সন্ধ্যার পরে ঠাকুরের সম্মন্ধে আমার দাদার সহিত কিছুক্ষণ কথাবার্ত্তা হইল। দাদা ঠাকুরকে এই প্রথম দেখিলেন, বিশেষ কিছুই বুজিয়া উঠিতে পারেন নাই এবং মনে হইল যে, আমতার সেই ভদ্রলোকের সরাসরি মন্তব্যটাও তাহাকে যেন একটু বিচলিত করিয়াছে। ঠাকুরের কি কি বৈশিষ্ট্য আমার নজরে পড়িয়াছে, বিশেষ করিয়া তাহাই তিনি জানিতে চাহিলেন। তখন ঠাকুরের সম্মন্ধে আমার অভিজ্ঞতা নিতান্তই অল্প, কি বলিয়াছিলাম ঠিক স্মরণ নাই, কিন্তু মনে হয় যে সামান্য যাহা কিছু বলিতে পারিয়াছিলাম, তাহাতেই কিছুটা কাজ হইয়াছিল। দাদা ও বৌদি ক্রমেই ঠাকুরের প্রতি আকৃষ্ট হইতে থাকেন এবং পরে তাঁহার কৃপালাভে সমর্থ হইয়াছিলেন।
কথাটা যখন উঠিয়াই পড়িয়াছে তখন এখানেই বিষয়টার একটু বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করিব। ঠাকুরের বৈশিষ্ট্য যে কি এবং কোথায় তাহা সম্যকরূপে বুজিবার শক্তি আমার নাই , তবে যেটুকু কতকটা বুজিয়াছি বলিয়া মনে হইয়াছে, শুধু তাহাই এখানে বলিবার চেষ্টা করিব। পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, তিনি নামমাত্র আহার করিতেন। আহার্য্যের কোন ধরাবাঁধা নিয়ম ছিল না, এক এক সময় এক এক রকম আহার করিতেন কিন্তু পরিমাপ সামান্যই থাকিত। কখনও কখনও যে ইহার ব্যতিক্রম হইত না তাহা নহে। পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, ঠাকুরের খাওয়া অনেকাংশে নির্ভর করিত যে খাওয়াইত তাহার মন ও নিষ্ঠার উপর। আমার নিজের অভিজ্ঞতা হইতে এখানে একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিব। আমি তখন ৫৬সি বিডন স্ট্রিটের বাসায় বামুন চাকর লইয়া একাকীই আছি। হঠাৎ একদিন ঠাকুর আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বৈকালে প্রভাতবাবু আসিলেন এবং আমাকে জানাইলেন যে, রাত্রিতে তিনি এখানেই থাকিবেন, সুতরাং একবার বাজারে যাইতে হইল। অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামাঝি, সবে নূতন আলু, ফুলকপি, কড়াই শুঁটি বাহির হইয়াছে, বাজারে গিয়া চক্ষু জুড়াইয়া গেল, থরে থরে কপি সাজান রহিয়াছে, দেখিয়াই আমার মনে হইল যে, ঠাকুর যদি একটু আলু কপির ডালনা গ্রহণ করিতেন তাহা হলে কি আনন্দই না হইত ! তৎক্ষনাৎ ২/৩টি বাছা বাছা কপি তৎসঙ্গে কিছু নতুন আলু ও কড়াই শুঁটি কিনিয়া ফেলিলাম এবং প্রভাতবাবুর জন্য কয়েকটা হাঁসের ডিম লইয়া বাড়ী ফিরিয়া আসিলাম। আমার মনের কথাটা শুনিয়া প্রভাতবাবু অত্যন্ত উৎসাহিত হইয়া উঠিলেন এবং আমার চাকর দামুকে ডাকিয়া তৎক্ষনাৎ তোলা উনানটা ধরাইতে বলিলেন। ইতিমধ্যে তিনি আবার স্নান করিয়া লইলেন এবং সযত্নে আলু কপি কুটিয়া ও কড়াই শুঁটি ছাড়াইয়া উনানে কড়াই বসাইয়া দিলেন। ঠাকুরকে কিছুই বলা হইল না। রান্না শেষ হইতেই আমি ঠাকুরের বিছানার উপরেই তাঁহার সম্মুখে একখানা কাগজ পাতিয়া দিলাম এবং প্রভাতবাবু একটা বড় জামবাটি ভর্ত্তি করিয়া সেই ডালনা আনিয়া কাগজের উপরে রাখিলেন, সঙ্গে একখানা চামচও দিলেন। ঠাকুর কিছুই বলিলেন না, সঙ্গে সঙ্গেই খাইতে সুরু করিলেন এবং যখন তাঁহার খাওয়া শেষ হইয়া গেল তখন দেখিলাম যে, কোথাও একটু ঝোলও লাগিয়া নাই, বাটিতে জল ঢালিয়া আমাদের প্রসাদ পাইতে হইল। এই জাতীয় অভিজ্ঞতা আমার আরও কয়েকবার হইয়াছে। এবং যথাস্থানে তাহা উল্লেখ করিব, কিন্তু এগুলি ব্যতিক্রম, স্বভাবতঃই ঠাকুর অত্যন্ত স্বল্পাহারী ছিলেন। এই আহারের ব্যাপার লইয়া একবার আমি তাঁহাকে একটি প্রশ্ন করিয়াছিলাম, উত্তরে বলিয়াছিলেন যে, কিছু কিছু সুদ দিলেই মহাজন সন্তুষ্ট থাকে, অধিক প্রয়োজন হয় না।
ইহাও বলা হইয়াছে যে, ঠাকুর কখনও স্নান করিতেন না এবং ছাড়াইয়া না দিলে কাপড়ও ছাড়িতেন না। সহজেই কথাটা বলিয়া ফেলিলাম কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই সহজ নহে। দু’চার দিন স্নান করিতে না পাইলে আমাদের যে কি অবস্থা হয় তাহা আমরা সকলেই জানি। আমার নিজের কথা বলিতে পারি, ২/৩ দিন স্নান না করিলে শুধু যে গা ঘিন ঘিন করে এবং বিছানা পৰ্য্যন্ত দুর্গন্ধে ভরিয়া যায়, তাহাই নহে, মেজাজও বিগড়াইয়া যায় এবং আহাৰ্য্য বস্তুও বিস্বাদ হইয়া উঠে। কিন্তু ঠাকুর মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর স্নান না করিয়া কাটাইয়া গিয়াছেন, অথচ ক্লেদের লেশও তাঁহাতে কখন প্রকাশ পায় নাই, তাঁহার সেই সৌম্য, প্রশান্ত, স্নিগ্ধোজ্জ্বল মূৰ্ত্তি অটুটই রহিয়াছে। আরও আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তাঁহার গায়ের সেই অপূৰ্ব্ব নয়নাভিরাম রঙটি সকল সময়ে এক প্রকার থাকিত না। একটা স্থায়ী রঙ অবশ্যই ছিল কিন্তু কখনও কখনও দুই তিন ঘণ্টার জন্য, কখনও বা দু’এক দিনের জন্য উহা পরিবর্ত্তিত হইয়া ভিন্ন রূপ ধারণ করিত। আমি স্বচক্ষে ইহা কয়েকবার প্রত্যক্ষ করিয়াছি। গায়ের রঙটি কখনও একটু হরিদ্রাভ, কখনও একটু রক্তাভ, কখনও বা কতকটা দুধের মত হইয়া যাইত এবং কিছুক্ষণ থাকিয়া আবার ধীরে ধীরে মিলাইয়া যাইত। ইহাও দেখিয়াছি যে, কখনও কখনও তাঁহার ললাটে আপনা হইতেই একটি ত্রিপুণ্ড্র ফুটিয়া উঠিত, দু’তিন ঘণ্টা থাকিয়া আবার চলিয়া যাইত। কেন এরূপ হইত বলিতে পারি না, ঠাকুরকে কখনও সে কথা জিজ্ঞাসা করি নাই। তিনি স্নান কেন করেন না, একথা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, তিনি উত্তরে বলিয়াছিলেনঃ “স্নান করার দরকার হয় না, স্নান হয়।” এই স্নান নিশ্চয়ই কোন আভ্যন্তরীণ ব্যাপার কিন্তু ইহার স্বরূপ সম্বন্ধে আমার কোন ধারণাই নাই। বৈষ্ণবেরা ‘লাবণ্যামৃতে স্নান, তারুণ্যামৃতে স্নান’, ইত্যাদির কথা বলিয়া থাকেন। ঠাকুরের এই স্বতঃসম্পাদিত স্নানও হয়তো সেই রকমই একটা কিছু হইবে।
