আমি তখন ঢাকা কলেজে দ্বিতীয় বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্র। কলেজের ছাত্রসভার সাহিত্য-শাখার এক অধিবেশনে ষষ্ঠ বার্ষিক শ্রেণীর ইংরাজী সাহিত্যের একজন ছাত্র “দায়ী কে?” নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করিয়াছিলেন। প্রবন্ধ-পাঠক লক্ষ্মীনারায়ণ মজুমদার মহাশয়ের প্রশ্ন ছিল এই যে, সংসারে যে এত দুঃখ, এত কলহ, এত বৈষম্য, এত নিৰ্য্যাতন, ইহার জন্য দায়ী কে? তিনি নানা দিক হইতে কথাটার বিচার করিয়া এই সিদ্ধান্তে আসিয়াছিলেন যে, এজন্য ভগবানই দায়ী। প্রবন্ধ-পাঠ সমাপ্ত হইতেই এক তুমুল বিতর্ক আরম্ভ হইল। কয়েকজন অধ্যাপক এবং এম্. এ. ক্লাসের কয়েকজন ছাত্র এই বিতর্কে যোগদান করিলেন এবং সকলেই অত্যন্ত তীব্রভাবে লক্ষ্মীনারায়ণবাবুর সিদ্ধান্তের সমালোচনা করিলেন। তখনও মানুষ আজিকার মত এতটা বুদ্ধিমান হইয়া উঠে নাই, সুতরাং ভগবানের উপর এই আক্রমণ কেহই সহ্য করিতে চাহিলেন না। পরিশেষে কলেজের অধ্যক্ষ মহাশয় সভাপতির ভাষণে বুঝাইয়া বলিলেন যে, প্রকৃত পক্ষে প্রবন্ধকার একটা জটিল সমস্যার অবতারণা করিয়াছেন মাত্র, সমালোচকেরা অযথা তাহাকে আক্রমণ না করিয়া যদি এই সমস্যার সমাধানে কিছু কিছু সাহায্য করিতে পারিতেন, তাহা হইলেই বিতর্কটি অধিকতর ফলপ্রসূ হইত। অধিবেশন ভাঙ্গিয়া গেল এবং কিছুক্ষণ পরেই বাড়ী ফিরিয়া আসিলাম, কিন্তু এই প্রশ্নটার হাত হইতে অব্যাহতি পাইলাম না। তখন আমি নিতান্ত অল্পবয়স্ক তরলমতি যুবক, একপ্রকার বালক বলিলেও চলে, অথচ এতবড় একটা গুরুতর সমস্যা আমার মনে দানা বাঁধিয়ারহিল, কিছুতেই ইহাকে এড়াইতে পারিলাম না। আমি অত্যন্ত মুশকিলে পড়িয়া গেলাম। ঠাট্টার ভয়ে সমবয়সী বন্ধুদের নিকট কথাটা উথ্থাপন করিতে পারিতাম না, আবার এদিকে বয়োজ্যেষ্ঠদের কিছু জিজ্ঞাসা করিতেও সাহসে কুলাইত না। কিন্তু কেন জানি না, আপনা হইতেই আমার মনে একটা বিশ্বাস গড়িয়া উঠিল যে, এই সমস্যার সমাধান কোনও প্রকৃত সাধু ভিন্ন অন্য কাহারও দ্বারাই সম্ভব হইবে না। কলেজে কৃতবিদ্য অধ্যাপকের অভাব ছিল না, বিশেষতঃ একজনের পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে আমার শ্রদ্ধার অন্ত ছিল না। তিনিও আমাকে অত্যন্ত ভালবাসিতেন এবং অন্তরঙ্গের মত ব্যবহার করিতেন। কিন্তু তাহার কাছেও এই প্রশ্ন লইয়া যাইতে ইচ্ছা হইল না। নিতান্ত অস্বস্তিতেই দিন কাটিতে লাগিল।
এইভাবে কয়েক মাস অতীত হইবার পর কি একটা উৎসব উপলক্ষে রামকৃষ্ণ মিশনের তিন চার জন নামজাদা স্বামীজী ঢাকায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সন্ধান লইয়া জানিলাম যে, বাঙ্গলাবাজার অঞ্চলে কোনও একটা বাড়ীতে তাঁহারা অবস্থান করিতেছেন। কালবিলম্ব না করিয়া সেখানে যাইয়া উপস্থিত হইলাম কিন্তু কোন লাভ হইল না। স্বামীজীরা রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের