শ্রীশ্রী কৈবল্যনাথের মোহন্ত পরম্পরা

শ্রীশ্রী কৈবল্যনাথের প্রথম মোহন্তঃ
শ্রীমৎ হঁরিপদ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩০ – ১৯৩৫)

চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে শ্রীশ্রী কৈবল্যধাম প্রতিষ্ঠার পূর্বেই শ্রীশ্রীঠাকুর স্বয়ং নিজেই শ্রীমৎ হঁরিপদ বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রথম মোহন্ত মহারাজ মনোনীত করেন। তিনি ১৮৭২ সালে ভারতের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার হালিশহর নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন।
পেশাগত জীবনে তিনি যখন ভারতের আসামে অবস্থিত লিডু নামক স্থানে অবস্থান করছিলেন, সেখানে তিনি পরম দয়াল শ্রীশ্রীরামঠাকুরের সান্নিধ্যে আসেন এবং পরবর্তীতে শ্রীশ্রীঠাকুরের নিকট হতে নাম প্রাপ্ত হয়েছিলেন। 
সঙ্গীতে ঊনার প্রচন্ড আকর্ষণ ছিল এবং তিনি নিজেও একজন ভালো গায়ক ছিলেন। তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর বিয়োগের পর, তিনি তাঁর চাকুরী থেকে ইস্তফা দিয়ে সম্পুর্ন্ন ভাবে নিজেকে বদলে ফেলেন এবং আসামের “থীয়সফিকাল সোসাইটি” নামক সামাজিক একটি সংগঠনের সাথে নিজেকে যুক্ত করেন।
শ্রীশ্রী কৈবল্যধাম আশ্রম প্রতিষ্ঠার দিনে ১৩৩৭ বঙ্গাব্দ শ্রাবণ মাসে,  ১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দের ২৬শে জুলাই তিনি মোহন্ত মহারাজ হিসেবে অভিষিক্ত হন। “কৈবল্য স্তোত্রম” সহ অনেক শ্রুতিমধুর গানের রূপকার তিনি স্বয়ং নিজেই। শ্রীশ্রীঠাকুর ঊনাকে নাম প্রদান করার অনুমতি দিলেন, কিন্তু অত্যন্ত বিনীতভাবে তিনি তা গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করলেন।
চৈত্র মাসের এক সুপ্রসন্ন দিনে (১৩৪১ বঙ্গাব্দ – ১৯৩৫ খ্রীষ্টাব্দ) দোল পূর্নিমার সময় দোল উৎসবে যোগ দিতে তিনি ফেনী গমন করেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের উপস্থিতিতে তিনি তাঁর নশ্বর দেহ ত্যাগ করেন। ফেনীর দাদপুর নামক স্থানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। সেইদিন থেকেই শ্রীশ্রীঠাকুর শ্রীমৎ শ্যাঁমাচরণ চট্টোপাধ্যায়কে শ্রীশ্রী কৈবল্যধামের পরবর্তী মোহন্ত মহারাজ ঘোষণা করেন। শ্রীশ্রী হরগৌরী মন্দিরটি শ্রীমৎ হঁরিপদ বন্দ্যোপাধ্যায় এর স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মান করা হয়।


শ্রীশ্রী কৈবল্যনাথের দ্বিতীয় মোহন্তঃ
শ্রীমৎ শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায় (১৯৩৫ – ১৯৬০)