আমি জানি যে, ঠাকুরের নিদ্রাও ছিল না। তিনি নিজেই বলিয়াছেনঃ “ঘুম তো আসে না, ঘুম আসিলেই তো মোহ আসিয়া গেল।” কিন্তু কথাটা অন্যকে বোঝান সহজ হইবে না এবং এ সম্বন্ধে মত বিরোধেরও সম্ভাবনা আছে। আমরা যেমন রাত্রিতে আহারাদির পর বিছানায় যাইয়া শুইয়া পড়ি এবং ধীরে ধীরে ঘুমাইয়া পড়ি, ঠাকুরও সেইরূপ মশারির ভিতরে বিছানায় যাইয়া শুইতেন এবং চক্ষু মুদিয়া এমন ভাবে থাকিতেন যে, মনে হইত যে তিনি ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন। সুতরাং ইহা যে নিদ্রা নহে, অন্য কিছু, তাহা প্রমাণ করা সহজসাধ্য নহে। এ সম্বন্ধে আমার নিজের যাহা বক্তব্য আছে তাহাই শুধু বলিতে পারি, গ্রহণ করা না করা, পাঠক-পাঠিকার ইচ্ছা। আমার জীবনে ঠাকুরের সহিত একাকী রাত্রি কাটাইবার সুযোগ কয়েকবারই হইয়াছে। একদিন আমার বিডন স্ট্রীটের বাসায় ভিতরের একখানা ঘরে আমার ও ঠাকুরের শোয়ার ব্যবস্থা করা হইল। খাটের উপর ঠাকুরের বিছানা পাতিয়া দেওয়া হইল এবং আমার বিছানা হইল মেঝের উপর। খানিকক্ষণ কথাবার্ত্তার পর মশারি টানাইয়া আলো নিভাইয়া দুইজনেই শুইয়া পড়িলাম। আমার কিন্তু ঘুম আসিল না, বিছানায় এপাশ ওপাশ করিতে লাগিলাম। ঘড়িতে ১২টা বাজিতে শুনিয়া বুঝিলাম যে, এক ঘণ্টার উপর এই ভাবে কাটাইয়াছি। রাস্তার আলোতে ঘরেও খানিকটা আলো ছিল, ঠাকুরের খাটের দিকে চাহিয়া দেখিলাম যে, তিনি স্থির হইয়া বসিয়া রহিয়াছেন। দেখাদেখি আমিও উঠিয়া বসিলাম এবং একটু পরে ঠাকুর বলিলেনঃ “উঠিয়া বসিলেন যে ?” আমি বলিলাম যে, ঘুম আসিতেছে না, তাই। তখন ঠাকুর বলিলেন: “তা হইলে এক কাজ করেন, মশারি তুইলা রাইখা আলো জ্বালাইয়া দেন।” আমি তৎক্ষণাৎ মহানন্দে ঠাকুরের আদেশ তামিল করিলাম। তিনি নানা বিষয়ে কথা বলিয়া চলিলেন, বেশ মনে আছে যে, সে রাত্রিতে তিনি তাঁহার জীবনের অনেক গুহ্য কথা আমাকে জানাইয়াছিলেন। কিভাবে যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলিয়া গেল কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। হঠাৎ চাহিয়া দেখি যে, ভোর হইয়া গিয়াছে। ঠাকুরের সঙ্গে এই প্রকার সারারাত্রি জাগরণ আমার অন্ততঃ দশবার ঘটিয়াছে কিন্তু প্রতিবারেই লক্ষ্য করিয়াছি যে, রাত্রি জাগরণের যে একটা স্বাভাবিক গ্লানি ও ক্লান্তি আছে, তাহার বিন্দুমাত্রও ঠাকুরকে স্পর্শ করে নাই। তিনি প্রত্যহ যেমন থাকেন তেমনই রহিয়াছেন, কোন ব্যতিক্রমই হয় নাই। আমরা হয়তো দিনে ৩/৪ ঘণ্টা ঘুমাইয়া রাত্রি জাগরণের অবসাদ দূর করিতে চেষ্টা করিয়াছি কিন্তু ঠাকুরের সে রকম কোন প্রয়োজনই হয় নাই। অন্যান্য দিন যেমন সমাগত ভদ্রমণ্ডলীর সহিত আলাপ আলোচনা করিয়া এবং কখন হয়তো বা সামান্য একটু বিশ্রাম করিয়া কাটাইয়া দেন, রাত্রি জাগরণের পরের দিনগুলিও হুবহু সেইভাবেই কাটাইয়াছেন। এমনও অনেকবার হইয়াছে যে, ঠাকুরকে আনিতে হাওড়া বা শিয়ালদহ ষ্টেসনে গিয়াছি, ঠাকুর একখানা প্যাসেঞ্জার ঠাসা তৃতীয় শ্রেণীর কামরা হইতে নামিয়াছেন, সারারাত্রি বসিয়াই আসিয়াছেন কিন্তু কোন ক্লান্তি বা গ্লানির চিহ্নমাত্রও তাঁহাতে দেখি নাই। স্বভাবতঃই মনে হইয়াছে যে, নিদ্রার কোন প্রয়োজনই তাঁহার নাই, নতুবা জাগরণের অবসাদ অন্ততঃ কিছু না কিছু প্রকাশ হইয়া পড়িতই।
কিন্তু শুধু ইহার উপর নির্ভর করিয়াই ঠাকুর জিতনিদ্র ছিলেন এরূপ সিদ্ধান্ত সমীচীন হইতে পারে না। মহাজনদের অনেক মজুতি শক্তি থাকে, তাহার প্রভাবে অসম্ভবও সম্ভব হইতে পারে, সুতরাং কাহারও অনিদ্রায় কোন প্রকারের গ্লানি না হইলেই যে তিনি জিতনিদ্র এমন কথা বলা চলে না। প্রকৃত প্রস্তাবে আমার বক্তব্যের মূল কথা ইহা নহে, এবং ইহার সহিত তাহার বিশেষ কোন সম্বন্ধও নাই। আমার প্রধান কথা হইল এই যে, দীর্ঘকাল ঠাকুরের সাহচর্য্যে কাটাইবার সৌভাগ্য আমার হইয়াছে কিন্তু কখনও তাঁহার মুখে নিজের সম্বন্ধে এই ঘুম, এমন কি বিশ্রাম কথাটাও শুনি নাই। তিনি অনেক সময়েই অসুস্থ হইয়া পড়িতেন, বাত তো প্রায় নিত্যসঙ্গীই ছিল, আরও নানা প্রকারের ব্যাধি বিভিন্ন লোকের নির্ব্বন্ধাতিশয্যে কুড়াইয়া আনিতেন এবং সময় সময় নিদারুণ যন্ত্রণায় ছটফট করিতেন। “পেট জ্বলিয়া গেল, পায়ের যন্ত্রণা অসহ্য হইয়া উঠিল,” ইত্যাদি নানা প্রকারের কাতরোক্তি করিতেন, কিন্তু ঘুম হইতেছে না, একটু ঘুমাইতে পারিলে বোধ হয় অনেকটা সুস্থ হইতাম, এরূপ কথা শুধু আমি কেন, কেহই কোন দিন তাঁহার