আদর্শ সম্বন্ধে বক্তৃতা করিলেন, এই আদর্শের বহুল প্রচারই যে গণকল্যাণের একমাত্র পন্থা, ইত্যাদি অনেক কিছুই বলিলেন কিন্তু কোন তাত্ত্বিক আলোচনার ধার দিয়া ও গেলেন না। আমি কোন কথা বলিবার অবসরই পাইলাম না, পাইলে ও বোধহয় কিছু জিজ্ঞাসা করিতে সাহসে কুলাইত না। যদি অপর কেই প্রশ্নটা জিজ্ঞাসা করেন এবং তদুত্তরে আমার সমস্যার সমাধান হইয়া যায় এই ভরসায় আরও তিন চার দিন সেখানে যাতায়াত করিলাম কিন্তু কিছুই হইল না।
ইহার কিছুদিন পরে, তৃতীয় বার্ষিকের শেষের দিকে, অন্য একটা কারণে আমার মনের অস্থিরতা অত্যন্ত বাড়িয়া গেল। এই সময়ে Ball প্রণীত “Story of the Heavens” নামক পুস্তকখানা পড়িবার আমার সুযোগ হয়। এই পুস্তকখানা আমার মনে এক বিপর্য্যয় আনিয়া দিল। বসিয়া বসিয়া ভাবিতাম যে, এই পরিদৃশ্যমান বিশ্ব-জগৎ, যাহার বিরাটত্বের কথা ভাবিতেও মাথা ঘুরিয়া যায়, যাহার তুলনায় আমাদের এই সসাগরা পৃথিবীর সামান্য একটা বালুকণার গুরুত্বও নাই, সেই পৃথিবীতে আমি একটি সাড়ে তিন হাত মনুষ্য! আমার নিজের অতি-ক্ষুদ্রত্ব এবং এই ব্রহ্মাণ্ডের অতি-বিশালত্ব আমার মনে এক বিষম বিপ্লব বাধাইয়া দিল। সময় সময় নিজেকে নিতান্ত অসহায় এবং একাকী মনে হইত এবং কোন কাজেই মনঃসংযোগ করিতে পারিতাম না। সতীর্থদের সহিত আলাপ আলোচনা করিয়া যে মনের ভার খানিকটা লঘু করিয়া লইব, সে উপায়ও ছিল না। দুএক জনের কাছে কথাটা তুলিয়া এমন মর্মান্তিক আঘাত পাইছিলাম যে, সে পথ একেবারেই বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। গভীররাত্রিতে একাকী বসিয়া নীরবে একদৃষ্টে আকাশের দিকে চাহিয়া থাকিতাম। মনটা উদাস হইয়া যাইত, কখন বা ভয়ে আড়ষ্ট হইয়া উঠিলাম, তখন “গীতা” কিছু কিছু পড়িতাম, ভয় হইত বুঝিবা সেই ভয়াবহ “বিশ্বরূপ“ হঠাৎ আমার চোখের সম্মুখে প্রতিভাত হইয়া উঠিবে। আমার মনের অবস্থা বিশ্লেষণ করিয়া আমি বুঝিয়াছিলাম যে, আমার একটা স্থির অবলম্বনের প্রয়োজন এবং ইহারই সন্ধানে সাধু-সন্ন্যাসীদিগের পিছনে ঘোরাঘুরি সুরু করিয়া দিলাম। এই সময়ে আমার হরেক রকমের সাধু-সন্ন্যাসী সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা জন্মে কিন্তু এখানে সে বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনার কোন প্রয়োজন আছে বলিয়া মনে করি না। বিশেষতঃ বেশী কিছু বলিতে গেলেই দু’চারটা অপ্রীতিকর কথা উঠিযা পড়িতে বাধ্য। ঠাকুরের কথা বলিতে বসিয়া গোড়াতেই একটা তিক্ততার সৃষ্টি করিতে ইচ্ছা হইতেছে না। শুধু এইটুকুই বলিব যে, যাহা খুঁজিতেছিলাম তাহা পাইলাম না। কিন্তুক্রমে আমার এই উৎকট অস্থিরতা কমিয়া গেল, কতকটা পড়াশুনার চাপে এবং কতকটা অন্যান্য কারণে মন স্বাভাবিক ও সুস্থ হইয়া আসিল। ফুটবল, ক্রিকেট, সখের থিয়েটার ইত্যাদি নানা ব্যাপারে আমার উৎসাহের অন্ত ছিল না, দাবা খেলা একটা নেশার মত পাইয়া বসিয়াছিল। বি.