প্রথম অধ্যায় (৩)

সে যাত্রায় আর ঠাকুরের দর্শন পাইলাম না, শুনিলাম তিনি বৃন্দাবন চলিয়া গিয়াছেন, এখন কিছুকাল সেখানেই অবস্থান করিবেন। যদিও সেদিন হঠকারিতা করিয়া ঠাকুরের নিকট হইতে চলিয়া আসিয়াছিলাম, তথাপি খবরটা শুনিয়া মনটা যেন খারাপ হইয়া গেল, ভাবিলাম যে আরও এক আধবার দেখা হইলে বোধ হয় মন্দ হইতো না। দু’এক দিন পরে বরদাবাবু বলিলেন যে, আমি ও প্রভাতবাবু যেদিন একত্রে ঠাকুর দর্শনে গিয়াছিলাম সেদিন এক ভদ্রলোক পূর্ব্ব হইতেই ঠাকুরের নিকটে বসিয়াছিলেন এবং আমরা চলিয়া আসার পর ও কিছুক্ষণ  সেখানে অপেক্ষা করিয়াছিলেন। তিনি নাকি বলিয়াছেন যে, আমরা ঠাকুরের নিকট উপস্থিত হইবার কিছুক্ষণ পূর্ব্বে তিনি হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন: “দুইটা জাহাজ আসতে আছে। “আমরা ফিরিয়া আসিবার পর আবার নাকি বলিয়াছিলেন: “জাহাজ দুইটা আইসা একটা ফ্ল্যাট-নৌকার সঙ্গে ধাক্কা খাইল, ফ্ল্যাট-নৌকার কিছুই হইলনা, জাহাজ দুইটাই ঝাঁকানি খাইয়া গেল। “কথাটা শুনামাত্রই আমার মনের মধ্যে একটা আলোড়নের সৃষ্টি হইল কিন্তু মুখে কিছুই বলিলাম না। “জাহাজ” কথাটা এরূপ স্থলে সাধারণতঃ ব্যঙ্গার্থেই ব্যবহৃত হয় কিন্তু সেজন্য ঠাকুরের প্রতি কোন বিরুদ্ধ ভাব মনের কোণেও স্থান পাইল না, ভাবিলাম যে আমি গিয়াছিলাম আমার বিদ্যাবুদ্ধির অভিমান, আমার বিচার – কুশলতার অভিমান ও আমার অভিজ্ঞতার অভিমান লইয়া ঠাকুরকে যাচাই করিতে এবং ভিতরে ভিতরে যে একটু ঔদ্ধত্য ও ছিল না, তাহাও হলফ করিয়া বলিতে পারি না। সুতরাং ঠাকুর যদি আমাকে একটা অভিমানের “জাহাজ” বলিয়া অভিহিত করিয়া থাকেন, তাহাতে ক্ষুব্ধ হইবার কিছুই থাকিতে পারে না। আর, ঝাঁকানি যে একটা খাইয়াছিলাম, তাহা বুঝিতেও বিলম্ব হইল না। বসিয়া বসিয়া ভাবিতাম যে, ঠাকুরকে যেন ঠিক শ্রদ্ধার চক্ষে দেখি নাই, নিজে কোন কথা বলি ও নাই, সবই যেন কেমন এলোমেলো হইয়া গিয়াছে। আর একবার দেখা হইলে খোলাখুলি কথাবার্তা বলিয়া একবার দেখিতাম যে, বাস্তবিকই তাঁহার উপর নির্ভর করিতে পারি কিনা। আর মাঝে মাঝে তাঁহার সেই মনোলোভা চাহনি আমার চক্ষুর সন্মুখে ফুটিয়া উঠিয়া আমাকে প্রবল ভাবে ঠাকুরের দিকে আকর্ষণ করিত, আমি ভিতরে ভিতরে অস্হির হইয়া উঠিতাম।