মুখে শোনে নাই। কথাটা একটু বিশেষ যত্ন সহকারে বুঝিয়া লওয়া কর্ত্তব্য। আমরা সকলেই জানি যে, রোগীর পক্ষে সাধারণতঃ ঘুম একটা অতি সুখকর অবস্থা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ডাক্তার বৈদ্যেরাও চিকিৎসার সময় রোগীর ঘুম হইতেছে কিনা, এই বিষয়ে অনুসন্ধান করেন এবং প্রয়োজন বোধ করিলে ঘুমের জন্য ঔষধাদিরও ব্যবস্থা করেন। কোন কঠিন রোগী খানিকক্ষণ ঘুমাইয়াছে শুনিলেই চিকিৎসকেরা আনন্দিত হ’ন। কিন্তু নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্যেও ঠাকুর ঘুমের কথা কখনও বলেন নাই। ইহা অত্যন্ত বিস্ময়কর সন্দেহ নাই এবং আমার বিশ্বাস যে আমাদের সমস্যার মীমাংসাও ইহার মধ্যেই আছে। ঠাকুরের ঘুম ছিলই না এবং সেই জন্যই যখন ঘুম অত্যন্ত প্রয়োজন তখনও ঘুমের কথাটা তাঁহার মুখ দিয়া বাহির হয় নাই। শুধু একবারই তিনি কথাটা বলিয়াছিলেন। তাঁহার অন্তিম শয্যার পাশে যাহারা উপস্থিত ছিলেন তাহাদের নিকট শুনিয়াছি যে, দেহত্যাগের কিছুক্ষণ পূৰ্ব্বে উপস্থিত আশ্রিতবৃন্দকে লক্ষ্য করিয়া ঠাকুর বলিয়াছিলেনঃ “আপনারা ঐ ঘরে যান, আমি একটু ঘুমাই।” যাঁহারা পূৰ্ব্বাপর ব্যাপারটা লক্ষ্য করিয়া আসিয়াছেন, তাঁহারা এই একটি কথা শুনিয়াই নিশ্চয়ই বুঝিয়াছিলেন যে, ঠাকুর আমাদিগকে ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেছেন, তাঁহার দেহত্যাগের আর বিলম্ব নাই। কথাটা বুঝাইয়া বলিতে পারিলাম কিনা জানি না কিন্তু আমার নিজের মনে কোন সন্দেহই নাই।
সুস্থ শরীরে ঠাকুর প্রায় সর্ব্বদাই চিৎ হইয়া শুইতেন এবং একখানা চাদর দিয়া সৰ্বাঙ্গ ঢাকিয়া লইতেন। তখন তাঁহাকে দেখিলে মনে হইত যে, একটি শব পড়িয়া রহিয়াছে, প্রাণের কোন স্পন্দনই যেন ইহাতে নাই। যোগীদিগের সম্পর্কে “শবাসন” বলিয়া একটা কথা শুনা যায়। আমার মনে হয় যে, যখন ঠাকুর ঘুমাইয়া আছেন বলিয়া বাহ্যতঃ দেখা যাইত, বাস্তবিক তখন তিনি শবাসনে কোনও একটা অবস্থায় থাকিতেন।
ইতিপূর্বে প্রসঙ্গক্রমে ইহাও বলিয়াছি যে, ঠাকুরের কখনও কোন ক্লান্তি বা অবসাদ দেখি নাই। শুধু কতকগুলি কথা বলিয়া ইহা বুঝান যাইবে না, সুতরাং কয়েকটি দৃষ্টান্তের সাহায্যে বিষয়টি পরিস্ফুট করিতে চেষ্টা করিব। আমার বিডন ষ্ট্রীটের মেসে একদিন সকাল বেলা ঠাকুর আমাকে বলিলেনঃ “চলেন, কালীঘাটের দিকে একবার বেড়াইয়া আসি।” আমি সানন্দে সম্মত হইলাম এবং তৎক্ষণাৎ জামা জুতা পরিয়া ঠাকুরের সঙ্গে বাহির হইয়া পড়িলাম। রাস্তায় নামিয়াই আমি বাঁ দিকে মোড় ফিরিলাম, ইচ্ছা যে হেদুয়ার নিকট আসিয়া ট্রামে চাপিব। ঠাকুর আমাকে থামাইলেন এবং একটু হাসিয়া বলিলেনঃ “ট্রামে উঠিলেই তো ট্রামের অধীন হইলেন, স্বাধীন ভাবেই চলেন।” অগত্যা নিতান্ত অনিচ্ছাক্রমে ঠাকুরের পিছু পিছু চলিলাম। সেন্ট্রাল এভেনিউ রাস্তাটা তখনও সমাপ্ত হয় নাই, কিন্তু পায়ে হাঁটিয়া কোন মতে যাওয়া চলিত। ঠাকুর এই রাস্তাই ধরিলেন এবং ক্রমে আমরা আসিয়া এসপ্লানেডে পৌঁছিলাম। আমার একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে, এইবার বোধ হয় ঠাকুর ট্রামে উঠিতে বলিবেন, কিন্তু তিনি সটান কার্জ্জন পার্কে ঢুকিলেন এবং ঐ পার্ক পার হইয়া রেড রোডে আসিয়া পড়িলেন। তারপর আরম্ভ হইল একটানা হাঁটা। শ্রাবণ মাস, আকাশে মেঘ থাকিবার কথা, কিন্তু আমার দুর্ভাগ্যক্রমে একটুও নাই, রৌদ্র ক্রমশঃই ঝাঁ ঝাঁ করিয়া উঠিতেছে, আর আমরা হাঁটিয়াই চলিয়াছি। ট্রামে যাইব মনে করিয়া এবং আকাশে মেঘ না দেখিয়া ছাতাটিও সঙ্গে আনি নাই। যাহাই হউক, ময়দান পার হইয়া হরিশ মুখার্জ্জী রোড ধরিয়া হাজরা রোডে আসিয়া পড়িলাম। পরে কালীঘাট রোড হইয়া আরও দুই তিনটি গলি ঘুরিয়া এক খোলার চালওয়ালা বাড়ীতে ঠাকুর আমাকে আনিয়া উঠাইলেন। আমার অবস্থা তখন অত্যন্ত শোচনীয় ; ঘামে জামা কাপড় ভিজিয়া ঢোল হইয়া গিয়াছে, পায়ে ফোস্কা পড়িয়াছে, পিপাসায় কণ্ঠতালু শুকাইয়া যাইবার উপক্রম। কিন্তু ঠাকুরের দিকে তাকাইয়া অবাক হইয়া গেলাম। গায়ে এক বিন্দু ঘাম নাই, কোন গ্লানি নাই, কোন ক্লান্তি নাই, আমার বাসা হইতে বাহির হইবার সময় যেমন ছিলেন, ঠিক তেমনই রহিয়াছেন। বস্তুতঃ, ঠাকুরের গায়ে ঘাম কোন দিনই দেখি নাই। দারুণ গ্রীষ্মে বদ্ধ ঘরের মধ্যে আমরা গলদঘর্ম হইয়া গিয়াছি কিন্তু ঠাকুরের দেহের বা ভাবের কোন প্রকারের কোন বৈলক্ষণ্য দেখি নাই।