এ. পরীক্ষার পর রীতিমত ওস্তাদ রাখিয়া প্রায় এক বৎসর কাল তবলা শিখিয়াছিলাম, সর্ব্বোপরি বয়সেরও একটা ধর্ম আছে, সুতরাং প্রশ্নটা সহজেই চাপা পড়িয়া গেল। কিন্তু কখনও কখনও টের পাইতাম যে, ইহা একেবারে যায় নাই, অন্তঃসলিলা ফল্গুর মত ভিতরে সর্ব্বদাই রহিয়াছে। কিন্তু আর পূর্বে্বর ন্যায় অস্থিরতা বোধ করিতাম না। এই সময়ে অন্য একটা ঘটনা আবার কয়েক দিনের জন্য আমাকে চঞ্চল করিয়া তুলিল। আমি তখন ষষ্ঠ বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্র, আমাদের টিকাটুলির বাড়ী হইতে কলেজে যাতায়াত করি। একদিন সকাল বেলা বাহিরের ঘরে বসিয়া আছি, এমন সময় একজন লোক জানালার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল এবং আমাকে লক্ষ্য করিয়া বলিল: “Your stars at present are very inauspicious, a great danger is impending,”অর্থাৎ “বর্ত্তমানে তোমার গ্রহগুলি অত্যন্ত অশুভ, শীঘ্রই একটা বড় রকমের বিপদ আসিতেছে।” সচরাচর যে সকল পাঞ্জাবী সামুদ্রিকেরা ঘুরিয়া বেড়ায় লোকটাকে দেখিয়া তাহাদেরই একজন বলিয়া মনে হইল কিন্তু উহার বেশভূষায় একটু যেন রকমফের ছিল। এই লোকগুলিকে আমি একেবারেই বরদাস্ত করিতে পারিতাম না, সুতরাং তৎক্ষণাৎ তাহাকে ভাগাইয়া দিতে চাহিলাম কিন্তু অত সহজে সে হটিল না, দৃঢ়তার সহিত বলিল যে, যাহা বলিয়াছে তাহার অব্যর্থ প্রমাণ সে দিতে পারে। ইহার আবার প্রমাণ কি করিয়া হইতে পারে আমার মাথায় আসিল না, কিন্তু একটু কৌতূহল হওয়ায় লোকটাকে ভিতরে আসিতে বলিলাম। ভিতরে আসিয়া তাহার পুটুলি হইতে একখানা আসন বাহির করিয়া মেঝেতে পাতিয়া লোকটা তাহার উপর বসিল। কনুই অবধি দুই হাত এবং হাঁটু অবধি দুই পা বেশ পরিষ্কাররূপে ধুইয়া বাড়ীর ভিতর হইতে একখানা আসন আনিয়া সে যেখানে বসিয়াছিল হার ৩/৪ হাত দূরে আমাকে বসিতে বলিল। আমি তাহার নির্দ্দেশ মত হাত পা ধুইয়া আসিয়া আসন পাতিয়া বসিলাম। সে তাহার পুটুলি হইতে একটুকরা ভাঙ্গা শ্লেট বাহির করিয়া তাহাতে দুইটি চিহ্ন আঁকিয়া আমাকে দেখাইল, একটি গুণন চিহ্ন (x), অপরটি অনেকটা ইংরাজী বড় হরফের প্রথম অক্ষরের মত, শুধু পেটকাটা দাগটি নাই (^)। পরে বুঝাইয়া বলিল যে, আমাকে জোড়াসনে হাত দুইটি মুষ্টিবদ্ধ করিয়া স্থির হইয়া বসিতে হইবে এবং সে একটি প্রক্রিয়া আরম্ভ করিবে। তাহার কাজ শেষ হইয়া গেলে দক্ষিণ মুষ্টিটি খুলিয়া যদি আমি দেখি যে, আমার হাতে প্রথম চিহ্নটি অঙ্কিত হইয়া আছে তাহা হইলে বুঝিতে হইবে যে, সমূহ আমার কোনও বিপদ নাই। কিন্তু যদি দেখি যে বাম হাতে দ্বিতীয় চিহ্নটি উঠিয়াছে তবে বুঝিতে হইবে যে, বিপদ আসন্ন। আমি তাহার নির্দ্দেশ মত স্থির হইয়া বসিলাম এবং সে তাহার পুটুলি হইতে কয়েকটি জিনিষ বাহির করিল। কালীঘাটের কালীর