প্রথম অধ্যায় (২)

১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দের ১লা ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরীতে প্রবেশ করিবার পর প্রায় আড়াই বৎসর আমি পুরাতন বৈঠকখানায় একটি মেসে কাটাইয়াছিলাম। এইখানেই আমার বরদাবাবুর সহিত পরিচয় হয়। ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসের শেষের দিকে গ্রীষ্মাবকাশের পর মেসে ফিরিয়া দেখিলাম যে, একটি নূতন প্রাণীর আমদানি হইয়াছে। একতলার একটি ঘরে একজন নবাগত ভদ্রলোক আসিয়া অধিষ্ঠিত হইয়াছেন। ঐ ঘরে একটা তাসের আডডা ছিল, রবিবার প্রায় সমস্ত দিন এবং অন্যান্য দিন সন্ধ্যা হইতে রাত্রি দশটা পর্য্যন্ত এই আড্ডা নিয়মিত ভাবে চলিত এবং একটু লক্ষ্য করিতেই বুঝিলাম যে, এই নবাগত ভদ্রলোকটিও দু’চার দিনের মধ্যেই এই আড্ডার একটি অপরিহার্য অঙ্গ হইয়া উঠিয়াছেন। অনুমানে বুঝিয়াছিলাম যে, ইনি আমাদের প্রায় সমবয়সী কিন্তু মাথায় একটি চকচকে সুপরিসর টাক থাকায় ইহার চেহারাটা একটু ভারিক্কী মনে হইত। যাহাই হউক, ঐ ঘরে পূৰ্ব্ব হইতেই দুই সহোদর দুইখানা সিট অধিকার করিয়া ছিলেন, কৌতূহলবশতঃ তাহাদের একজনের নিকটে সন্ধান লইয়া জানিলাম যে, এই আগন্তুকটি উহাদেরই আত্মীয়, নাম বরদাচরণ রায়, বাড়ী বিক্রমপুর, এখানে কোন এক স্কুলে মাষ্টারী করেন এবং ল’ পড়েন। কাহারও সহিত আলাপ পরিচয় করিতে গোড়ার দিকে আমার অত্যন্ত মন্থর গতিতে চলাই অভ্যাস, সুতরাং এক মেসে থাকিলেও প্রায় দুই সপ্তাহ কাল ভদ্রলোকের সহিত আমার কোন বাক্যালাপই হইল না, হঠাৎ একদিন একটা অপ্রত্যাশিত রকমে বরদাবাবুর সহিত আমার আলাপ হইয়া গেল।

সেদিন ছিল রবিবার। উহাদের প্রাতঃকালীন তাসের আড্ডা বসি বসি করিতেছে এমন সময়ে মনে হইল যে, দুই সহোদরে একটা তর্ক বাধিয়া গিয়াছে। আমার দোতলার ঘর হইতে বিশেষ কিছুই বুঝিতে পারিলাম না, শুধু drop এবং letter, এই দুইটা কথা কয়েকবার কানে আসিল। ৫/৭ মিনিট পরেই তর্ক থামিয়া গেল, বুঝিতে পারিলাম যে, তাস খেলা সুরু হইয়া গিয়াছে। এই সময় কি একটা কাজে বারান্দায় যাইয়া দেখিলাম যে, বরদাবাবু নিজে খেলিতে বসেন নাই, দরজার নিকটে দাঁড়াইয়া আছেন। চোখাচোখি হইতেই আমি বরদাবাবুকে হাতছানির সাহায্যে উপরে আসিতে আহ্বান করিলাম, তিনিও তৎক্ষণাৎ আমার ঘরে উঠিয়া আসিলেন। তর্কের ব্যাপারটা জানিবার জন্য আমার এমন কৌতূহল হইয়াছিল যে, বরদাবাবুর সঙ্গে যে আমার এ পর্য্যন্ত বাক্যালাপও হয় নাই এবং তাহাকে এভাবে ডাকিয়া আনা যে অসঙ্গত এরূপ কোন কথাই আমার মনে হইলনা। ভাইয়ে ভাইয়ে এরূপ কথা কাটাকাটি প্রায়ই হইত এবং ইহা লইয়া আমরা