর পাইয়া আমার স্ত্রী রান্নাঘর হইতে আসিয়া ঠাকুর কে প্রণাম করিলেন এবং ঠাকুরের সস্মুখে বসিলেন। দুই চারিটা কুশল প্রশ্নাদির পর ঠাকুর তাঁহার ঝোলা হইতে একটি আংটি বাহির করিয়া আমার স্ত্রীর হাতে দিয়া বলিলেনঃ ” মা,এই আংটিটি নেন,এটা আপনারই” । সেই আংটিটি এখনও আমার স্ত্রীর হাতে আছে।তিনটি পাথর লাগান ছিল,সেগুলি ভাঙ্গিয়া পড়িয়া গিয়াছে কিন্তু পরিবর্ত্তে অন্য পাথর বসাইবার ইচ্ছা তাহার কখনও হয় নাই।
আমার মনে হয় যে, আংটি দেওয়ার পিছনে একটু রহস্য আছে। এই সময়ের কিছুদিন পূর্ব্বে অনেকের মুখেই শুনিয়াছিলাম যে , ঠাকুর নাকি বালিয়াছেন যে, ৺লক্ষ্মীপূজার দিন একটু আপাং গাছের শিকড় সোনা কিংবা তামার তাবিজে ভরিয়া বাঁ হাতের কনুই-এর ঠিক উপরে লাল সূতা দিয়া বাঁধিয়া ধারণ করিলে সংসারে নাকি আর অভাব অনটন থাকে না, বেশ সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে দিন চলিয়া যায়। ঠাকুরের নিজের মুখে আমি কিছু শুনি নাই এবং কথাটা যে কিভাবে চাউর হইয়াছিল, তাহাও ঠিক জানি না।কিন্তু সেবার ৺লক্ষ্মীপূজার দিন নানাস্থানে এই তাবিজ ধারণ করিবার ধুম পড়িয়া গিয়াছিল। আমার যে এই ব্যাপারে বিশেষ কোন আগ্রহ ছিল তাহা বলিতে পারি না কিন্তু যখন দেখিলাম যে, আমার কয়েকজন নিতান্ত অন্তরঙ্গ বন্ধু এই তাবিজ ধারণ করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছেন , তখন আমিও দুইটি তাবিজের ব্যবস্হা করিয়া নির্দ্দিষ্ট দিনে যথারীতি একটি নিজে ধারণ করিলাম এবং অন্যটি আমার স্ত্রীকে দিলাম। কিন্তু ৩/৪ দিন যাইতেই আমার মনে এক অসোয়াস্তি আরম্ভ হইল। তাবিজটার দিকে নজর পড়লেই মনে হইত ,এই আপদ আসিয়া জুটিল কেন? ঠাকুরকে লইয়া বেশ নিশ্চিন্তে ছিলাম ,এই তাবিজ টা যেন মাঝখানে দাঁড়াইয়াছে। অসোয়াস্তি বাড়িয়াই চলিল এবং নিশ্চিত বুঝিতে পারিলাম যে, এই তাবিজ টা আমাকে ঠাকুরের নিকট হইতে দূরে সরাইয়া দিতেছে।সুতারং ৮/১০ দিনের মধ্যেই তাবিজটা খুলিয়া বাক্সে বন্ধ করিয়া রাখিলাম।আমার স্ত্রীর তাবিজটি কিন্তু তাহার হাতেই ছিল কিন্তু হঠাৎ একদিন শুনিলাম যে, সেটা হারাইয়া গিয়াছে। ভাবিলাম যে, আপদ গিয়াছে কিন্তু আমার স্ত্রী ব্যাপারটা ঠিক এইভাবে গ্রহণ করিতে পারিলেন না। তাবিজটার জন্য একটু ক্ষোভ ও দুশ্চিন্তা তাহার মনে লাগিয়াই রহিল। ঠাকুরের নির্দ্দেশে তাবিজটি ধারণ করিয়াছিলেন, সেই তাবিজ হারাইয়া গেল, ঘটনাটা কোন ভাবী অমঙ্গলের ইঙ্গিত করিতেছে কিনা, এই জাতীয় চিন্তা তিনি এড়াইতে পারিতেন না। কিন্তু ঠাকুরের নিকট হইতে আংটিটি পাইয়া তাহার ক্ষোভ, দুঃখ ও দুর্ভাবনার একত্রে অবসান হইয়া গেল।
কলেজ খোলা ছিল, সুতরাং স্নানাহার সারিয়া ১২-টার পূর্ব্বেই বাহির হইয়া গেলাম এবং ফিরিতে প্রায় ৪-টা বাজিয়া গেল। ঠাকুরের ঘরে আসিয়াই দেখিলাম যে, বরদাবাবু সেখানে বসিয়া রহিয়াছেন এবং ঠাকুররের সঙ্গে আস্তে আস্তে কি যেন কথাবার্ত্তা হইতেছে।আমিও তাড়াতাড়ি জামা-কাপড় ছাড়িয়া ও হাত মুখ ধুইয়া ঠাকুরের নিকটে আসিয়া বসিলাম এবং একটু পরেই আমার ভৃত্য দুইজন ভদ্রলোককে আনিয়া হাজির করিল।সকাল বেলা কে যেন আমাকে বলিয়া গিয়াছিল যে, বৈকালে দুইজন ভদ্রলোক ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করিতে আসিবেন।