ঠাকুর ভাের হইলেই চলিয়া যাইবেন, সুতরাং আমার স্ত্রী তাঁহার ভােগের ব্যবস্থা করিয়া কিছুক্ষণের জন্য ঠাকুরের নিকটে আসিয়া বসিলেন, আমিও ইত্যবসরে রাত্রির আহার সমাধা করিয়া আসিলাম। আমার স্ত্রী বেশীক্ষণ বসিতে পারিলেন না, ছেলেমেয়ের তাগিদে তাহাকে চলিয়া যাইতে হইল। আমি কিন্তু সে রাত্রিতে সহজে ঠাকুরের সান্নিধ্য ছাড়িতে চাহিলাম না।রাত্রি একটার পর তিনি এক রকম জোর করিয়াই আমাকে শুইতে পাঠাইয়া দিলেন। সে রাত্রিতে ঠাকুরের মুখে অনেক কিছুই শুনিয়াছিলাম,দুইটি কথা বেশ স্পষ্ট মনে আছে।ঠাকুর বলিয়াছিলেন যে, গাজীয়াবাদ অঞ্চলে কোনও এক বনে তিনি দীর্ঘকাল তপশ্চর্য্যায় নিযুক্ত ছিলেন।একটি গাছের তলায় তিনি আসন করিয়া মৌনী হইয়া বসিয়া থাকিতেন, সম্মুখে ধুনী জ্বলিত এবং কাঠুরিয়ারা স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া যে ফলমূল আনিয়া দিত তাহাতেই তাঁহার আহার নিষ্পন্ন হইত।কয়েক বৎসর এইভাবে চলিয়া গেল। কাঠুরিয়ারা ক্রমে ঠাকুরের অত্যন্ত অনুগত হইয়া পড়িল এবং তাঁহার মাহাত্ম্য সম্বন্ধে তাহাদের বিশ্বাস এমন দৃঢ় হইয়া উঠিল যে, কাহারও কোন অসুখ-বিসুখ হইলে তাঁহারা ঠাকুরের ধুনী হইতে কিছু ছাই লইয়া গিয়া রোগীকে খাওয়াইয়া দিত, অথবা তাহার গায়ে মাখাইয়া দিত। ইহাতে তাহারা এমন আশ্চর্য্য ফল পাইতে লাগিল যে, কথাটা জানাজানি হইতে বিশেষ বিলম্ব হইল না। ঠাকুরের নিকট নানা প্রকারের রোগী আসিয়া জুটিতে লাগিল এবং সেই বনে জনসমাগম অত্যন্ত বাড়িয়া গেল। ঠাকুরের আর সেখানে থাকা সম্ভব হইল না,এক রাত্রিতে সকলের অজ্ঞাতসারে তিনি সরিয়া পড়িলেন।
সেই রাত্রিতেই ঠাকুর আমার নিকট এক রাজপুত দম্পতির কথাও সবিস্তারে বলিয়াছিলেন। ইহাদের গৃহে ঠাকুর বৎসরাধিক কাল কাটাইয়াছিলেন।রাজপুতানার কোনও এক গ্রামে এক নিঃসন্তান দম্পতি বাস করিত। গ্রামটির নাম এবং অবস্থিতি সম্বন্ধে ঠাকুর কিছু বলিয়াছিলেন কিনা স্মরণ নাই। ইঁহারা বেশ সম্পন্ন গৃহস্থ ছিলেন এবং ইহাদের গোশালায় অনেকগুলি দুগ্ধবতী গাভী ছিল। কোথায়, কিভাবে ইঁহারা প্রথম ঠাকুরের সহিত পরিচিত হ’ন, আমি জানি না। ঠাকুর বলিয়াছিলেন যে, স্বামী-স্ত্রী উভয়েই তাঁহাকে পুত্রবৎ স্নেহ করিতেন এবং বাৎসল্যভাবেই তাঁহার সেবা করিতেন। বাড়িতে প্রচুর দুগ্ধ ছিল,সেই দুগ্ধে দধি, ক্ষীর, মাখন, ছানা, মিষ্টান্ন প্রভৃতি নানাবিধ উপকরণ প্রস্তুত করিয়া স্বামী-স্ত্রী মিলিয়া গোপাল সেবার আয়োজন করিতেন। ঠাকুরকে তাহারা গোপাল জ্ঞানেই সেবা করিতেন। কিন্তু একটি বিষয়ে ঠাকুর ইহাদের অনুরোধ সযত্নে এড়াইয়া চলিতেন। স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই ইচ্ছা