আর একটি কথাও এইখানে বলিয়া রাখা প্রয়োজন মনে হইতেছে। আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি তখন ঠাকুর জুতা ব্যবহার করিতেন না, পূৰ্ব্বেও কখন করিয়াছেন বলিয়া শুনি নাই। ইহার প্রায় ১৫/২০ বৎসর পরে আমরাই বলিয়া কহিয়া তাঁহাকে জুতা ব্যবহার করিতে সম্মত করাইয়াছিলাম। তখন একখানি ধুতি ও একখানি চাদর, ইহাই ছিল তাহার সজ্জা। শুধু পায়ে তিনি সর্ব্বদাই হাঁটাহাঁটি করিতেন কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, ঠাকুরের পায়ের তলায় এই হাঁটাচলার কোন নিদর্শনই ছিল না। পায়ের তলা দুইটি ছিল নির্ম্মল, মসৃণ এবং পাখীর পালকের মত কোমল। ইহা অনেকেই প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। আর একটা বিশেষত্ব ছিল এই যে, তিনি যখন হাঁটিয়া যাইতেন তখন কোন প্রকারের কোন শব্দ হইত না। সাধারণতঃ লোকে যখন চলাফেরা করে, চোখে না দেখিলেও বুঝা যায় যে, কেহ যাইতেছে। কিন্তু ঠাকুরের বেলায় এরূপ বুঝিবার কোন উপায় ছিল না। এমন বহুবার দেখিয়াছি যে, ঠাকুর সিঁড়ি ধরিয়া উপরে চলিয়া আসিয়াছেন, সিঁড়ির পাশের ঘরে এবং বারান্দায় অনেকেই রহিয়াছেন, কিন্তু একজন লোক যে নীচ হইতে উপরে চলিয়া আসিল তাহা কেহই বুঝিতে পারিলেন না। আমার মনে হইত যে, ঠাকুর যখন হাঁটিয়া যাইতেন তখন তাহার দেহের ভার মাটির উপর পড়িত না এবং সেই জন্যই হাঁটিবার সময় কোন শব্দ হইত না এবং এত হাঁটাহাঁটি করা সত্ত্বেও তাঁহার পায়ের তলা এমন অবিকৃত অবস্থায় ছিল। একদিন আমি ঠাকুরকে এই কথাটা লইয়া চাপিয়া ধরিয়াছিলাম, তিনি স্পষ্ট কিছু বলিলেও প্রকারান্তরে আমার অনুমানের যাথার্থ্য স্বীকার করিয়াছিলেন।
এই জন্যই তাহার সহিত কেহই হাঁটিয়া পারিত না। আমার বিশিষ্ট বন্ধু শ্রীসুধীরচন্দ্র সরখেল (ইনি কটকে কন্ট্রাক্টারী করিতেন, এখন সপরিবারে সেইখানেই বসবাস করেন) একদিন কোন কাৰ্য্যোপলক্ষে উত্তর কলিকাতায় গিয়াছিলেন, হঠাৎ বেথুন কলেজের সম্মুখে তাহার ঠাকুরের সহিত সাক্ষাৎ হইয়া গেল। আমরা সকলেই জানিতাম যে, ঠাকুর তখন ১০ নং যদু মল্লিক ষ্ট্রীটে শ্রীউপেন্দ্রকুমার সাহার গদীবাড়ীতে অসুস্থ অবস্থায় আছেন এবং একথাও প্রচার ছিল যে, তিনি কিছুদিন কাহারও সহিত সাক্ষাৎ করিবেন না, সুতরাং ঠাকুরকে সেখানে দেখিয়া সুধীরবাবু একটু আশ্চৰ্য্যই হইলেন। ঠাকুরের চেহারা দেখিয়াই সুধীরবাবু বুঝিলেন যে, তিনি বাস্তবিকই অসুস্থ এবং যদু মল্লিক ষ্ট্রীট হইতে এতটা দূরে একাকী কি করিয়া আসিলেন, স্বভাবতঃই ঠাকুরকে এই কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। ঠাকুর বলিলেনঃ “দুপুর বেলা ওরা সবাই বিশ্রাম করিতেছে, এই ফাঁকে একটু বেড়াইতে বাহির হইয়াছি, চল এই পার্কে একটু ঘুরি।” এই বলিয়া ঠাকুর পার্কে ঢুকিলেন এবং সুধীরবাবুও সঙ্গে সঙ্গে গেলেন। তারপর আরম্ভ হইল ঘোরা। সুধীরবাবুর মুখে এই ঘোরার বিবরণ শুনিয়া স্তম্ভিত হইয়া গেলাম। ঠাকুর কত পাক যে ঘুরিলেন তাহার ইয়ত্তা নাই কিন্তু তথাপি তাঁহার ঘোরা আর থামে না। সুধীরবাবু স্বাস্থ্যবান ও বলিষ্ঠ পুরুষ, ৬৫ বৎসর বয়সেও তিনি ৭/৮ মাইল হাঁটিতে এবং ১৫ মাইল সাইকেল চালাইতে অনায়াসেই পারেন, কিন্তু নিতান্ত অসুস্থ ঠাকুরের সহিত হাঁটিতে গিয়া তিনিই ঘায়েল হইয়া গেলেন। শেষে সুধীরবাবুকেই বলিতে হইল:
“চলেন, একটা বেঞ্চে একটু বসি।” ইহা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে যে, একটা অফুরন্ত মজুতি শক্তি ঠাকুরের ভিতরে ছিল এবং তিনি যখন খুশি তখনই তাহা কাজে লাগাইতে পারিতেন।
কথাটা পরিস্ফুট করিবার জন্য আমি এখানে আরও দুইটি ঘটনার উল্লেখ করিব। ঠাকুর তখন মতিবাবুর ডিক্সন লেনের বাসায় আছেন, অত্যন্ত অসুস্থ ; দুইটি পা-ই বাতে আক্রান্ত হইয়াছে। সেক, মালিশ প্রভৃতি যথারীতি চলিতেছে কিন্তু কিছুতেই যন্ত্রণার উপশম হইতেছে না। একদিন প্রাতঃকালে সেখানে যাইয়া দেখি যে, ঠাকুর পা দুইটি সম্মুখের দিকে ছড়াইয়া বসিয়া আছেন, গুটাইয়া বসিবার সামর্থ্য আর তাঁহার নাই। দুইটি পা-ই আগাগোড়া ফ্ল্যানেলে জড়ান, মাঝে মাঝে যন্ত্রণায় কাতরাইয়া উঠিতেছেন। ঠাকুরের কাছে প্রভাতবাবু, মতিবাবু, জিতেন বক্সী (মতিবাবুর শালক), আরও কে কে যেন বসিয়াছিলেন ঠিক স্মরণ নাই। বরদাবাবুও বোধ হয় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেদিন ঠাকুরের পায়ের বেদনা এমন তীব্র হইয়া উঠিয়াছিল যে, আস্তে আস্তে একটু টিপিয়া বা হাত বুলাইয়া যে তাহার পরিচৰ্য্যা করিব তাহারও কোনও উপায় ছিল না, কোন কিছুর সামান্য স্পর্শও তিনি সহ্য করিতে পারিতেছিলেন না। আমরা প্রায় নিঃশব্দেই কিছুক্ষণ বসিয়া আছি এমন সময় স্বর্গীয় কুঞ্জলাল নাগ মহাশয় ঠাকুর দর্শনে আসিলেন। তিনি ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া উঠিয়া আমাদিগকে বলিলেনঃ “জীবনে তিনজন মহাপুরুষের সঙ্গলাভ করিয়াছিলাম, আজ গণ্ডা পূর্ণ হইল।” যতদূর স্মরণ হয় কুঞ্জবাবু এই ঘটনার কিছুদিন পূর্ব্বে বিদ্যাসাগর কলেজের অধ্যক্ষের পদ হইতে অবসর গ্রহণ করিয়াছিলেন। কুঞ্জবাবু বলিলেন যে, তাহার বাড়ী বারদীগ্রামে এবং শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার সঙ্গ তিনি শৈশব হইতেই পাইয়াছিলেন। পরে তাহার রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সহিত সাক্ষাৎ হয় এবং শ্রীমৎ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী মহাশয় তাহার দীক্ষাগুরু ছিলেন। প্রভাতবাবু কুঞ্জবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ “আপনি তো বাল্যকাল হইতেই লোকনাথ বাবার সঙ্গ পাইয়াছেন এবং তাঁহাকে আন্তরিক শ্রদ্ধাও করেন দেখিতেছি, তবে তাঁহার নিকট দীক্ষা না লইয়া গোস্বামী মহাশয়ের নিকট দীক্ষা লইলেন কেন?” কুঞ্জবাবু বলিলেন যে, তাহারা যখন কলেজে পড়িতেন, সেই সময়ে অধিকাংশ ইংরাজী শিক্ষিত যুবকেরাই ব্রাহ্মসমাজের দিকে আকৃষ্ট হইত, তিনিও সে প্রভাব এড়াইতে পারেন নাই। পরে যখন গোস্বামী মহাশয় ব্রাহ্মসমাজ ছাড়িয়া বাহির হইয়া আসিলেন, তিনিও সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের প্রভাবমুক্ত হইয়া গোস্বামী মহাশয়ের শরণাপন্ন হইলেন। কুঞ্জবাবু আরও অনেক কিছু বলিয়াছিলেন, কিন্তু কিছুই স্মরণ হইতেছে না।