কিন্তু আমার এই অবস্থাটা গোপনেই রাখিলাম, বরদাবাবুকে ইহার কিছুই জানিতে দিলাম না। মাঝে মাঝে ঠাকুর প্রসঙ্গ উঠিত কিন্তু পূর্ব্বের মত আর জমিতে চাহিত না। যতদূর স্মরণ হয় ঠাকুরের বৃন্দাবন চলিয়া যাওয়ার কয়েকদিন পরে প্রভাতবাবু একদিন একখানা চিঠি আনিয়া আমাকে দেখাইলেন। বারদীর শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার শিষ্য, “ধর্ম্মসার সংগ্রহ” নামক গ্রন্থ-প্রণেতা ঁযামিনীমোহন মুখোপাধ্যায় মহাশয় এক ভদ্রলোক মারফৎ চিঠিখানা ঠাকুরকে লিখিয়াছিলেন। চিঠিখানার বয়ান এখনও আমার মনে আছে। ইহাতে মুখোপাধ্যায় মহাশয় লিখিয়াছিলেন: “রাম, তুমি নাকি বলিয়াছ যে আমার গুরুদেব আবার দেহ পরিগ্রহ করিয়াছেন। তোমাকে আমি মুক্ত পুরুষ বলিয়া বিশ্বাস করি এবং তুমি যাহা বলিয়াছ তাহা মিথ্যা হইতে পারে না। আমার বিনীত অনুরোধ যে গুরুদেব কোথায় কিভাবে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন তাহা আমাকে জানাইয়া অনুগৃহীত করিবা। “প্রভাতবাবু বলিলেন যে, যামিনীবাবুর মত একজন কৃতবিদ্য ও ধর্ম্মপ্রান ব্যক্তি যাঁহাকে মুক্ত পুরুষ বলিয়া বিশ্বাস করেন তিনি কখনই একজন সাধারণ লোক হইতে পারেন না, সুতরাং ঠাকুরকে আর একবার বেশ ভালো করিয়া বাজাইয়া দেখিতে হইবে। আমার তৎকালীন মানসিক অবস্থায় ঠাকুরের সম্বন্ধে পরের মুখে ঝাল খাইবার ইচ্ছা আমার আদৌও ছিল না, তথাপি এই চিঠিখানা যে আমার মনের উপর কোন প্রভাবই বিস্তার করে নাই, একথা বলাও বোধহয় সঙ্গত হইবে না।

কয়েকদিনের মধ্যেই পূজার ছুটি আসিয়া পড়িল এবং আমি ঢাকা চলিয়া গেলাম। কিন্তু ঠাকুর আমাকে পাইয়া বসিয়াছিলেন,  বরদাবাবুর ইন্ধনের আর কোন প্রয়োজন ছিল না। ঢাকায় নূতন পরিবেশের মধ্যে আসিয়াও আমার ভিতরের অবস্থার বিশেষ কোনও পরিবর্ত্ত্ন হইল না। বেশ বুঝিতে পারিতাম যে, ঠাকুর আমাকে তাঁহার নিকট টানিতেছেন কিন্তু মনে প্রাণে সাড়া দিতে পারিতাম না। ঢাকায় গেলে আমি সাধারণতঃ প্রফুল্লবাবু (প্রফুল্লরঞ্জন চক্রবর্ত্তী,  স্কুলে ও  কিছুদিন কলেজে আমার সহপাঠী ছিলেন,  পরে বিবাহ সূত্রে ইহার সহিত আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা হইয়াছিল) ও হরিদাসবাবুর (শ্রী হরিদাস আচার্য্য, আমার শ্বশুরবাড়ির নিকটে ইহার বাড়ি ছিল,  প্রফুল্লবাবুর মাধ্যমে ইহার সহিত আমার পরিচয় হয় এবং ক্রমে সেই পরিচয় অন্তরঙ্গতায় পরিণত হয়) সঙ্গেই অধিকাংশ সময় কাটাইতাম, নানাপ্রকার গল্পগুজব,  তাস, দাবা, মাঝে মাঝে নৌকাভ্রমণ এবং কখনো বা একটু বিশেষ খানাপিনায় সময়টা আনন্দেই কাটিয়া যাইত, টেরও পাইতাম না। এবার কিন্তু জমিতে চাহিল না। অনেকবার বলি বলি করিয়া অবশেষে প্রফুল্লবাবু ও হরিদাসবাবুকে ঠাকুরের কথাটা বলিয়াই ফেলিলাম, হরিদাসবাবু নীরবেই রহিলেন কিন্তু প্রফুল্লবাবু মন্তব্য করিলেন: “বুঝেছি, তোমার মত একটা পাষন্ডকেও যখন টলাইয়াছে, তখন লোকটা নিশ্চয়ই একটু বেশী পাকা। “ইহার পর আর অগ্রসর হওয়া চলে না, সুতরাং প্রসঙ্গটা ঐখানেই চাপা পড়িয়া গেল।