যে ঠাকুর তাহাদের সম্মুখে বসিয়া ক্ষীর, সর, মিষ্টান্নাদি আহার করেন এবং তাহা দেখিয়া তাঁহারা নয়ন সার্থক করেন, কিন্তু ঠাকুর কিছুতেই তাহাতে সম্মত হইতেন না। তিনি ক্ষীর, সরাদির পাত্রগুলি একটি ঘরে লইয়া গিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিতেন এবং আনুমানিক ২০ মিনিট পরে দরজা খুলিয়া দিলে দেখা যাইত যে, খাদ্যগুলি সবই নিঃশেষিত হইয়া গিয়াছে, শুধু একটি ছোট বাটিতে কিছু মিষ্টান্ন স্বামী-স্ত্রীর জন্য উদ্বৃত্ত রহিয়াছে । এইভাবে এক বৎসর কাটিয়া গেল এবং ক্রমে সেই দম্পতির মনে একটা সন্দেহ জাগিয়া উঠিল। ঠাকুর নিজেই এই ক্ষীর, সরাদি খাইয়া ফেলেন,না ইহার ভিতর অন্য কোনও রহস্য আছে , এইরূপ একটা প্রশ্ন তাহাদের মনে দানা বাঁধিয়া উঠিল। ঠাকুর যখন দরজা খুলিয়া বাহির হইয়া আসিতেন, তিনি যে এইমাত্র এতগুলি খাদ্যদ্রব্য উদরসাৎ করিয়া আসিয়াছেন তাহার কোন লক্ষণই তাঁহারা দেখিতে পাইতেন না। সুতরাং স্বামী-স্ত্রী মিলিয়া স্থির করিলেন যে, ঠাকুর ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া বাস্তবিক কি করেন লুকাইয়া তাহা দেখিতে হইবে। একদিন ঠকুর দরজা বন্ধ করিতেই তাঁহারা দুইজনে যাইয়া গবাক্ষের দুইটি ছিদ্রপথে উঁকি মারিয়া রহিলেন। একটু পরেই দেখিলেন যে, এক বিরাটাকায় পুরুষ ঘরের মধ্যে আসিয়া প্রবেশ করিলেন এবং দু’ চার মিনিটের মধ্যে খাদ্যগুলি নিঃশেষ করিয়া অন্তর্হিত হইয়া গেলেন। স্বামী- স্ত্রী অবাক হইয়া তৎক্ষণাৎ সে স্থান হইতে সরিয়া পড়িলেন। যথাসময়ে ঠাকুর বাহির হইয়া আসিলে তাঁহারা আর কৌতূহল দমন করিতে পারিলেন না, ঠাকুরের নিকট সেই বিরাটাকায় পুরুষের পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলেন। ঠাকুর সঠিক কিছুই বলিলেন না এবং রাত্রিতে সকলের অজ্ঞাতসারে সেই গৃহ পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন।
এই ঘটনাটির মধ্যে একটু অলৌকিকত্ব থকায় ইহা প্রকাশ করিব না বলিয়াই স্থির করিয়াছিলাম কিন্তু এই ঘটনা উপলক্ষ্যে ঠাকুর যে দু’একটা কথা বলিয়াছিলেন তাহার খাতিরেই ব্যপারটা শেষ পর্য্যন্ত খুলিয়া বলিতে হইল। আমার এই কথা হইতে কেহ যদি মনে করেন যে, অলৌকিক ব্যাপারের প্রতি আমার একটা বিরাগ আছে, অথবা আমি ইহা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি না, তাহা হইলে আমাকে অত্যন্ত ভুল বুঝা হইবে। মহাজনদের যে নানা প্রকার অলৌকিক শক্তি থাকে তাহা আমি সর্ব্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করি, নিজেও কিছু কিছু প্রত্যক্ষ করিয়াছি। ঠাকুর বলিতেন যে, যাঁহারা মহাজন,যোগৈশ্বর্য্যগুলি তাঁহাদের পরিচর্য্যার প্রতীক্ষায় সর্ব্বদাই সঙ্গে সঙ্গে থাকে।