একখানা পট নিজের সম্মুখে বসাইল, দুইটি রুদ্রাক্ষ পটের দুইদিকে রাখিল এবং একটি পুঁতির মালা পরাইয়া দিল। তাহার পর স্থির হইয়া বসিয়া করজোড়ে একটি স্তব পাঠ আরম্ভ করিল। স্তবটি শেষ হইয়া গেলে কিছুক্ষণ একটি মন্ত্র আওড়াইল, এই কাৰ্য্য দুইটি সমাধা হইয়া যাইতে প্রায় ১৫ মিনিট সময় লাগিল। এইবার লোকটা আমাকে হাত দুইটি একে একে খুলিয়া দেখিতে বলিল। ডান হাত খুলিয়া দেখিলাম যে, সেখানে কিছুই নাই, পরিষ্কার যেরূপ ছিল সেইরূপই রহিয়াছে। কিন্তু বাঁ হাত খুলিয়াই দেখি যে, দ্বিতীয় চিহ্নটি স্পষ্ট সেখানে উঠিয়াছে, আমার মনে হইল কেহ যেন একখণ্ড অঙ্গার দিয়া চিহ্নটি পরিপাটিরূপে আঁকিয়া রাখিয়াছে। লোকটার নির্দ্দেশে বাঁ পা পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম যে, সেখানেও হাঁটুর ঠিক নীচে, পিছনের দিকে, অবিকল ঐ চিহ্নটি রহিয়াছে। আমি অতিমাত্রায় বিস্মিত হইলাম কিন্তু তথাপি লোকটাকে বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। আমার মনে হইল যে, এই ব্যাপারে কোথাও না কোথাও, একটা ফাঁকি নিশ্চয়ই আছে। প্রথমে ভাবিলাম যে, লোকটাবোধ হয় আমাকে হিপনটাইজ করিয়াছে। কথাটা মনে হইতেই বাড়ীর ভিতরে চলিয়া গেলাম, আমার বড় বৌদি এবং আরও কয়েকজনকে আমার হাত ও পা দেখাইলাম, সকলেই বলিল যে, চিহ্ন দুইটি বাস্তবিকই আছে। কিন্তু ইহাতেও আমি সন্তুষ্ট হইতে পারিলামনা। ‘Mass hypnotism” (একসঙ্গে অনেককে হিপনটাইজ করা) বলিয়াও একটা কথা আছে, ইহারাও তো নিকটেই ছিলেন, কেহ কেহ বারান্দা ও ভিতরের দরজা হইতে লোকটার কার্য্যকলাপ লক্ষ্য করিতেছিলেন, সুতরাং ইহাদের সাক্ষ্য বিশ্বাসযোগ্য না-ও হইতে পারে। পাচক রান্নাঘরে তাহার নিজ কাজে ব্যস্ত ছিল, সে এই ব্যাপারের কিছুই জানে না, সুতরাং তাহার সাক্ষ্য হয়তো অধিকতর নির্ভরযোগ্য হইতে পারে, এই ভরসায় তাহার নিকট গেলাম কিন্তু সে-ও বলিল যে, চিহ্ন দুইটি ঠিকই আছে। আমি ইহাতেও নিবৃত্ত হইলাম না, পাড়ায় বাহির হইয়া দুই তিন বাড়ী ঘুরিয়া আরও ৭/৮ জনকে ধরিলাম কিন্তু যখন সকলেই একবাক্যে বলিল যে, চিহ্ন দুইটি পরিষ্কারই আছে, তখন অগত্যা “mass hypnotism”-এর অনুমানটা ত্যাগই করিতে হইল। লোকটার নিকট ফিরিয়া আসিতেই সে বলিল: “আমার কথার প্রমাণ তো পাইয়াছেন কিন্তু ভয়ের কিছুই নাই। এই বিপদের কাটানও আমার জানা আছে। বেশী কিছু লাগিবে না, একখানা পুরান কাপড়, একটি সূচ, কিছু সূতা ও তিনটি টাকা হইলেই চলিয়া যাইবে।” আমি হাঁ না কিছুই বলিলাম না, ইচ্ছা হইতেছিল যে উহাকে ঘাড় ধরিয়া বাহির করিয়া দেই। কিন্তু কিছুই হইল না, বাড়ীর ভিতর হইতে আমার ডাক পড়িল এবং বৌদির নির্ব্বন্ধাতিশয্যে লোকটাকে তাহার প্রার্থিত জিনিষগুলি ও তিনটি টাকা দিয়াই বিদায় করিতে হইল। স্পষ্টই বুঝিলাম যে, সে আমাকে ঠকাইয়া গেল। এই ঘটনায় আমি এত বিরক্ত হইয়াছিলাম