ছুটির শেষে কলিকাতায় ফিরিয়া আসিলাম,  আবার সেই আমি ও বরদাবাবু।   ঠাকুর কোথায় আছেন এবং কবে পর্যন্ত্য কলিকাতায় আসিবেন,  বরদাবাবুকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করিতে সর্ব্বদাই ইচ্ছা হইত, কিন্তু আমার সেই হটকারিতার কথা মনে করিয়া কিছুতেই পারিতাম না। কি প্রসঙ্গে  কথাটা উঠিয়াছিল ঠিক মনে নাই, বরদাবাবু একদিন বলিলেন যে, ঠাকুর বৃন্দাবনে অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছিলেন, শীঘ্রই কলিকাতা আসিবেন। আমি বাহ্যিক বিশেষ কোনও আগ্রহ দেখাইলাম না কিন্তু মনে মনে দিন গুণিতে লাগিলাম। কয়েক দিন পরে বরদাবাবু বলিলেন যে, ঠাকুর আসিয়াছেন এবং পটুয়াটোলায় ঁসত্যেন্দ্রচন্দ্র মিত্র মহাশয়ের(সুপরিচিত কংগ্রেসকর্ম্মী, পুরাতন সংবিধানে ইনি ব্যবস্থাপক সভার সভাপতি নির্ব্বাচিত হ’ন ;শুনিয়াছি যে জাজিরা চরে অন্তরীণ থাকার সময় ঠাকুরের সহিত ইহার প্রথম পরিচয় হয়) বাসায় উঠিয়াছেন। আমি কি বলিয়াছিলাম স্মরণ নাই কিন্তু বরদাবাবু যখন জিজ্ঞাসা করিলেন যে, আমি ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করিতে যাইব কিনা, তখন এমন ভাব দেখাইলাম যে আমার যাওয়া না-যাওয়াতে বিশেষ কোনই ক্ষতিবৃদ্ধি নাই, শুধু বরদাবাবুর খাতিরেই যেন যাইতে সন্মত হইতেছি।

পরের দিন সকাল বেলা বরদাবাবুর সহিত ঠাকুর দর্শনে আসিলাম। এইটি আমার জীবনের একটি অতি শুভ দিন কিন্তু নিতান্ত দুঃখের বিষয় যে তারিখটা কিছুতেই স্মরণ করিতে পারিতেছি না। শুধু এটুকুই মনে পড়ে যে সময়টা ছিল শীতকাল, সম্ভবতঃ ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী কি ফেব্রুয়ারী মাস। আমরা ঘরে ঢুকিতেই বরদাবাবু “ইন্দুবাবু” বলিয়া ঠাকুরের নিকট পরিচিত করিলেন। আমি প্রণাম করিয়া উঠিতেই ঠাকুর জিজ্ঞাসা করিলেন:” ভালো আছেন?”দুইটি মাত্র কথা, কিন্তু ইহাতে যে কি ছিল, তাহা আমি কিছুতেই বুঝাইয়া বলিতে পারিব না। কত স্নেহ ,  কত আশ্বাস,  কত স্বান্তনা,  যে এই কথা দুইটির মধ্যে ছিল,  তাহা অপরকে বুঝান যাইবে না। শুধু ইহাই বলিতে পারি যে, আমি নিঃসন্দেহে বুঝিলাম যে তিনি আমাকে আপন করিয়া লইলেন। ঘরে প্রবেশ করিয়া যখন প্রথম ঠাকুরকে দেখিলাম,  তখনই তাঁহার রোগ-কাতর মূর্ত্তি দেখিয়া হৃদয়ে দারুণ বেদনা অনুভব করিয়াছিলাম। কন্ঠা বাহির হইয়া পড়িয়াছে,  বহুদিন ক্ষৌরকার্য্য বন্ধ থাকায় মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, রোগ-শীর্ণ দেহ,  ধীরে ধীরে যেন অতি কষ্টে কথাবার্ত্তা বলিতেছেন,  এই দৃশ্য দেখিয়া আমার চোখে জল আসিবার উপক্রম হইল। তিনি যে আমার অত্যন্ত আপনার জন ইহা যেন স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম। একটা বিপর্য্যয় হইয়া গেল। আমার বিদ্যাভিমান, আমার সমস্যা,  আমার বিচার-বিতর্ক,  সবই যেন স্রোতমুখে তৃণের মত ভাসিয়া গেল, আমি অজানিতে ঠাকুরের নিকট আত্মসমর্পণ করিয়া বসিলাম। প্রীতির বাঁধনে তিনি আমাকে আটকাইয়া ফেলিলেন।