মেসের অন্যান্য সকলেই বেশ আমোদ উপভোগ করিতাম। বরদাবাবু বলিলেন যে, ছোটভাই তাহার মামার নিকট একখানা পত্র লিখিয়া দাদাকে পড়িতে দিয়াছিলেন। পত্রের গোড়াতেই তিনি লিখিয়াছিলেন। “Very anxious, not a drop of letter for the last two months,”ইহা লইয়া তর্ক। দাদা বলিলেন যে, ‘drop of letter’কথাটা ভুল হইয়াছে কিন্তু ছোট ভাই তাহা কিছুতেই স্বীকার করিতে চাহিলেন না। আমি হাসিয়া উঠিলাম, বরদাবাবুও হাসিলেন, এবং এই হাস্য পরিহাসের ভিতর দিয়াই তাহার সহিত আমার পরিচয়ের সূত্রপাত হইল।

দু’চার দিনের মধ্যেই বরদাবাবু তাসের আড্ডা ছাড়িয়া দিলেন এবং অবসর সময়ে নিয়মিত আমার ঘরে আসিয়া বসিতে আরম্ভ করিলেন। তিনি পূর্ব্বে কখনও তামাক খাইতেন না কিন্তু আমার সংস্পর্শে আসিয়া হপ্তাখানেকের মধ্যেই তামাক টানিতে শিখিলেন ও তামাক সাজার কাজটাও সাগ্রহে নিজের হাতেই তুলিয়া লইলেন। রবিবার ভিন্ন অন্য দিন কাজকর্ম্মের তাগিদে সকালবেলা বসিবার বিশেষ সুবিধা হইত না কিন্তু আমাদের সান্ধ্য আড্ডাটি বেশ জমিয়া উঠিল। অধিকাংশ সময় আমরা দুইজনেই কথাবার্ত্তা বলিতাম, মাঝে মাঝে প্রভাতবাবুও আসিয়া জুটিতেন। তাসের আড্ডা হইতে অভিযোগ উঠিল যে, আমি বরদাবাবুকে যাদু করিয়া তাহাদের হাত হইতে ছিনাইয়া লইয়াছি এবং মেসের অন্যান্য মেম্বাররাও আমাদের এই নিয়মিত বিশ্রম্ভালাপ লইয়া ঠাট্টা বিদ্রুপ আরম্ভ করিলেন, কিন্তু এ সকল কিছুই আমরা গায়ে মাখিলাম না। কিছুদিন আমার মতিগতি লক্ষ্য করিয়া বরদাবাবু আমাদের আলোচনার মধ্যে ধীরে ধীরে দু’একটাধর্মপ্রসঙ্গ উত্থাপন করিতে লাগিলেন এবং এই বিষয়ে আমার ভিতরেও যে একটা আন্তরিক আকর্ষণ আছে, আমিও তাহা গোপন রাখিতে পারিলাম না। সুতরাং অতি শীঘ্রই ধর্ম-সংক্রান্ত নানা প্রকারের প্রশ্নই আমাদের আলোচনার প্রধান বিষয় হইয়া দাঁড়াইল। স্পষ্ট মনে আছে যে, সংসারত্যাগী সাধুদিগের বিরুদ্ধে কতকগুলি সস্তা, মামুলী বকুনি ঝাড়িয়া আমি প্রথম প্রথম বরদাবাবুকে নাজেহাল করিতে চেষ্টা করিতাম। সাধুরা কাপুরুষ, জীবনযুদ্ধের সম্মুখীন হইবার সাহস নাই বলিয়াই সংসার ছাড়িয়া সরিয়া পড়ে, তাহারা escapist, সমাজের কোন কাজেই লাগে না, অথচ সমাজের ঘাড়ে বসিয়া আরামে কালাতিপাত করে। যে সকল সাধু কোন না কোন সেবা প্রতিষ্ঠানের সহিত সংশ্লিষ্ট তাহাদিগকে বা কতকটা বরদাস্ত করা যাইতে পারে কিন্তু যাহারা সামাজিক দায়িত্ব এড়াইয়া চলে তাহাদের প্রয়োজনীয়তাই বা কি, উপকারিতাই বা কি? কিন্তু বাহ্যিক সমাজ সেবার পরিমাপে সাধুত্বের বিচার করিতে বরদাবাবু কিছুতেই স্বীকৃত হইতেন না, সুতরাং তর্ক লাগিয়াই থাকিত। বরদাবাবু একদিন আমাকে বলিলেনঃ “আপনি খাঁটি সাধু দেখেন নাই, সেইজন্যই এই সব বাজে তর্ক তোলেন।” আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম যে, তিনি নিজে কোন প্রকৃত সাধু দেখিয়াছেন কিনা এবং আমাকে দেখাইতে পারেন কিনা। উত্তরে বরদাবাবু বলিলেন যে, তিনি দেখিয়াছেন কিন্তু দেখাইতে পারিবেন কিনা তাহা বলিতে পারেন না।