যে, ইহার ৩/৪ দিন পরে আমার এক প্রতিবেশী যখন আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন যে, লোকটা বাছিয়া বাছিয়া ওই সামান্য জিনিষ ক’টি চাহিয়া লইল কেন, উত্তরে আমি বলিয়াছিলাম যে, ওই পুরাতন কাপড়খানা সেলাই করিয়া যে আমার ভাগ্য মেরামত করিবে, আর ওই টাকা তিনটি পারিশ্রমিক। (অমৃতবাজার পত্রিকায় উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল কে. এম. মুন্সী মহাশয়ের যে চিঠিগুলি বাহির হইতেছে, তাহার একটিতে দেখিলাম যে মুন্সীজীর জীবনেও অনুরূপ একটি ঘটনা ঘটিয়াছিল)।
নিতান্ত অশ্রদ্ধার সহিত সেই সামুদ্রিকের কথাটা এখানে বিবৃত করিলাম কিন্তু মনে হইতেছে যে এতটা না করিলেই বোধ হয় সঙ্গত হইত, কারণ একটি বিষয়ে আমি এই সামুদ্রিকের নিকট বিশেষ ভাবে ঋণী। আমি তখন পুরাদস্তুর যুক্তিবাদী, সহজে কিছুই বিশ্বাস করিতে চাহিতাম না। এই ঘটনাকেও যাদুকরের কারসাজি বলিয়া উড়াইয়া দিতে চাহিয়াছিলাম, কিন্তু কেন জানি না, তাহা পারিলাম না। আমার যুক্তিবাদই প্রবল একটা ধাক্কা খাইল এবং যেন খানিকটা শিথিল হইয়া গেল। যুক্তি ও বুদ্ধির সাহায্যে যেন সব কিছুই বুঝিয়া উঠা যায় না, তাহাদের অধিকারেরও যেন একটা সীমা আছে, এরূপ একটা ধারণা নিজের অজ্ঞাতসারেই মনে দানা বাঁধিয়া উঠিল। ইহাও মনে হইল যে, যুক্তি ও বুদ্ধির যে পৰ্য্যন্ত অবিসংবাদিত অধিকার, তাহার মধ্যে অকারণে রহস্য টানিয়া আনিলে কুসংস্কারের আবর্তে পড়িতেই হইবে; আবার তাহাদের একাধিপত্য স্বীকার করিলে ঠকিতেই হইবে। পরবর্ত্তী জীবনে যে ক্রমে ক্রমে ঠাকুরের উপর কতকটা নির্ভর করিতে পারিয়াছি আমার বিশ্বাস যে এই ধারণাটা তাহাতে আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছে। কিন্তু তাহাই বা বলি কেন ? নিজেই তো দেখিয়াছি যে, ঠাকুরের দুর্নিবার আকর্ষণে কত তর্ক, কত যুক্তি স্রোতমুখে তৃণের মত ভাসিয়া গিয়াছে, কত অনমনীয় যুক্তিবাদী নির্ব্বিচারে তাহার শরণাপন্ন হইয়াছেন।
আর একটা কথা বলিলেই আমার এই ভণিতা শেষ হইয়া যায়। পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি যে, সাধু-সন্ন্যাসীদিগের পিছনে ঘোরা আমার বাতিক হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। কখন প্রবল হইয়া উঠিত, কখন বা আস্তে আস্তে মন্দা হইয়া যাইত, কিন্তু একেবারে ছাড়িয়া যাইতে চাহিত না। এম্.এ. পরীক্ষা দিয়া ঢাকায় ফিরিবার কিছুদিন পরে আমার এক আত্মীয় আমাকে জানাইলেন যে, সূত্রাপুর লোহার পুলের ঠিক পূর্ব্ব গায়ে একজন মুসলমান ফকীর আসিয়া আসন করিয়াছেন। তিনি সেখানে গিয়াছিলেন এবং তাহার বিশ্বাস হইয়াছে যে, ফকীর সাহেব একজন প্রকৃত মহাপুরুষ। সেইদিনই বৈকালে ফকীর সাহেবের নিকটে যাইয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম বহু লোক আসিয়া সেখানে জড় হইয়াছে, কেহ রাস্তার ধারে