হঠাৎ দেখি যে, কুঞ্জবাবু ঠাকুরের একখানা পা কোলে তুলিয়া লইয়া আস্তে আস্তে টিপিতে আরম্ভ করিয়াছেন। তাহাকে নিষেধ করিব ভাবিতেছি কিন্তু ঠাকুরের দিকে দৃষ্টি পড়িতেই নিৰ্ব্বাক হইয়া গেলাম। সেই দারুণ রোগ যন্ত্রণার আর কোন চিহ্নই তাঁহাতে নাই, যেন একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যক্তি স্থির চিত্তে সমাহিত হইয়া বসিয়া রহিয়াছেন। আমরা কেহই কিছু বলিলাম না, কুঞ্জবাবু ঠাকুরের পা টিপিয়াই চলিলেন। ইতিমধ্যে আরও একটা ব্যাপার ঘটিয়া গেল। এক বাবাজী ঠাকুরকে একখানা গান শুনাইবার জন্য ২/৩ দিন ধরিয়া মতিবাবুর বাসায় আসিতেছিল, ঠাকুর অসুস্থ বলিয়া আমরা তাহাকে হাঁকাইয়া দিয়াছিলাম। কিন্তু সেদিন বাবাজী আর আমাদের অনুমতির জন্য অপেক্ষা না করিয়া উপরে আসিয়া ছাদের এক কোণে বসিয়া খঞ্জনী বাজাইয়া গান ধরিয়া দিল। কি জানি কেন, সেদিন বাবাজীর গানটা এত ভাল লাগিয়াছিল যে, তাহার গোড়ার দিকটা এখনও মনে আছে। বাবাজী গাইয়াছিল:
“তুমি ধরবে কিসে,
কামনার কামসাগরে ডুবে আছ মায়ার বিষে।
যেমন গোদেহেতে মাখন আছে, গাভীর কি তা জানা আছে,
খইল ভুষি পেলে সে যে আনন্দেতে ভাসে।
গোপীগণের মরম জেনে, দোহন কর ক’ষে,
দোহন করে চড়কি দিলে, ঊর্দ্ধে মাখন উঠবে ভেসে।”
যাহাই হউক, বাবাজীর গান আরম্ভ হইতেই কুঞ্জবাবুর হাত নিশপিশ করিতে লাগিল। তিনি বেশ ভাল খোল বাজাইতে পারিতেন এবং একটু পরেই আত্মবিস্মৃত হইয়া ঠাকুরের পায়ের উপরেই ধীরে ধীরে খোলের বোল বাজাইতে লাগিলেন। গানের গতির সঙ্গে সঙ্গে তাহার বাজনাও ক্রমে দ্রুত এবং গুরুতর আকার ধারণ করিল। ঠাকুর কিন্তু সেই এক ভাবেই রহিলেন। বাবাজীর গান থামিয়া যাইতেই কুঞ্জবাবুর হুঁস হইল এবং তিনি যারপর নাই লজ্জিত হইলেন। জোড়হাতে নিতান্ত কাতরতার সহিত ঠাকুরের নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করিলেন এবং অল্প কিছুক্ষণ পরে ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া বিদায় লইয়া চলিয়া গেলেন। প্রভাতবাবু ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করিলেন যে, তিনি এই নিদারুণ যন্ত্রণা সত্ত্বেও কুঞ্জবাবুকে সতর্ক করিলেন না কেন। ঠাকুর বলিলেনঃ “অপরের আনন্দে কি বাধা দিতে আছে।” টিপ্পনী করিয়া এই মধুর কথাটিকে বিরস করিয়া তুলিতে ইচ্ছা হইতেছে না। এই যে অনন্যসাধারণ সহ্য শক্তি ইহা যে কি বস্তু, পাঠক-পাঠিকারা নিজেরাই তাহা অনুমান করিয়া লইবেন, আমি কিছুই বলিতে পারিলাম না।
এইবার যে ঘটনাটি বিবৃত করিব তাহার সূত্রপাত হয় চাঁদপুরে, মধ্যাবস্থা ডাক্তারদা’র (শ্রীযতীন্দ্রমোহন দাশগুপ্ত, ইহার পরিচয় পূর্ব্বেই দিয়াছি, এখন হইতে তাহাকে “ডাক্তারদা” বলিয়াই উল্লেখ করিব) বাড়ীতে এবং পৰ্য্যাবসান গঙ্গাপ্রসাদ মুখার্জী রোডে স্বর্গীয় প্রতাপ চক্রবর্ত্তী মহাশয়ের বাসাতে। একবার চাঁদপুরে মারাত্মক ব্যাসিলারি ডিসেন্ট্রিতে আক্রান্ত হইয়া ঠাকুর একেবারে শয্যাশায়ী হইয়া পড়েন। টেলিগ্রাম পাইয়া ডাক্তারদা’ চাঁদপুর চলিয়া যান। অনেক কষ্টে এবং প্রভূত অর্থ ব্যয়ে যাবতীয় প্রয়োজনীয় বিষয়ের ব্যবস্থা করিয়া ঠাকুরকে তাহার কলিকাতার বাড়ীতে লইয়া আসেন। ঠাকুরের অসুখ সেবার যে কি মারাত্মক আকার ধারণ করিয়াছিল, তাহা যে নিজে না দেখিয়াছে তাহাকে সহজে বুঝান যাইবে না। যাহারা সর্ব্বদা ঠাকুরের নিকটে থাকিয়া তাঁহার পরিচৰ্য্যা করিত তাহাদের নিকট শুনিয়াছি যে, মিনিটে ১৫।২০ বার মলত্যাগ হইত, তাহারা তুলার প্যাড হাতে লইয়া প্রস্তুত হইয়া থাকিতেন, প্রায় সর্ব্বদাই মল পরিষ্কার করিয়া দিতে হইত। আর তার উপর অসহ্য যন্ত্রণা ও কাতরানি। আমি প্রত্যহই একবার এবং কোনদিন বা দু’বার ডাক্তারদা’র বাড়ী যাইয়া খবর লইয়া আসিতাম, ঠাকুরের ঘরে কদাচিৎ যাইতাম, কারণ সেখানে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। এই রোগের চিকিৎসার জন্য কলিকাতাতে যাহা কিছু করা সম্ভব ডাক্তারদা’ তাহার সকল ব্যবস্থাই করিয়াছিলেন, কিন্তু এইরূপ সুচিকিৎসা ও পরিচর্য্যার এমন সুবন্দোবস্ত সত্ত্বেও ঠাকুরের অসুখের আশানুরূপ উপশম হইতেছিল না। ঠাকুরকে কলিকাতা লইয়া আসিবার আনুমানিক ৮/১০ দিন পরে ডাক্তারদা’ আমাদের অনেককেই বৈকালে একবার তাহার বাড়ীতে যাইবার জন্য খবর পাঠাইলেন। যে সংবাদ লইয়া আসিয়াছিল তাহার নিকট শুনিলাম যে, ঠাকুরের চিকিৎসা সম্বন্ধে আমাদের সকলের সঙ্গে একটা পরামর্শ করিবার জন্যই তিনি আমাদের ডাকিয়াছেন। কিন্তু সেখানে যাইয়া যাহা দেখিলাম তাহাতে নিজের চক্ষুকেই সহসা বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। যাঁহার