ইহার পর বরদাবাবু ক্রমে একটু একটু করিয়া ঠাকুরের প্রসঙ্গ উত্থাপন করিতে লাগিলেন এবং কয়েক দিনের মধ্যেই আমার মনে ঠাকুরের সম্বন্ধে একটা বিশেষ কৌতূহলের উদ্রেক হইল। কিন্তু বরদাবাবুকে বিশেষ কিছুই জানিতে দিলাম না। তর্ক আগের মতই চালাইয়া গেলাম এবং বরদাবাবুর ঠাকুরকেও মোটেই আমল দিতে চাহিলাম না। বরদাবাবু কিন্তু মোটেই দমিলেন না, প্রায় প্রত্যহই ঠাকুর সম্বন্ধে কিছু না কিছু বলিতেন এবং একদিন কথাপ্রসঙ্গে আমাকে জানাইলেন যে, কবিবর নবীনচন্দ্র সেন তাহার “আমার জীবন” গ্রন্থে ঠাকুরের সম্বন্ধে ছোট একটি নিবন্ধ লিখিয়া গিয়াছেন। পরের দিনই কলেজ লাইব্রেরীতে যাইয়া নিবন্ধটি পড়িলাম, ইহাতে ঠাকুরকে একবার দেখিবার আগ্রহ অদম্য হইয়া উঠিল। ইহার কয়েক দিন পরে বরদাবাবু ঠাকুরের একখানা ফটো আনিয়া আমাকে দেখাইলেন। উপর উপর দেখিয়া বেশী কিছু নজরে পড়িল না, সামান্য একখানা ধুতি পরিধান করিয়া নগ্নগাত্রে, মুক্তাসনে, যজ্ঞোপবীতধারী একজন ব্রাহ্মণ বসিয়া রহিয়াছেন, বিশেষের মধ্যে শুধু গলায় একছড়া তুলসীর মালা। কিন্তু আমার দুটা একটা লক্ষণ জানা ছিল, সেগুলি মিলাইয়া পাইতেই মনটা উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। মুখে কিছুই বলিলাম না কিন্তু ভিতরে ভিতরে ঠাকুরের প্রতি একটা ঐকান্তিক আকর্ষণ অনুভব করিতে লাগিলাম। ইহার পর হইতে আমাদের তর্কের তীব্রতা অনেকটা কমিয়া গেল, বরদাবাবুও সাগ্রহে ঠাকুরের সম্বন্ধে নানাবিধ প্রসঙ্গের অবতারণা করিতে লাগিলেন। ঠাকুর ও তদীয় গুরু সম্বন্ধে কয়েকটা অলৌকিক কাহিনী বরদাবাবু আমাকে জানাইয়াছিলেন স্মরণ আছে, কিন্তু এগুলি যে তখন নির্ব্বিচারে বিশ্বাস করিয়াছিলাম, এ কথা বলিলে সত্যের অপলাপ করা হইবে।

অবশেষে সেই অতি শুভ দিনটি আসিল, ঠাকুরের সাক্ষাৎ দর্শন পাইলাম। যতদূর স্মরণ হয়, সময়টা বোধ হয় ১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ, তারিখটা কিছুতেই মনে পড়িতেছে না। বন্ধুবর পরলোকগত খ্যাতনামা অধ্যাপক ৺বেণীমাধব বড়ুয়া তখন শিয়ালদহ ষ্টেশনের উল্টা দিকে একটা বাড়ীতে থাকিতেন। আমি সন্ধ্যার পর সেখানে গিয়াছিলাম, ডক্টর বড়ুয়া অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে অশোকের কোনও এক শিলালিপি