ঘন্টাখানেক পরে ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া বাহির হইয়া আসিলাম,  বরদাবাবুকে বিশেষ কিছুই বলিলাম না, তিনিও কিছু জিজ্ঞাসা করিলেন না, অন্য একটা মুখরোচক ব্যাপার হাতের কাছেই ছিল এবং সেই বিষয়েই আমাদের কতাবার্ত্তা হইল। বৃন্দাবন থাকাকালীন ঠাকুরের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়। ভদ্রলোকটি তিলকমালা-ভূষিত,  দীর্ঘশীখ , একজন নৈষ্ঠিক বৈষ্ণব। আমরা আসিয়া দেখি যে, তিনি দুইজন শিষ্য সমভিব্যাহারে ঠাকুরের নিকট বসিয়া রহিয়াছেন। হয়তো অনেকক্ষণ আসিয়াছিলেন, কারণ আমরা আসিবার মিনিট দশেক পরেই তিনি চলিয়া যাইবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন। উঠি উঠি করিয়াও প্রায় আধঘণ্টা নানা কথাবার্ত্তার পর তিনি বাস্তবিকই উঠিলেন,  কিন্তু উঠিলে হইবে কি, ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া যাইতে তাহার প্রায় ২০ মিনিট সময় লাগিয়া গেল। তাহার ও তাহার শিষ্যদ্বয়ের প্রণাম এবং নমস্কার যেন ফুরাইতে চাহে না। প্রথমে তিনি ঠাকুরের পায়ে মাথা রাখিয়া প্রণাম করিলেন,  শিষ্যদ্বয়ও তাহাই করিল। পরে একটু পিছাইয়া আসিয়া সাষ্টাঙ্গে মেঝের উপর প্রায় ৩ মিনিট কাল পড়িয়া রহিলেন,  ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিলেন,  এবং হাতজোড় করিয়া কিয়ৎক্ষণ ঠাকুরের দিকে তাকাইয়া রহিলেন। তারপর আরম্ভ হইল উপস্থিত ভদ্রলোকদিগের সহিত নমস্কার ও প্রতিনমস্কারের পালা। তিনি একবার নমস্কার করেন, স্বভাবতঃই প্রতিনমস্কার হয়, কিন্তু তিনি আবার নমস্কার করেন,  আবার প্রতিনমস্কার হয়, নমস্কারের পালা শেষ হয় না। শিষ্যদ্বয়ও হুবহু গুরুদেবকে অনুকরণ করিয়া চলিলেন। আমার মনে হইল যে, ভদ্রলোকটির যেন ইচ্ছা যে শেষ নমস্কারটি তিনিই করেন। যাহাই হউক, ভদ্রলোক শিষ্যদ্বয়কে লইয়া কোনও প্রকারে দরজার নিকটে পৌঁছিলেন, আবার হাঁটু গাড়িয়া বসিলেন এবং জোড়হস্তে নিমীলিত নেত্রে খানিকক্ষণ কাটাইয়া ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়া নীচে নামিয়া গেলেন। ব্যাপারটা আমাদের চক্ষে কেমন যেন বিসদৃশ ঠেকিল এবং এই বিষয়ে আলোচনা করিতে করিতে আমরা মেসে ফিরিয়া গেলাম।

এ যাত্রায় আর ঠাকুরের দর্শনলাভের সুযোগ হইল না, তিনি কাশী হইয়া আবার বৃন্দাবন চলিয়া গেলেন। কিন্তু আমাদের ঠাকুর প্রসঙ্গ আবার জমিয়া উঠিল। ঠাকুর ও তদীয় গুরু সম্বন্ধে বরদাবাবু অনেক কিছুই বলিতেন স্মরণ আছে, কিন্তু গুরুর প্রসঙ্গ আমার তেমন মনঃপুত হইত না, আমি ঠাকুরের কথাই বেশী শুনিতে চাহিতাম। “গুরুদেব” না বলিয়া শুধু “গুরু” বলাতে কেহ কেহ মনে করিতে পারেন যে শ্রদ্ধার অভাব সূচিত হইতেছে, কিন্তু”গুরুদেব”কথাটা ঠাকুরের মুখে কোন দিনই শুনি নাই, তিনি শুধু “গুরু”ই বলিতেন। ইহার তাৎপর্য্য আমি যাহা বুঝিয়াছি তাহা যথাস্থানে বিবৃত করিব। সে যাহাই হউক,  এই ভাবে কয়েক মাস কাটিয়া গেল।  ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে আমি বৈঠকখানার মেস ছাড়িয়া দিলাম। গ্রীষ্মাবকাশের পর দর্জ্জিপাড়া অঞ্চলে একখানা বাড়ি ভাড়া করিয়া সপরিবারে তাহাতে আসিয়া উঠিলাম। এইখানেই আমার ঠাকুরের সহিত পরিচয়ের দ্বিতীয় অধ্যায় সূচিত হইল।