বালিসের উপর হইতে মাথা তুলিতে কষ্ট হয়, অস্থির হইয়া পড়েন, আবার কখনও বা যন্ত্রণায় খাটে উপরে বেহুঁসের মত গড়াগড়ি দিতে থাকেন, সেই ঠাকুর দোতলার হলঘরে একখানা জলচৌকির উপর আসিয়া বসিয়াছেন এবং রাগতভাবে অনেক কিছুই বলিয়া যাইতেছেন। তিনি এত দুর্ব্বল যে বসিয়া থাকিতে তাঁহার যেন কষ্ট বোধ হইতেছে এবং মনে হইল যেন তিনি কাঁপিতেছেন। আমরা সকলেই নিৰ্ব্বাক, কাহারও কোন কথা বলিতে সাহসে কুলাইতেছিল না। ঠাকুর বলিতেছিলেন যে, তিনি তখনই অন্যত্র চলিয়া যাইবেন, এখানে আর এক মুহূর্ত্তও থাকিবেন না। ডাক্তারদা’ ভাল ভাবেই জানিতেন যে, একবার যখন ঠাকুর যাইবেন বলিয়া গোঁ ধরিয়াছেন, তখন আর তাঁহাকে কিছুতেই ফিরান যাইবে না, সুতরাং তিনিও প্রায় নীরবেই ছিলেন, শুধু তাহার একটা কথা আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। ডাক্তারদা’ ঠাকুরকে বলিয়াছিলেনঃ “আমি বোকা হইলেও এত বোকা নই; আমার এই ইটকাঠ দিয়া যে আপনাকে বাঁধিয়া রাখিতে পারিব না, তাহা আমি জানি।” যোগেশবাবু (ঠাকুরের শ্রীচরণাশ্রিত অবসরপ্রাপ্ত এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার, শ্ৰীযেগেশচন্দ্র গুহ) নিকটেই দাঁড়াইয়াছিলেন, ঠাকুর তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন যে, তিনি গাড়ী আনিয়াছেন কিনা। যোগেশবাবু হাঁ বলিতেই ঠাকুর তাহাকে বলিলেন যে, এখনই তাঁহাকে প্রতাপবাবুর বাড়ীতে পৌঁছাইয়া দিতে হইবে। ইহাতে যোগেশবাবুর বলিবার কিছুই ছিল না, সুতরাং ধরাধরি করিয়া ঠাকুরকে কোনওক্রমে গাড়ীতে আনিয়া উঠান হইল এবং তিনি প্রতাপবাবুর বাসায় চলিয়া গেলেন। সেখানে পৌঁছিবার কিছুক্ষণ পরে ঠাকুরের একবার বাহ্যের বেগ আসিল। প্রতাপবাবু দুইখানা ইট এবং তাহার মধ্যে একটি মাটির মালসা পাতিয়া ব্যবস্থা করিয়া দিলেন, এবং ঠাকুরও অনায়াসেই সেখানে মলত্যাগ করিয়া পুনরায় ঘরে আসিয়া বসিলেন। এই সময়টায় আমি সেখানে ছিলাম না, কিন্তু যাহারা ছিলেন তাহাদের কাছে শুনিয়াছি যে, প্রতাপবাবুর বাসায় পৌঁছাইবার পরই ঠাকুরের অসুখ যেন আপনা হইতেই অর্দ্ধেক কমিয়া গেল। কোথায় বা গেল বেডপ্যান, কোথায় বা গেল তুলার প্যাড, আর কোথায় বা গেল ঔষধ আর পত্র। পরের দিন প্রাতঃকালে ঠাকুরের নিকটে আসিয়া দেখিলাম যে, তিনি সুস্থ হইয়া উঠিয়াছেন, শুধু দেহের শীর্ণতা ছাড়া রোগের আর বিশেষ কোন লক্ষণ তাঁহাতে নাই। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এরূপ একটা অবস্থান্তর চিকিংসা-বিজ্ঞান ধারণাও করিতে পারে না। পূর্ব্বে যে ঠাকুরের একটা অফুরন্ত মজুতি শক্তির কথা বলিয়াছি, তাহার সাহায্যেই ব্যাপারটা বুঝিয়া লইতে হইবে।
কিন্তু ঠাকুর সেদিন রাগারাগি করিয়া ডাক্তারদা’র বাড়ী হইতে চলিয়া আসিলেন কেন? বিষয়টা লইয়া আমি নানাভাবে ভাবিয়াছি এবং আমার যাহা মনে হইয়াছে তাহাই এইস্থানে লিপিবদ্ধ করিতেছি, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ইহাও বলিয়া রাখিতেছি যে, আমার এই সিদ্ধান্ত নির্ভুল না-ও হইতে পারে। ঠাকুরের অসুখ এবং আমাদের অসুখ যে এক পর্য্যায়ের নহে, মূলগত একটা বৈষম্য আছে, ইহা ডাক্তারদা’ বিশেষ ভাবেই জানিতেন, কিন্তু ঠাকুরের কোন কঠিন অসুখ দেখিলেই কথাটা তাহার ভুল হইয়া যাইত। ঠাকুরের প্রতি আত্যন্তিক মমতা বশে তাহার চিকিৎসা-বুদ্ধিই প্রবল হইয়া উঠিত এবং ঠাকুরের চিকিৎসার জন্য তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া পড়িতেন। এই ব্যাপার লইয়া ঠাকুরের সঙ্গে তাহার প্রায়ই খটাখটি বাধিত এবং কখনও কখনও তিনি ঠাকুরের নিকট গালাগালিও খাইতেন। তাহার বাড়ীর অতি নিপুণ সুব্যবস্থিত চিকিৎসার মধ্য হইতে প্রতাপবাবুর বাসাতে এক প্রকার অচিকিৎসার মধ্যে আসিয়া এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রোগমুক্ত হইয়া ঠাকুর ডাক্তারদা’কে চোখে আঙ্গুল দিয়া দেখাইলেন যে, তাহাদের চিকিৎসা-বিদ্যার আইন-কানুন তাঁহার বেলায় খাটিবে না।
ঠাকুরের এই অসুখের সঙ্গে আরও একটা গুরুতর ব্যাপার জড়িত আছে। তিনি কলিকাতা আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুনিলাম যে, এই মারাত্মক ব্যাধিটি ঠাকুর কুড়াইয়া আনিয়াছেন। চাঁদপুরে এক ব্যক্তি এই কঠিন রোগে আক্রান্ত হইয়াছিলেন এবং তাহার আত্মীয়স্বজনের নিৰ্ব্বন্ধাতিশয্যে ঠাকুর এই ব্যাধিটি নিজ দেহে তুলিয়া লইয়াছিলেন। এই বৈজ্ঞানিক যুগে কথাটা বিশ্বাস করা সহজসাধ্য নহে, এবং ইহা যে কি করিয়া সম্ভব, তাহাও আমাদের সাধারণ বুদ্ধির অগম্য। কিন্তু কথাটা অবিসংবাদিত সত্য। ব্যাধিটা গোড়া হইতেই এমন মারাত্মক আকার ধারণ করিয়াছিল যে, অভিজ্ঞ চিকিৎসকগণের মতে এবং আধুনিক চিকিৎসা-বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তে আরোগ্যের পথে চলিলেও ১৫/২০ দিনের পূর্ব্বে রোগীর নিরাময় হইবার কোন সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু যিনি এই রোগে আক্রান্ত হইলেন, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি সুস্থ হইয়া উঠিলেন, আর এই দুরন্ত