সম্বন্ধে তাহার এক নূতন আবিষ্কারের কথা আমাকে বুঝাইতেছিলেন। এমন সময় দেখি যে, বরদাবাবু সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। তিনি জনান্তিকে আমাকে জানাইলেন যে, ঠাকুর কলিকাতা আসিয়াছেন এবং শীঘ্র চলিয়া গেলে তখনই তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইতে পারে। কিন্তু ডক্টর বড়ুয়া আমাকে সহজে ছাড়িলেন না এবং আমার যে বিশেষ কোনও গরজ নাই, শুধু তাহার খাতিরেই যাইতেছি, বরদাবাবুকে ইহা বুঝাইবার জন্য ইচ্ছা করিয়াই একটু বিলম্ব করিলাম। রাস্তায় বাহির হইয়া দেখিলাম যে, ৯টা বাজিয়া গিয়াছে। আমি বলিলামঃ “আজ রাত্রি হইয়া গিয়াছে, ঠাকুরকে বিরক্ত না করাই ভাল, কাল প্রাতেই না হয় যাইব।” কিন্তু বরদাবাবু আমার কথা আমলেই আনিলেন না এবং তাহার আগ্রহাতিশয্যে শেষ পর্য্যন্ত যাইতেই হইল। ঠাকুর আসিয়া উঠিয়াছিলেন ১৮৬ নং বৌবাজারে তেতলার একটি মেসে। এখানে প্রধানতঃ নিকটবর্ত্তী কাপড় ও কাটা কাপড়ের দোকানের কর্ম্মচারীরা থাকিতেন। আমরা তেতলায় যাইয়া পৌঁছিতেই এক ভদ্রলোক অগ্রসর হইয়া আসিলেন। তিনি জানাইলেন যে, ঠাকুর বিশ্রাম করিতেছেন, রাত্রিও হইয়াছে, এ সময়ে তাঁহাকে বিরক্ত না করিয়া আমাদের ফিরিয়া যাওয়াই সঙ্গত। আমি তৎক্ষণাৎ ফিরিতে উদ্যত হইলাম কিন্তু বরদাবাবু এক রকম জোর করিয়াই আমাকে ঠাকুরের ঘরে লইয়া গেলেন, ভদ্রলোকের আপত্তি গ্রাহ্য করিলেন না। নাতিবৃহৎ একখানি ঘর, তিনখানা তক্তাপোশ পাতা রহিয়াছে। তাহারই একখানিতে চাদর মুড়ি দিয়া ঠাকুর শুইয়া রহিয়াছেন। তাঁহাকে এই অবস্থায় দেখিয়া আমি পুনরায় বরদাবাবুকে বলিলাম যে, আমাদের চলিয়া যাওয়াই যুক্তিযুক্ত কিন্তু বরদাবাবু নাছোড়বান্দা, সুতরাং একখানা তক্তাপোশের উপর নীরবে বসিয়া রহিলাম। এইভাবে প্রায় দশ মিনিট কাটিয়া যাইবার পর হঠাৎ ঠাকুর উঠিয়া বসিলেন এবং বরদাবাবুকে কুশল প্রশ্নাদি করিলেন। আমি ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া পূৰ্ব্ববৎ নীরবেই বসিয়া রহিলাম। একটু পরে ঠাকুর নিজ হইতেই কথা বলিতে আরম্ভ করিলেন। কি বলিয়াছিলেন কিছুই স্মরণ নাই, শুধু এলোমেলোভাবে দু’একটা কথা মনে পড়িতেছে। একবার যেন বলিয়াছিলেন যে, গাঢ় ঘুমের সময় কিছুই থাকে না, মন বুদ্ধির ক্রিয়াও বন্ধ হইয়া যায় এবং সত্যের এরূপ একটা লক্ষণ যেন দিয়াছিলেন যে যাহা কিছুতেই

