শ্রীশ্রীরাম ঠাকুর – কবিবর নবীনচন্দ্র সেন লিখিত

শ্রীশ্রীরাম ঠাকুর

(কবিবর ँনবীনচন্দ্র সেন লিখিত আমার জীবন, চতুর্থ ভাগ প্রচারক না প্রবঞ্চক)

 

“রাম ঠাকুরের বাড়ী বিক্রমপুর, বয়স ২৬/২৭ বৎসর মাত্র। তাঁহার মুখে শুনিয়াছি যে, তাঁহার গুরুদেব একজন প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক ছিলেন। রাম ঠাকুরের যখন ৮ বৎসর বয়স, তিনি মৃত্যুমুখে তাঁহাকে বলিয়া যান যে, রাম ঠাকুরের সঙ্গে তাঁহার আবার সাক্ষাৎ হইবে। কথাটি শুনিয়া বালকের মনে এক বিপ্লব উপস্থিত হইল। মৃত ব্যক্তির সঙ্গে আবার সাক্ষাৎ হইবে ইহার অর্থ কি? বালক ইহার কিছুই সিদ্ধান্ত করিতে পারিল না। কিন্তু তাহার প্রাণে এক উদ্যম সঞ্চারিত হইল। তাহার পড়াশুনাতে মন লাগিত না। অবশেষে সে ১২ বৎসর বয়সে গৃহত্যাগ করিয়া নানাস্থানে সন্ন্যাসীর সঙ্গে ভ্রমণ করিতে আরম্ভ করে। একদিন কামরূপের কামাখ্যা দেবীকে প্রণাম করিয়া মন্দির হইতে বাহির হইবে, এমন সময়ে এক পার্শ্ব হইতে কে বলিল, “তুই আমার গাঁজা সাজাইয়া দিয়া যা”। সে ফিরিয়া দেখিল, একজন সন্ন্যাসী। চোখে দেখা হইলে তিনি বলিলেন – “তুই আমাকে চিনিতে পারিতেছিস না?” রাম ঠাকুরের বোধ হইল এই কন্ঠস্বর তাহার গুরুদেবের। পরে তাঁহার সঙ্গে বহু বৎসর হিমালয় ভ্রমণ করে এবং মহাত্মাদের কলেবর পরিবর্তন ইত্যাদি বহু অদ্ভুত ব্যাপার দর্শন করে। তাহার গুরুদেব তাহাকে মাতার মৃত্যু পর্যন্ত সংসারাশ্রমে ফিরাইয়া পাঠান। রাম ঠাকুর তাহার গ্রামস্থ একজন ওভারসিয়ারের পাচক হইয়া নোয়াখালী আসে। গল্প উঠিল যে, একদিন সে আহ্নিকে বসিয়া হঠাৎ বলিয়া উঠিল – “আহা! অমুকের শিশুপুত্রটি মারা গেল।” বাস্তবিক নোয়াখালী শহরের অন্যস্থানে ঠিক সেই সময়ে সেই শিশুটির দৈব ঘটনাতে মৃত্যু হইল। তাহার পর ফেণীতে যে ‘জেলখানা’ প্রস্তুত হইতেছিল, রাম ঠাকুর তাহার সরকার হইয়া আসিল। লোকে বলিতে লাগিল যে, কখনও তাহাকে গৃহে আহ্নিকে দেখিয়াছে এবং পরের মুহূর্তে রাম ঠাকুর অদৃশ্য হইয়াছে। কেহ তাহাকে রাত্রিশেষে রক্তচন্দন চর্চ্চিত অবস্থায় কোনও বৃক্ষ হইতে অবতরণ করিতে দেখিয়াছে। সর্প দংশন করিতে, গরু মহিষ মারিতে আসিতেছে, আর রাম ঠাকুর বারণ করা মাত্র চলিয়া গিয়াছে। নিজে কিছুই আহার করে না। কদাচিৎ দুগ্ধ বা ফল আহার করে। অথচ তাহার সবল সুস্থ শরীর। পরসেবায় তাহার পরমানন্দ। জেলখানার ইটখোলার গৃহে পাব্লিক ওয়ার্ক প্রভুদের বারাঙ্গনাগণ কখন পালে পালে উপস্থিত হয়। কিন্তু রাম ঠাকুর তাহাদের ঘৃণা করা দূরে থাকুক, বরং সন্তোষের সহিত নিজে রাঁধিয়া তাহাদের অতি যত্নে আহার করায়, এবং মাতাল হইয়া পড়িলে তাহাদের আপন মাতা কি ভগিনীর মত শুশ্রূষা করে। সে সময়ে নোয়াখালী হইতে বহুদূর ভবানীগঞ্জে ষ্টীমারে উঠিতে হইত। রাম ঠাকুর একদিন একটি আত্মীয়কে ষ্টীমারে তুলিয়া দিয়া ফিরিতে রাত্রি হইলে একটি মসজীদে আশ্রয় গ্রহণ করিল। গভীর রাত্রিতে রাম ঠাকুর দেখিল, মসজীদ আলোকিত হইয়াছে এবং তাহার গুরুদেব আর দুইজন সন্ন্যাসীর সঙ্গে তাহার সমক্ষে দাঁড়াইয়া আছেন। তিনি বলিলেন যে, তাঁহারা কৌশিকী পর্ব্বত হইতে চন্দ্রনাথ যাইতেছিলেন। নির্জন স্থানে, একাকী, গভীর রাত্রি, রাম ঠাকুর ভীত হইয়াছে দেখিয়া তাহাকে দেখিতে আসিলেন।

আর একটি গল্প বহু লোকের মুখে, সর্ব্বশেষে রাম ঠাকুরের নিজ মুখেও শুনিয়াছিলাম। সে বৎসর শিবচতুৰ্দ্দশীতে চন্দ্রনাথে তাহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিবেন বলিয়া তাহার গুরুদেব প্রতিশ্রুত ছিলেন। রাম ঠাকুর ছুটীর দরখাস্ত করিয়াছিল, কিন্তু একজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার পরিদর্শনে আসিবেন বলিয়া ওভারসিয়ার ছুটি দিলেন না। রাম ঠাকুর শিবচতুৰ্দ্দশীর প্রাতে বড় মনোদুঃখে বসিয়া, গুরুদেব তাহাকে কেন এই দর্শন হইতে বঞ্চিত করিলেন ভাবিতেছে। এমন সময়ে টেলিগ্রাম আসিল যে, সাহেব আসিবেন না। তাহার ছুটি মঞ্জুর হইল। রাম ঠাকুর আনন্দে আত্মহারা হইয়া চন্দ্রনাথ দর্শনে ছুটিল কিন্তু অকস্মাৎ উত্তেজনায় ভ্রান্ত হইয়া দক্ষিণ মুখে না গিয়া উত্তর মুখে চলিল। কিছু দূর গেলে একজন লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইল, সে বলিল যে, রামঠাকুর চন্দ্রনাথের বিপরীত দিকে যাইতেছে। তখন ভ্রম বুঝিয়া এক বৃক্ষতলায় বড় সন্তপ্ত হৃদয়ে বসিয়া আছে, এমন সময়ে একটি সন্ন্যাসী আসিয়া উপস্থিত হইয়া, রাম ঠাকুর কি চন্দ্রনাথ যাইবে জিজ্ঞাসা করিল। রাম ঠাকুর বলিল যে, ভ্রমবশতঃ বিপরীত দিকে আসিয়াছে অতএব সেদিন আর চন্দ্রনাথে পৌঁছিবার সম্ভবনা নাই। সন্ন্যাসী তাঁহার সঙ্গে যাইতে বলিলেন এবং পাহাড়ের ভিতরে প্রবেশ করিয়া পার্ব্বত্য পথে তাহাকে সন্ধ্যার পূর্ব্বে চন্দ্রনাথ পর্ব্বতের সানুদেশে উপস্থিত করিলেন। সেই স্থান হইতে চন্দ্রনাথ চল্লিশ এবং ফেণী হইতে ত্রিশ মাইলের পথ। সেই রাত্রি সীতাকুণ্ডে অতিবাহিত করিবার পর আবার সেরূপ অজ্ঞাতভাবে তাহাকে আনিয়া ফেণীর উত্তরদিকে একটি স্থানে রাখিয়া গেলেন। সেখানে একজন পেয়াদার সঙ্গে রাম ঠাকুরের সাক্ষাৎ হইতেই সে লুকাইতেছিল। পেয়াদা তাহাকে পাকড়াও করিল এবং তাহার দ্বারা মহম্মদের এক রাত্রিতে বিশ্বভ্রমণের ন্যায় এই তীর্থদর্শন-কাহিনী প্রথম প্রচারিত হইল। রাম ঠাকুর দেখিতে ক্ষীণাঙ্গ, সুন্দর, শান্তমূর্ত্তি। নিতান্ত পীড়াপীড়ি না করিলে কাহারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করে না, কোনও কথা কহে না। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, তাহার ৮ হইতে ১২ বৎসর বয়স পর্যন্ত সামান্য বাঙ্গালা শিক্ষা মাত্র হইয়াছিল। কিন্তু ধর্ম্মের নিগূঢ় তত্ত্ব, এমন কি, প্রণবের অর্থ পর্য্যন্ত সে জলের মত বুঝাইয়া দিত। আমি তাহাকে বড় শ্রদ্ধা করিতাম। মধ্যে মধ্যে আমি তাহাকে পীড়াপীড়ি করিয়া আমার গৃহে আনাইতাম এবং পতি-পত্নী মুগ্ধ চিত্তে তাহার অদ্ভুত ব্যাখ্যা সকল শুনিতাম। বলা বাহুল্য, সে পেশাদারী হিন্দু প্রচারকের ব্যাখ্যা নহে। একদিন রাণাঘাটে উষাক্ষণে জাগিয়া স্ত্রী বলিলেন যে, তিনি সেবার কালী দর্শন করতে গিয়া শুনিয়াছিলেন, রাম ঠাকুর কালীঘাটে আসিয়াছিল। আমাদের সঙ্গে কেন দেখা করিল না — তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি বলিলাম, কেমন করিয়া বলিব? মুখ প্রক্ষালন করিয়া আমি অফিস-কক্ষে ‘সোফার’ উপর বসিয়া যেই বাহির দিকে দেখিতেছি, দেখি, আমার সম্মুখে বারান্দায় অধোমুখে স্থিরভাবে রাম ঠাকুর দাঁড়াইয়া আছে। আমার বোধ হইল, যেন রাম ঠাকুর আকাশ হইতে সে স্থানে অবতীর্ণ হইয়াছে। অন্যথা আমি তাহাকে আসিতে দেখিতে পাইতাম। তাহার সঙ্গে আমার আর সাক্ষাৎ হয় নাই। শুনিয়াছি, রাম ঠাকুর এখন সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়াছেন”

 

★★★★★

 