প্রথম মোহন্ত মহারাজ শ্রীমৎ হঁরিপদ বন্দ্যোপাধ্যায় এর শ্রীদেহ ত্যাগের পর শ্রীশ্রীঠাকুরের নির্দেশে ১৩৪১ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে কৈবল্যধামে শ্রীশ্রী কৈবল্যনাথের দ্বিতীয় মোহন্ত মহারাজ হিসেবে দ্বায়িত্বভার গ্রহণ করেন শ্রীমৎ শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায়।
শ্রীঅবনীচরণ চট্টোপাধ্যায় ও শ্রীমতী ষোড়শীবালা দেবীর সন্তান শ্রীমৎ শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায় ১২৭৯ বঙ্গাব্দের কার্ত্তিক মাসে বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত কোয়ারপুর নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শ্রীশ্রীঠাকুর হতে নাম প্রাপ্ত হন এবং পরবর্তীতে শ্রীশ্রীঠাকুর স্বয়ং তাঁকে ভক্তদের নাম প্রদানের অধিকার দেন। ১৩৪৬ বঙ্গাব্দের ১৩ই ফাল্গুন (২৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৪২) যাদবপুরের শ্রীশ্রী কৈবল্যধামের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে শ্রীমৎ শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায় শ্রীশ্রীঠাকুরের পূণ্য পাদুকাযুগল অর্চনা করেছিলেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের পবিত্র এই পাদুকা দুটি আজও নিয়মিত পূজিত হয় যাদবপুর শ্রীশ্রী কৈবল্যধামে।
শ্রীমৎ শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায় শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্মভূমি বাংলাদেশের ডিঙ্গামানিকে ‘শ্রীশ্রী সত্যনারায়ণ সেবামন্দির’ এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
১৩৫৬ বঙ্গাব্দের ১৮ই বৈশাখ (১লা মে ১৯৪৯) শ্রীশ্রীঠাকুর দেহরক্ষা করলে চৌমুহনীতে তাঁর দেহাবশেষ সমাহিত হয় শ্রীমৎ শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে এবং তাঁর পরিচালনায় সেখানে নির্মিত হয় ‘সমাধিমন্দির’ নামে সুন্দর একটি দেবদেউল।
ডিঙ্গামানিক ও চৌমুহনীর দুটি ধাম ও মন্দিরে প্রচুর উন্নয়নমূলক কাজের উদ্যোগ নিয়েছিলেন শ্রীমৎ শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায়। ভারতবর্ষ ও অধুনা বাংলাদেশের বহু স্থানে ভ্রমণ করে তিনি বহু ভক্তকে দীক্ষাদান করেছিলেন, নানা ধরণের পবিত্র উৎসবের আয়োজন করেছিলেন। জীবনের শেষ কয়েক বছরে দুর্বল স্বাস্থ্য সত্ত্বেও তিনি তাঁর নিত্যকার কর্মধারারও কোনও পরিবর্তন করেননি।

‘গুরুচক্র’ ও ‘ভগ্নী-সন্মেলন’ এর নামকরণ তিনি নিজে করেন। পশু, পাখি ও গাছপালার প্রতি তাঁর গভীর ভক্তি ও ভালবাসা ছিল। ‘গোমাতা’ উৎসব (গরুকে মাতৃজ্ঞানে পূজা করা) তিনি প্রর্বতন করেছিলেন। মোহন্ত থাকাকালীন, পাহাড়তলী শ্রীশ্রী কৈবল্যধামে কামধেনুমাতা ও ময়নাপাখির আবাসস্থল হয় এবং পরে তাদের মৃত্যুর পর সমাধিতে স্বতন্ত্র স্মৃতি ফলক স্থাপন করা হয়। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের ২রা মার্চ সরস্বতী পূজা শেষ করার পর তিনি কৈবল্যলোকে যাত্রা করেন। শ্রীশ্রী কৈবল্যধামে তাঁর মরদেহ সমাহিত করা হয় এবং সেখানে নির্মাণ করা হয় একটি স্মৃতিস্তম্ভ।


শ্রীশ্রী কৈবল্যনাথের তৃতীয় মোহন্তঃ
শ্রীমৎ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৬০ – ১৯৭১)

দ্বিতীয় মোহন্ত মহারাজের কৈবল্যপ্রাপ্তির পর ১৩৬৬ (বাংলা) ফাল্গুন মাসে পাহাড়তলী কৈবল্যধামের ট্রাষ্টি দ্বিতীয় মোহন্ত মহারাজের পরম যত্নে রেখে যাওয়া একটি বদ্ধ খাম সর্ব সমক্ষে খুলে তৃতীয় মোহন্তরূপে শ্রীমৎ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম লিখিতভাবে দেখে তখনই শ্রীমৎ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরবর্তী মোহন্ত মহারাজ বলে ঘোষণা করলেন।