বর্জ্জন করা যায় না, তাহাই সত্য। অন্ধকার ও আলো একত্রে থাকিতে পারে না, এই কথাটার সূত্র ধরিয়াও খানিকটা কি বলিয়াছিলেন, মনে পড়ে। পরে ঠাকুরের মুখে যাহা শুনিয়াছি তাহার সাহায্যে এই কথা কয়টি মিলাইয়া একটা কিছু দাঁড় করাইয়া দিতে অনায়াসেই পারি। কিন্তু সে আমার কথা হইবে, ঠাকুরের কথা হইবে না। এই প্রথম সাক্ষাতের দিনে ঠাকুরের সেই অপূৰ্ব্ব মূর্ত্তিটিও যে আমার মনে কোন আলোড়নের সৃষ্টি করিয়াছিল, এমন কথা বলিতে পারিনা। সেখানে বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ছিল না, ঘরের এক কোণায় টিমটিম্ করিয়া একটা হারিকেন জ্বলিতেছিল, সেই অস্পষ্ট আলোকে তাঁহাকে একটু বিশেষভাবে লক্ষ্য করিয়া দেখিবার সুযোগই হয় নাই। কিন্তু তাঁহার  সেই অপরূপ কথা বলার ভঙ্গীটি প্রথম হইতেই আমাকে আকৃষ্ট করিয়াছিল। প্রায় ২০ মিনিট একটানা কথা বলিয়া গেলেন, তাঁহার সেই শান্ত, মধুর স্বরপ্রবাহ এক ভাবেই চলিল। কোন উত্থান-পতন নাই, সহজ, স্বাভাবিক ভাবে যেন আপনা হইতেই বাহির হইয়া আসিতেছে। কিন্তু যে ইহা নিজে কখন শুনে নাই, তাহাকে সহজে এই ব্যাপারটা বুঝান যাইবে না।

আরও একটা কথা এইখানে বলিয়া রাখা সমীচীন মনে হইতেছে। ঠাকুর  উঠিয়া বসিলেন, ফটোতে যাহা দেখিয়াছিলাম প্রায় সেইরূপই দেখিলাম, পরিধানে অতি সাধারণ একখানা থান ধুতি, গাত্র সম্পূর্ণ নগ্ন, স্কন্ধে যজ্ঞোপবীত এবং গলায় এক ছড়া তুলসীর মালা। সাধূচিত বেশভূষার কিছুই তাঁহার নাই, সুতরাং আচমকা অভিভূত হইবার মত কিছুই সেখানে ছিল না। কিন্তু সেখানে যাহা দেখিলাম, অন্য কোথাও তাহা দেখিয়াছি বলিয়া মনে পড়ে না। পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি যে, দীর্ঘ ৪/৫ বৎসর ব্যাপিয়া অনেক সাধুসন্ন্যাসী ঘাঁটিয়া আসিয়াছি, যেখানে গিয়াছি সেখানেই মনে হইয়াছে যে, সাধুজী যেন অনেক উচ্চে বসিয়া রহিয়াছেন এবং সেখান হইতে নেহাৎ কৃপা করিয়া আমাদের উপর উপদেশবাণী বর্ষণ করিতেছেন। তাঁহার এবং অন্যান্য সকলের মধ্যে একটা পার্থক্য যেন স্বতঃই সেখানে বিরাজমান এবং সাধুজীও এ সম্বন্ধে যেন বিশেষভাবেই সজাগ। কোন কোন ক্ষেত্রে সঙ্কোচে এবং একটা অস্বাভাবিক পরিবেশে অস্বস্তি বোধ করিয়াছি। কিন্তু প্রথম সাক্ষাতের দিনেই ঠাকুরের নিকট বসিয়া এবং তাহার কথাবার্ত্তা শুনিয়া মনে হইল যেন তিনি আমাদেরই একজন, নিতান্ত অন্তরঙ্গের মতই আলাপ আলোচনা করিতেছেন। আমার বক্তব্যটা বুঝাইতে পারিলাম কিনা জানি না, কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে কথাটা আরও একাধিকবার আসিবে এবং ভরসা করি যে ক্রমে পরিস্ফুট হইয়া উঠিবে।

