শ্রীশ্রীঠাকুরের অপার করুণায় তাঁহার স্বহস্ত লিখিত পত্রাবলীর প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হইল। প্রায় ২০ বৎসর পূর্ব্বে আমি এই পত্রাবলী সংগ্রহ করিতে আরম্ভ করি এবং ব্যক্তিগত কথাগুলি বর্জ্জন করিয়া সারাংশ সমূহ তাঁহার নিজস্ব ভাষায় লিখিয়া রাখি। যতদূর স্মরণ হয় প্রায় ৩ বৎসর এই কার্য্যে ব্রতী ছিলাম। এই সংগ্রহ আমি আমার নিজের জন্যই করিয়াছিলাম এবং তখন মনে হইয়াছিল যে, যাহা হইয়াছে তাহাই যথেষ্ট। ইহা সাধারণে প্রচার করিবার ইচ্ছা আমার আদৌ ছিল না এবং এ বিষয়ে শ্রীশ্রী ঠাকুরের সঙ্গে কখনও কোন আলোচনা করি নাই। অবশ্য অনেকেই এই সংগ্রহ আমার নিকট হইতে নকল করিয়া নিয়াছেন এবং নকলের নকলও অনেক হইয়াছে বলিয়া জানি।
কিন্তু শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রকট লীলা সম্বরণের পর যে, নূতন পরিস্থিতির উদ্ভব হইয়াছে তাহাতে এই পত্রাবলী স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করিতে পারিতেছি এবং নূতন উদ্যমে এই কার্য্যে ব্রতী হইয়াছি। অনেকেই অনুগ্রহ করিয়া আমার নিকট শ্রীশ্রীঠাকুরের শ্রীহস্ত লিখিত পত্রাবলী পাঠাইতেছেন এবং আরও অনেক পত্র ভবিষ্যতে আমার হাতে আসিবে এরূপ মনে হয়। কিন্তু ইহার জন্য অনির্দ্দিষ্টকাল অপেক্ষা করিয়া থাকা সঙ্গত মনে না হওয়ায় কতকগুলি পত্রের সার সংগ্রহ লইয়া এই প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হইল। আমি ভরসা করি যে, ভবিষ্যতে এরূপ আরও দুই তিন খণ্ড প্রকাশ করিতে পারিব।
কি প্রণালীতে পত্রাবলীর সারাংশ এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত হইয়াছে সে সম্বন্ধে কিছু বলিয়া রাখা প্রয়োজন বোধ করিতেছি। প্রথমে ভাবিয়াছিলাম যে, হয় কালক্রমানুসারে নতুবা বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে পত্রাংশগুলি সাজাইয়া গেলেই চলিবে। কিন্তু কার্য্যতঃ এই দুইটি পন্থার কোনটিই অবলম্বন করিতে পারি নাই। শ্রীশ্রীঠাকুর পত্রে প্রায় কখনও কোন তারিখের উল্লেখ করিতেন না। সেই জন্য পোষ্ট অফিসের সিল হইতে সময়োদ্ধারের চেষ্টা আমি যথাসম্ভব করিয়াছি কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সেই সিলগুলি এতই অস্পষ্ট হইয়া গিয়াছে যে, পাঠোদ্ধার সম্ভব হয় নাই। অনেক এনভেলপের পত্রের শুধু পত্রখানাই আমার হস্তগত হইয়াছে, এনভেলপ পাই নাই। হিসাব করিয়া দেখিলাম যে, প্রায় অর্দ্ধাধিক পত্রেরই তারিখ উদ্ধার করিতে পারি নাই। সুতরাং সময়ক্রমের পন্থা পরিত্যাগ করিতে হইয়াছে। এ বিষয়ে আমি অনেকের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করিয়াছি এবং তাহাদের মধ্যে প্রায় সকলেই বিষয়বস্তু অনুসারে শ্রেণী বিভাগ করিয়া বিভিন্ন অধ্যায়ে পত্রাংশগুলি সন্নিবেশিত করিতে আমাকে উপদেশ দিয়াছেন। এই উপদেশের সারবত্তা অস্বীকার করিতে পারি না। যদিও শ্রীশ্রীঠাকুর