ব্যাধির সমস্ত লক্ষণগুলিই সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরের দেহে আসিয়া প্রকাশ পাইল। এখনও এমন অনেকেই বিদ্যমান আছেন যাহারা এই ব্যাপারটা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন এবং এ বিষয়ে নিশ্চিত সাক্ষ্য দিতে পারেন। ঠাকুর যে এইভাবে অন্যের ব্যাধি তুলিয়া আনিতেন, তাহার ২/৩টি দৃষ্টান্তের উল্লেখ আমি “বেদবাণী”র দ্বিতীয় খণ্ডের সম্পাদকীয়তে করিয়াছি এবং আরও কয়েকটি আমার জানা আছে। যাহারা একটু দীর্ঘকাল ঠাকুরের সঙ্গ করিয়াছেন তাহাদের অনেকেই হয়তো এ সম্বন্ধে আরও কিছু বলিতে পারিবেন, সুতরাং ঠাকুর যে মাঝে মাঝে অপরের দেহের দুরারোগ্য ব্যাধি নিজের দেহে টানিয়া আনিতেন, এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকিতে পারে না। ঠাকুর নিজেই ইহা স্বীকার করিয়াছেন এবং উল্লিখিত “বেদবাণী”র দ্বিতীয় খণ্ডে সম্পাদকীয়তে ঠাকুরের স্বীকারোক্তির দুইটি দৃষ্টান্ত দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি যে, ইহা যে কি করিয়া সম্ভব হইত এবং ঠাকুর যে কি কৌশলে ইহা করিতেন, তাহা আমি জানি না এবং সে সম্বন্ধে কিছু বলিতেও পারিব না। কথাটা ঠাকুরকে কখন জিজ্ঞাসা করি নাই কিন্তু সেই জন্য আমার বিশেষ কোন আপসোস নাই, কারণ তিনি ব্যাপারটা বুঝাইয়া বলিলেই যে আমি বুঝিতে পারিতাম, তাহা আমি সম্ভব বলিয়া মনে করি না। একদিন আমি ঠাকুরকে বলিয়াছিলাম যে, অযথা তিনি এই রোগ যন্ত্রণাগুলি সহ্য করেন কেন, ইচ্ছা করিলেই তো এগুলিকে এড়াইয়া নির্ব্বিবাদে বসিয়া থাকিতে পারেন। ঠাকুর বলিয়াছিলেনঃ “তা হইলে যে রোগ-ঋণ শোধ হয় না।”
কিন্তু ঠাকুর যে শুধু অন্যের ব্যাধিই নিজের শরীরে টানিয়া লইতেন তাহাই নহে, কখনও কখনও অপরকে ভাবী বিপদ হইতে রক্ষা করিবার জন্য নিজের ঘাড়ে বিপদ টানিয়া আনিতেন। এখানে একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিব। ঘটনাটি আমি শ্রীরোহিণীকুমার মজুমদার (ঠাকুরের শ্রীচরণাশ্রিত, পূৰ্ব্বে ‘জর্জ টেলিগ্রাফ’ অপিসে চাকুরী করিতেন, বর্ত্তমানে অবসর গ্রহণ করিয়া বজবজে বসবাস করিতেছেন) মহাশয়ের নিকট শুনিয়াছিলাম এবং পরে শ্রীশুভময় দত্ত (ঠাকুরের শ্রীচরণাশ্রিত রায় বাহাদুর শ্রীশুভময় দত্ত, নোয়াখালীর ভূতপূর্ব্ব সরকারী উকীল, বর্ত্তমানে মাইজদিতে ওকালতি করেন) মহাশয়ও ইহা আমার নিকট বিবৃত করিয়াছিলেন। ঘটনাটি ঘটিয়াছিল মজঃফ্ফরপুরে রোহিণীবাবুর বাসাতে, শুভময়বাবুও ঠাকুরের সঙ্গে পূজার ছুটি উপলক্ষে সেখানেই ছিলেন। সে দিন মাংস রান্না হইতেছিল, রান্না শেষ হইতে রোহিণীবাবু সকলকে লইয়া খাইতে বসিবার ব্যবস্থা করিতেছেন, এমন সময় ঠাকুর হঠাৎ বলিয়া বসিলেনঃ “আমিও মাংস খাইব, আমাকেও দেন।” রোহিণী বাবুর স্ত্রী সানন্দে একবাটি মাংস আনিয়া ঠাকুরের সম্মুখে রাখিলেন, ঠাকুর তাড়াতাড়ি বাটিটি নিঃশেষ করিয়া আবার মাংস চাহিলেন। আর এক বাটি আসিল, তাহাও নিঃশেষ হইতে বিলম্ব হইল না, এবং এইভাবে ক্রমে ক্রমে ঠাকুর সমস্ত মাংসটাই খাইয়া ফেলিলেন, একটু ঝোলও অবশিষ্ট রহিল না। ইহার কয়েক ঘণ্টা পরেই ঠাকুরের পেটে দারুণ যন্ত্রণা সুরু হইল এবং ঘন ঘন দাস্ত হইতে লাগিল। প্রায় তিন দিন দুঃসহ যন্ত্রণায় ভুগিয়া ঠাকুর সুস্থ হইয়া উঠিলেন। রোহিনীবাবুর প্রশ্নের উত্তরে ঠাকুর বলিয়াছিলেন যে, মাংসটা বিষাক্ত হইয়া গিয়াছিল এবং উহা খাইলে তাহাদের সকলেরই জীবন নাশের আশঙ্কা হইত। রোহিণীবাবুর কাছে এই কথাটা শুনিবার কিছুদিন পরে ঠাকুরের সঙ্গে এই বিষয়ে আমার একটু আলোচনা হইয়াছিল। আমি তাঁহাকে বলিয়াছিলাম যে, রোহিণীবাবুকে বলিলেই তো মাংসটা তিনি ফেলিয়া দিতে পারিতেন, অযথা এতটা মর্ম্মান্তিক যন্ত্রণা ঠাকুর সহ্য করিতে গেলেন কেন। উত্তরে তিনি বলিয়াছিলেন:
“ফেলিয়া দিলেই কাক, বিড়াল, কুকুর ইত্যাদিতে উহা খাইত, এবং তাহাদের জীবন শঙ্কটাপন্ন হইত।“ কথা কয়টি যখন বলিলেন তখন তাঁহাকে দেখিয়া মনে হইল যে, করুণার একটি বাস্তব মূৰ্ত্তি আমার সম্মুখে বসিয়া রহিয়াছেন। ইহারই নাম মৈত্রী—সৰ্ব্বভূতে সমদৃষ্টি। শুধ মিছিল বাহির করিয়া কর্ণভেদী ঢক্কানিনাদে “মৈত্রী মৈত্রী” বলিয়া জিগির তুলিলে এই বস্তুর সন্ধান পাওয়া যায় না।
কত কথাই না মনে পড়িতেছে কিন্তু আপাততঃ আর বেশী কিছু বলিব না, ঠাকুরের আর দুইটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করিয়াই এই অধ্যায়ের উপসংহার করিব। ঠাকুর যখন কথাবার্ত্তা বলিতেন, তাঁহার গলার সেই সুমধুর স্বরটি সৰ্ব্বদা এক সুরেই বাঁধা থাকিত, কখনও উঠিতও না, কখনও নামিতও না। সাধারণতঃ আমাদের প্রত্যেকের গলারই একটি বিশিষ্ট সুর থাকে এবং সেই সুরেই আমরা কথাবার্ত্তা বলি। কিন্তু এই সুরের স্থিতিত্ব নির্ভর করে আমাদের মনের অবস্থার উপর। মনে কোন প্রকারের চাঞ্চল্য বা উত্তেজনা আসিলেই সুরটিও বিকৃত হইয়া যায়, রাগ হইলে চিৎকার করিয়া বাড়ী ফাটাইবার উপক্রম করি, শোকে আর্ত্তনাদ করিয়া উঠি, কখনও বা এমন ম্রিয়মাণ হইয়া পড়ি যে, গলা দিয়া কোন স্বর বাহির হইতে চাহে না। ঠাকুরের কিন্তু এসকল