শ্রীমৎ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯২৬ বাংলা সনে ঢাকা জেলার বিক্রমপুরের আউটসাহী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। শৈশব কাটে চাঁদপুরের হাজিগঞ্জ থানার আলীগঞ্জ নামক গ্রামে। পিতা শ্রীগুরুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিন পুত্রের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। ময়মনসিংহ শহরে তাঁর পিসতুত দাদার বাড়ি থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা মিটফোর্ড মেডিক্যাল স্কুলে ভর্তি হন। ডাক্তারী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের ডাক্তারের পদে নানা স্থানে চাকুরী করেন। পরবর্তীতে স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে তিনি সরকারি চাকুরী ছেড়ে আলীগঞ্জের বাড়ীতে বাস করতে লাগলেন। সেখানে তিনি ডাক্তারখানা খুলে চিকিৎসা শুরু করেন।

দ্বিতীয় মোহন্ত মহারাজ শ্রীমৎ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আধ্যাত্মিক ভাব ও শক্তির পরিচয় পেয়ে পরবর্তী মোহন্তরূপে তাঁকে মনোনীত করেন। মোহন্ত মহারাজরূপে অভিষিক্ত হবার পর শ্রীমৎ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় গুরুভাই – বোনদের উদ্দেশ্যে যে স্মরণীয় ভাষণ দিয়েছিলেন তা শুনে সকলেই অভিভূত হয়েছিলেন।
তিনি ‘নাম’ পেয়েছিলেন দ্বিতীয় মোহন্ত মহারাজ শ্রীমৎ শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে। ঠাকুর তখন শ্রীদেহে। তথাপি দ্বিতীয় মোহন্ত মহারাজের মাধ্যমে শ্রীমৎ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়-কেও ‘নাম’ দিয়ে ঠাকুর এই দৃষ্টান্তই স্থাপন করলেন যে, কৈবল্যধামের মোহন্ত মহারাজের মধ্যেই কৈবল্যনাথ স্বয়ং অবস্থান করেন। ‘নাম’ পাবার পর আলীগঞ্জের বাড়িতে ফিরে তিনি সেখানে নাম-কীর্তন-উৎসব ইত্যাদি নিয়েই সদানন্দে থাকতেন। একবার স্বয়ং ঠাকুরও ওই উৎসবে এসেছিলেন। ১৩৬১ বাংলা সনে বাড়িতে দোল পূর্ণিমা উৎসবের তৃতীয় দিনে ঊনার পত্নী বিয়োগ হয়। এরপরই সাংসারিক বন্ধন থেকে সার্বিক মুক্তি পেলেন।

তৃতীয় মহারাজ সকলের প্রিয় শ্রীমৎ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্তর্ধান বা স্বেচ্ছা মৃত্যুবরণ এ যুগে এক অবস্মরণীয় ঐতিহাসিক ঘটনা হিসাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে আধ্যাত্মিক সাধন মার্গে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের রক্তক্ষয়ী দিনগুলিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সৈন্যদের অমানবিক বর্র্বরোচিত আক্রমণে সাধনক্ষেত্র পাহাড়তলী কৈবল্যধামের অবর্ণনীয় ক্ষতি হয়। যে কথাটি বিশেষ ভাবে বলার তা হলো, শ্রীমৎ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের খান সেনাদের কৈবল্যধামে আগমনের বার্তা পেয়েও আশ্রম ছেড়ে যেতে রাজী হননি। কারণ ঠাকুরকে (যাঁর প্রাণ ধামেই রয়েছে) ছেড়ে তিনি অন্যত্র যাবেন না। এই ছিল তার পণ! মৃত্যু অনিবার্য জেনেও তিনি তাই ধামে রয়ে গেলেন। সঙ্গে থাকলেন ২/৪ জন শ্রীমৎ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুব কাছের কয়েকজন। যাঁরা বার বার অনুরোধ করেও ব্রজেনদাকে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে পাঠাতে পারলেন না। অবশেষে দুর্বৃত্তের নিষ্টুর আঘাতে তৃতীয় মহারাজ কতিপয় আশ্রমবাসীগণ সবাই নির্মম ভাবে নিহত হলেন। গুরুভক্তির এমন দৃষ্টান্তমূলক আত্মবলিদান এ যুগে আর কোথাও হয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই। আত্মাহুতি দিয়ে ঠাকুরের জন্য যে কোন ত্যাগ ও গভীর নিষ্ঠার যে জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত তৃতীয় মহারাজ স্থাপন করে গেলেন তার তুলনা শুধু – ‘তিনিই’। এমন আত্মত্যাগী মহাত্মা খুবই কম আসেন এ জগতে।