এই বিবরণ সম্বন্ধে দুই একটি কথা এখানে বলিয়া রাখা সঙ্গত হইতেছে। ইহার সত্যতা সম্বন্ধে আমি একাধিকবার শ্রীশ্রীঠাকুরকে প্রশ্ন করিয়াছি এবং উত্তরে তিনি দুইটি বিষয় ছাড়া আর সকল কথাই প্রকারান্তরে – স্বীকার করিয়াছেন। নবীন বাবু শ্রীশ্রীঠাকুরের গুরুদেব সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন তাহাতে একটু গোলযোগের সৃষ্টি হইয়াছে। অন্ততঃ ঠাকুরের কথায় আমার ইহাই মনে হইয়াছে। ঠাকুরের পিতা রাধামাধব চক্রবর্তী মহাশয়ের গুরু ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক। প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় বলা হইয়াছে যে, বাল্যকালে তাঁহার সহিত ঠাকুরের অত্যন্ত সম্প্রীতি ছিল এবং ঠাকুর তাঁহার পিতৃদেবের গুরুকে নিজগুরুর মতই ভক্তি শ্রদ্ধা করিতেন। ঠাকুর বলিয়াছেন যে, নবীন বাবু তাঁহার কথা সম্যক বুঝিতে না পারিয়া তাঁহার পিতৃদেবের গুরুকেই তাঁহার নিজ গুরু বলিয়া ধরিয়া লইয়াছেন। প্রথম খণ্ডে লিখিয়াছিলাম যে, ঠাকুর স্বপ্নে সিদ্ধমন্ত্র লাভ করেন। “স্বপ্নে” কথাটা ব্যবহার না করাই বোধ হয় সঙ্গত ছিল, কারণ আমার যতদূর স্মরণ হয়, কোনও অপ্রকাশ্য, অতীন্দ্রিয় উপায়ে তিনি মন্ত্রলাভ করিয়া ছিলেন, এই কথাই যেন তিনি বলিয়াছিলেন। গুরুর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকার হয় কামাখ্যায় এবং সেই প্রসঙ্গে নবীন বাবু যাহা লিখিয়াছেন তাহার আংশিক সত্যতা ঠাকুর স্বীকার করিয়াছেন। নবীন বাবুর অন্যান্য মন্তব্য সম্বন্ধে ঠাকুর শুধু বলিয়াছেনঃ “এরকম ত হয়ই।” কেবল মসজীদে গুরু সাক্ষাৎকার সম্বন্ধে বলিয়াছিলেন যে, উহা পূর্ব্ব হইতেই নির্দিষ্ট ছিল। তিনি ভীত হওয়ায় গুরু আসিয়া তাঁহাকে দর্শন দেন, এ কথা ঠিক নহে।

এরকম যে হয় তাহার দুই চারিটি দৃষ্টান্ত আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতা হইতেও দিতে পারি। আমি তখন দর্জিপাড়ায় ছিদাম মুদী লেনে থাকি। সেখানেই ঠাকুর সর্ব্বপ্রথম আমার বাসায় শুভাগমন করেন। তেতলায় নিরিবিলি একখানা ঘর ছিল, সেখানেই ঠাকুরের থাকার ব্যবস্থা হইয়াছিল। মেজের উপর পাতা বিছানায় ঠাকুর বসিয়া আছেন, আমি ও আর একজন ভদ্রলোক পাশেই একখানা মাদুরের উপর বসিয়া আছি, এমন সময় হঠাৎ দেখি যে, এক ভীষণ দর্শন বিচ্ছু (কাঁকড়া-বিছা) বিছানার উপর উঠিয়া ধীরে ধীরে তাঁহার দিকে অগ্রসর হইতেছে। আমি চিৎকার করিয়া উঠিলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘরের কোণে রক্ষিত একখানা লাঠি হাতে তুলিয়া লইলাম। ঠাকুর বলিলেন, “মারিবেন না, ও কোন অনিষ্ট করিবে না”। মনে হইল যেন অঙ্গুলী সঙ্কেতে উহার নিষ্ক্রমণের পথ দেখাইয়া দিলেন এবং আমরা আশ্চর্য্য হইয়া দেখিলাম যে, ঠাকুরের অভিভাবিত পথেই বিচ্ছুটি ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল।

এই প্রসঙ্গে অনেক কথাই মনে আসিতেছে। ঠাকুর একদিন কথাপ্রসঙ্গে বলিয়াছিলেন যে, যাঁহারা মহাজন, যোগৈশ্বর্য্যগুলি তাঁহাদের পরিচর্যার প্রতীক্ষায় অনবরতই সঙ্গে সঙ্গে থাকে। মহাজনেরা সে দিকে দৃকপাত করেন না ইহা নিশ্চিত, কিন্তু কখন কখন কোনও বিশেষ কারণে ঐ সকল যোগ-বিভূতির অভিব্যক্তি প্রত্যক্ষ হইয়া পড়ে। ঠাকুর নিজে সর্ব্বদাই নিতান্ত সহজভাবে থাকিতেন, ঘনিষ্ঠভাবে কিছুকাল না মিশিলে এবং বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করিয়া না দেখিলে তাঁহাতে কিংবা তাঁহার আচরণে অস্বাভাবিক কিংবা অলৌকিক কোন কিছুই দৃষ্টিগোচর হইত না। কিন্তু কখন কখন ইহার ব্যতিক্রমও হইত। পাঠকবর্গের কৌতূহল নিবারণের জন্য আমি নিজে যাহা সাক্ষাৎ সম্বন্ধে জানি, অথবা ঠাকুরের শ্রীমুখে শুনিয়াছি, এখানে এইরূপ কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করিব।

বিক্রমপুর বেজগাঁও নিবাসী ँসতীশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয়ের নিকট শুনিয়াছিলাম যে, তাঁহার যখন ৪/৫ বৎসর বয়স, সেই সময়ে ঠাকুর কিছুকাল তাঁহাদের বাড়ীতে ছিলেন। তিনি ঠাকুরের অত্যন্ত ন্যাওটা হইয়া পড়িয়াছিলেন এবং অনেক সময়েই ঠাকুরের সঙ্গে সঙ্গে থাকিতেন। ঠাকুরও তাঁহার স্নেহের অত্যাচার হাসিমুখেই সহ্য করিতেন। একদিন দ্বিপ্রহরে ঠাকুর তাহাকে লইয়া বাহির বাড়ীর একখানা টিনের ঘরে শুইয়া ছিলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই বালক ঘুমাইয়া পড়িল। কিছুকাল পরে হঠাৎ কোনও কারণে তাহার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। জাগিয়াই বালক দেখিল যে, ঠাকুর পদ্মাসনে শূন্যে বসিয়া রহিয়াছেন, তাঁহার মাথা ঘরের চালে যাইয়া ঠেকিয়াছে। বালক চিৎকার করিয়া উঠিতেই ঠাকুর তাড়াতাড়ি নামিয়া আসিলেন এবং নানা কথা বলিয়া বালককে ভুলাইতে চেষ্টা করিলেন। সতীশ বাবুর এই কথার সত্যতা সম্বন্ধে আমি ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, ঠাকুর বলিয়াছিলেনঃ “এ রকম ত হয়ই।” এই জাতীয় ঘটনা সম্বন্ধে প্রশ্ন করিয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই এক উত্তরই পাইয়াছি।