ইঁহারা কোথাকার এক হরিসভার সভাপতি ও সম্পাদক এবং বৈষ্ণবশাস্ত্রে নাকি বিশেষ অভিজ্ঞ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অনুপবাবুও আসিলেন এবং ইঁহাদিগকে ঠাকুরের সহিত পরিচিত করিয়া দিলেন। ইঁহারা দুই হাত জোড় করিয়া মাথায় ঠেকাইয়া ঠাকুরকে নমস্কার করিলেন এবং ঠাকুর ও যথারীতি প্রতিনমস্কার করিয়া অত্যন্ত আপ্যায়নের সহিত উহাদিগকে বসাইলেন। এইখানে আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলিয়া রাখা প্রয়োজন মনে করিতেছি। আমি ইহা বহুক্ষেত্রে দেখিয়াছি যে, ঠাকুরের কাছে যে যে- ভাব লইয়া আসিয়াছে অভ্যর্থনা ও সেইরূপই পাইয়াছে। আমি এক ভদ্রলোকের কথা জানি যিনি ঠাকুরের কাছে আসিয়াছিলেন এই ভাব লইয়া যে, “আমি একজন মহাপুরুষের শিষ্য, উনিও তাহার বেশী আর বিশেষ কি, সুতরাং উহাকে আমার গুরুভ্রাতা স্থানীয় মনে করিতে পারি” এবং আশ্চর্য্য এই যে, ঠাকুর ও তাহার সহিত অনুরূপ ব্যবহার করিয়াছিলেন।কয়েকবার ঠাকুরের নিকট যাতায়াত করিবার পর আস্তে আস্তে সেই ভদ্রলোকের মনোভাব পরিবর্ত্তিত হইতে লাগিল এবং ঠাকুরের ব্যবহারও সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্ত্তিত হইয়া গেল।ক্রমে ইনি ঠাকুরের একজন বিশেষ ভক্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন এবং আমার নিকট নিজেই তাহার ভাব পরিবর্ত্তনের কথা স্বীকার করিয়াছিলেন। এরূপ আরও কতকগুলি দৃষ্টান্ত আমার জানা আছে। কিন্তু ঠাকুর যে ইচ্ছা করিয়া বা চেষ্টা করিয়া এই প্রকার ভাবানুরূপ ব্যবহার করিতেন,তাহা মনে করিলে ঠাকুরকে অত্যন্ত ভুল বুঝা হইবে।স্বভাবতঃই এইরূপ হইত,তিনি হয়তো ইহার কিছু জানিতেনও না। একবার একখানা পত্রে ঠাকুর লিখিয়াছিলেনঃ “আমাকে যে যেমন ভাবে আমি সেই ভাবে ই প্রকাশ হইয়া তা’র কাছে থাকি।ইহা আমার কর্ত্তৃত্ব সত্ত্বে নাই,ভগবান একমাত্র চালক।” বহুদিন ঠাকুরের সঙ্গ করিয়া এবং নিবিষ্ট মনে তাঁহার আচার ব্যবহার লক্ষ্য করিয়া আমি এই রহস্যটি নিশ্চিতরূপে বুঝিতে পারিয়াছি বলিয়াই মনে করি, কিন্তু পাঠক-পাঠিকাদিগকেও কথাটা বুঝাইতে পারিলাম কিনা জানি না।
এই জন্যই ঠাকুর কোন ব্যক্তিকে একটু অধিক আদর আপ্যায়ন করিতেছেন দেখিলেন আমার চক্ষু খাড়া হইয়া উঠিত এবং সেই আপ্যয়িত ব্যক্তিকে একটু বিশেষ ভাবে নজর করিয়া দেখিতাম।এই ক্ষেত্রে ও তাহাই হইল, ঐ সভাপতি ও সম্পাদক মহাশয়কে একটু নিবিষ্ট ভাবে পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম।আমার মনে হইল যে, আত্মাভিমানের দুইটি পিপা যেন ঠাকুরের সম্মুখে আসিয়া বসিয়াছেন। প্রথমে তাহারা দুইজনেই কথা বলিতে লাগিলেন।সভাপতি মহাশয় একটি শ্লোক আওড়াইলেন,সম্পাদক মহাশয় তাহার ব্যাখ্যা করিলেন এবং প্রসঙ্গক্রমে অপর একটি শ্লোক আওড়াইলেন।এবার সভাপতি মহাশয়ের ব্যাখ্যা সুরু হইল। এইভাবে প্রায় পনর মিনিট চলিয়া গেল।ঠাকুরও এমন ভাব দেখাইলেন যে, তাহাদের এই আলোচনা তিনি যেন অত্যন্ত আগ্রহের সহিত শুনিতেছেন এবং তাহা যেন কতই না সারগর্ভ।যাহাই হউক,হঠাৎ বোধ হয় তাহাদের খেয়াল হইল যে, তাহারা শুধু শুনাইতেই আসেন নাই,শুনিতেও আসিয়াছেন, এবং খানিকক্ষণ নীরব হইয়া রহিলেন।কিন্তু ঠাকুর কিছুই বলিতেছেন না দেখিয়া সম্পাদক মহাশয় প্রশ্ন করিলেন: “আচ্ছা এই যে এত কৃষ্ণ,কৃষ্ণ ক’রেছে, কৃষ্ণ বস্তুটা কি?” ঠাকুর বলিলেনঃ “একমাত্র সেইটিই বস্তু,আর সব অবস্তু।” এই প্রসঙ্গে ঠাকুরের ঠিক এই জাতীয় আর একটি কথা মনে পড়িতেছে। এক ভদ্রলোক ঠাকুরকে প্রশ্ন করিয়াছিলেনঃ “ভগবান সাকার না নিরাকার?” উত্তরে ঠাকুর বলিয়াছিলেনঃ “একমাত্র তিনিই সাকার, আর সব নিরাকার।” যাহাই হউক, সম্পাদক মহাশয়ের সহিত ঠাকুরের যে আলোচনা হইয়াছিল,তাহার বিশেষ কিছুই স্মরণ করিতে পারিতেছি না।কৃষ্ণ মানে কর্ষণ,আকর্ষণী শক্তি এক আনন্দেরই আছে,সুতরাং কৃষ্ণ আনন্দ, ইত্যাদি অনেক কথাই হইয়াছিল কিন্তু ধারাবাহিক ভাবে কিছু মনে পড়িতেছে না।কিন্তু দুই একটি অবান্তর কথা বেশ স্পষ্টই মনে আছে। সভাপতি মহাশয় কেবলই ঠাকুরের কথার মধ্যে অসামঞ্জস্য ও বিরোধ আবিষ্কার করিতে চেষ্টা করিতেছিলেন।