মহাজনেরা সে দিকে দৃকপাত করেন না সত্য, কিন্তু কখন কখন কোনও বিশেষ কারণে ঐ সকল যোগ বিভূতি প্রত্যক্ষ হইয়া পড়ে। কিন্তু ঠাকুর আমাকে অনেক বার সাবধান করিয়া দিয়াছেন যে, এইগুলির দিকে মনোযোগ দিতে নাই। অতিরিক্ত মাত্রায় এই সকল কাহিনীর অনুসরণ করিলে আবরণের সৃষ্টি হয় এবং প্রকৃত পন্থা ধূমাছন্ন হইয়া উঠে। আবার ইহাদের আসল নকলও আছে, সকল সময়ে সঠিক বুঝিয়া উঠা যায় না। একটা গল্প মনে পড়িতেছে, গল্পটি শুনিয়াছিলাম কাশীতে একজন কবীরপন্থী সাধুর মুখে। ভক্তপ্রবর কবীরের চন্দন নামে এক বাল্যবন্ধু ছিল। দুই বন্ধুর মধ্যে অত্যন্ত সম্প্রীতি ছিল, কেহ কাহাকেও ছাড়িয়া থাকিতে পারিতেন না, এবং ছেলেবেলা হইতেই তাঁহারা দুইজনে ভগবৎপ্রসঙ্গ করিয়া প্রত্যহই অনেকটা সময় কাটাইয়া দিতেন। ক্রমে এক সময় আসিল যখন উভয়েই একটা আশ্রয়ের প্রয়ােজন অনুভব করিলেন এবং গুরুর সন্ধানে বাড়ী হইতে বাহির হইয়া গেলেন। কবীর কাশী যাইয়া শ্রীমৎ রামানন্দের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিলেন এবং গৃহে ফিরিয়া আসিয়া রামগুণগান করিয়া পরমানন্দে দিনাতিপাত করিতে লাগিলেন। এদিকে কবীরের বন্ধু চন্দন নানাস্থানে পর্য্যটন করিয়া অবশেষে এক হঠযােগী সাধুর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করিলেন। প্রায় দ্বাদশ বৎসর একান্ত মনে সাধনায় নিবিষ্ট হইয়া রহিলেন এবং কিছু কিছু বিভূতি তাঁহার করায়ত্ত হইল। তাঁহার ধারণা হইল যে, তিনি সাধনমার্গে অনেকটা অগ্রসর হইয়াছেন এবং একটু অভিমানও আসিয়া তাঁহাকে আশ্রয় করিল। তিনি মনস্থ করিলেন যে, কবীর এতদিনে কতদূর কি করিয়াছে একবার দেখিয়া আসিতে হইবে। এই উদ্দেশ্যে তিনি প্রায় ১৩ বৎসর পর দেশে ফিরিয়া আসিয়া কবীরের কুটীরে উপস্থিত হইলেন। এতদিন পরে প্রাণের বন্ধুকে পাইয়া কবীর আনন্দে আত্মহারা হইলেন এবং তাঁহাকে সুদৃঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করিলেন। পরে নিজের নিকটে বসাইয়া কুশল প্রশ্নাদি আরম্ভ করিলেন। দু’চার কথার পরেই স্বভাবতঃই সাধন ভজনের কথা উঠিয়া পড়িল। চন্দনের প্রশ্নের উত্তরে কবীর বলিলেন যে, তিনি শ্রীমৎ রামানন্দের আশ্রয় পাইয়াছেন, রামনাম লইয়াই আছেন। তাঁতে কাপড় বুনিয়া এবং হাটে তাহা বিক্রয় করিয়া যে আয় হয় তাহাতেই তাঁহার স্বচ্ছন্দে চলিয়া যায়, কোন অভাবই তাহার নাই। চন্দন হাসিয়া উঠিলেন এবং তাঁহার চোখে-মুখে একটা তাচ্ছিল্যের ভাব প্রকাশ পাইল। তখন কবীর তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন যে, তিনি কোথায় গুরুকরণ করিয়াছেন এবং সাধন ভজনেই বা কতদূর