ঠাকুরের আশ্রিতবর্গের মধ্যে অনেকেই জানেন যে, তিনি সময়ে সময়ে নানাপ্রকার ব্যাধিতে ভুগিতেন। এই সকল ব্যাধি অনেক ক্ষেত্রেই যে ঠাকুর অন্যের দেহ হইতে আকর্ষণ করিয়া আনিয়া নিজে ভোগ করিতেন, এ কথাও নিশ্চয়ই অনেকে অবগত আছেন। কথাপ্রসঙ্গে একদিন বলিয়াছিলেন যে, ভোগ ভিন্ন প্রারব্ধ দণ্ড খণ্ডন হয় না, সুতরাং ঐশ্বর্য্যবলে কোন ব্যাধি নিরাময় করিলে সেই রোগ-ঋণ জমা হইয়া থাকে, একদিন না একদিন সুদে আসলে তাহা পরিশোধ করিতে হয়। এই জন্যই কৃপাবশে কাহারও রোগ মুক্তির জন্য অগ্রসর হইলে তিনি উহা নিজ শরীরে ভোগ করিয়া রোগ-ঋণ একেবারে চুকাইয়া ফেলিতেন। এরূপ বহু ঘটনা আমার জানা আছে। কখন কখন এমনও দেখিয়াছি যে, এইরূপে যাচিয়া আনা কোনও ব্যাধি নিঃশেষে চুকিয়া না গিয়া মাঝে মাঝে আত্মপ্রকাশ করিত। একদিন আমার ৫৬/সি বিডন স্ট্রীটের বাসায় বৈঠকখানা ঘরে প্রাতঃকালে আমি ও ঢাকা শক্তি ঔষধালয়ের কবিরাজ ँজানকীনাথ দাসগুপ্ত মহাশয় ঠাকুরের সম্মুখে বসিয়া ছিলাম। আমরা এক আশ্চর্য্য ঘটনা প্রত্যক্ষ করিলাম। উভয়ে দেখিলাম যে, প্রায় অর্দ্ধঘণ্টার মধ্যে ধীরে ধীরে কতকগুলি গুটি উঠিয়া ঠাকুরের দুই হাত ও বুক ছাইয়া ফেলিল। কবিরাজ মহাশয় পরীক্ষা করিয়া বলিলেন যে, এগুলি বসন্তের গুটি এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার চিকিৎসক-বুদ্ধি সজাগ হইয়া উঠিল। আমাকে কয়েকটি বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করিতে বলিয়া তিনি উঠিয়া গেলেন এবং যাইবার সময় আমাকে বলিয়া গেলেন যে, শীঘ্রই ঠাকুরের জন্য ঔষধ পাঠাইয়া দিবেন। কবিরাজ মহাশয় চলিয়া যাইতেই ঠাকুর মৃদু হাসিয়া আমাকে বলিলেন “উনি ঠিক বলিয়াছেন; এগুলি বসন্তেরই গুটি। কিন্তু উনি অনর্থক ভীত হইয়াছেন। ঔষধের প্রয়োজন হইবে না এবং ইহা হইতে কাহারও কোন অনিষ্টেরও আশঙ্কা নাই।” এই কথা বলিয়া ঠাকুর আঙ্গুল দিয়া গুটিগুলি আস্তে আস্তে টিপিতে লাগিলেন এবং আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, ঘণ্টাখানেক পরে ঐগুলি নিঃশেষে মিলাইয়া গেল। আমি পীড়া-পীড়ি করিয়া ধরাতে ঠাকুর স্বীকার করিলেন যে, বহুদিন পূর্ব্বে তিনি এক মরণাপন্ন বসন্তের রোগীকে নিরাময় করিয়াছিলেন এবং সেই রোগ এখনও মাঝে মাঝে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু সকল সময়ে তিনি এত সহজে নিস্কৃতি পাইতেন না। ঠাকুরের সংস্পর্শে আসিবার পর হইতেই দেখিয়াছি যে, অনেক সময়ে তিনি বাতের আক্রমণে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করিতেন। সাধারণতঃ পায়েই এই আক্রমণ হইত, হাঁটু ফুলিয়া উঠিত এবং কখন কখন যন্ত্রণা এত মারাত্মক হইয়া পড়িত যে, ঠাকুর ছটফট্ করিয়া বিছানায় এপাশ ওপাশ করিতেন। ফ্ল্যানেলে পা জড়াইয়া রাখা, সেক, মালিশ ইত্যাদি যথারীতি চলিত, কিন্তু একবার হইলে সহজে এই রোগ ছাড়িতে চাহিত না। পরে ঘটনাক্রমে এই ব্যাধির ইতিহাস জানিতে পারিয়াছিলাম। একদিন ঢাকার বীরেন্দ্রকুমার মজুমদার মহাশয়ের বাসায় আমার শ্বশুর শক্তি ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মথুরামোহন চক্রবর্তী মহাশয়ের সহিত ঠাকুর দর্শনে গিয়াছিলাম। তখনও ঠাকুর এই বাতে ভুগিতেছিলেন। শ্বশুর মহাশয় প্রস্তাব করিলেন যে, তিনি একবার এই বাতের চিকিৎসা করিয়া দেখিবেন। তাহাতে ঠাকুর বলিলেনঃ “কোনও দৈব কারণে মাঝে মাঝে এই বাতের আক্রমণ হয়, চিকিৎসায় উপকার হইবে না।” শ্বশুর মহাশয় ঠাকুরকে কথাটা আরও একটু খুলিয়া বলিতে অনুরোধ করিলেন। ঠাকুর প্রথমে নীরবেই রহিলেন কিন্তু শেষে শ্বশুর মহাশয়ের পীড়া-পীড়িতে ঘটনাটা প্রকাশ করিয়া বলিলেন। এক সময়ে ঠাকুর বাঁশবেড়ের নিকটে কোনও এক স্থানে ছিলেন। এক ভদ্রলোক তাঁহার স্ত্রী ও দশবৎসর বয়স্ক এক পুত্র লইয়া সেখানে বাস করিতেন এবং অত্যন্ত আগ্রহ ও শ্রদ্ধা সহকারে ঠাকুরকে নিজ গৃহে রাখিয়াছিলেন। কয়েক দিন পরে হঠাৎ তাঁহার সেই একমাত্র সন্তানটি বাতব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। শরীরের বামার্দ্ধ সম্পূর্ণ অবশ হইয়া যায়। ডাক্তার কবিরাজেরা কোন ভরসাই দিতে পারিলেন না, শুধু কর্ত্তব্য হিসাবে চিকিৎসা করিয়া যাইতে লাগিলেন, ফল কিছুই হইল না। তখন সেই ভদ্রলোক ও তাঁহার স্ত্রী নাছোড়বান্দা হইয়া ঠাকুরকে ধরিয়া পড়িলেন। পুনঃ পুনঃ বলিতে লাগিলেন যে, ঠাকুর ইচ্ছা করিলেই একটা উপায় করিয়া দিতে পারেন। অনেক চেষ্টা করিয়াও ঠাকুর ইহাদের অনুরোধ এড়াইতে পারিলেন না। একদিন রাত্রিতে নিকটস্থ গঙ্গার এক চরে কাশবনের মধ্যে আসন করিয়া বসিলেন। ৩/৪ ঘণ্টার মধ্যেই ছেলেটির আরোগ্য হইয়া গেল এবং তাহার শরীরস্থ বাত আসিয়া ঠাকুরের দেহ আশ্রয় করিল। ঠাকুর একেবারে নিশ্চল, নিঃস্পন্দ হইয়া গেলেন, সামান্য একটু নড়াচড়া করিবার শক্তিও তাঁহার রহিল না। এইভাবে কিছুক্ষণ কাটিবার পর ঠাকুর দেখিলেন যে, তাঁহার গুরু সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। কোন কথা না বলিয়া তিনি ঠাকুরের পিছনে চলিয়া আসিলেন এবং হঠাৎ এক লাথি মারিয়া তাঁহাকে প্রায় ১৪/১৫ হাত দূরে ফেলিয়া দিলেন। ইহাতেই ঠাকুরের আড়ষ্ট হাত পা ছাড়িয়া গেল। গুরু ঠাকুরকে তাঁহার নিকটে আসিতে বলিলেন কিন্তু ঠাকুর স্বাভাবিক ভাবে হাঁটিয়া তাঁহার নিকট আসিতে পারিলেন না, তাঁহাকে হামা দিয়া আসিতে হইল। ইহা দেখিয়া গুরু বলিলেন, “একটু দোষ থাকিয়াই গেল, দেহ যতদিন আছে ততদিন মাঝে মাঝে এই বাতের আক্রমণে ভুগিতে হইবে।” এই কথা বলিয়া গুরু অন্তর্হিত হইলেন এবং ঠাকুরও কষ্টেসৃষ্টে সেই ভদ্রলোকের বাড়ীতে ফিরিয়া আসিলেন।

ঠাকুরের নিজদেহে অপরের রোগভোগের অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে এবং তাঁহার আশ্রিতবর্গের মধ্যে অনেকেই তাহা জানেন, সুতরাং এই প্রসঙ্গ আর অধিক না বাড়াইয়া আমি ভিন্ন জাতীয় আর কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করিয়া আমার বক্তব্য শেষ করিব। আমি তখন ৫৬/সি বিডন স্ট্রীটে থাকি, দোতলা ও তেতলা ভাড়া করিয়া ৩/৪ দিন পূর্ব্বে সেখানে আসিয়া উঠিয়াছি। আমার স্ত্রী ছেলে-মেয়েদের লইয়া সবে মাত্র ঢাকা হইতে এখানে আসিয়া পৌঁছিয়াছেন। উহারা আসিবার পরের দিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীমান পল্টু হারাইয়া গেল। আমার বাড়ীর ঝি কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীটে একটি দোকানে কেরোসিন এবং আরও কি কি জিনিস কিনিবার জন্য গিয়াছিল। পল্টুও তাহার অজ্ঞাতসারে পিছনে পিছনে গিয়াছিল। ঝি ফিরিয়া আসিল কিন্তু পল্টু আসিল না। পল্টু যে ঝি’র পিছনে পিছনে গিয়াছিল একথা ঝি এবং অপর কেহ না জানায় তাহার অনুপস্থিতি কাহারও দৃষ্টি আকর্ষণ করিল না কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই ছেলের খোঁজ আরম্ভ হইল এবং দেখা গেল যে, সম্ভাব্য কোনও স্থানেই সে নাই। আমি সে সময়ে বাড়ী ছিলাম না, রাত্রি ৭টা নাগাদ ফিরিয়া আসিয়া এই ব্যাপার অবগত হইলাম। তৎক্ষনাৎ আবার বাহির হইয়া প্রায় ঘণ্টা খানেক কাছাকাছি অনেকগুলি গলিতে ঘুরিয়া সন্ধান করিলাম কিন্তু কোন সংবাদই পাইলাম না। ইহার পর আমি একখানা ট্যাক্সি লইয়া প্রভাত বাবুর বাসায় আসিলাম। তাঁহার এক আত্মীয় তখন জোড়াসাঁকো থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী ছিলেন, এই ভদ্রলোকের সাহায্য লইলে অনুসন্ধানের সুবিধা হইবে মনে করিয়া প্রভাতবাবুকে সঙ্গে লইয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিব, এই উদ্দেশেই প্রভাতবাবুর বাড়ী আসিলাম। প্রভাতবাবু বাড়ীতে ছিলেন না, সুতরাং বিলম্ব না করিয়া প্রভাতবাবুর ভ্রাতুষ্পুত্র ও উপরোক্ত পুলিশ কর্মচারী মহাশয়ের জামাতা শ্রীমান দামুকে সঙ্গে লইয়া জোড়াসাঁকো থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। মদনবাবু (ঐ পুলিশ অফিসারের নাম) আমার প্রয়োজন জানিয়া লইয়া একে একে কলিকাতার সমস্ত থানায় ফোন করিয়া সন্ধান লইতে লাগিলেন। প্রত্যেক থানায়ই শুনিলাম যে, ২/৪ জন হারানো ছেলে-মেয়ে জমা হইয়া আছে কিন্তু কাহারও বিবরণ পল্টুর সঙ্গে মিলিল না। কলিকাতায় যে দৈনিক কত ছেলেমেয়ে হারায় তাহার একটা আভাস সেইদিন পাইয়াছিলাম। হাসপাতালগুলিতেও সন্ধান লওয়া হইল কিন্তু কোন ফল হইল না। মদনবাবু বলিলেন যে, তিনি ঘণ্টা দুই পরে আর একবার খবর লইবেন এবং কোন সন্ধান পাইলে আমাকে জানাইবেন। অগত্যা বাড়ী ফিরিয়া আসিলাম। সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়াই দেখি যে, প্রভাত বাবু আমার বৈঠকখানা ঘরে বসিয়া রহিয়াছেন। বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি যে, ঠাকুর তখন কলিকাতাতেই মতিলাল বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের ডিক্সনলেনের বাসাতে ছিলেন। প্রভাতবাবু বলিলেন যে, তিনি বাড়ী ফিরিয়া এই সংবাদ পাইয়াই ঠাকুরের নিকট গিয়াছিলেন, ঠাকুর বলিয়াছেন যে, কথাটা একটু জানাজানি হইলেই ছেলের সন্ধান পাওয়া যাইবে। জানাজানি করাইবার শ্রেষ্ঠ উপকরণ সংবাদপত্র; কিন্তু তখন রাত্রি ১১টা পরের দিনের কাগজে বিজ্ঞাপন বাহির করা যাইবে এরূপ ভরসা হইল না। যাহা হউক তৎক্ষনাৎ সংবাদ পাঠাইয়া শক্তি ঔষধালয়ের বিজ্ঞাপনের এজেন্ট অনাথবাবুকে আনাইলাম এবং তাঁহার সাহায্যে অতি কষ্টে ফরওয়ার্ড, অমৃতবাজার এবং দৈনিক বসুমতীতে বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করিয়া আসিলাম। বাকী রাত্রি আমি ও প্রভাতবাবু বৈঠকখানা ঘরে বসিয়াই কাটাইয়া দিলাম। বলা বাহুল্য যে, রাত্রিতে উভয়ের কাহারই আহার হইল না।