তিনি কয়েকবার এইরূপ আপত্তিও তুলিয়াছিলেন,কিন্তু ঠাকুর যখন অতি সহজেই তাহার সন্দেহের মীমাংসা করিয়া দিলেন তখন তিনি যেন একটু মনঃক্ষুণ্ণই হইলেন,মনে হইল।আরও একটা ব্যাপার লক্ষ্য করিয়াছিলাম, মনে আছে। ঠাকুর কথাপ্রসঙ্গে ৩/৪ বার বলিয়াছিলেন যে, সভা করিয়া কৃষ্ণভজন হয় না, কৃষ্ণভজন নিজে নিজেই করিতে হয়।ইহারা দুইজন যে একটা হরিসভার সহিত সংশ্লিষ্ট এ কথা ঠাকুরের জানা ছিল না, শুধু আমিই জানিতাম।বরদাবাবু জনান্তিকে আমাকে বলিলেনঃ “ইহারা নিশ্চয়ই কোন হরিসভা কিম্বা ঐ জাতীয় কোন প্রতিষ্ঠানের সহিত সংশ্লিষ্ট, নতুবা ঠাকুর বারবার সভার কথা বলিলেন কেন।” তাহার অনুমান যে যথার্থ আমার নিকট কথাটা জানিয়া তিনি যেন বেশ একটু খুসী হইলেন মনে হইল।
কিন্তু আমি ভাবিতেছি আমার নিজের কথা।আমি কিছু লিখিয়া রাখি নাই এবং অনেক চেষ্টা করিয়া আমাকে এই কথাগুলি স্মরণ করিতে হইতেছে কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, অবান্তর এবং বাজে ব্যাপারগুলি যত সহজে মনে আসিতেছে, ঠাকুর সম্পর্কে প্রকৃত মূল্যবান ও শিক্ষাপ্রদ ঘটনাগুলি তত সহজে স্মরণ করিতে পারিতেছি না। কে কবে, কিভাবে অপদস্হ হইয়াছিল,কাহার সঙ্গে ঠাকুর কি ঠাট্টা করিয়াছিলেন,কবে কাহার উপর এক হাত লইতে পারিয়াছিলাম এবং মনে মনে আনন্দ ও গর্ব্ব অনুভব করিয়াছিলাম,ইত্যাদি ব্যাপারগুলি সহজেই মনে পড়িয়া যাইতেছে কিন্তু ঠাকুরের অমূল্য কথাগুলি অনেক কষ্টে কিছু কিছু মাত্র স্মরণে আসিতেছে।তাই মনে হয় যে, অনেক সময় ঠাকুরের কাছে বসিয়া থাকিয়াও ঠাকুর সঙ্গ করি নাই; চোরের মন যেমন বোঁচকার দিকে থাকে,আমার মনও তেমন অধিকাংশ সময়েই বাজে রঙ্গরসের দিকেই রহিয়াছে।পূর্ব্বে একবার বলিয়াছি, আবারও বলি, ঠাকুর কাছে থাকিলেই ঠাকুরসঙ্গ হয়, দূরে থাকিলে হয় না, এরূপ ধারণার কোন যৌক্তিকতা নাই।বরং অনেক সময়েই অনুভব করিয়াছি যে, দূরে থাকিয়াই যেন ঠাকুরের সঙ্গ অধিকতর সুষ্ঠুভাবে উপভোগ করা যায়।
সে যাহাই হউক,কথাবার্ত্তা চলিতে লাগিল এবং শেষের দিকে কি প্রসঙ্গে ঠিক স্মরণ নাই, “নামে রুচি,জীবে দয়া, বৈষ্ণব সেবন”, বৈষ্ণব সমাজে সুপরিচিত এই কথাটি আলোচনার মধ্যে আসিয়া পড়িল। সভাপতি মহাশয় বলিলেন যে, সাধারণতঃ যে ভাবে এই কথা কয়টির ব্যাখ্যা করা হয়, তাহাতে তিনি সন্তুষ্ট হইতে পারেন নাই। তাহার বিশ্বাস যে কথা কয়টির গভীরতর কোন তাৎপর্য্য নিশ্চয়ই আছে এবং ঠাকুরকে এই বিষয়টি লইয়া একটু আলোচনা করিবার জন্য অনুরোধ করিলেন।ঠাকুরের মুখে এই আলোচনা আমি আরও কয়েকবার শুনিয়াছিলাম; সুতরাং তাঁহার ব্যাখ্যাটি মোটামুটি বুঝাইয়া বলিতে আমাকে বিশেষ বেগ পাইতে হইবে না। ঠাকুর “নাম” বলিতে মুখ্যতঃ বুঝাইতেন অনন্যচিন্তা। চিন্তা যখন একখাতে বহিতে আরম্ভ করে,অন্য কিছুই আর ভাল লাগে না,তখনই নামে রুচির সূচনা হয় এবং ক্রমে যখন এই চিন্তা অনন্য হইয়া যায়, তখনই আসে যথার্থ নামে রুচি।একখানি পত্রে ঠাকুর লিখিয়াছিলেনঃ “অহৈতুকী প্রেম আচরনের দ্বারা পরদেহ ত্যাগ করিয়া স্বদেহ লাভ হইলে তখন ভগবানের নামে রুচি সংঘটন হইয়া থাকে।” (বেদবাণী, প্রথম খণ্ড,২৫৭ নং ) । সুতরাং দেখা যাইতেছে যে, মুখ্যতঃ বলিতে গেলে “নামে রুচি” ও প্রাপ্তি একই কথা। “জীবে দয়া” কথাটির ঠাকুর অর্থ করিলেন নিজের প্রতি দয়া করা। তোমার ভিতরে যে জীব বদ্ধ হইয়া রহিয়াছে তাহার প্রতি দয়া করিয়া তাহার উদ্ধারের প্রচেষ্টার নামই “জীবে দয়া”। নিজের প্রতি যাহার দয়া নাই, অন্যের প্রতি দয়া তাহার পক্ষে শুধু কথার কথা মাত্র।কথাটা অত্যন্ত জটিল এবং একটু যত্ন করিয়া বুঝিয়া লওয়া প্রয়োজন। এখানে ও মুখ্য এবং গৌণ এই দুইটি দৃষ্টিভঙ্গীর কথা স্মরণ রাখিতে হইবে।