অগ্রসর হইয়াছেন। কবীরের প্রশ্ন শুনিয়া চন্দন গম্ভীর হইয়া গেলেন এবং একটু ভারিক্কী চালে কবীরকে বলিলেন যে, তিনি একজন সিদ্ধযােগীকে গুরুত্বে বরণ করিয়া দ্বাদশবর্ষব্যাপী কঠোর সাধনায় কয়েকটি চমকপ্রদ অলৌকিক শক্তি অর্জ্জন করিয়াছেন ; তিনি খড়ম পায়ে হাঁটিয়া নদী পার হইয়া যাইতে পারেন এবং শূন্যে বিচরণ করিতে পারেন। আরও কিছুকাল সাধনা করিতে পারিলে অনেক কিছুই যে তাঁহার করায়ত্ত হইবে, এ বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ। এবার কবীর উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিলেন এবং হাসি থামিলে চন্দনকে বলিলেনঃ “ভাই, এতটা উদ্যম, এতটা পরিশ্রম, আর এতটা সময় এমন ভাবে অযথা নষ্ট করিয়া আসিলে। খেয়ামাঝিকে একটা পয়সা দিলেই তাে নদী পার হওয়া যায়, আর শূন্যে বিচরণ, সে তাে চিড়িয়ারাও করে।” কবীরের কথাটি শুনিয়া চন্দন এমন একটা বিষম ধাক্কা খাইলেন যে, কিছুক্ষণ তিনি কোন কথাই বলিতে পারিলেন না, শেষে নিজের ভ্রম বুঝিতে পারিয়া অঝােরে কাঁদিতে লাগিলেন। অনেক বলিয়া কহিয়া পরিশেষে তিনি কবীরেরই শিষ্যত্ব গ্রহণ করিলেন। এইজন্যই অলৌকিক কাহিনী লইয়া বেশী ঘাঁটাঘাঁটি করা আমি বাঞ্ছনীয় মনে করি না।
যাহাই হউক, রাজপুত দম্পতির ঘটনাটি বিবৃত করিয়া ঠাকুর আমাকে বলিয়াছিলেন যে, ইঁহারা বাস্তবিক অনন্যভাবেই তাঁহাকে ভালবাসিয়াছিলেন এবং তিনিও তাহাদের নিকট বাঁধা পড়িয়াছিলেন কিন্তু সামান্য একটু সন্দেহের ছায়াপাতেই বন্ধন শিথিল হইয়া গেল। তাঁহারা আর ঠাকুরকে ধরিয়া রাখিতে পারিলেন না। ঠাকুরের দাবী ষোল আনা,সামান্য এক পাই কম হইলেও তাহা দিয়া প্রকৃত ঠাকুর সেবা হয় না। ঠাকুর কখন কখন বলিতেনঃ “যে করে আমার আশ, তার করি সর্ব্বনাশ।” ঠাকুরের মুখের এই “সর্ব্বনাশ” এবং সঙ্গে সঙ্গে “নির্ব্বংশ” ও “শ্মশান” কথা দুইটি তাঁহার আশ্রিতবর্গের মধ্যে অনেকের মনে যে একটা আতঙ্ক ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে ইহা আমি সাক্ষাৎভাবেই জানি, সুতরাং কথা কয়টি একটু পরিষ্কার ভাবে বুঝিবার জন্য যত্ন করা প্রয়োজন মনে হইতেছে। আমরা অজ্ঞানান্ধ জীব, মায়াচক্রে ঘুরিয়া বেড়াই, “সর্ব্বনাশ” কথাটা শুনিলেই ভয়ে আঁতকাইয়া উঠি। সর্ব্বনাশ হইবে শুনিলেই আমরা ভাবি যে আত্মীয় পরিজন মরিয়া যাইবে, বিষয় সম্পত্তি নষ্ট হইয়া যাইবে এবং পরিণামে হয়তাে একেবারে রাস্তায় আসিয়া দাঁড়াইব, কাজেই আতঙ্কে বিহ্বল হইয়া পড়ি, কিন্তু ঠাকুর কথাটা ঠিক এই অর্থে ব্যবহার করিতেন না। আমার পরিচিত এক ভদ্রলােক বিবাহ করিবেন, কি করিবেন না, এই চিন্তায় কিছুদিন যাবৎ মনে মনে ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন। বিবাহ করিলেই সংসার বন্ধনে জড়াইতে হইবে, ইহাই ছিল তাহার আশঙ্কার কারণ। একদিন খােলাখুলি ঠাকুরকে তিনি কথাটা জিজ্ঞাসাই করিয়া ফেলিলেন এবং উত্তরে ঠাকুর বলিলেন যে, বিবাহ বন্ধন করে না, বন্ধন করে আসক্তি। এই আসক্তির নাশই সৰ্ব্বনাশ, মূল ব্যাধি দূর হইয়া গেলে আর কোন কিছুতেই পায় না। কিন্তু এই আসক্তি যখন ক্রমে শিথিল হইতে থাকে তখন আবার এক নূতন আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। যাহা ছিল সবই যে যাইতে বসিল, পরিবর্ত্তে তাে তেমন কিছুই পাইলাম না, এরূপ একটা অনিশ্চিত ভাব আসিয়া মনকে আশ্রয় করিতে চায়। এই অবস্থাও অতিক্রম করিয়া যাইতে পারিলে ক্রমে প্রকৃত “সর্ব্বনাশ” হইয়া যায় এবং ঠাকুরের দাসানুদাস পদবী লাভ হইতে পারে। সুতরাং “সৰ্ব্বনাশ” কথাটা শুনিলেই ভয়ে আঁতকাইয়া উঠিবার কোন কারণ নাই। একটা দৃষ্টান্ত দিলেই কথাটা আরও পরিস্ফুট হইবে। জনকের রাজসভা, ব্রহ্মবিদ্যা সম্বন্ধে আলােচনার জন্য বহু গণ্যমান্য মুনিঋষিরা আসিয়া সেখানে সমবেত হইয়াছেন, ইহাদের শিষ্যেরাও কেহ কেহ আসিয়াছেন, বেশ জমকালাে সভা বসিয়াছে। আলােচনা চলিতেছে, ইতিমধ্যে এক দৌবারিক আসিয়া রাজাকে সংবাদ দিল যে, প্রাসাদে আগুন লাগিয়াছে। কাষ্ঠ-নির্ম্মিত প্রাসাদ, সুতরাং বিপদ অত্যন্ত গুরুতর কিন্তু জনক রাজা এই সংবাদে বিন্দুমাত্র বিচলিত হইলেন না, সভার কার্য্য যথারীতি চলিতে লাগিল। এক মুনির সঙ্গে তাহার দুইজন শিষ্যও সভায় আসিয়াছিলেন, দৌবারিকের কথাটা ইহাদের কানে যাইতেই দুইজনেই অত্যন্ত চঞ্চল হইয়া উঠিলেন। প্রাসাদের সংলগ্ন অতিথিশালায় ইহাদের বাসস্থান নির্দ্দিষ্ট হইয়াছিল এবং সেখানে দু’জনের দুইটি বোঁচকা ছিল। উভয়ের বোঁচকার মধ্যে ছিল একটি কমণ্ডলু, একটি কৌপীন, আর একখানা ছেঁড়া কাঁথা। অতিথিশালায় আগুন লাগিয়া পাছে তাহাদের সম্পত্তি নষ্ট হইয়া যায়, এই ভয়ে দু’জনেই অত্যন্ত আতঙ্কিত হইয়া উঠিলেন। একটি সমৃদ্ধ রাজ্যের অধীশ্বর, সৈন্য, সামন্ত, অর্থ, রথ, অশ্ব ইত্যাদি কোন কিছুরই অভাব নাই, পুত্রকন্যা, আত্মীয়স্বজনে ভরপুর সংসার, চতুর্দ্দিকেই প্রাচুর্য্য, তথাপি জনক রাজার “সর্ব্বনাশ” হইয়া গিয়াছে, কিছুতেই আর তাহার আসক্তি নাই। আর ঐ কমণ্ডলু-কৌপীন-কাঁথাসর্ব্বস্ব শিষ্যদ্বয়ের সর্ব্বনাশের সূচনাও হয় নাই।