একটা নিতান্ত জরুরী কাজ থাকায় ভোর হইতেই প্রভাতবাবু বাড়ী চলিয়া গেলেন, বলিয়া গেলেন যে, ঘণ্টা দু’য়ের মধ্যেই তিনি ফিরিবেন এবং পথে মদনবাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আসিবেন। দেখিতে দেখিতে আমার আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে অনেকেই আসিয়া জুটিলেন এবং চতুর্দিকে জোর অনুসন্ধান চলিতে লাগিল। ইতিমধ্যে আমার এক খ্যাতনামা জ্যোতিষীর কথা মনে হওয়ায় আমার সহকর্মী নারায়ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়কে সঙ্গে লইয়া তাঁহার নিকটে গেলাম। তিনি আমার কথা শুনিয়া একটু কাল নীরবে চোখ বুঝিয়া রহিলেন। পরে আমাকে বলিলেনঃ “আপনি বাড়ী ফিরিয়া যান আপনার ছেলে ফিরিয়া আসিয়াছে, আর না আসিয়া থাকিলেও শীঘ্রই ফিরিয়া আসিবে, কোন চিন্তা নাই।” আমি ভদ্রলোককে কিঞ্চিৎ দক্ষিণা দিয়া তৎক্ষনাৎ চলিয়া আসিলাম, বাড়ী ফিরিয়া বাস্তবিকই দেখিলাম যে, পল্টুকে পাওয়া গিয়াছে। শুনিলাম যে “ফরওয়ার্ডে” বিজ্ঞাপন দেখিয়া এক ভদ্রলোক আমার বাড়ী আসিয়াছিলেন। তিনি জানাইয়া গিয়াছিলেন যে, গতকল্য রাত্রি আন্দাজ ৭টার সময় তিনি অফিস হইতে ফিরিবার পথে দেখিতে পান যে, কয়েকজন ভদ্রলোক একটি ছোট ছেলেকে ঘিরিয়া তাহাকে নানাপ্রকার জিজ্ঞাসাবাদ করিতেছেন, ছেলেটি হতভম্ব হইয়া দাঁড়াইয়া আছে, কোন কথাই বলিতে পারিতেছে না। এমতাবস্থায় উহাকে নিকটবর্তী কোন থানায় জমা করিয়া দেওয়াই সমীচীন মনে হওয়ায় ভদ্রলোক ছেলেটিকে মুচিপাড়া থানায় দিয়া আসেন। ছেলেটির আঙ্গুলে একটি সোনার আংটি ছিল, তাহাও তিনি আলাদা জমা দিয়া আসিয়াছেন এবং রসিদ লইয়াছেন। বিজ্ঞাপন দেখিয়া তিনি স্থির বুঝিতে পারিয়াছেন যে, সেই ছেলেটিই আমাদের। শুনিলাম যে, ভদ্রলোকের নির্দেশ মত আমার শ্যালক ননীগোপাল ও শক্তি ঔষধালয়ের বিডন স্ট্রীট ব্রাঞ্চের ম্যানেজার ँঅনুপবাবু কিছুক্ষণ পূর্ব্বে মুচিপাড়া থানা হইতে পল্টুকে বাড়ী লইয়া আসিয়াছেন।

শেষ পর্যন্ত ঠাকুরের কথাই ঠিক হইল, একটু জানাজানি হইতেই ছেলে পাওয়া গেল। ঠাকুর যে বলিতেন যে, প্রারব্ধ দণ্ড ভোগ করিতেই হয়, তাহারও অকাট্য প্রমাণ পাইলাম। সেই রাত্রির জন্য আমার অদৃষ্টে সে অশান্তি, দুর্ভোগ এবং অর্থদণ্ড নিৰ্দ্দিষ্ট ছিল, তাহা পাইতেই হইল। মদনবাবু দু’ দু’বার সমস্ত থানায় ফোন করিলেন কিন্তু দু’বারই ভুলক্রমে মুচিপাড়া থানা বাদ পড়িয়া গেল। বসুমতী অফিসে বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করিয়া ফিরিবার সময় অনাথবাবু মুচিপাড়া থানায় একবার খোঁজ লইতে চাহিলেন কিন্তু আমি তাঁহাকে নিরস্ত করিলাম। তাঁহাকে বলিলাম যে, দু’বার ফোন করিয়াও কোন খবর পাওয়া যায় নাই, এখন রাত্রি ১২টার সময় সেখানে গিয়া কোন লাভ হইবে বলিয়া মনে হয় না। বুদ্ধিও অদৃষ্টেরই অনুসরণ করিল, কিছুতেই প্রারব্ধ দণ্ডের অন্যথা হইল না। কিন্তু শুধু এই কথা বলিবার জন্য আমি এই প্রসঙ্গের অবতারণা করি নাই। ছেলেকে কিছু খাওয়াইয়া শান্ত করিয়া তাহার মা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ “বড় বড় রাস্তা পার হইয়া, এতটা পথ একা চলিয়া গেলি, তোর ভয় হইল না?” উত্তরে ছেলে বলিলঃ “ভয় হইবে কেন? ঠাকুর যে আগাগোড়াই সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন এবং বড় রাস্তাগুলি হাতে ধরিয়া পার করাইয়া দিয়াছেন। রাস্তায় ভদ্রলোকেরা যখন আমাকে ঘিরিয়া নানারূপ প্রশ্ন আরম্ভ করিল, তখন হইতেই আর ঠাকুরকে দেখি নাই।” যতবার জিজ্ঞাসা করা গেল, এই এক কথাই বলিল। পাঁচ বৎসরের বালক, সে যে বানাইয়া এমন একটা কথা বলিয়াছে, ইহা কল্পনাও করা যায় না। সুতরাং ইহা নিশ্চিত যে, ঠাকুর বালকের সঙ্গে সঙ্গে থাকিয়া তাহাকে রক্ষা করিয়া আসিয়াছেন এবং ভদ্রলোকেরা আসিয়া জুটিতে যখন দেখিয়াছেন যে, তাঁহার আর প্রয়োজন নাই, তখনই অন্তর্হিত হইয়া গিয়াছেন। বলা বাহুল্য যে, উল্লিখিত সময়ে তিনি মতিবাবুর ডিক্সন লেনের বাসাতেই সশরীরে উপস্থিত ছিলেন।

ঠাকুরের এই প্রকার একই সময়ে একাধিক স্থানে উপস্থিতি সম্বন্ধে আরও অনেক কাহিনী আমি শুনিয়াছি। কিন্তু এখানে আমার স্বচক্ষে দেখা একটি ঘটনারই শুধু উল্লেখ করিব। আমার বিশিষ্ট বন্ধু প্রভাতবাবু তখন বৌবাজার অঞ্চলে থাকিতেন। একদিন বৈকালে তাঁহার বাড়ীতে যাইয়া দেখি যে, তিনি এবং আমাদের অপর একজন বন্ধু অত্যন্ত বিষণ্ণ বদনে বৈঠকখানা ঘরে বসিয়া রহিয়াছেন। আমি ঘরে প্রবেশ করিতেই বন্ধুবর বলিলেনঃ “এখনি বাড়ী ফিরিয়া যাও, আর এক মিনিটও এখানে অপেক্ষা করিও না।” আমি কিছুই বুঝিতে না পারিয়া অপর বন্ধুটির দিকে তাকাইলাম এবং তিনি আমাকে জানাইলেন যে, প্রভাতবাবুর এক কন্যা, এক পুত্র ও এক ভাগিনেয়ের বসন্ত হইয়াছে, মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ, সেই জন্য তিনি আমাকে চলিয়া যাইতে বলিতেছেন। আমি জাঁকিয়া বসিলাম এবং তামাক আনিতে বলিলাম। বন্ধুবর আরও দুই একবার আপত্তি করিয়াছিলেন কিন্তু যখন বুঝিলেন যে, আমি কিছুতেই যাইব না, তখন চিকিৎসার বিষয়ে আমার পরামর্শ চাহিলেন। বসন্ত রোগে বাইও-কেমিক চিকিৎসা বিশেষ ফলপ্রদ হয় ইহা আমি বহুক্ষেত্রে দেখিয়াছি এবং আমি নিজেও এই চিকিৎসা কিছু কিছু জানিতাম, সুতরাং বাইও-কেমিক চিকিৎসা করাইবার পরামর্শই আমি তাঁহাকে দিলাম। আমরা এই কথা লইয়া আলোচনা করিতেছি, এমন সময়ে হঠাৎ আমরা তিনজনেই দেখিলাম যে, শ্রীশ্রীঠাকুর ভিতরে প্রবেশ করিতেছেন। নগ্ন পা, গায়ে একখানা চাদর, অবনতমুখে ধীরে ধীরে আমাদের সম্মুখ দিয়া ভিতরে চলিয়া গেলেন।

এইখানে সেই বাসাটির একটা বিবরণ না দিলে কথাটা পরিস্ফুট হইবে না। রাস্তার উপর সদর দরজা, সেখান হইতে সোজা একটি চাতাল ভিতরের বারান্দার এক প্রান্তে গিয়া মিলিয়াছে। সদর দরজা দিয়া বাড়ীতে প্রবেশ করিতেই বাঁ হাতে বৈঠকখানা ঘর এবং চাতালটির ডান দিকে উঠান। আব্রু রক্ষার জন্য রাস্তার দিকে উঠানটি একটি টিনের বেড়া দিয়া ঘেরা। চাতালটির বাঁ দিকে বৈঠকখানার সংলগ্ন আর একখানি ঘর কিন্তু তাহা অন্য ভাড়াটিয়ার এবং তাহার প্রবেশপথও চাতালের উল্টা দিকে। ভিতরের বারান্দার কোলে দুইখানি ঘর, ইহার একখানিতেই বন্ধু-পত্নী রোগীদের লইয়া ছিলেন। আমরা দেখিলাম যে, ঠাকুর সদর দরজা দিয়া বাড়ীতে প্রবেশ করিয়া চাতাল ধরিয়া সোজা চলিয়া গেলেন। তৎক্ষনাৎ বৈঠকখানার বাহিরে আসিলাম কিন্তু ঠাকুরকে দেখিতে পাইলাম না, অনুমান করিলাম যে, তিনি ভিতরের বারান্দায় প্রবেশ করিয়াছেন, সেই জন্যই দেখিতে পাইতেছি না। বারান্দায় গিয়াও ঠাকুরকে দেখিতে পাইলাম না এবং বন্ধু-পত্নীর ঘরের দরজায় আসিয়া দেখিলাম যে, তিনি একখানা আসন হাতে লইয়া হতভম্ব হইয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন। আমাদের দেখিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন যে, ঠাকুর কোথায় গেলেন। প্রভাতবাবুর প্রশ্নের উত্তরে বলিলেন যে, ঠাকুর ঘরের দরজায় আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন দেখিয়া তিনি তাকের উপর হইতে আসন খানা আনিবার জন্য উঠিয়াছিলেন, ফিরিয়া দেখেন যে, ঠাকুর নাই। ইহাও বলিলেন যে, দরজার বরাবর উল্টাদিকের দেওয়ালে যে আয়না ঝোলান ছিল তাহাতেই প্রথম তিনি ঠাকুরের প্রতিচ্ছবি দেখিতে পান। আমরা তখন এদিক ওদিক খোঁজ করিয়া দেখিলাম কিন্তু ঠাকুরের কোন সন্ধান মিলিল না।