রাত্রি হইয়াছিল, সুতরাং ঠাকুরের কথা শেষ হওয়ার দু’চার মিনিট পরেই তাঁহাকে প্রণাম করিয়া আমরা মেসের দিকে রওয়ানা হইলাম। পথে বরদাবাবু আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ “ঠাকুরকে কেমন দেখলেন ?” উত্তরে আমি কি বলিয়াছিলাম স্মরণ করিতে পারিতেছিনা। যাহাই হউক, পরের দিন প্রাতঃকালে প্রভাতবাবুকে সংবাদ দিয়া আসিলাম, স্থির হইল যে কলেজের পর ৪টা নাগাদ একত্রে ঠাকুরের নিকট যাইব। নির্দ্দিষ্ট সময়ে বরদাবাবু ও প্রভাতবাবুকে সঙ্গে লইয়া আবার ঠাকুর দর্শনে আসিলাম। সেই ১৮৬ নং বৌবাজার তেতলার একটি বড় ঘরে একখানা সতরঞ্চি বিছান রহিয়াছে, একদিকে ঠাকুর বসিয়া রহিয়াছেন এবং তাঁহার সম্মুখে বসিয়া কতিপয় ভদ্রলোক নিবিষ্ট মনে তাঁহার কথা শুনিতেছেন। আমরা যাইয়া প্রণাম করিতেই ঠাকুর অভ্যর্থনা করিয়া আমাদের বসাইলেন, একটু যেন বিশেষ আদর আপ্যায়ন করিলেন। ইহার কারণ তখন কিছু বুঝি নাই কিন্তু কিছুকাল ঠাকুরের সঙ্গ করিবার পর কতকটা যেন বুঝিতে পারিয়াছিলাম এবং যথাস্থানে কথাটার আলোচনা করিব। আমরা আসিতেই ঠাকুর নীরব হইয়া রহিলেন এবং অন্যান্য সকলে কৌতূহলী দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকাইতে লাগিলেন। প্রভাতবাবু ধীরে ধীরে তাহার প্রশ্নের অবতারণা করিলেন। প্রশ্নটি উত্থাপন করিতে বন্ধুবরের প্রায় আধঘন্টা সময় লাগিয়াছিল। অনেক কথাই তিনি বলিয়াছিলেন, তাহার মধ্যে সামান্য দু’চারটি এখনও আমার স্মরণে আছে।প্রভাতবাবু বলিয়াছিলেন যে, কেহ ভীমনাগের সন্দেশ খায়, কেহ চানাচুর ও পায় না, এই বৈষম্যের কি প্রয়োজন ছিল? তিনি এক ছিলেন, এক থাকিলেই তো পারিতেন, বহু হইয়া প্রকাশ হইতে তাঁহাকে কে বলিয়াছিল ? আর একটা কথাও বেশ স্পষ্ট মনে আছে। প্রভাতবাবু কি একটা শব্দের প্রসঙ্গে বতুপ প্রত্যয় কথাটা ব্যবহার করিয়াছিলেন। ঠাকুর জিজ্ঞাসা করিলেনঃ “বতুপ কি ?” তৎক্ষণাৎ প্রভাতবাবু ব্যাকরণের একটি সূত্র ঝাড়িয়া দিলেন। বরদাবাবুই না কে যেন বলিলেনঃ “উনি ত আর গ্রামার পড়েন নাই।“ বিশেষ করিয়া কথাটা মনে আছে এই জন্য যে পরে প্রভাতবাবু অনেক সময়ে আক্ষেপ করিয়া বলিতেন যে, তিনি এমন একটা হস্তিমূর্খ যে ঠাকুরকে গিয়াছিলেন বতুপ প্রত্যয় বুঝাইতে।

প্রভাতবাবু যে প্রশ্নটা করিলেন, পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে ঠিক এই প্রশ্নটাই আমার মনে দানা বাঁধিয়াছিল এবং মাঝে মাঝে আমাকে উত্যক্ত করিয়া তুলিত, সুতরাং অত্যন্ত মনোযোগের সহিত ঠাকুরের উত্তর শুনিবার জন্য প্রস্তুত হইলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় ঠাকুর কি বলিয়াছিলেন তাহার প্রায় কিছুই স্মরণে আসিতেছে না। শুধু এইটুকুই মনে আছে যে, “সবই ভ্রান্তি” এই কথাটা বলিয়াই ঠাকুর তাঁহার উত্তর আরম্ভ করিয়াছিলেন। ঠাকুর একটানা অনেকক্ষণ বলিয়াছিলেন, স্পষ্ট মনে আছে যে, আমরা যখন তাঁহাকে প্রণাম করিয়া