বসিয়া পড়িয়াছে, কেহ বা দাঁড়াইয়া আছে, প্রায় সকলেই উদগ্রীব হইয়া ফকীর সাহেবের দিকে তাকাইয়া আছে, কিন্তু তিনি নির্ব্বিকার, আপন মনেই নীরবে বসিয়া রহিয়াছেন। প্রায় এক ঘণ্টাকাল সেখানে অপেক্ষা করিলাম কিন্তু ফকীর সাহেবের কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করিলাম না। তিনি আপন মনেই রহিলেন, কাহারও দিকে একবার দৃকপাতও করিলেন না। আমি ফিরিয়া যাইতে উদ্যত হইয়াছি এমন সময়ে আমার পরিচিত এক কনেষ্টবলের সঙ্গে দেখা হইয়া গেল। সে আমাকে জানাইল যে, গভীর রাত্রিতে যখন লোকজন নিতান্তই অল্প থাকে, তখন ফকীর সাহেব দু’টা একটা কথা বলেন, অন্য সময় নির্ব্বাকই থাকেন। তাহার সহিত কথা কহিতে হইলে একটু বেশী রাত্রিতে আসা প্রয়োজন। আমি তৎক্ষণাৎ বাড়ী ফিরিয়া আসিলাম, তাড়াতাড়িতে ফকীর সাহেবের জন্য যে ফল কয়টি আনিয়াছিলাম তাহাও রাখিয়া আসিতে ভুল হইয়া গেল। বাড়ী ফিরিয়াই পাড়ার এক গাড়োয়ানের সঙ্গে বন্দোবস্ত করিলাম যে, সে আমাকে রাত্রি ১টার পর ফকীর সাহেবের নিকট লইয়া যাইবে। রাত্রি প্রায় দেড়টার সময় সেই ফল কয়টি লইয়া ফকীর সাহেবের আস্তানায় আসিয়া পৌঁছিলাম। গাড়ীটা পশ্চিম পারে রাখিয়া পুলটা হাঁটিয়াই পার হইলাম এবং অতি সন্তর্পণে ফল কয়টি ফকীর সাহেবের সম্মুখে রাখিয়া রাস্তার উপরেই বসিয়া পড়িলাম। প্রায় ২০ মিনিট নীরবেই কাটিয়া গেল, আমিও কিছু বলিলাম না, ফকীর সাহেবও কিছু বলিলেননা। হঠাৎ এক সময় ফকীর সাহেব অত্যন্ত তীব্র দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাইলেন এবং চিৎকার করিয়া বলিলেনঃ “ইধার উধার কাহে ঢুরতা ? আরামসে ঘরমে বৈঠ রহো, যব বকত হোগা, মিল্ যায়েগা।“ এই কথার পর আমি আর সেখানে অপেক্ষা করিলাম না, ফকীর সাহেবকে সেলাম করিয়া বাড়ী ফিরিয়া আসিলাম। আমার সাধু-খোঁজা বাতিক একেবারেই মিটিয়া গেল।
ঠাকুরের প্রসঙ্গ আরম্ভ করিবার পূর্ব্বে নিতান্ত প্রয়োজনবোধেই নিজের সম্বন্ধে এই কথা কয়টি বলিয়া লইতে হইল। আমি কি উদ্দেশ্যে এবং কি প্রকার মনোভাব লইয়া ঠাকুরের নিকট গিয়াছিলাম তাহা জানা না থাকিলে আমার ঠাকুরের সহিত প্রথম দিকের পরিচয় ও আনুষঙ্গিক কয়েকটি ব্যাপার পাঠক-পাঠিকাদের সহজবোধ্য হইবে না। হরেক রকম সাধুর পিছনে ঘুরিয়া ঘুরিয়া নিজের অজ্ঞাতসারে আমার মনের মধ্যে সাধু যাচাই করিবার একটা মাপকাঠি গড়িয়া উঠিয়াছিল। আমি স্থির বুঝিয়াছিলাম যে, আসক্তিমুক্ত না হইলে কেহই মতলবমুক্ত হইতে পারে না এবং যিনি যত চতুরই হউন না কেন, সতর্কদৃষ্টির সম্মুখে, দুদিন আগে বা দুদিন পরে, তাহার মতলববাজি ধরাপড়িতে বাধ্য। হঠাৎ কিছু করিয়া বসিলে যে পরে পস্তাইতে হইতে পারে, এই ধারণা আমার মনে বদ্ধমূল হইয়াছিল। আমার এই বিচার-বুদ্ধি ঠাকুরের সম্বন্ধে কতটা কার্য্যকরী হইয়াছিল যথাস্থানে পাঠক-পাঠিকারা তাহা জানিতে পারিবেন।