আমরা বৈঠকখানায় ফিরিয়া আসিলাম এবং ঠাকুরের এই আকস্মিক আবির্ভাবের কথা লইয়া আলোচনা করিতে লাগিলাম। বসন্ত রোগাক্রান্ত আমার বন্ধুর সেই ভাগিনেয়ও ঠাকুরকে দরজার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইতে দেখিয়াছিলেন, সুতরাং একই সময়ে যে পাঁচ জন লোকের দৃষ্টি বিভ্রম হইয়াছিল, ইহা কিছুতেই মনে করিতে পারিলাম না। আর আমাদের দেখার মধ্যে কোন অস্পষ্টতা ছিল না, সুতরাং এই দেখাটাকে অলীক বলিয়া উড়াইয়া দিতে পারিলাম না। ঠাকুর সে সময়ে হরিদ্বারে ছিলেন, পরের দিনই সেখানে পত্র লেখা হইল। উত্তরে জানিতে পারিলাম যে, উল্লিখিত দিনে ও সময়ে ঠাকুর হরিদ্বারেই ছিলেন এবং কেহ কেহ তাঁহার নিকটেই বসিয়া ছিলেন। কোন কোন মহাপুরুষ সম্বন্ধে এরূপ কথা প্রচলিত আছে যে, একই সময়ে দুই বা ততোধিক স্থানে তাঁহাদিগকে দেখিতে পাওয়া গিয়াছে। বন্ধুগৃহে ঠাকুরের এই আকস্মিক আর্বিভাবও যে ঐ জাতীয়ই, সে সম্বন্ধে আমার নিজের মনে কোন সন্দেহ নাই।

ইতিমধ্যে একটা আশ্চর্য্য ব্যাপার ঘটিল। বন্ধু পত্নী আমাদিগকে জানাইয়াছিলেন যে, এক সঙ্গে তিন জনের বসন্ত হওয়াতে তিনি অত্যন্ত ভীত হইয়া পড়িয়াছিলেন এবং ঐকান্তিক আকুতির সহিত ঠাকুরকে স্মরণ করিয়াছিলেন। দেখা গেল যে, বসন্তের গুটিগুলি ২/৩ দিনের মধ্যেই মিলাইয়া গেল। পাকিলও না, বেদনাদি অন্য কোন উপসর্গও আসিল না। চিকিৎসকেরাও ইহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না। পরে ঠাকুরকে আমি এই ঘটনার বিষয় জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। আমরা তাঁহাকে বাস্তবিকই দেখিয়াছিলাম কি না, এত সহজে এমন মারাত্মক পীড়া কি করিয়া সারিল, ইত্যাদি কোন কথাই বাদ দেই নাই। ঠাকুর সেই এক উত্তরই করিয়াছিলেনঃ “এ রকম ত হয়ই”। পাঠকবর্গ নিজেরাই ঠাকুরের কথার অর্থ করিয়া লইবেন। ঠাকুরের সম্বন্ধে এই প্রকারের আরও অনেক ঘটনার উল্লেখ করা যাইতে পারে কিন্তু আমার মনে হয় যে, যাহা বলা হইয়াছে তাহাই যথেষ্ট। ঠাকুরের প্রতি আমাদের বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাকে কিছুটা দৃঢ়তর করিতে পারে মনে করিয়াই ঘটনাগুলি এইস্থানে বিবৃত করিলাম কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস যে, ঠাকুরকে স্বরূপতঃ বুঝিতে হইলে ইহাদের বিশেষ কোনও প্রয়োজন নাই। পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, তিনি ছিলেন নিতান্ত সহজ এবং তাঁহাকে বুঝিতে শুধু একটু সহজ বুদ্ধির প্রয়োজন। কিন্তু এই আবিল্যময় সংসারে সহজ বুদ্ধি বস্তুটি নিতান্ত সহজলভ্য নহে। মুখে আমরা যাহাই বলি না কেন, আমাদের মনের ভিতরে নানা প্রকারের প্রশ্ন থাকিয়াই যায়। বুদ্ধির স্বভাবই এই যে, সকল দিক বিবেচনা করিয়া সে অত্যন্ত সতর্কতার সহিত অগ্রসর হইতে চায়, সকল দিক বজায় রাখিতেই যেন সে ব্যস্ত, লাভ লোকসানের মাপকাঠি কিছুতেই ছাড়িতে চাহে না। আমাদের মধ্যে অধিকাংশের বুদ্ধিই এই জাতীয় এবং সেই জন্যই আমরা ঠাকুরকে ধরিতে পারি নাই এবং তাঁহার কথাও বুঝিতে পারি না। ‘অনন্যশরণ’, ‘পতিব্রতা ধৰ্ম্ম’ প্রভৃতি কথাগুলি আমাদের পক্ষে শুধু কথার কথাই থাকিয়া যায়। আত্মবিশ্লেষণ করিলে বুঝিতে বিলম্ব হয় না যে, প্রকৃত প্রস্তাবে আমরা ঠাকুরকে চাহি না। কিন্তু যে ঐকান্তিকভাবে ঠাকুরকে চায় তিনি যে তাহাকে কৃপা করেন, ইহা নিঃসন্দেহে। ঠাকুরের শ্রীমুখে শুনা কয়েকটি দৃষ্টান্তের সাহায্যে কথাটা পরিস্ফুট করিতে চেষ্টা করিব।

ঠাকুর ঢাকা হইতে কলিকাতা আসিতেছেন, তাঁহারই শ্রীচরণাশ্রিত তিনজন ভদ্রলোক সঙ্গে আছেন। তাঁহারা মহানন্দে সারাদিন ঠাকুরের সঙ্গ করিয়া রাত্রি নয়টা নাগাদ গোয়ালন্দ আসিয়া পৌঁছিলেন। ঢাকা মেলের ভীড় চিরন্তন, সেই জন্যই ঐ ভদ্রলোকদের মধ্যে একজন তাড়াতাড়ি নামিয়া আসিয়া গাড়ীতে একটু জায়গা দখল করিলেন। তাঁহারা তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রী, সুতরাং এইরূপ সতর্কতা অবলম্বন না করিলে অনেক সময়েই জায়গা পাওয়া দুরূহ হইয়া উঠিত। যাহা হউক, একটু পরে অপর দুইজন ভদ্রলোকের সহিত ঠাকুরও আসিয়া পৌঁছিলেন। প্রথমোক্ত ভদ্রলোক ছোট্ট একটু বিছানা করিয়া রাখিয়াছিলেন, ঠাকুরকে সেখানে বসাইয়া এবং তাঁহার জিম্মায় জিনিসপত্র রাখিয়া উঁহারা তিন জন হোটেলে আহার করিতে চলিয়া গেলেন। উঁহারা ফিরিয়া আসিয়া দেখিলেন যে, বিছানা যেমন পাতা ছিল তেমনই আছে, জিনিসপত্রও সব ঠিকই আছে কিন্তু ঠাকুর সেখানে নাই। ভদ্রলোকেরা মনে করিলেন যে, ঠাকুর নিশ্চয়ই নিকটে কোথাও গিয়াছেন। একজন গাড়ীতে উঠিয়া বসিলেন, অপর দুইজন প্ল্যাটফর্মের দুইদিকে ঠাকুরের অনুসন্ধানে চলিলেন। কিন্তু ঠাকুরের কোন খোঁজই পাওয়া গেল না। অবশেষে যখন গাড়ী ছাড়িবার প্রথম ঘণ্টা পড়িয়া গেল তখন ঐ দুই ভদ্রলোক তাঁহাদের জিনিসপত্র গাড়ী হইতে নামাইয়া লইলেন। তাঁহারা ঠাকুরের অপেক্ষায় স্টেশনেই থাকিবেন স্থির করিলেন। বিশেষ জরুরী কাজ থাকায় যিনি গাড়ীতে ছিলেন তিনি কলিকাতায় চলিয়া আসিলেন।

রাত্রি ভোর হইয়া গেল কিন্তু ঠাকুর ফিরিলেন না। ঐ দুই ভদ্রলোক মহা মুশকিলে পড়িলেন। ঠাকুরকে এ ভাবে ফেলিয়াও যাইতে পারেন না, অথচ কলিকাতায় না গেলেও নয়, কি করিবেন কিছুই স্থির করিতে পারিতেছেন না, এরূপ অবস্থায় আরও ২/৩ ঘণ্টা কাটিয়া গেল। উহারা ঠাকুরের ফিরিবার আশা এক প্রকার ছাড়িয়াই দিয়াছেন এমন সময় হঠাৎ দেখিলেন যে, একটি ১০/১২ বৎসর বয়স্ক বালককে সঙ্গে লইয়া ঠাকুর খুব তাড়াতাড়ি হাঁটিয়া আসিতেছেন। উঁহাদের নিকট পৌঁছিয়া কোন প্রকারের ভূমিকা না করিয়া ঠাকুর বলিলেনঃ “রাহা খরচের অতিরিক্ত আপনাদের কাছে যাহা আছে শীঘ্র আমায় দিন।” টিকিট করাই ছিল, উঁহারা সামান্য ২/১ টাকা হাতে রাখিয়া বাকী সমস্তটাই ঠাকুরের হাতে তুলিয়া দিলেন। ঠাকুরও সঙ্গে সঙ্গে ঐ টাকা সঙ্গীয় সেই ছেলেটির হাতে দিলেন। ছেলেটি কিছু বলিল না, ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া আস্তে আস্তে চলিয়া গেল। ঘণ্টা ২/৩ পরে চট্টগ্রাম মেল করিয়া ভদ্রলোকেরা ঠাকুরকে লইয়া কলিকাতা চলিয়া আসিলেন।