বাহির হইয়া আসি তখন রাস্তায় আলো জ্বলিয়াছে। কিন্তু তাঁহার কথা মোটেই বুঝিলাম না, আমাদের সমস্যার কোন মীমাংসা হইল না। কিন্তু সেদিন যে ঠাকুরের কাছে কিছুই পাই নাই, এমন কথাও বলিতে পারিনা। কথা বলিতে বলিতে মাঝে মাঝে, ঠাকুর এক অপূর্ব্ব ভঙ্গীতে আমার দিকে তাকাইতেছিলেন। যাহারা ঠাকুরের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে মিশিয়াছেন এবং একটু নিবিষ্ট মনে তাঁহার গতিবিধি লক্ষ্য করিয়াছেন, তাহারা অনেকেই অল্প বিস্তর এই স্নেহ-স্নিগ্ধ দৃষ্টির সহিত পরিচিত, কিন্তু শুধু স্নেহ-স্নিগ্ধ বলিলে কিছুই বলা হইল না। এই দৃষ্টিকে বিশদ করিয়া বুঝাইবার ভাষা আমার জানা নাই, শুধু এইটুকু বলিয়াই ক্ষান্ত হইব যে, ইহাতে পাইয়াছিলাম প্রাণস্পর্শী আশ্বাস ও এক অবর্ণনীয় আকর্ষণ। কিন্তু সেই দ্বিতীয় সাক্ষাতের দিনেই যে এতটা ভাবিয়াছিলাম বা বুঝিয়াছিলাম, তাহাও বলিতে পারি না। ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া রাস্তায় নামিয়া আসিয়া সিগারেট সহযোগে আমাদের মতামত জাহির করিয়াছিলাম, বেশ মনে আছে। প্রভাতবাবু বলিয়াছিলেন যে, ইনি একজন যোগী, সন্দেহ নাই, কিন্তু মনে হইল যেন কখন যুক্ত থাকেন, কখন যুক্ত থাকেন না ; স্থৈর্য্যও অনেকটা আয়ত্ত করিয়াছেন কিন্তু কথাবার্ত্তা যাহা বলিলেন তাহার মাথা মুণ্ড কিছুই বুঝা গেলনা। আমি কিছু বলিয়াছিলাম কিনা স্মরণ করিতে পারিতেছি না কিন্তু এইটুকু স্পষ্ট মনে আছে যে, আমাদের কথাবার্ত্তায় বিরক্ত হইয়া বরদাবাবু মুখ ভার করিয়া চলিয়া গিয়াছিলেন। পরবর্ত্তী জীবনে এই ব্যাপারটা লইয়া নিজেদের মধ্যে কত রহস্যালাপ ও কত আনন্দই করিয়াছি!

পরের দিন প্রাতঃকালে বরদাবাবুর ঐকান্তিক আগ্রহে আবার ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করিতে আসিলাম। আমরা উপস্থিত হইয়া দেখিলাম যে, কয়েকজন ভদ্রলোক বসিয়া রহিয়াছেন এবং ঠাকুর বুদ্ধ সম্বন্ধে কি যেন বলিতেছেন। দু’চার মিনিট ঠাকুরের কথা শুনিয়াই আমার মেজাজ বিগড়াইয়া গেল। আমার মনে হইল যে, ঠাকুর বুদ্ধদেবের বাস্তবিকতা উড়াইয়া দিয়া তাহাকে একটি রূপক কল্পনা করিয়া আলোচনা করিতেছেন। তৎক্ষণাৎ আমার ঐতিহাসিক বুদ্ধি জাগ্রত হইয়া উঠিল, আর সেখানে বসিয়া থাকিতে ইচ্ছা হইল না। বরদাবাবুও বিশেষ পীড়াপীড়ি করিলেননা, সুতরাং অল্প কিছুক্ষণ পরেই ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া বাহিরে চলিয়া আসিলাম। রাস্তায় বরদাবাবুকে বলিলাম যে, আমার এখানে পোষাইবে না, অযথা ঘোরাঘুরি করিয়া কোন লাভ হইবে না, বরদাবাবু বিশেষ কিছু বলিলেন না, নীরবেই মেসে ফিরিয়া আসিলাম।