আপাতদৃষ্টিতে ঠাকুরের কথায় মনে হইতে পারে যে, তিনি যেন আত্মপরতারই প্রশ্রয় দিতেছেন। নিজের প্রতি দয়া কর, অর্থাৎ নিজের হিতেরই চেষ্টা কর, পরের হিতে তোমার কোন প্রয়োজন নাই।কিন্তু মুখ্যতঃ কথাটা হইতেছে এই যে, আত্মহিতই প্রকৃত হিত এবং পরহিতের সহিত ইহার কোন বিরোধ নাই।যে প্রকৃত আত্মহিতে রত থাকে পরহিতের জন্য তাহার আর পৃথক চেষ্টা করিতে হয় না,আত্মহিতেই পরহিত যাহা হইবার আপনা আপনিই হইয়া যায়, হিত করিবার জন্য হিত করিতেছি এই বুদ্ধি সেখানে থাকে না। আমার মনে হয় যে, এই মুখ্য দৃষ্টি হইতেই ঠাকুর “জীবে দয়া” কথাটির অর্থ করিয়াছিলেন। মহাজনদের আচরণ একটু বিচার করিয়া দেখিলে কথাটা অনেকটা বুঝিতে পারা যায়। তাঁহাদের কর্ত্তৃত্ব বুদ্ধি নাই, সুতরাং কর্ত্তব্য বুদ্ধিও নাই কিন্তু স্বভাবতঃ তাঁহারা যাহা করেন তাহাতেই জগতের প্রভূত কল্যাণ সাধিত হইয়া যায়। সাধারণতঃ আমরা যাহাকে জীবে দয়া বা পরহিত বলিয়া বুঝি তাহাও ভিত্তি এই প্রকৃত আত্মহিতেই।শুনিয়াছি যে, কলিকাতার তৎকালীন একজন স্বনামধন্য ব্যক্তি দক্ষিণেশ্বরে পরমহংসদেবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলেন। তিনি নাকি বলিয়াছিলেনঃ “ধর্ম,টর্ম্ম,কিছু বুঝি না, তবে সাধ্যমত পরোপকার করি। ” এই কথা শুনিয়া পরমহংসদেব বলিয়াছিলেনঃ “নিজের উপকার ক’রতে পারেন না,উনি পরের উপকার করেন”, অর্থাৎ আত্মহিত সম্বন্ধে যাহার চেতনা নাই,তাহার দ্বারা পরহিত সম্ভবপর নহে। খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল দিয়া হাজার লোকের স্বাস্থ্যহানি ও কখন বা জীবনাশঙ্কা ঘটাইয়া অর্জ্জিত যে অর্থ, তাহার কিয়দংশ ব্যায়ে প্রতিষ্ঠিত যে হাসপাতাল, তাহাতে পরের হিত হইতে পারে, কিন্তু তাহা পরহিত নহে।তাহা না হইলে,নামযশাদির লোভে জনহিতকর প্রতিষ্ঠানে মুক্তহস্তে অর্থদান,ঘি’য়ে চর্ব্বি মেশানো অর্থে ধর্ম্মশালা নির্ম্মাণ, অথবা ইলেকসনের পূর্ব্ব এখানে সেখানে দুই চারিটি নলকূপ স্থাপন ইত্যাদি কার্য্যাবলীও “জীবে দয়া” সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হইতে পারিত। যে কোন কার্য্য বা ব্যবস্থার ফলে পরের হিত হয়, তাহাকেই “পরহিত” আখ্যা দেওয়া চলে না। স্থির চিত্তে একটু বিচার করিলেই বুঝিতে পারা যায় যে, সাধারণতঃ পরসেবা বলিতে আমরা যাহা বুঝি তাহার আধিকাংশই আত্মসেবারই নামান্তর মাত্র।
সভাপতি মহাশয় নীরবেই ঠাকুরের কথাগুলি শুনিয়া যাইতেছিলেন এবং মাঝে মাঝে মাথা নাড়িতেছিলেন কিন্তু আমি বুঝিতেছিলাম যে, ভদ্রলোকের আজন্ম বর্দ্ধিত সংস্কারে দারুণ আঘাত লাগিতেছে; তিনি ঠাকুরের কথাগুলি নির্ব্বিচারে গ্রহণও করিতে পারিতেছে না, একেবারে অগ্রাহ্য করিতেও সাহসে কুলাইতেছে না । তৃতীয় কথাটির অর্থও ঠাকুর যখন ঠিক একভাবেই নিষ্পন্ন করিলেন তখন মনে হইল যে, ভদ্রলোক প্রায় অতিষ্ট হইয়া উঠিয়াছেন। ঠাকুর বলিলেন যে, বিষ্ণু অর্থ ব্যাপ্ত, অর্থাৎ যিনি এই ত্রিজগত ব্যাপিয়া রহিয়াছেন।এই ব্যাপ্ত বুদ্ধির আশ্রয়ে থাকিয়া তাহার সেবা পরিচর্য্যার নামই “বৈষ্ণব সেবন”। ঠাকুর বলিতেনঃ “ভগবান সর্ব্বত্র সমভাব নিরপেক্ষ শক্তি।” এই সমভাব বা নিরপেক্ষ শক্তির সেবাই ‘বৈষ্ণব সেবন’। এইভাবে ঠাকুর তিনটি কথাকেই এক সূত্রে গাঁথিয়া দিলেন, প্রত্যেকটিকে পৃথক পৃথক দৃষ্টিতে দেখিবার আর কোন প্রয়োজন রহিল না।ঠাকুর সাধারণতঃ মুখ্যার্থ ধরিয়াই কথাবার্ত্তা বলিতেন এবং এই জন্য প্রথম দিকে অনেকেই তাঁহার কথা ধরিতে পারিতেন না। এক্ষেত্রেও তাহাই হইল, ঠাকুরের ব্যাখ্যা সভাপতি মহাশয়ের ঠিক মনঃপূত হইল না।একটু পরেই তিনি ও সম্পাদক মহাশয় ঠাকুরকে একটা শুষ্ক নমস্কার করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন,আমিও সিঁড়ি পর্য্যন্ত তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে গেলাম। সিঁড়ি দিয়া নামিবার পূর্ব্বে সম্পাদক মহাশয় আমাকে বলিলেনঃ “আপনাদের ঠাকুর অযথা সহজ কথাকে কঠিন করিয়া তোলেন। ‘নামে রুচি,জীবে দয়া, বৈষ্ণব সেবন’ অতি সহজ কথা,তাৎপর্য্য বুঝিতে কোন কষ্টই হয় না, অথচ ঠাকুর এই কথা কয়টি লইয়া একটা কুহেলিকার সৃষ্টি করিয়া ফেলিলেন।” উত্তরে আমি কি বলিয়াছিলাম ঠিক স্মরণ করিতে পারিতেছি না।