ইহার দিন দুই পরে, ঢাকা হইতে আসিতে চট্টগ্রাম মেলে কেন আসিলেন, এই প্রশ্নের উত্তরে ঠাকুর এই ঘটনাটি বিশদ করিয়া বলিয়াছিলেন। গোয়ালন্দ স্টেশন হইতে মাইল দুই দূরে কোনও গ্রামে স্ত্রী এবং দুইটি নাবালক পুত্র লইয়া এক ভদ্রলোক বাস করিতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দরিদ্র, সামান্য একখানা কুঁড়ে ঘরে কোনও প্রকারে মাথা গুঁজিয়া থাকিতেন। নির্দিষ্ট কোন বিষয় কৰ্ম্ম ছিল না, যখন যাহা জুটিত তাহাই করিতেন, কায়ক্লেশে দিনাতিপাত হইত। কিন্তু তিনি ছিলেন ঠাকুরের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। যে সময়ের কথা বলিতেছি, তাহার প্রায় ১৫ বৎসর পূর্ব্বে তিনি ঠাকুরের কৃপালাভ করেন এবং তদবধি ঐকান্তিক নিষ্ঠার সহিত “নাম” লইয়া পড়িয়া ছিলেন। তিনি ঠাকুরকে অন্তরে পাইয়াছিলেন, সুতরাং তাঁহাকে বাহিরে খোঁজাখুঁজির কোন প্রয়োজন অনুভব করেন নাই এবং একবার বৈ দ্বিতীয়বার ঠাকুরের সহিত তাঁহার কখনও সাক্ষাৎও হয় নাই। ঐ ভদ্রলোক কিছুদিন যাবৎ অসুখে ভুগিতেছিলেন এবং উল্লিখিত দিবসে সন্ধ্যার পর হইতে তাঁহার অবস্থা অত্যন্ত সঙ্কটজনক হইয়া দাঁড়ায়। অন্তিম সময়ে তাঁহার শয্যাপার্শ্বে উপস্থিত থাকিবার জন্যই ঠাকুর গোয়ালন্দ স্টেশন হইতে তাঁহার গৃহে গিয়াছিলেন। ঠাকুরকে দেখিয়াই ভদ্রলোক যেন সুস্থ হইয়া উঠিলেন। তিনি উঠিয়াই বসিলেন এবং স্ত্রীকে ডাকিয়া তাঁহার বিছানার উপরেই ঠাকুরের জন্য একটা কিছু পাতিয়া দিতে বলিলেন। ঠাকুর আসন গ্রহণ করিতেই ভদ্রলোক ভক্তিভরে তাঁহাকে প্রণাম করিলেন, পরে স্ত্রী ও পুত্র দুইটিকে কাছে ডাকিয়া বলিলেনঃ “তোমরা শীঘ্র খাওয়া দাওয়া সারিয়া ফেল, আমার আর সময় নাই।” মৃত্যু যে অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, যখন সময় আসিবে তখনই যাইতে হইবে, অন্যথা হইবে না, ইত্যাদি কতকগুলি কথা বলিয়া স্ত্রী ও পুত্র দুইটিকে খাইতে পাঠাইয়া দিলেন। তাহারাও বিনা বাক্যব্যায়ে চলিয়া গেল। তাহারা ফিরিয়া আসিলে ভদ্রলোক ঠাকুরের পায়ে মাথা রাখিয়া লম্বা হইয়া শুইয়া পড়িলেন এবং কিছুক্ষণ পরেই তাঁহার মৃত্যু হইল। ঠাকুর নিজেই লোকজন ডাকাইয়া শবদাহের ব্যবস্থা করিলেন এবং বড় ছেলেটিকে সঙ্গে লইয়া আসিয়া তাহাদের আশু প্রয়োজনের জন্য কিছু অর্থ তাহার হাতে দিয়া দিলেন।

ঠাকুরের শ্রীমুখে এই ঘটনার বিবরণ শুনিয়া বিস্ময়ে হতবাক্ হইয়া গিয়াছিলাম। এক নিতান্ত অসহায়া, নিঃসম্বলা নারী দুইটি নাবালক পুত্র লইয়া বিধবা হইতে চলিয়াছে কিন্তু সে জন্য তাহার যেন কোন উদ্বেগই নাই, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত স্বামীর আদেশ পালন করিয়া যাওয়াই যেন তাহার একমাত্র লক্ষ্য। নাবালক পুত্র দুইটিও অকাতরে মায়ের এবং ঠাকুরের নির্দেশ মানিয়া চলিতেছে, তাহাদের যে কত বড় ভাগ্য-বিপর্যয় হইয়া গেল, তাহা যেন তাহারা কিছুই বুঝিল না, কান্নাকাটি, হা-হুতাশ, আকুলি-বিকুলি প্রভৃতি শোকের সাধারণ লক্ষণগুলি যেন লজ্জায় দূরে পলাইয়া গেল। ভগবৎ কৃপা যেখানে প্রত্যক্ষ, কেবলমাত্র সেখানেই ইহা সম্ভব, অন্যত্র এরূপ অবস্থা কল্পনাও করা যায় না। ঐ ভদ্রলোকের কথা ভাবিয়াও আশ্চর্য্য হইয়া গেলাম। জীবনে একবার মাত্র ঠাকুরের দর্শন পাইয়াছিলেন এবং তাঁহার শ্রীমুখের দুই চারিটি কথা শুনিয়াই চিরদিনের জন্য তাঁহার সকল প্রশ্ন মিটিয়া গিয়াছিল। তদবধি, ঠাকুরের বাক্য ধরিয়াই পড়িয়া ছিলেন, অপর কোন কিছুতেই তাঁহাকে আকর্ষণ করিতে পারে নাই। “গুরুর বাক্যই গুরু”, এ কথার তাৎপর্য্য সম্যক হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলেন বলিয়াই ঠাকুরের পিছু পিছু ঘুরিবার প্রয়োজনও অনুভব করেন নাই, এবং আমাদের মত উৎসব, আশ্রম, কীর্ত্তন প্রভৃতিতে মাতিয়া আসর সরগরমের চেষ্টাও কখন করেন নাই। এ কথা অবশ্য স্বীকার্য্য যে, আমাদের মত নিম্নাধিকারীর পক্ষে এই সকল অনুষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানেরও প্রয়োজনীয়তা আছে, নতুবা ঠাকুর ইহাদের প্রচলন করিতেন না। কিন্তু সর্ব্বদাই স্মরণ রাখিতে হইবে যে, একনিষ্ঠ পতিব্রতা ধর্মই আমাদের লক্ষ্য, প্রতিষ্ঠানাদি উপায় মাত্র।

এই শ্রেণীর আরও কয়েকজন একনিষ্ঠ ভক্তের প্রসঙ্গ ঠাকুরের শ্রীমুখে শুনিয়াছি কিন্তু তাঁহাদের সম্বন্ধে এখানে কোন বিস্তৃত বিবরণের প্রয়োজন আছে বলিয়া মনে করি না। মূল কথাটা একই, প্রত্যেকেই অনন্যভাবে ঠাকুরকে লইয়া ছিলেন এবং পরিণামে ঠাকুরের শ্রীচরণে চিরশান্তি লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু আজমীর অঞ্চলের এক ভক্ত দম্পতির কাহিনীটি বলিবার প্রলোভন কিছুতেই সম্বরণ করিতে পারিলাম না। এই ঘটনাটির ভিতরে কতকটা বৈচিত্র্য আছে এবং ইহাই বোধ হয় আমার হস্ত কণ্ডুয়নের কারণ। গল্পটি প্রথমে আমার এক বন্ধুর মুখে শুনিয়াছিলাম এবং পরে আমার প্রশ্নের উত্তরে ঠাকুরও ইহার পুনরাবৃত্তি করিয়াছিলেন। আজমীর শহরের নিকটবর্তী কোনও এক স্থানে এক মহা ধনবান শ্রেষ্ঠী সপরিবারে বাস করিতেন। স্বামী, স্ত্রী, একটি মাত্র পুত্র, পুত্রটিও উপযুক্ত ও বিবাহিত, একটি কন্যা ও একটি পুত্রের জনক, শ্রেষ্ঠীর মহা সুখের সংসার, চারিদিকে প্রাচুর্য্য, ঘরে বাহিরে অনাবিল শান্তি। কিন্তু হঠাৎ একটা বিপর্যয় ঘটিয়া গেল। শ্রেষ্ঠী এবং তাহার পত্নী যুগলে একখানি ফটো তুলিতে মনস্থ করিলেন এবং একজন অত্যন্ত নিপুণ ও অভিজ্ঞ ফটোগ্রাফার আসিয়া ছবি তুলিয়া লইয়া গেলেন। দিন তিনেক পরে তিনি যখন ছবি লইয়া আসিলেন তখন দেখা গেল যে, স্বামী-স্ত্রী’র পিছনে দণ্ডায়মান আর একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তির প্রতিকৃতি ফটোতে উঠিয়াছে। সকলেই আশ্চর্য্য হইয়া গেলেন এবং শীঘ্রই সেই অঞ্চলে এই ব্যাপার লইয়া একটা হৈ চৈ বাধিয়া গেল। ফটোগ্রাফার উক্ত নিগেটিভ হইতে আরও কয়েকখানা ছবি উদঘাটিত করিলেন কিন্তু সেই তৃতীয় ব্যক্তির প্রতিকৃতি অবিকৃতই রহিল, কোন অন্যথা হইল না। অনেকে অনেক কথা বলিলেন কিন্তু রহস্যের কোন সমাধান হইল না। ক্রমে অন্যান্য সকলের কৌতূহল কমিয়া গেল কিন্তু শ্রেষ্ঠী ও শ্রেষ্ঠীপত্নী কিছুতেই ব্যাপারটা ভুলিতে পারিলেন না। বরং শীঘ্রই দেখা গেল যে, তাঁহাদের মনে এক অভূতপূর্ব্ব পরিবর্তন দানা বাঁধিয়া উঠিতেছে। তাঁহারা ঐ তৃতীয় ব্যক্তির প্রতিকৃতির প্রতি একটা অভাবনীয় আকর্ষণ অনুভব করিতে লাগিলেন এবং ক্রমে এমন অবস্থা দাঁড়াইল যে, অধিকাংশ সময়ই তাঁহারা দুইজনে তন্ময় হইয়া ঐ ছবির সম্মুখে বসিয়া থাকিতেন। কোন কথাবার্তা বলিতেন না, নীরবে শুধু চাহিয়া চাহিয়া দেখিতেন, দেখিয়া যেন তাঁহাদের আর আশ মিটিত না। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবেরা প্রমাদ গণিলেন। একটা অনিশ্চিত আলেয়ার পিছনে ছুটিয়া ইহারা কি পাগল হইয়া যাইবে? তাঁহারা নানাভাবে বুঝাইয়া শ্রেষ্ঠী ও তাঁহার পত্নীকে কতকটা প্রকৃতিস্থ করিলেন এবং তাঁহাদের পরামর্শে শ্রেষ্ঠী আবার নতুন উদ্যমে বিষয় – কর্মে মনোনিবেশ করিতে চেষ্টা করিলেন। কিন্তু শীঘ্রই তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, তিনি একেবারে বদলাইয়া গিয়াছেন। তিনি ছিলেন একজন নিতান্ত কৰ্ম্মঠ ও নিপুণ ব্যবসায়ী কিন্তু এখন সাধারণ ব্যাপারেও তাঁহার নানা প্রকারের ত্রুটি বিচ্যুতি হইতে লাগিল এবং তিনি দেখিলেন যে, তাঁহার স্মরণশক্তি যেন একেবারেই বিনষ্ট হইয়া গিয়াছে। আসলে তিনি সেই ছবির আকর্ষণ কিছুতেই এড়াইতে পারিলেন না এবং কিছুদিন পরেই পুনরায় ঘরে আসিয়া বসিলেন এবং স্বামী-স্ত্রীতে পূর্ব্বের ন্যায় সেই ফটোর সম্মুখে বসিয়া দিবারাত্রি কাটাইতে লাগিলেন। এ যে কি মারাত্মক আকর্ষণ, তাহা আমাদের মত সাধারণ মানুষের পক্ষে বুঝিয়া উঠা অসম্ভব। বৈষ্ণব কবিগণ শ্রীরাধার পূর্ব্বরাগের যে চিত্র আঁকিয়াছেন শ্রেষ্ঠী ও তাঁহার স্ত্রীর অবস্থা যেন সেই দৃশ্যই স্মরণ করাইয়া দেয়। “বিরলে বসিয়া, পটেতে লিখিয়া, বিশাখা দেখাল আনি।” বিশাখা পটেতে আঁকিয়া শ্রীকৃষ্ণের সেই ভুবনমোহন রূপ শ্রীরাধাকে দেখাইলেন। অমনি এই পট এক বির্পয্যয়ের সৃষ্টি করিল। শ্রীরাধা বলিতেছেনঃ-