শ্রীশ্রী কৈবল্যনাথের চতুর্থ মোহন্তঃ
শ্রীমৎ ভবতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৭২ – ২০০০)

১৯৭১ সালে ২৯ শে মার্চ, শ্রীশ্রী কৈবল্যধামের তৃতীয় মোহন্ত মহারাজের পাশবিক এবং বর্বর হত্যাকান্ডের পর, শ্রীমৎ ভবতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৭২ সালে চতুর্থ মোহন্ত মহারাজের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

শ্রীআশুতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রীমতী লাবণ্যপ্রভার সন্তান শ্রীমৎ ভবতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা ১৩২৫ সনে (ইংরেজী ১৬ই নভেম্বর ১৯১৮ সাল) ঢাকা জেলার বিক্রমপুর নামক স্থানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার মাস্টার’স শেষ করার পর তিনি একজন গেজেটেড অফিসার হিসেবে সরকারী চাকরিতে যোগদান করেন এবং নিষ্ঠার সঙ্গে তার কর্তব্য শেষ করার পর চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে তিনি নামগ্রহণ করেছিলেন।

শ্রীশ্রী কৈবল্যধাম আশ্রমের মোহান্ত মহারাজ হিসাবে দায়িত্ব গ্রহনের সাথে সাথে তিনি আশ্রমের সংস্কারের বিভিন্ন উদ্দ্যোগ গ্রহণ করেন, কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্বর-হায়েনা পাকিস্তানিরা শুধু আশ্রমের মোহান্ত মহারাজ কে হত্যা করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, তারা আশ্রমটিকেও সম্পূর্ন ধ্বংস করে যায়। শ্রীশ্রী কৈবল্যধাম আশ্রম যাদবপুর, কলকাতার দাতব্য চিকিত্সালয় এর উন্নতিকরণ ঊনার মাধ্যমে সূচিত হয়। তাঁর পূর্বসুরীদের মত, তিনি নিবেদিতপ্রাণ ভক্তমণ্ডলী দের দীক্ষা জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। ঊনার সময়কালে শ্রীশ্রী কৈবল্যধাম আশ্রম একটি গৌরবময় স্থান হিসাবে পরিচিত হয়। জীবনের শেষ কয়েক বছর তিনি যাদবপুর কৈবল্যধামে কাটিয়েছেন। ২০০০ সালের মে মাসের ১৩ তারিখে তিনি কৈবল্যলোকে গমন করেন। যাদবপুর শ্রীশ্রী কৈবল্যধামে ঊনাকে সমাহিত করা হয় এবং সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মান করা হয়। তাঁর চিতাভস্ম এনে পাহাড়তলী কৈবল্যধাম আশ্রমে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মান করা হয়।


শ্রীশ্রী কৈবল্যনাথের পঞ্চম মোহন্তঃ
শ্রীমৎ বিমলেন্দু বিকাশ রায়চৌধুরী (২০০১ – ২০০৫)