সভাপতি মহাশয়কে আর কখনও ঠাকুরের নিকট আসিতে দেখি নাই,কিন্তু বিশ্বস্তসূত্রে জানিতে পারিয়াছিলাম যে, ঠাকুরের মুখে সে দিন যাহা শুনিয়াছিলেন, সেই সকল কথা আওড়াইয়া তিনি এখানে সেখানে কিস্তিমাতের চেষ্টা করিতেন।ইহার ৪/৫ দিন পরে কলেজ হইতে ফিরিয়া আসিয়া দেখি যে, সভাপতি মহাশয় বসিয়া রহিয়াছেন এবং শুনিলাম যে, তিনি আমার জন্যই অপেক্ষা করিতেছেন। তাহাকে উপরে আমার বসিবার ঘরে লইয়া গেলাম। এ কথা সে কথার পর তিনি বলিলেন যে, ঠাকুর সেদিন সুখ আর আনন্দের মধ্যে যেন একটা পার্থক্য করিতেছিলেন।কথাটা তিনি ঠিক স্মরণ করিতে পারিতেছেন না, আমার মনে আছে কিনা জিজ্ঞাসা করিলেন।ঠাকুরের মুখে এই আলোচনা আমি একাধিকবার শুনিয়াছিলাম,সুতরাং ছোট একটি বক্তৃতা ঝাড়িয়া দিতে আমার কোনই অসুবিধা হইল না।সুখ আসে একটা কারণ অবলম্বন করিয়া; আনন্দ নিরাবলম্ব, স্বপ্রতিষ্ঠ, কোন কিছুরই অপেক্ষা করে না।কারণের অপেক্ষা করে বলিয়াই সুখ ক্ষণস্থায়ী ও খণ্ড এবং নিরপেক্ষ বলিয়াই আনন্দ অখণ্ড ও অনন্ত। মানুষ আনন্দই চায় কিন্তু বিষয়ের মধ্য দিয়া তাহার অনুসন্ধান করে বলিয়া সুখই কখনও কখনও পায়, আনন্দ পায় না।সেই জন্যই রবীন্দ্রনাথ গাহিয়াছেনঃ “যাহা চাই তাহা ভুল ক’রে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না।” চাই আনন্দ কিন্তু ভাবি যে ধনজন, বিষয়বৈভবাদি পাইলেই বুঝি আনন্দ পাইব। যখন ধনজনাদি আয়ত্তের মধ্যে আসে তখন মনে হয় যে, ঠিক এইগুলি আমি চাই নাই, যাহা চাহিয়াছিলাম তাহা যেন পাই নাই। “মানুষ চায় সুখ,পায় সামগ্রী।” আনন্দ তো দূরের কথা, বাস্তবিক পক্ষে সুখও নিতান্ত সহজলভ্য নহে।ভাবিলাম যে, একখানা নিজস্ব বাড়ী পাইলেই বুঝি সুখী হইব কিন্তু বাড়ীখানা পাইয়া দেখি যে, বাড়ীখানাই পাইয়াছি,সুখ সরিয়া দাঁড়াইয়াছে। আরও বিপদ হইল এই যে, সুখের সঙ্গে দুঃখ অঙ্গাঙ্গীভাবেই রহিয়াছে।একখানা মোটর গাড়ী পাইলাম কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আসিল পাঁচ রকমের ঝঞ্ঝাট।এই বুঝি ড্রাইভার তেল চুরি করিল, হয়তো বা একটা দুর্ঘটনা ঘটাইয়া বসিল,আজ এটা ভাঙ্গিল, কাল ওটা হারাইল, মেরামতির খরচ বাড়িতে বাড়িতে আতঙ্কের সৃষ্টি করিয়া তুলিল,সুখের আশা উধাও হইয়া গেল,বিচার করিয়া দেখিলাম যে, সুখ যাহা পাইয়াছি তাহা নগণ্য,প্রকৃত প্রস্তাবে শুধু গাড়ীটাই পাইয়াছি।আরও অনেক কিছু বলিয়াছিলাম, স্মরণ নাই। সভাপতি মহাশয় খুশী হইয়া ফিরিয়া গিয়াছিলেন। পরে জানিতে পারিয়াছিলাম যে, শনিবারের হরিসভায় এই প্রসঙ্গ তুলিয়া তিনি সেদিনকার আসর একেবারে মাত করিয়া ফেলিয়াছিলেন।
সম্পাদক মহাশয় কিন্তু ইহার পরেও কিছুকাল ঠাকুরের পিছনে ঘোরাফেরা করিয়াছিলেন এবং তাহার কতকটা ভাবান্তরও লক্ষ্য করিয়াছিলাম।শেষের দিকে তিনি ঠাকুরের পায়ে হাত দিয়াই প্রণাম করিতেন এবং শ্রদ্ধার সহিত তাঁহার উপদেশাদি শ্রবণ করিতেন।কিন্তু ভদ্রলোকের দুর্ভাগ্যবশতঃ ঠাকুর নাকি একদিন কথাপ্রসঙ্গে বলিয়াছিলেন যে, তিনি একজন শাস্ত্ররসজ্ঞ। এই সার্টিফিকেট পাইবার পর তিনি আর ঠাকুরের নিকট আসিবার প্রয়োজন বোধ করেন নাই।তাহার এই সার্টিফিকেটের কথা আমি সভাপতি মহাশয়ের নিকট শুনিয়াছিলাম। ইহাদের কেহই আর ইহজগতে নাই, কিন্তু সামান্য কিছুদিনের পরিচয় হইলেও সেই সভাপতি ও সম্পাদক মহাশয়কে ভুলিতে পারি নাই।