কোন বালাই ছিল না। তিনি রাগারাগিও করিতেন, গালাগালিও করিতেন কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, কোন সময়েই তাঁহাতে কোন প্রকারের কোন উত্তেজনার লক্ষণ প্রকাশ পাইত না এবং গলার সুরটিও অবিকৃতই থাকিত। এখানে একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিব। আমার বিডন ষ্ট্রীটের বাসার বাহিরের ঘরে শ্রীসুধীরচন্দ্র সরখেল মহাশয়ের সহিত কোন একটি বিষয় লইয়া ঠাকুরের প্রায় এক ঘণ্টার উপর বাদানুবাদ চলিয়াছিল, আমি নিকটেই বসিয়াছিলাম। গোড়ার দিকে সুধীরবাবু বেশ ধীরেসুস্থেই কথাটা ঠাকুরের নিকট পাড়িয়াছিলেন, কিন্তু ঠাকুরের কথাবার্ত্তার ধরণে তিনি ক্রমেই উত্তেজিত হইতে লাগিলেন এবং কিছুক্ষণ পরেই তাহার গলার স্বর সপ্তমে চড়িয়া গেল, পঞ্চমের নীচে আর নামিতেই চাহিল না। ঠাকুরও বেশ জোরের সহিতই তর্ক চালাইতেছিলেন এবং সুধীরবাবুর একটা কথাও তিনি মানিয়া লইতে চাহিতেছিলেন না, কিন্তু আশ্চর্য্য হইয়া দেখিলাম যে, ঠাকুরের মধ্যে কোন প্রকারের কোন চাঞ্চল্য বা উত্তেজনার লেশমাত্রও নাই, তিনি তাঁহার সেই স্বাভাবিক একটানা সুরেই কথা বলিয়া যাইতেছেন। গালিবর্ষণ হইতেছে অথচ কোন চিত্তবিক্ষোভ নাই, যিনি ইহা সচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন নাই, তাহাকে সহজে বুঝান যাইবে না। কত বিভিন্ন লোককেই না কত বিভিন্ন কথা লইয়া ঠাকুরের কাছে আসিতে দেখিলাম- কেহ আসিলেন কন্যার শুভ বিবাহের খবর লইয়া, কেহ বা কন্যা বৈধব্যের সংবাদ লইয়া আসিলেন; কেহ আসিলেন নূতন চাকুরীতে বহাল হইয়া, কেহ বা পদচ্যুত হইয়া আসিলেন; কেহ আসিলেন কোন নিকট আত্মীয়ের মরণাপন্ন অসুখের সংবাদ লইয়া, কেহ বা সরকারী খেতাব পাইয়া আহ্লাদে ডগমগ হইয়া ঠাকুরকে সেই খবর নিবেদন করিতে আসিলেন—সৰ্ব্বদাই দেখিয়াছি যে, ঠাকুর এই বিভিন্ন সংবাদগুলি ঠিক এক ভাবেই গ্রহণ করিয়াছেন, কোন ইতর বিশেষ কখনও দেখি নাই। কোন ঘনিষ্ঠ অন্তরঙ্গের মৃত্যু সংবাদ শুনিলে কেহ যে সম্পূর্ণ অবিচলিত থাকিতে পারেন, ইহা আমরা ধারণাও করিতে পারি না। অন্ততঃ একটু আধটু “আহা, উহু” অথবা “কবে মারা গেলেন, কি হইয়াছিল” এই জাতীয় কিছু না কিছু বলিতেই হয়। ঠাকুরের নিকটে বসিয়া তাঁহার নিতান্ত অনুগত কতিপয় ব্যক্তির মৃত্যু-সংবাদ পাইতে আমি তাঁহাকে দেখিয়াছি কিন্তু ঠাকুর যেমন ছিলেন ঠিক তেমনই রহিয়াছেন, এই মর্ম্মান্তিক মৃত্যু-সংবাদগুলি তাঁহাকে স্পর্শ করিতে পারেন নাই। আমার মনে হইয়াছে যে, “অমুকে মারা গিয়াছে” আর “ইলিশ মাছ আসিয়াছিল” এরূপ দুইটি কথাও যেন ঠাকুরের দৃষ্টিতে পার্থক্যশূন্য। আমার এক কন্যার মৃত্যুর কয়েক দিন পরে ঠাকুর আমার বিডন ষ্ট্ৰীটের বাসায় আসিয়াছিলেন। সান্ত্বনাচ্ছলে আমাকে বলিয়াছিলেনঃ “কেহ তো মরে না, ঘুরিয়া ফিরিয়া আবার আসে, এতো দেখতেই পাওয়া যায়।“ সুতরাং মৃত্যুকে যে তিনি আমাদের দৃষ্টিতে না দেখিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখিতেন, তাহা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে।
বহুদিন যাবৎ ঠাকুরের নানাবিধ আচরণ অত্যন্ত নিবিষ্ট মনে লক্ষ্য করিয়া এই ধারণা আমার বদ্ধমূল হইয়াছে যে, প্রকৃতির কাজ প্রকৃতি করিয়া যাইত, ঠাকুর সর্ব্বদা আত্মস্থ হইয়াই থাকিতেন। কথাটা ভবিষ্যতে আবার উঠিবে এবং আমি ভরসা করি যে, ঠাকুরের কয়েকটা অত্যদ্ভুত আচরণের আলোচনা প্রসঙ্গে ইহাকে আরও পরিস্ফুট করিতে সক্ষম হইব। যাহাই হউক, আর একটি সামান্য ব্যাপারের উল্লেখ করিলেই আপাততঃ আমার বক্তব্য শেষ হইয়া যায়। ঠাকুর তখন আমার বিডন ষ্ট্রীটের বাসায় ছিলেন। সকাল বেলা বাহিরের ঘরে ঠাকুরের নিকট বসিয়া আছি, এমন সময় হঠাৎ মনে হইল যে, কলেজে যাইতে হইবে, সুতরাং সময়টা একবার দেখা দরকার। আমার নির্দ্দেশক্রমে আমার ভৃত্য দামু ভিতর হইতে আমার হাতঘড়িটি আমাকে আনিয়া দিল, দেখিলাম যে ঘড়িটি বন্ধ হইয়া রহিয়াছে, আগের দিন দম দিতে ভুল হইয়া গিয়াছিল। আমি দামুকে সময়টা নীচের দোকান হইতে দেখিয়া আসিতে বলিতেই ঠাকুর বলিলেন যে, ৯|১৮ মিনিট হইয়াছে। আমি ঠাকুরের কথাটা তেমন গ্রাহ্য না করিয়া দামুকে নীচে পাঠাইয়া দিলাম, সে আসিয়া বলিল যে, ৯।২০ মিনিট হইয়াছে। ঠাকুর এমনভাবে আমার দিকে তাকাইলেন যে, আমি একটু লজ্জিতই হইলাম। ব্যাপারটা পরীক্ষা করিয়া দেখিবার জন্য আরও কয়েকবার ঠাকুরের নিকট সময়টা জানিয়া লইয়া ঘড়ি খুলিয়া দেখিয়াছি যে, প্রতিবারই ঠাকুর নির্ভুল সময়টি বলিয়া দিয়াছেন। পরে আমার এমন একটা অভ্যাস দাঁড়াইয়া গিয়াছিল যে, ঠাকুর আমার বাসায় উপস্থিত থাকাকালীন ঘড়ি মিলাইবার প্রয়োজন হইলে তাঁহার নিকট জিজ্ঞাসা করিয়াই ঘড়ি মিলাইতাম। তাহাতে কখনও কোন অসুবিধায় পড়িতে হয় নাই। দু’এক মিনিটের গরমিল যে, কখনও হয় নাই এমন নহে, কিন্তু অনুসন্ধানে বুঝিয়াছি যে, সেজন্য আমার ঘড়িই দায়ী, ঠাকুর দায়ী নহেন।
আমি ভরসা করি যে, চতুর্থ অধ্যায়ের শেষাংশে এবং পঞ্চম অধ্যায়ে আমি যাহা বলিয়াছি তাহা হইতেই পাঠক-পাঠিকারা ঠাকুরের সম্বন্ধে একটা মোটামুটি ধারণা লইতে পারিবেন।