শ্রীশ্রী কৈবল্যনাথের মোহন্ত পরম্পরায় কৈবল্যধামের সাংবিধানিক রীতিনীতি অনুসারে শ্রীশ্রীকৈবল্যনাথের পঞ্চম মোহন্ত মহারাজ হিসেবে অভিষিক্ত হন শ্রীমৎ বিমলেন্দু বিকাশ রায় চৌধুরী। ২০০১ সালের ৯ই ডিসেম্বর, শীতের সিগ্ধ প্রাতে ঊনার অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় মোহন্ত মহারাজ শ্রীমৎ শ্যামাচরন চট্টোপাধ্যায়ের কাছে তিনি নামগ্রহণ করেছিলেন। শ্রীশ্রী কৈবল্যনাথের পঞ্চম মোহন্ত মহারাজের অভিষেক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় কুমিল্লা নিবাসী শ্রদ্ধেয় ব্রজেন্দ্র চক্রবর্তী। আগরতলা নিবাসী মধুসূদন চক্রবর্তী, ডিঙ্গামানিকের তৎকালীন সেবাইত কালীপ্রসাদ চক্রবর্তী, অধ্যাপক ডঃ পুলিন রঞ্জন দাস, দীপক মুখোপাধ্যায় মহাশয়ানসহ ভারত-বাংলাদেশের অনেক ভক্ত উপস্থিত ছিলেন।
চাঁদপুর জেলার বাকিলা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে ১৯৩৫ সালের ১লা নভেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ঊনার পিতৃদেব সর্গ্বীয় রাজেন্দ্রলাল রায় চৌধুরী বাকিলা উচ্চ বিদ্যালয়ের নামকরা প্রধান শিক্ষক ছিলেন। এই স্কুলটির প্রতিষ্ঠা ছিলেন তার পিতামহ জমিদার প্যারিকৃষ্ণ রায় চৌধুরী।
১৯৬২ সালে আইনে স্নাতক ডিগ্রী নেওয়ার পরে আইনজীবি হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন, এর পূর্বে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। ঊনাকে ১৯৮১ সালে “ইন্টারন্যাশনাল এন্ড কম্পারেটিভ ল সেন্টার, ডালাস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র” থেকে বিশেষ সন্মাননা প্রদান করা হয়।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের একজন বিচারক হিসাবে মনোনিত হন। মাঝে মধ্যে প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতে তিনি প্রধান বিচারপতির ভূমিকা পালন করতেন। অবসরের পর ২০০০ সালের জানুয়ারীর ১১ তারিখে তিনি বাংলাদেশ আইন কমিশনের সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হন এবং তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এর একজন উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি ছিলেন বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ও ঢাকা ভিত্তিক ব্রহ্মা সমাজ কল্যাণ ট্রাস্ট এর আজীবন সদস্য এবং তিনি অনেক অন্যান্য ধর্মীয় ও কল্যাণ সংস্থা এবং তাদের কার্যক্রমের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি শ্রীশ্রী কৈবল্যধাম আশ্রমের উন্নয়নমূলক ও কল্যাণকর অনেক কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। যাদবপুর কৈবল্যধামে সমাজের দরিদ্র মানুষের শিক্ষা ও চিকিত্সার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করার নিমিত্তে একটি নতুন প্রোগ্রাম চালু করেন এছাড়াও ২০০৩ সালের ৯ই ডিসেম্বর তারিখে শ্রীশ্রী কৈবল্যধাম, যাদবপুরে ধর্মীয় বই এর একটি লাইব্রেরি চালু করেন। ২০০৫ সালের ১০ই এপ্রিল ঊনার পার্থিব জীবনের উপর পর্দা নেমে এলে নশ্বর শরীর শ্রীশ্রী কৈবল্যধাম আশ্রম, পাহাড়তলীতে সমাহিত করা হয় এবং সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মান করা হয়।


শ্রীশ্রী কৈবল্যনাথের ষষ্ঠ মোহন্তঃ
শ্রীমৎ অশোককুমার চট্টোপাধ্যায় (২০০৫ – ২০২০)

শ্রীশ্রী কৈবল্যধামের পঞ্চম মোহান্তের জীবনাবসানের পর শ্রীমৎ অশোককুমার চট্টোপাধ্যায় ৩১শে শ্রাবন ১৪১২ বঙ্গাব্দ সনে, ইংরেজী ২০০৫ সালের ১৬ই আগস্ট মাসে ষষ্ঠ মোহন্ত মহারাজ হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

শ্রীঅতুলচন্দ্র ও শ্রীমতী অমিয়বালার সন্তান শ্রীমৎ অশোককুমার চট্টোপাধ্যায় বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার অন্তর্গত বানিয়াগতি গ্রামে ১৯৪৫ সালের ২রা জানুয়ারী জন্মগ্রহণ করেন।

ইংরেজিতে এম.এ. পাশ করে তিনি ইংরেজী সাহিত্যের অধ্যাপক হিসাবে অধ্যাপনা করেন বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি কলেজে এবং শেরপুর সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।