ইঁহারা দুই জনেই ধর্ম্মের জন্য যথেষ্ট পরিশ্রম স্বীকার করিয়াছিলেন ,বৈষ্ণবশাস্ত্রের অত্যন্ত দুরূহ গ্রন্থগুলির সঙ্গেও ইহাদের পরিচয় ছিল, কীর্ত্তন সাধুসঙ্গ প্রভৃতি সকল বিষয়েই ইহাদের পরিচয় ছিল, কীর্ত্তন সাধুসঙ্গ প্রভৃতি সকল বিষয়েই ইহাদের অনুরাগ ছিল, কিন্তু এ সকলের কিছুই তাহাদের নিজেদের কোন কাজে আসিল না, আত্মাভিমানের ইন্ধন যোগাইতেই নিঃশেষ হইয়া গেল।ইহাদের শেষ জীবনেও ইহাদের সহিত কয়েকবার আমার সাক্ষাৎ হইয়াছিল কিন্তু কোন পরিবর্ত্তন লক্ষ্য করি নাই।ইঁহারা ধর্ম্ম ধর্ম্ম করিয়াই জীবন কাটাইয়া গেলেন কিন্তু করিয়া গেলেন অহংসেবা, ধর্ম্মের ধারেও ঘেঁষিতে পারিলেন না।পদে পদেই মোহগর্ত্ত, অত্যন্ত হুঁসিয়ার না হইলে এই রাস্তায় অগ্রসর হওয়া যায় না।
ভদ্রলোকেরা চলিয়া যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে বরদাবাবুও চালিয়া গেলেন,সুতরাং ঠাকুরের নিকটে আর কেহই রহিল না। কিছুক্ষণ নীরবে কাটিয়া গেল,হঠাৎ ঠাকুর আমাকে বলিলেন যে, আগামী কাল প্রাতঃকালে তিনি চাঁটগা মেল ধরিয়া চাঁদপুরের দিকে রওয়ানা হইয়া যাইবেন। ঠাকুর যে মাত্র একদিনের জন্য আমার বাসায় আসিয়াছেন, একথা আমি জানিতাম না, সুতরাং ঠাকুরের কথা শুনিয়া মনটা অত্যন্ত খারাপ হইয়া গেল। কিন্ত ইহাতে আমার বলিবার কিছুই ছিল না, সুতরাং তাঁহাকে শুধু জিজ্ঞাসা করিলাম যে, তিনি একাকীই যাইবেন, না সঙ্গে আর কেহ যাইবে। ঠাকুর বলিলেন যে, তিনি এক ভদ্রলোকের সঙ্গে যাইতেছেন, কাল ভোরে আসিয়া তিনি তাঁহাকে এখান হইতে ষ্টেসনে লইয়া যাইবেন।ঠিক এই সময় প্রভাতবাবু একজন ভদ্রলোককে সঙ্গে লইয়া ঠাকুর দর্শনে আসিলেন। এই ভদ্রলোককে আমি চিনিতাম। ইনি এক সমস্যায় পড়িয়াছিলেন এবং তাহার সমাধানের জন্য কিছুদিন যাবৎ ঠাকুরের খোঁজ করিতেছিলেন। তিনি পূর্ব্বেই আমাকে বলিয়াছিলেন যে, তিনি যখন তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণীতে পড়েন সেই সময়েই তাহার বিবাহ হয় এবং কিছুদিন পরে সস্ত্রীক যথারীতি তাহাদের কুলগুরুর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন। পরে বিষয়কৰ্ম্ম উপলক্ষে কলিকাতাতে আসিয়া স্থায়ী হইয়া বসিলেন এবং কয়েকজন সহকর্ম্মীর প্ররােচনায় একজন খ্যাতনামা সাধুর নিকট পুনরায় দীক্ষা গ্রহণ করিলেন। কিন্তু ইহাতেও নিবৃত্তি হইল না। কি একটা ছুটি উপলক্ষে তিনি ৩/৪ জন সহকর্ম্মী বন্ধুদের সঙ্গে পুরী বেড়াইতে গিয়াছিলেন, সেখানে অন্য একজন সাধুকে দেখিয়া তাহার প্রাণ ভক্তি ও শ্রদ্ধায় একেবারে বিগলিত হইয়া গেল, ইহাকেও গুরুত্বে বরণ না করিয়া তিনি স্থির থাকিতে পারিলেন না। হইল তিন, কিন্তু ইহার পরের ঘটনাটি আরও মজাদার। এই ভদ্রলােকের একজন বিশিষ্ট বন্ধুর কাকীমা কাশীতে এক সাধুর নিকট কয়েক দিন ঘােরাফেরা করিয়া স্থির করিলেন যে, ইঁহার নিকটেই তিনি দীক্ষা গ্রহণ করিবেন। সাধুর নিকট তাহার সঙ্কল্পের কথা নিবেদন করিতেই তিনি বলিলেন যে, সে সময়টা দীক্ষার পক্ষে প্রশস্ত নহে এবং প্রায় ছয়মাস পরের একটা দিন ধার্য্য করিয়া দিলেন। ভদ্রমহিলাও কলিকাতায় ফিরিয়া আসিলেন। সেই শুভ দিনটি নিকটবর্ত্তী হইতেই সেই কাকীমা কাশী যাইবার জন্য প্রস্তুত হইলেন কিন্তু বিপদ হইল এই যে, তাহার ভাশুরপুত্র তখন কয়েকটা বৈষয়িক ব্যাপারে এমন জড়াইয়া পড়িয়াছিলেন যে, এক দিনের জন্যও তাহার কলিকাতা ছাড়িয়া স্থানান্তরে যাইবার উপায় ছিল না। তিনি আসিয়া তাহার বন্ধুকে, অর্থাৎ আমাদের এই ভদ্রলােককে, ধরিয়া বসিলেন যে, তিন দিনের ছুটি লইয়া কাশী যাইয়া কাকীমার এই কাজটা তাহাকে করাইয়া দিতেই