একখানি পত্রে ঠাকুর লিখিয়াছিলেনঃ “সত্যনারায়ণ নির্ব্বংশ,তাঁর সেবক নির্ব্বংশ জানিবে।” (বেদবাণী, প্রথম খণ্ড,৩৪৫ নং)। তাঁহার দেহ ত্যাগের কয়েক বৎসর পূর্ব্ব হইতে তিনি তাঁহার আশ্রিতবর্গের মধ্যে সত্যনারায়ণ সেবার প্রচলন করিয়াছিলেন, সে কথা যথাস্থানে আলােচনা করিব।(লেখকের পরলোক গমনের জন্য এই আলোচনা সম্ভবপর হইয়া উঠে নাই)। সেই সময় হইতে ঠাকুরের আশ্রিতেরা প্রায় সকলেই সত্যনারায়ণের সেবা করিয়া আসিতেছেন, কোন কোন গৃহে এই সেবা প্রত্যহই অনুষ্ঠিত হয়। সুতরাং ঠাকুরের এই কথাটি যখন ছাপার হরফে বাহির হইয়া গেল, অনেকের মনেই ইহা একটা আলােড়নের সৃষ্টি করিল। সত্যনারায়ণের সেবা করিলে যদি নিৰ্ব্বংশ হইতে হয়, তাহা হইলে ঠাকুর এই সেবার প্রচলন করিলেন কেন? এই কথাটা লইয়া অনেকেই আমার নিকট আসিয়াছেন এবং এ বিষয়ে আমি কয়েকখানি পত্রও পাইয়াছি। কিন্তু সমস্যাটা জটিল নহে, “নিৰ্ব্বংশ” কথাটাকেও উপরােক্ত “সর্বনাশ” কথাটার মতই বুঝিতে হইবে। এই নিৰ্ব্বংশ কথাটার সম্পর্কে ঠাকুর কখন কখন রক্তবীজের কাহিনীটির উল্লেখ করিতেন। অমিততেজা রক্তবীজ দৈত্যরাজ শুম্ভের সেনাপতি। রক্তবীজের বিশেষত্ব ছিল এই যে, তাহার শরীর হইতে ভূমিতে রক্ত বিন্দু পতিত হইলেই পৃথিবী হইতে সর্ব্বপ্রকারে তাহার ন্যায় বলবিক্রম সম্পন্ন আর একটি অসুরের উদ্ভব হইত। সুতরাং রক্তবীজ যখন যুদ্ধার্থে অগ্রসর হইয়া আসিল, তখন দেবী এক মহাসমস্যায় পড়িলেন। প্রথমে রক্তবীজ গদাহস্তে ঐন্দ্রীর সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। ঐন্দ্রী স্বীয় বজ্রের দ্বারা রক্তবীজকে আহত করিলেন কিন্তু বজ্রাহত তদীয় দেহ হইতে রক্তস্রাব হইতে লাগিল এবং সঙ্গে সঙ্গে রক্তবিন্দুগুলি হইতে নূতন নূতন রক্তবীজ উত্থিত হইতে লাগিল। বৈষ্ণবী চক্রের আঘাতে রক্তবীজের দেহ ছিন্ন ভিন্ন হইয়া গেল কিন্তু তাহার দেহের রক্ত প্রবাহ হইতে সহস্র সহস্র মহাসুরের উদ্ভব হইল। শেষে এমন অবস্থা হইল যে, রক্তবীজের রক্তসম্ভূত এই সকল মহাসুরে জগৎ পরিব্যাপ্ত হইয়া গেল, ইন্দ্রাদি দেবগণ অত্যন্ত আতঙ্কিত হইয়া পড়িলেন। অবস্থা যখন এইরূপ ভয়াবহ হইয়া দাঁড়াইল, তখন দেবী চামুণ্ডাকে তাঁহার মুখবিবর বিস্তার করিতে বলিলেন। দেবীর অস্ত্রাঘাতে যে সকল অসুর নিহত হইতে লাগিল, চামুণ্ডা তাহাদের রক্তাক্ত দেহ নিজ মুখের মধ্যে গ্রহণ করিতে লাগিলেন, আর নূতন অসুর জন্মাইতে পারিল না। এইভাবে ক্রমে ক্ষীণরক্ত হইয়া রক্তবীজ প্রাণত্যাগ করিল। ঠাকুর বলিতেন যে, রক্তবীজ হইল বাসনার প্রতীক, বাসনা হইতেই বাসনার সৃষ্টি হয়, এই বাসনা-পরম্পরা কিছুতেই নিবৃত্ত হইতে চাহে না। কিন্তু চামুণ্ডা যেমন রক্তবীজের এক বিন্দু রক্তও মাটিতে পড়িতে না দিয়া, শূন্যে নিজের মুখের মধ্যে তাহা গ্রহণ করিয়া রক্তবীজের জড় মারিয়া দিলেন সেইরূপ কেহ যদি শূন্যের সহিত সম্বন্ধ পাতাইয়া ধীরে ধীরে এই বাসনাগুলিকে শূন্যে মিলাইয়া দিতে পারে তাহা হইলে এই বাসনা-বংশ-পরম্পরা আর থাকে না, রক্তবীজের নিধন হয় এবং ‘নির্ব্বংশ’ হওয়া যায়।