শ্রীমৎ অশোককুমার চট্টোপাধ্যায়কে নামদান করেছিলেন শ্রীশ্রী কৈবল্যধামের চতুর্থ মোহান্ত শ্রীমৎ ভবতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়। আশ্রমের বিভিন্ন সেবামূলক উন্নয়ন কর্মকান্ডের পাশাপাশি কৈবল্যধামের ওয়েবসাইট টি তাঁর সার্বিক তত্ত্বাবধানে তৈরী করা হয়।

তাঁর অনুপ্রেরণা ও আশীর্বাদে শ্রীশ্রীঠাকুর এবং শ্রদ্ধেয় মহারাজবৃন্দের দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য চিত্র সংকলিত অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। তিনি দু-দেশের শ্রীশ্রী রামঠাকুরের বিভিন্ন মন্দির প্রতিষ্ঠানসহ ধামে কৈবল্যপ্রাপ্তির সহজ উপায় “শ্রীনাম” ভক্তদের মাঝে বিতরণ করেন।

তাঁর নেতৃত্বে শ্রীশ্রী কৈবল্যধাম চট্টগ্রামের প্রভুত উন্নয়নমূলক ও কল্যাণকর অনেক কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। তিনি মন্দিরের মূল তহবিলে হাত না দিয়ে ভক্তদের দ্বারেদ্বারে ঘুরে তহবিল সংগ্রহ করেছেন।

শ্রীধামে মূল মন্দির সংস্কার, নাট মন্দিরে উন্নয়ন কাজ, কৈবল্যধাম এর নতুন তীর্থযাত্রী নিবাস সহ প্রচুর উন্নয়ন মূলক কাজ ঊনার জীবদ্দশায় সুসম্পন্ন হয়। কিছু কাজ এখনো চলমান, কিন্তু সেই কাজের নির্দেশনা তিনি দিয়ে গেছেন।

ইংরেজি ২০২০ সালের ৪ই মার্চ বুধবার; বাংলা ২০শে ফাল্গুন ১৪২৬, শুক্ল দশমী তিথিতে রাত্রি ২ঃ১৫ মিনিটে কলকাতার একটি হাসপাতালে ঊনার পার্থিব জীবনের উপর পর্দা নেমে এলে ইংরেজি ২০২০ সালের ৬ই মার্চ শুক্রবার শ্রীশ্রী সত্যনারায়ণ পূজা সমাপন্তে ঊনার শ্রীদেহ শ্রীশ্রী কৈবল্যধাম আশ্রম, পাহাড়তলীতে সমাহিত করা হয় এবং সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মান করা হয়।


শ্রীশ্রী কৈবল্যনাথের সপ্তম মোহন্তঃ
শ্রীমৎ কালীপদ ভট্টাচার্য্য (২০২০ থেকে)

শ্রীশ্রীকৈবল্যনাথের পরম পূজ্যপাদ ৬ষ্ঠ মোহন্ত মহারাজ শ্রীমৎ অশোককুমার চট্টোপাধ্যায় এর আত্মা পরমাত্মায় লীন হবার পর বিগত ১০ শ্রাবণ ১৪২৭ বঙ্গাব্দ (২৬ জুলাই ২০২০ খ্রীষ্টাব্দ) রবিবার সপ্তম মোহন্ত মহারাজ হিসেবে শ্রীমৎ কালীপদ ভট্টাচার্য্য মহাশয় শ্রীশ্রী কৈবল্যধাম-চট্টগ্রামে অধিষ্ঠিত হন।

শ্রীশচীন্দ্র লাল ভট্টাচার্য্য ও শ্রীমতি চারুবালা ভট্টাচার্য্যের জ্যেষ্ঠ সন্তান শ্রীমৎ কালীপদ ভট্টাচার্য্য বাংলা ২৫শে বৈশাখ ১৩৫৯ বঙ্গাব্দ (ইংরেজী ৮ই মে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ) চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া’র গৈরলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে জন্মের পরপরই তিনি স্বপরিবারে সীতাকুণ্ডে মাতুলালয়ে চলে আসেন। সে থেকে তিনি পরমতীর্থ সীতাকুণ্ডের সূর্য্যসন্তান হিসেবে বেড়ে ওঠেন।