হইবে। পাঠক-পাঠিকারা এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝিয়াছেন যে, স্বভাবতঃই এই ভদ্রলােক সহজে কাহারও অনুরােধ এড়াইতে পারিতেন না, সুতরাং নির্দ্দিষ্ট তারিখের পূর্ব্বের দিন তিনিই ঐ ভদ্রমহিলাকে লইয়া কাশী গিয়া পৌঁছিলেন। ঐ সাধুজী কাশীর বাহিরে বরুণার ওপারে ক্ষুদ্র একখানা কুটিরে থাকিতেন, দীক্ষার নির্দ্দিষ্ট দিন প্রাতঃকালে ইহারা যাইয়া দেখিলেন যে, কুটিরের সম্মুখে একটা গাছে দোলনা খাটান রহিয়াছে এবং সাধুজী ঐ দোলনায় বসিয়া ধীরে ধীরে দোল খাইতেছেন। ইহাদের দেখিয়া সাধুজী তাঁহার দোল থামাইলেন এবং ভদ্রমহিলাকে তাঁহার নিকটে আসিতে বলিলেন। ভদ্রমহিলা কাছে আসিতেই সাধুজী তাহার দক্ষিণ কানের উপর নিজের মুখ স্থাপন করিয়া তাহাকে তাহার ইষ্টমন্ত্র বলিয়া দিলেন। তিনিও সাধুজীকে প্রণাম করিয়া একটু দূরে সরিয়া আসিলেন। আমাদের ঐ ভদ্রলােক নিকটেই ছিলেন, হঠাৎ সাধুজী বলিয়া বসিলেনঃ “তু-ভি আ যাও।” তিনি আর কি করেন, আগাইয়া আসিতেই হইল এবং সাধুজীও তাহার কানে আর এক নম্বর মন্ত্র ফুঁকিয়া দিলেন। এই চারিটি “নাম” ও চারিটি গুরু লইয়া ভদ্রলােক ফাঁপরে পড়িয়াছিলেন। আরও বিপদ হইয়াছিল এই যে, তিনি যে তলে তলে এতখানি বাধাইয়াছেন তাহা তাহার স্ত্রী কিম্বা বাড়ীর অপর কেহ ঘুণাক্ষণেও জানিতেন না। কথাটা প্রকাশ হইয়া পড়িলে বাড়ীতেও যে একটা অনর্থ বাধিয়া উঠিবে, এই ভয়ে ভদ্রলােক সৰ্ব্বদাই সন্ত্রস্ত থাকিতেন। ঠাকুরের সংবাদ তিনি কোথায় পাইয়াছিলেন ঠিক মনে নাই কিন্তু তাহার, কেন জানি না, একটা স্থির বিশ্বাস জন্মিয়াছিল যে, ঠাকুরই তাহার এই সমস্যার মীমাংসা করিয়া দিতে পারিবেন। পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, এই জন্যই মাঝে মাঝে ঠাকুরের খোঁজে তিনি আমার নিকট আসিতেন। আমি তাহাকে ঠাট্টা করিয়া বলিতাম যে, তিনি দ্রৌপদী হইতে চাহিতেছেন, চারিজন তাে আছেই, ঠাকুরকে পাইলেই সংখ্যা পূর্ণ হয়।
যাহাই হউক, ভদ্রলােক অকপটে তাহার সকল কথাই ঠাকুরের নিকট খুলিয়া বলিলেন, কোন কিছুই গােপন করিলেন না। তাহার কথা শেষ হইতেই ঠাকুরের পা দুখানি তাহার বুকের উপর আঁকড়াইয়া ধরিয়া ঝরঝর করিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। ঠাকুর কিছুই বলিলেন না, আমরাও কিছু বলিলাম না, প্রায় ১০ মিনিট এই ভাবেই কাটিয়া গেল। শেষে ভদ্রলোক অত্যন্ত কাতরস্বরে ঠাকুরকে বলিলেন যে, তাহার একটা গতি করিয়া দিতেই হইবে।ঠাকুর কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া পরে ভদ্রলোককে বলিলেনঃ “আমি কি করব, আপনার ‘নাম’ তো আমার কাছে নাই।” কিন্তু তিনিও নাছোড়বান্দা , ঠাকুরের পা দুখানি আঁকড়াইয়া রহিলেন, কিছুতেই ছাড়িলেন না । আবার কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কাটিয়া গেল। হঠাৎ ঠাকুর একটি ‘নাম’ উচ্চারণ করিলেন। ভদ্রলোক চমকিয়া উঠিলেন এবং ঠাকুরকে বলিলেনঃ “এই ‘নাম’ই তো আমি এবং আমার স্ত্রী আমাদের কুলগুরুর নিকট পাইয়াছিলাম।” তখন ঠাকুর তাহাকে বলিলেনঃ “এইটিই আপনার ‘নাম’, পরে যাহা কিছু পাইয়াছেন ,সবই ভূতের মন্ত্রণা। এই ‘নাম’ লইয়াই পড়িয়া থাকেন, ইহারই সেবা পরিচর্য্যা করেন, ক্রমে সবই পরিষ্কার হইয়া যাইবে।” ঠাকুরের এই কথার উপর ঐ ভদ্রলোক সরলভাবেই বলিলেন যে, যে- কুলগুরুর নিকট হইতে তিনি এই ‘মন্ত্র’ পাইয়াছেন তিনি একজন ঘোর সংসারী, সাধূচিত কিছুই তাহার মধ্যে নাই। মামলা-মোকদ্দমায় তাহার অদম্য উৎসাহ এবং আরও অনেক প্রকার অপকর্ম্মে তিনি সিদ্ধহস্ত, এই জন্যই তাহার প্রদত্ত ‘নামে’ শ্রদ্ধা রাখিতে পারেন নাই। ঠাকুর বলিলেনঃ “তিনি কি করেন না করেন, তাহাতে তো আপনার কোন প্রয়োজন নাই,আপনার প্রয়োজন ‘নাম’। সেই নাম তো আপনি পাইয়াছেন, তাহা লইয়াই থাকেন।নামের আশ্রয়ে থাকিয়া তাহার সেবা করিয়া গেলে ঘরে বসিয়াই সমস্ত পাওয়া যায়,আর কোন কুহক প্রলোভনে পড়িতে হয় না।একটু সবল হইয়া থাকিতে হয়, সবলতাই পরম পবিত্র ধর্ম্ম।” ভদ্রলোক ঠাকুরের কথায় অনেকটা আশ্বস্ত হইলেন, মনে হইল যে তিনি একটা পথ পাইয়াছেন। আরও কিছুক্ষণ কথাবার্ত্তার পর ভদ্রলোক চলিয়া গেলেন, প্রভাতবাবুও তাহার সঙ্গেই বিদায় লইলেন।