একদিন ঠাকুরের আশ্রিত কোনও এক ভদ্রলােক আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন। আমি অসুস্থ থাকায় ভদ্রলোককে দোতলায় আমার শােবার ঘরে আনাইয়াছিলাম। সেই ঘরে ঠাকুরের একখানা পদ্মাসনে উপবিষ্ট ঊর্দ্ধনেত্র ছবি দেয়ালে টাঙ্গানাে আছে। আমার সঙ্গে কথা বলিতে বলিতে ভদ্রলােকের দৃষ্টি হঠাৎ সেই ছবির উপর পড়িল এবং তিনি আতঙ্কে একেবারে শিহরিয়া উঠিলেন। ভীতিবিহ্বল কণ্ঠে আমাকে বলিলেনঃ “এ আপনি করিয়াছেন কি? এই ছবি ঘরে রাখিয়াছেন, শীঘ্র সরাইয়া ফেলুন।” আমি অতিমাত্রায় বিস্মিত হইয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলামঃ “কেন কি হইয়াছে?” ভদ্রলােক বলিলেন যে, তিনি স্বকর্ণে ঠাকুরকে বলিতে শুনিয়াছেন যে, যে এই ছবি ঘরে রাখিবে সে নিৰ্ব্বংশ হইয়া যাইবে। ছবিটি সরাইয়া ফেলিতে তিনি পুনরায় আমাকে সনির্ব্বন্ধ অনুরােধ জানাইলেন। তাহার এই ব্যগ্রতা দেখিয়া আমি বেশ একটু কৌতুক অনুভব করিতেছিলাম কিন্তু মনের ভাব চাপিয়া রাখিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলামঃ “নিৰ্ব্বংশ শব্দে আপনি কি বুঝিয়াছেন?” তিনি বলিলেনঃ “নিৰ্ব্বংশ মানে নিৰ্ব্বংশ, ইহার আর বােঝাবুঝি কি?” আমি তাহাকে ঠাকুরের অভিপ্রেত অর্থটা বুঝাইতে চেষ্টা করিলাম কিন্তু তিনি আমার কোন কথাই শুনিতে চাহিলেন না, অত্যন্ত তাড়াতাড়ি বিদায় লইয়া চলিয়া গেলেন। এই ছবিখানা লইয়া এই প্রকারের বাদানুবাদ আমাকে অনেকের সঙ্গেই করিতে হইয়াছে। কিছুদিন পূর্ব্বে ঠাকুরেরই আশ্রিত এক প্রবীণ ভদ্রলােক আমার সেই ঘরে আসিয়াছিলেন। তিনিও এই ছবিখানা দেখিয়া অতিমাত্রায় বিস্মিত হইলেন। আমাকে জানাইলেন যে, এই ছবিখানা তাহার ঘরেও ছিল এবং ঠাকুর নাকি ছবিখানা দেখিয়া তাহাকে বলিয়াছিলেন যে, এটি শ্মশানের ছবি। ঠাকুরের কথাটা শুনিয়া তাহার মনে ভীতির সঞ্চার হইল, ছবিখানা ঘরে রাখিলে বুঝিবা তাহার গৃহই শ্মশান হইয়া যাইবে। এই ভয়ে ঠাকুরের অনুমতি লইয়া ছবিখানা গঙ্গায় ভাসাইয়া দিয়া আসিলেন। ভদ্রলােক নিতান্ত সরলভাবেই কথাটা আমাকে বলিয়াছিলেন। আমি তাহাকে বলিলাম যে, ঠাকুরের কথাটা তিনি ঠিক ধরিতে পারেন নাই। “সৰ্ব্বনাশ” ও “নিৰ্ব্বংশ” কথা দুইটির মত এই “শ্মশান” কথাটিকেও বাসনার মূলােৎপাটন অর্থেই বুঝিতে হইবে। হৃদয় শ্মশান না হইলে শ্মশানবাসিনীর নৃত্য সেখানে হয় না। এই জন্যই ভক্ত-সাধক গাহিয়াছেনঃ
“শ্মশান ভালােবাসিস ব’লে, শ্মশান ক’রেছি হৃদি,
শ্মশানবাসিনী শ্যামা, তুই নাচবি ব’লে নিরবধি।
আর কোন সাধ নাই মা চিতে, শুধু চিতার আগুন জ্বলছে চিতে,
চিতাভস্ম চারিভিতে রেখেছি মা আসিস যদি।”