শিক্ষাজীবনে স্নাতক পাস করার পরপরই তিনি অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডে অডিটর পদে যোগদান করে সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে সুনাম ও দক্ষতার সাথে কর্মজীবনের ইতি টানেন।

তাঁর মাতামহ স্বনামধন্য পণ্ডিত ও কবিরাজ শ্রীচন্দ্রনাথ পুরোহিত তৎকালীন সীতাকুণ্ড স্রাইন এস্টেটের রাজ পুরোহিত ছিলেন। ছোটবেলা থেকে তাঁরই স্নেহসান্নিধ্যে তাঁর পাণ্ডিত্যে হাতেখড়ি। সাথে সাথে তিনি বেদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, চণ্ডী, শ্রীমদ্ভাগবদগীতা, গুরুগীতা, বেদবাণীসহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের রস আস্বাদনেও ব্রতী হন। তিনি ৭/৮ বছর বয়স হতে শ্রীশ্রীঠাকুরের শ্বেত-শুভ্র পটের নিবিড় আকৃষ্টতা অনুভব করেন এবং ঘন্টার পর ঘন্টা তিনি তাঁহান শ্রীপটের সন্মুখে তন্ময়ভাবে আত্মমগ্ন থাকতেন। এ ধারাবাহিকতায় শ্রীশ্রীঠাকুরের বিভিন্ন মঠ মন্দিরের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা দিনদিন প্রকট হতে প্রকটতর হয়। তারই ফলশ্রুতিতে জীবনের এক সুবর্ণক্ষণে শ্রীশ্রী কৈবল্যনাথের চতুর্থ মোহন্ত মহারাজ তাঁকে সদগুরু শ্রীশ্রীরামঠাকুরের নাম প্রদান করেন।

ব্যক্তি জীবনে তিনি একজন সৎ, নির্ভীক, স্বধর্মপরায়ন, বিজ্ঞ শিক্ষক, পরহিতৈষী, দানশীল ও অকৃতদার ব্যক্তিত্ব। এছাড়াও তিনি একজন বিজ্ঞ শাস্ত্রজ্ঞ, বিবিধ শাস্ত্র বিশারদ, ধর্মীয় উপদেষ্টা, সমাজ সংস্কারক ও সুবক্তা। অবসর জীবনে তিনি এলাকায় কয়েকটি গীতা স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করতেন। এলাকার গরীব ছেলেমেয়েদের নিজগৃহে বিনাপারিশ্রমিকে পড়াতেন। তাছাড়া বিভিন্ন মঠ মন্দিরে তাঁর দান অনুদান সর্বজনবিদিত এবং যা এখনো চলমান। তাঁর কর্মবহুল জীবনে তিনি দেশের ৪টি মঠ মন্দিরে জলাধারসহ সুপেয় পাণীয় জলের সুবন্দোবস্ত করে দেন।

শ্রীশ্রী কৈবল্যনাথের মোহন্ত পরম্পরায় অধিষ্ঠিত হবার আগ পর্যন্ত তিনি চারুকুটিরে নিভৃত জীবনযাপন করতেন। ব্রাহ্মণ সমাজের ঈর্ষণীয় পারিবারিক ঐতিহ্যে লালিত শিক্ষা, মার্জিত চালচলন, চিত্তাকর্ষক ব্যবহার, সর্বোপরি বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার ও সদগুরু রামঠাকুরের প্রীতিময়তায় তিনি আজ শ্রীশ্রী কৈবল্যনাথের স্বরূপে কৈবল্যধামে সমাসীন।

কৈবল্যধাম-চট্টগ্রাম আজ তাঁর সার্বক্ষণিক কর্মকুশলতায় দিনদিন পরিপাটি হচ্ছে। ৬ষ্ঠ মোহন্ত মহারাজের স্মৃতি মন্দির নির্মাণ কাজসহ শ্রীধামকে সম্পূর্ণ ডিজিটাল করার প্রক্রিয়া চলমান। পরম দয়াল শ্রীশ্রীঠাকুর রামচন্দ্রদেব এর শুভাশিষ তাঁর চির পাথেয়।