কিন্তু এখানে একটা গুরুতর প্রশ্নের উদ্ভব হইতেছে এবং যদিও পরে স্থানে স্থানে গুরুতত্ত্ব সম্বন্ধে আমাকে অনেক কথাই বলিতে হইবে, তথাপি প্রশ্নটাকে একেবারে এড়াইয়া যাইতে ইচ্ছা হইতেছে না। ঠাকুর যাহা বলিলেন তাহাতে ইহাই মনে হয় যে, গুরুর বাক্যই মুখ্য এবং তাঁহার ব্যক্তিত্বটা গৌণ। নিজের দেহের দিকে অঙ্গুলী নির্দ্দেশ করিয়া তিনি অনেক সময় বলিতেনঃ “এই ভূতটার পিছনে ঘুরিয়া লাভ কি? যাহা পাইয়াছেন তাহা লইয়াই থাকেন।” যাহা ক্ষণস্থায়ী,ভঙ্গুর, আজ আছে কাল নাই, এই অর্থেই “ভূত” শব্দটি ব্যবহার করিতেন। সুতরাং “গুরুর বাক্যই গুরু” এই কথাটাই তিনি বলিয়া গিয়াছেন। “গুরুদেব” কথাটা কখনও তাঁহার মুখে কেহ শােনে নাই, তিনি শুধু “গুরু” শব্দটাই ব্যবহার করিতেন, এবং অনেক সময়েই মনে হইত যে “গুরু” বলিতে তিনি কোন ব্যক্তিকে নির্দ্দেশ করিতেন না, একটা তত্ত্বকেই বুঝাইতেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলােচনার স্থান এখানে নাই, আমি শুধু “গুরুর বাক্যই গুরু” এ সম্বন্ধে একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিয়াই আপাতত ক্ষান্ত হইব। দৃষ্টান্তটি আছে গিরিশচন্দ্রের “পাণ্ডব-গৌরব” নাটকে। অবন্তীরাজ দণ্ডী কৃষ্ণভয়ে ব্যাকুল হইয়া ত্রিভুবনের সর্ব্বত্র আশ্রয় খুঁজিয়া বেড়াইলেন কিন্তু কৃষ্ণের শত্রুকে কেহই আশ্রয় দিতে সম্মত হইল না। উপায়ান্তর না দেখিয়া দণ্ডী আত্মহত্যা করিতে কৃতসঙ্কল্প হইলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি নদীতে ঝাঁপাইতে যাইতেছেন এমন সময় সুভদ্রা তাহাকে বাধা দিলেন, তিনি ঐ ঘাটে স্নান করিতে আসিয়াছিলেন। দণ্ডীর মুখে সকল কথা শুনিয়া যদিও তিনি নিঃসন্দেহে বুঝিতে পারিলেন যে, তাহাকে আশ্রয় দিলে কৃষ্ণের বিরাগভাজন হইতে হইবে, তথাপি সুভদ্রা বিন্দুমাত্র দ্বিধাও করিলেন না, কারণ কৃষ্ণই তাহাকে শিখাইয়াছেন যে, “সার ধর্ম্ম আশ্রিত রক্ষণ”। পাণ্ডবেরাও সুভদ্রার কার্য্যের অনুমােদন না করিয়া পারিলেন না, কারণ তাঁহারাও কৃষ্ণের মুখেই শুনিয়াছেন যে, আশ্রিত রক্ষণই ধর্ম্ম। কৃষ্ণ কিন্তু বাহ্যতঃ কিছুই বুঝিতে চাহিলেন না। দণ্ডীকে তাহার হাতে সমর্পণ করিবার জন্য জরুরী নির্দ্দেশ জানাইলেন। কৃষ্ণের বাক্যে ও কৃষ্ণে বিরােধ বাঁধিয়া গেল, পাণ্ডবেরা এখন করেন কি? “গুরুর বাক্যই গুরু’, সুতরাং তাঁহারা কৃষ্ণবাক্যকেই আঁকড়াইয়া রহিলেন ; কৃষ্ণের বহিরাম্ফালনকে গ্রাহ্য করিলেন না। শেষ পর্য্যন্ত ব্যাপারটা যাইয়া যুদ্ধে পর্য্যবসিত হইল কিন্তু পাণ্ডবেরা অটলই রহিলেন। তাঁহারা জানিতেন যে, কৃষ্ণের বাক্য নির্ব্বিচারে পালন করিয়া তাঁহারা কৃষ্ণসেবাই করিতেছেন, সুতরাং বাহ্যতঃ কৃষ্ণের শত্রুতা করিতেও দ্বিধা করিলেন না। এই কথাটাই নাট্যকার কুন্তীর অভিযােগের উত্তরে ভীমের উক্তির মধ্য দিয়া আমাদিগকে জানাইয়াছেন।
ভীম বলিতেছেনঃ
“মাতা, ভেবাে না বিষাদ, কেবা ক’রে বাদ,
কে দেছে আশ্রয় বল অনাথ দণ্ডীরে,
বিহনে অনাথনাথ কে আশ্রয় দাতা।
কা’র দয়ার প্রবাহ বহিতেছে হৃদয়ে আমার ,
ত্রিভুবন অরি, তবু মাের অটল হৃদয়।
কৃষ্ণভক্ত আমি, নাহি কৃষ্ণ সনে বাদ,
কাৰ্য্য তাঁ’র আশ্রিত রক্ষণ,
সে কার্য্যে নিযুক্ত আমি, কিঙ্কর তাঁহার।”