অনন্যচেতা হইয়া অদ্বৈতভাব অবলম্বনের উপদেশই পূর্ব্বাপর দিয়া গিয়াছেন, আমাদের মত সাধারণ জীবের পক্ষে সেই আদেশ প্রতিপালন এক প্রকার অসম্ভব বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। অভ্যাসযোগে থাকিতে থাকিতে হয়ত তাঁহার অপার করুণায় একদিন সেই বাঞ্ছিত অবস্থা আমাদের আসিবে কিন্তু আমরা প্রায় সকলেই মন বুদ্ধির আবর্ত্তে পড়িয়া হাবুডুবু খাইতেছি। আমাদের ভাবেরও অন্ত নাই, চিন্তারও অন্ত নাই। সেই জন্যই কখন কোন উপদেশ আমাদের হৃদয়গ্রাহী হইবে তাহারও কোন স্থিরতা নাই। সুতরাং বিষয়বস্তুর প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া “সংসার ধর্ম্ম”, “পতিব্রতা ধর্ম্ম”, “নাম”, “অভ্যাস-যোগ”, “প্রারব্ধ চক্র” ইত্যাদি বিভিন্ন পর্য্যায়ে পত্রাংশগুলিকে সাজাইয়া দিলে পাঠকের পক্ষে নিজ ভাবানুরূপ ও প্রয়োজনানুরূপ অংশগুলি বাছিয়া লইতে কোনই অসুবিধা হয় না। কিন্ত নানা কারণে এই পথেও আমি অগ্রসর হইতে পারি নাই। প্রথমতঃ কতকগুলি পত্রের বিষয়বস্তু এমন ব্যাপকভাবে আছে যে, ঐগুলিকে একটা কোনও বিশেষ শ্রেণীভুক্ত করা একেবারেই অসম্ভব। প্রায় অর্দ্ধাধিক পত্রই এই জাতীয়। সুতরাং এই পদ্ধতিতে অধিকাংশ পত্রই “বিবিধ” পর্য্যায়ে ফেলিয়া বাকীগুলিই শুধু শ্রেণীবদ্ধ করা যাইতে পারিত। ইহা ছাড়া শ্রেণীবিভাগ সম্বন্ধে আপত্তির আরও একটি গুরুতর কারণ আছে। এই পত্রাংশগুলি পুনঃ পুনঃ পড়িয়া এই ধারণা আমার বদ্ধমূল হইয়াছে যে ইহার সকলগুলিই একই সূত্রে গ্রথিত এবং একই ভাবের পরিপোষক। সুতরাং সীমাবদ্ধ বুদ্ধি লইয়া কতকগুলি মনগড়া গন্ডী টানিয়া এই পত্রাংশগুলিকে বিচ্ছিন্ন করিবার সাহস আমার হয় নাই। পত্রগুলি যেমন যেমন আসিয়াছে এবং পত্রাংশগুলি আমি যে পর্য্যায়ে নকল করিয়া গিয়াছি ঠিক সেই ভাবেই পর পর সাজাইয়া গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা হইল।
আমরা যাহাকে বিদ্যা বলি শ্রীশ্রীঠাকুর সেই বিদ্যার বিশেষ কোনও ধার ধারিতেন না। অতি শৈশবেই তাঁহার পাঠশালার পাঠ সাঙ্গ হইয়াছিল। কাজেই তাঁহার পত্রাবলীর মধ্যে তথাকথিত বর্ণাশুদ্ধি ও ব্যাকরণের দোষত্রুটি সময়ে সময়ে দৃষ্টিগোচর হইবে ইহাতে আশ্চর্য্য হইবার কিছুই নাই। কিন্তু এইগুলি আমাদের প্রচলিত নিয়মে পরিবর্ত্তিত করিয়া শুদ্ধ করিবার স্পর্দ্ধা আমার হয় নাই। একদিন যখন শ্রীশ্রীঠাকুর পত্র লিখিতেছিলেন তখন জনৈক গুরুভ্রাতা তাঁহাকে জিজ্ঞেস করিয়াছিলেনঃ “আপনি লিখিতে ন’য়ে দীর্ঘ ঈকার দিলেন কেন?” তাহাতে তিনি উত্তর করিয়াছিলেনঃ “কেন, আপনার কি বুঝিতে কোন কষ্ট হইতেছে?” বস্তুতঃ যেখানে সঠিক পাঠোদ্ধার সম্ভব হইয়াছে সেখানে বর্ণাশুদ্ধি বা ব্যাকরণের দোষত্রুটির জন্য পত্রগুলির মর্ম্মার্থ বুঝিয়া লইতে বিশেষ কোন অসুবিধা হয় এরূপ বলিতে পারি না। শ্রীশ্রীঠাকুরের পত্র লেখাও এক অভিনব ব্যাপার ছিল। ইহা দেখিবার সৌভাগ্য আমার অনেকবারই