 

“হরি, হরি, এমন কেনে বা হ’ল

বিষম বাড়ব অনল মাঝারে

আমারে ডারিয়া দিল”।

তারপর,

“রাধার কি হৈল অন্তরে ব্যথা

বসিয়া বিরলে                থাকয়ে একলে

না শুনে কাহারো কথা”।

 

শ্রেষ্ঠী ও তাঁহার পত্নীরও ঠিক এই অবস্থাই হইয়াছিল। কথাটা মোটামুটি বুঝিতে পারা যায় কিন্তু যে জীবনে এই জাতীয় আকর্ষণ কখনও অনুভব করে নাই, তাহার পক্ষে ইহার রসাস্বাদন সম্ভবপর নহে।

সে যাহাই হউক, আরও কিছুদিন এইভাবে কাটিয়া যাইবার পর শ্রেষ্ঠীদম্পতি আর কিছুতেই ঘরে তিষ্ঠিতে পারিলেন না। ফটোগ্রাফে উদ্ধৃত সেই তৃতীয় ব্যক্তিকে খুঁজিয়া বাহির করিবার এক অদম্য ইচ্ছা তাঁহাদিগকে পাইয়া বসিল। পুত্রকে বিষয় আশয় বুঝাইয়া দিয়া এবং পুত্রবধুর উপর গৃহদেবতার সেবার ভার অর্পণ করিয়া তাঁহারা বাহির হইয়া পড়িলেন। পাচক, ভৃত্য, দ্বারবান, সরকার প্রভৃতি কয়েকজন আজ্ঞাবাহীও সঙ্গে চলিল। ইহার পর একাদিক্রমে প্রায় ১৫ বৎসর ধরিয়া তাঁহারা ভারতবর্ষের নানাস্থানে ঘুরিয়া বেড়াইলেন। বদরীনারায়ণ হইতে রামেশ্বর ও দ্বারকা হইতে কামাখ্যা, কোন তীর্থই বাকী রহিল না। যেখানে যাহার সহিত সাক্ষাৎ হয় তাহাকেই ঐ ফটোগ্রাফ দেখাইয়া সেই তৃতীয় ব্যক্তি সম্বন্ধে অনুসন্ধান করেন, কিন্তু প্রতিবারেই বিফল মনোরথ হইতে হয়, কেহই তাঁহার সন্ধান বলিতে পারে না। এইরূপ দীর্ঘকাল ঘুরিয়া ঘুরিয়া এবং প্রতিনিয়ত ব্যর্থকাম হইয়া তাঁহারা ক্লান্ত হইয়া পড়িলেন। অবশেষে কাশীতে আসিয়া একখানি বাড়ীভাড়া লইয়া তাঁহারা বাস করিতে লাগিলেন এবং মনস্থ করিলেন যে, বাকী জীবন সেইখানেই কাটাইয়া দিবেন। তাঁহারা বৃদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিলেন এবং তাঁহাদের শরীরেও ভাঙ্গন ধরিয়াছিল কিন্তু তথাপি গঙ্গায় ঊষাস্নান তাঁহাদের নিত্যকর্ম ছিল এবং কোন কারণেই এই স্নান হইতে তাঁহারা বিরত হইতেন না। এই একবার মাত্র তাঁহারা গৃহের বাহির হইতেন, আহার নিদ্রা প্রভৃতি অতি সংক্ষেপে সারিতেন এবং বাকী সময় ঐ ফটোর দিকে তন্ময় হইয়া চাহিয়া থাকিতেন এবং নীরবে অশ্রু বিসর্জন করিতেন। এইভাবে আরও কয়েক বৎসর কাটিয়া গেল। ক্রমে তাঁহারা অত্যন্ত দুর্ব্বল হইয়া পড়িলেন কিন্তু তথাপি ঊষাস্নান বন্ধ করিলেন না। হাঁটিয়া যাইতে পারিতেন না, পাল্কী করিয়া যাইতেন। একদিন তাঁহারা গঙ্গার ঘাটে যাইবার পথে হঠাৎ দেখিতে পাইলেন যে, তাঁহাদের মনোচোরা, বহু ঈপ্সিত আরাধ্য দেবতা, আমাদের ঠাকুর, রাস্তার এক পাশে অবনত মস্তকে দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন। তাঁহারা তৎক্ষণাৎ পাল্কী থামাইলেন এবং উভয়ে সাষ্টাঙ্গে ঠাকুরের চরণে নিপতিত হইলেন। এই অবস্থায়ই তাঁহাদের দেহত্যাগ হইল। তাঁহাদের মৃতদেহ মণিকর্ণিকা ঘাটে লইয়া যাওয়া হইল এবং ঠাকুর নিজেই তাঁহাদের শেষকৃত্য সম্পাদন করিলেন। যতদূর স্মরণ হয়, এই শ্রেষ্ঠীর নাম ছিল শিবরাম ও তাঁহার স্ত্রীর নাম ছিল দুর্গামণি। ইহাই পতিব্রতা ধৰ্ম্ম। ঠাকুর তাঁহার পত্রাবলীর বহুস্থানে পতিব্রতা ধর্ম্মের কথা বলিয়াছেন এবং ইহাকেই সংসারোদ্ধারের একমাত্র উপায় বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। মূল কথা হইল অনন্যনিষ্ঠা এবং যাহা কিছু এই অনন্যনিষ্ঠার প্রতিপোষক তাহাই ধৰ্ম্ম, যাহা কিছু ইহার পরিপন্থী তাহাই অধৰ্ম্ম। অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠানাদির ভালমন্দ বিচারেরও এই একই মাপকাঠি। একখানা চিঠিতে ঠাকুর লিখিয়াছিলেনঃ “বিশুদ্ধ ভক্তি লাভ হইলেই প্রেম লাভ হয়, সেই প্রেমেই কৃষ্ণচন্দ্র মিলন ঘটে। উৎসব কি সভার মধ্যে তিনি থাকেন না।” (বেদবাণী, প্রথম খণ্ড ১১১ নং)। উৎসবাদির মধ্যে যদি তিনি না থাকেন, তাহা হইলে উহারা শিবহীন যজ্ঞ, দক্ষযজ্ঞেরই নামান্তর। কিন্তু এ কথাও অনস্বীকার্য্য যে, ঠাকুর নিজে উৎসবাদির ব্যবস্থাও করিয়া গিয়াছেন। তাহা হইলে ইহার সামঞ্জস্য কোথায়? যখন ঐ চিঠিখানা আমার হাতে আসে, তাহার কয়েক দিন পরেই ঠাকুর আমার বাড়ীতে শুভাগমন করিয়াছিলেন। আমি তখন তাঁহাকে এই প্রশ্নই করিয়াছিলাম, আমি বলিয়াছিলাম যে, উৎসবাদির ব্যবস্থা ত সকল ধর্মেই আছে, শৈব, শাক্ত, গাণপত্য, বৈষ্ণব, খৃষ্টান, মুসলমান, সকলেরই নানাবিধ উৎসব আছে, এগুলি কি একেবারেই নিরর্থক? তাহাই যদি হয় তবে ইহাদের প্রবর্তন হইয়াছে কেন? উত্তরে ঠাকুর বলিয়াছিলেনঃ “ইহারা স্মারক, ইহাই ইহাদের মূল্য, আর কোন মূল্য নাই, ইহারা ইষ্টস্মৃতি জাগাইয়া তোলে এবং তাহাতেই ইহাদের সার্থকতা।” একটু কাল নীরব থাকিয়া পরে আবার বলিলেন, “কিন্তু আপনারা খিচুড়ী শুধু মুগের ডালের হইবে, না অন্য ডালও থাকিবে, এই জাতীয় তর্ক লইয়া এমন মাতিয়া উঠেন এবং এমন হৈ চৈ বাঁধাইয়া তোলেন যে উৎসবের আসল উদ্দেশ্যই অনেক সময়ে ব্যর্থ হইয়া যায়।” সুতরাং সকল সময়েই লক্ষ্য রাখিতে হইবে ইষ্ঠ নিষ্ঠার দিকে এবং যাহা কিছু তাহার পরিপন্থী বা বাধক, তাহাকেই অকাতরে বর্জন করিতে হইবে। লক্ষ্য স্থির রাখিয়া অত্যন্ত সতকর্তার সহিত না চলিলে নানা প্রকার আগাছা পরগাছার আবর্জনায় আত্মসম্বিৎ হারাইয়া ফেলিতে হয়। ঠাকুর বলিতেন, “এক সাধে সব পায়, বহু সাধে সব যায়।” এই কথাটি সর্ব্বদা স্মৃতিপথে জাগাইয়া রাখিলে অনেক প্রলোভন ও শাসনের উৎপাত হইতে আত্মরক্ষা করা যায়।

বুঝাইতে পারিব কি না জানি না কিন্তু আমার স্থির বিশ্বাস যে, ঠাকুর তাঁহার পত্রগুলির ভিতর দিয়া একটা কথাই বলিতে চাহিয়াছেন। অকর্ত্তাবুদ্ধিই স্বভাব, অনন্যচিন্তাই নাম, অনন্যশরণই পন্থা, ধৈর্য্যই ধৰ্ম্ম, ইত্যাদি বাক্যগুলি আপাতদৃষ্টিতে বিভিন্ন মনে হইলেও একটু চিন্তা করিলেই বুঝিতে পারা যায় যে, ইহারা বস্তুতঃ একই। ইহার একটি না আসিলে অপরগুলি আসিতে পারে না এবং একটি যেখানে উদয় আছে সেখানে সবগুলিই আছে। প্রকৃত প্রস্তাবে ইহাদের মধ্যে কোন প্রভেদই নাই। অনন্যশরণ ও অনন্যচিন্তা একই কথা এবং চিন্তা যেখানে অনন্য, সেখানে কর্তৃত্বের কোন অবকাশই নাই। ধৈর্য্যও সেখানে কোন পৃথক চেষ্টার অপেক্ষা করে না, স্বভাবতঃই আছে। পক্ষান্তরে, কর্তৃত্ববুদ্ধি যেখানে নিঃশেষ হইয়া যায় নাই, সেখানে ভালমন্দ লাভলোকসান, ইত্যাদি দ্বন্দ্ব নিশ্চিতই আছে, সুতরাং অনন্যশরণও নাই, ধৈর্য্যও নাই। ঠাকুর বলিয়াছেনঃ “ভগবান সৰ্ব্বজ্ঞ সমভাব নিরপেক্ষ শক্তি।” (বেদবাণী, প্রথম খণ্ড, ১৬২ নং) অকর্তা না হইলে যে সমভাব বা নিরপেক্ষ শক্তির আশ্রয় পাওয়া যায় না, ইহা স্বতঃসিদ্ধ।