হইয়াছে এবং সকল সময়ই লক্ষ্য করিয়াছি যে, তিনি পোষ্ট কার্ড কিংবা চিঠির কাগজ হাতে লইয়া এক ধারায় লিখিয়া গিয়াছেন, লেখা শেষ হইলে ফিরিয়া পড়িতেও কখনও দেখি নাই। আমার সর্ব্বদাই মনে হইয়াছে যে, চিঠিখানা যেন আপনিই লেখা হইয়া গেল, শ্রীশ্রীঠাকুরের হাতখানি নিমিত্ত মাত্র। মন কিংবা বুদ্ধির কোন ক্রিয়া যেন ইহাতে নাই। কথাটা জটিল এবং পরিষ্ফুট করা অত্যন্ত দুষ্কর কিন্তু আমার এই বাস্তব অভিজ্ঞতার পর শ্রীশ্রীঠাকুরের পত্রাবলীর সামান্য পরিবর্ত্তন করিতেও সাহসী হই নাই। যদি কোথাও কিছু হইয়া থাকে অসাবধানতা বশতঃই হইয়াছে। পত্রাংশগুলি অবিকল রাখিতে যথাসাধ্য প্রয়াস পাইয়াছি। কিন্তু অনেক পুরাতন পত্রের বিশেষতঃ পেন্সিলে লেখা পত্রগুলির সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার সকল সময়ে সম্ভব হয় নাই। যেখানে কোনও প্রকার পাঠোদ্ধার করিতে পারিয়াছি কিন্তু নিঃসন্দেহ হইতে পারি নাই সেরূপ স্থলে প্রশ্নবোধক চিহ্ন [?] যোজন করিয়া আমার সন্দেহের ইঙ্গিত করিয়াছি। যেখানে পাঠোদ্ধার একেবারেই সম্ভব হয় নাই সেখানে নিজেই প্রয়োজনমত এক বা একাধিক শব্দ [ ] এইরূপ তৃতীয় বন্ধনীর ভিতর বসাইয়া দিয়াছি। প্রায় অধিকাংশ পত্রেই প্রথমাংশ ও শেষাংশ বর্জ্জন করা হইয়াছে, কারণ ব্যক্তিগত কথাগুলি প্রায়শঃই ঐ দুইটি স্থানে থাকে দেখিয়াছি। এই দুই স্থানে কোন নির্দেশ দেওয়া হয় নাই কিন্তু যেখানে প্রয়োজনীয় অংশের মধ্য হইতে কোনও অংশ ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছে সেখানে …………. এইরূপ কয়েকটি বিন্দুচিহ্ন দিয়া তাহার ইঙ্গিত করিয়াছি।
পরিশেষে বক্তব্য এই যে, কেহ কেহ আমাকে এই গ্রন্থে কিছু কিছু টীকা-টিপ্পনী সংযোজন করিবার কথা বলিয়াছিলেন। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হইতে বলিতে পারি যে, শ্রদ্ধা সহকারে এই পত্রাংশগুলি পুনঃ পুনঃ পড়িলে ইহার মর্ম্মার্থ ক্রমেই পরিষ্ফুট হইয়া উঠে এবং যত বেশী পড়া যায় ততই নূতন নূতন ভাবের উদ্দীপন হইয়া থাকে। কখন কখন বিভিন্ন পত্রাংশগুলির মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে যে সকল অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হয় তাহারও সুনিশ্চিত মীমাংসা হইয়া যায়। আমি যাহা বুঝিয়াছি তাহাই যে ঠিক এইরূপ স্পর্দ্ধা আমার নাই, সুতরাং আমার ভাব অন্যের উপর চাপাইবার চেষ্টা হইতে বিরত হইলাম। মহাজনের বাক্যই আছে “যার যেই ভাব তার সেই সর্ব্বোত্তম” এবং শ্রীশ্রীঠাকুরও অনেক সময় বলিতেন “সর্ব্বথা ভাগবতম্ গ্রাহ্যং ন চ ভাষ্যম্ ন চ টীকা”। তাঁহার পবিত্র রাতুল শ্রীচরণে প্রার্থনা করি যেন এই পত্রাংশগুলি আলোচনা করিয়া পাঠকবর্গ নিজ নিজ ভাবের উৎকর্ষ সাধন করিয়া সত্যপথে অগ্রসর হইতে পারেন। আমার নিজের সীমাবদ্ধ বুদ্ধি বিবেচনায় যাহা বুঝিয়াছি অপরকেও যে সেইরূপই বুঝিতে হইবে এরূপ ধারণা আমার নাই।