আর একটি কথা বলিয়াই আমি আমার বক্তব্য শেষ করিব। জীবের বন্ধনের কারণ ও উদ্ধারের উপায় প্রসঙ্গে ঠাকুর অনেক সময়েই সীতার দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিতেন। সীতা, রাম ও লক্ষণের সহিত, পঞ্চবটীতে কুটীর বাঁধিয়া মহাসুখে বাস করিতেছিলেন। তিনি যে রাজনন্দিনী, রাজকুলবধূ, তাহা তিনি ভুলিয়াই গিয়াছিলেন। রাজপ্রাসাদের সেই বিলাসপঙ্কিল, খরস্রোত জীবন তাঁহার নিকট স্বপ্ন বলিয়াই মনে হইত। পরিধানে সামান্য বল্কল, ফলমূল আহার, কিন্তু সকলই অমৃততুল্য, স্বামীর অকুন্ঠ প্রেম ও দেবরের নিষ্কলুষ স্নেহ তাঁহাকে এক বিচিত্র মধুর নিগড়ে মুগ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল। এক কথায় কোন অভাবই তাঁহার ছিল না। কিন্তু হঠাৎ একদিন তিনি প্রলোভনে পড়িয়া গেলেন, মায়ামৃগ দেখিয়া তিনি আত্মহারা হইলেন। স্বর্ণমৃগ যে কখন বাস্তব হইতে পারে না, তাহা যে নিশ্চিতই অলীক, মায়ামরীচিকা ভিন্ন অন্য কিছুই নহে, এই প্রকারের কোন যুক্তিই তাঁহার মনে কোন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করিল না, নিদারুন প্রলোভনে তিনি তখন কাণ্ডজ্ঞানহীন। ফল দাঁড়াইল এই যে, রাবণ তাঁহাকে হরণ করিয়া লইয়া গেল, পথে জটায়ুর সাহায্যে কিছুই হইল না, সীতা অশোকবনে বন্দিনী হইয়া রহিলেন। জীবও এই প্রকার মায়ামরীচিকার পিছনে ঘুরিয়া বন্দী হয়, প্রলোভনই বন্ধনের কারণ।

আবার রামই আসিয়া তাঁহাকে উদ্ধার করিলেন। সুগ্রীবের সহিত মিত্রতা করিয়া, সমুদ্রে সেতুবন্ধন করিয়া, ঘোরতর যুদ্ধের পর রাবণকে সবংশে নিধন করিয়া সীতাকে উদ্ধার করিয়া লইয়া গেলেন। কিন্তু সীতা করিলেন কি? তিনি চেড়ীগণের প্রলোভন ও শাসন অকাতরে সহ্য করিয়া অনুক্ষণ রাম চিন্তায় মগ্ন হইয়া রহিলেন। সুতরাং দেখা গেল যে, বন্ধনের কারণ যেমন প্রলোভন, উদ্ধারের উপায় অনন্যচিন্তা ও অকাতরে প্রারব্ধ বেগ সহ্য করা। এই মূল কথাটি বিশদ করিয়া ঠাকুর একখানি পত্রে লিখিয়াছিলেনঃ “ঐহিক সুখের জন্য ক্ষণভঙ্গুর পিপাসার তৃপ্তির জন্য অধৈর্য্যের বেগে মুগ্ধ হইয়া পবিত্র যে সতী সীতাদেবী পূর্ণ লক্ষ্মী রাবণের কবলগ্রস্থ হইয়াছিল। তাহার দৌরাত্ম্য প্রলোভন শাসন হইতে নিষ্কৃতি পাওয়ার একমাত্র ধৈয্যই সহায় হইয়াছিল। তা ছাড়া অন্য কোন শক্তিতে তাহাকে রাক্ষসী কবল হইতে মুক্ত করিতে পারে নাই। তাহার প্রমাণ জটায়ু পাখী, সীতার পক্ষযুত হইয়াও পাখা ছেদে জবাই হইয়াছিল। অতএব সর্ব্বদা মনের বেগ, বুদ্ধির বেগ এবং শরীরস্থ কামনা বাসনা গুণের চঞ্চলভুক্ত বেগ সমস্ত সহ্য করিতে চেষ্টা করিবে। এই সমস্ত বেগ সহ্য করিতে করিতে রাম আসিয়া যেমন সীতাকে সমুদ্র বন্ধন করিয়া সীতার প্রকাশ বাধকমুক্ত করিয়া সদানন্দপদ সীতাদেবীকে উদ্ধার করিয়াছিল, সেইরূপ নিজ পতিও গুণ প্রবুদ্ধ ভবসাগর বন্ধন করিয়া উদ্ধার করিবেন সন্দেহ নাই।” (বেদবাণী, প্রথম খণ্ডে ৩১১ নং)। ঠাকুরের পত্রগুলি পুনঃ পুনঃ পড়িয়া এই বিশ্বাস আমার বদ্ধমূল হইয়াছে যে, তিনি নানাভাবে, নানা ভঙ্গীতে, বিভিন্ন দৃষ্টান্তের সাহায্যে এবং স্বকীয় আচরণের দ্বারা মূলতঃ এই একটি কথাই বলিয়া গিয়াছেন। উদ্ধার তিনিই করিবেন, সে বিষয়ে আমাদের চিন্তাভাবনার কিছুই নাই, আমাদের কার্য্য শুধু প্রারব্ধ বেগ সহ্য করিয়া যাওয়া। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ “সকল ভারই গুরু বহন করিতেছেন, করিবেন। তজ্জন্য চিন্তা করিবেন না। যাহা পারেন করিবেন, না পরেন না করিবেন”। (বেদবাণী, প্রথম খণ্ড, ৯১নং)। অন্যত্র বলিতেছেনঃ “ইহার সাধন ভজন আর কিছুই নাই, কেবলমাত্র প্রারব্ধ ভোগ সহ্য করিয়া যাইতে হয়”। (বেদবাণী, প্রথম খণ্ড, ১৪৩ নং)।

কেবল ইহাই নহে, ঠাকুর আমাদিগকে সাবধান করিয়া দিয়াছেন যে, “অনুভূতি যাহা লোকে সাধনাদি সূত্রে লাভ করে তাহা কেবল গুণের বন্টন অবস্থা, তরঙ্গ মাত্র।” (বেদবাণী, প্রথম খণ্ড, ১৩০ নং); “পতিব্রত ধৰ্ম্ম ব্যতীত অন্য কোন ধৰ্ম্ম সহায়ে কৃতকার্য্য সম্পাদন হইতে পারে না। মনের সুখ বোধ যাহা হয় তাহা কেবল প্রকৃতির বিকারমাত্র, ক্ষণস্থায়ী।” (বেদবাণী, প্রথম খণ্ড, ৪৮ নং)। “সংসারের সাধন, ভজন সিদ্ধাসিদ্ধ মন্ত্রাদির দ্বারায় কর্তৃত্বপদ ভুল হয় না, বরং ভূয়ঃ ভূয়ঃ বন্ধনই ঘটে।” (বেদবাণী, প্রথম খণ্ড, ১৬১ নং)। “যদি কেহ সাধ্য সাধন করিয়া আনন্দ উপভোগ করে সে দেহ বিবরেই আবদ্ধ থাকিবে, কিছুতেই মায়া বন্ধন ছিন্ন করিতে পারিবে না। সকলি অভাব ভোজেরবাজী বলিয়া লইতে হয়।” (বেদবাণী, প্রথম খণ্ড, ২৫৭ নং), “বাজীকরের কৃষণ হইতে যে সকল বৃক্ষ সদ্য উৎপন্ন হইয়া ফল প্রসব হয় দেখা যায় তাহাই ইন্দ্রজাল এবং ভ্রান্ত, ক্ষণ সুখকর, আমোদজনক বলিয়া জানিবে। ইহাতে কৃষ্ণ ভক্তির নিকটও জানতে দেয় না। আবরণের বৃদ্ধিই ঘটে, কালেই সমাপ্ত করিয়া থাকে।” (বেদবাণী, প্রথম খণ্ড, ৩২৬ নং)। “এই গঞ্জনা সহ্য করিতে পারিবে না ভয়ে যদি জপ তপস্যা যোগ যাগ প্রবন্ধন করে তাহাতে ঋণ মুক্ত হয় না, বরং কৰ্ম্ম বৃদ্ধি হইয়া বন্ধনই হয়।” (বেদবাণী, প্রথম খণ্ডে, ১০২ নং)। এইভাবে পুনঃ পুনঃ আমাদিগকে সতর্ক করিবার অর্থ হইল এই যে, আমরা যেন ঐশ্বর্যাদির মোহে আকৃষ্ট হইয়া বিপথস্থ হইয়া না পড়ি। পথে চলিতে চলিতে অনেক দৃশ্যই দৃষ্টিগোচর হয় কিন্তু ইহাদের দিকে লক্ষ্য করিতে নাই। পথে মাতিয়া থাকিলে আর গন্তব্যস্থানে পৌঁছান যায় না। টালীগঞ্জ হইতে শ্যামবাজার যাইব বলিয়া সোজা রওয়ানা হইলাম, কিছুদূর যাইতেই নজরে পড়িতে লাগিল সিনেমা গৃহ, একটির পর একটি। ইহাদের আকর্ষণের মোহে টিকিট কিনিয়া একস্থানে ঢুকিয়া পড়িলাম, শ্যামবাজার আর যাওয়া হইল না, অথবা পথের কিঞ্চিৎ দূরে অবস্থিত ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখিয়া এমন মাতিয়া উঠিলাম যে, সেখানেই যাইয়া উপস্থিত হইলাম এবং ক্রমে পথ ও গন্তব্যস্থানের কথা ভুলিয়াই গেলাম। এইভাবে অনেক সময়ে আমরা পথে আটকাইয়া পড়ি অথবা বিপথে চলিয়া যাই। সামান্য প্রলোভনেই ভ্রান্তি আসিয়া উপস্থিত হয়। যাঁহারা ঠাকুরের নির্দেশ মত নিয়মিত ভাবে শূন্য চিন্তা বা প্রাণের সঙ্গ করিয়া থাকেন তাঁহাদের যে কখন কখন বিশেষ বিশেষ অনুভূতি হয়, ইহা নিশ্চিত। কীর্ত্তনাদিতেও অনেক সময় অশ্রু, পুলক, ভাববিহ্বলতা, ইত্যাদি দেখা যায়। ঠাকুর সাবধান করিয়া দিতেছেন যে, এগুলির বিশেষ কোন মূল্য নাই, ইহাদের লইয়া মাতিও না। তোমার প্রয়োজন ধৈর্য্য এবং যাহা এই ধৈর্য্যশক্তির পরিপোষক, একমাত্র তাহাই তোমার কাম্য।

★★★★★