চতুর্থ অধ্যায় (১)

১৯২১ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাস। অসহযোগ আন্দোলনের প্রবল বন্যা যেন গোটা দেশটাকেই ভাসাইয়া দিতে চাহিতেছে। নাগপুর কংগ্রেসে গান্ধীজীর মতোই গৃহীত হইয়াছে এবং যদিও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন পূর্বে গান্ধীজীর বিরোধিতা করিয়াছিলেন এখন তিনিই এই আন্দোলনের প্রাদেশিক নেতৃত্ব গ্রহণ করিলেন। তুমুল আন্দোলন আরম্ভ হইল। ১৪৪ ধারা অমান্য করিয়া, পুলিশের লাঠি ও বেটনকে অগ্রাহ্য করিয়া রাস্তায় রাস্তায় মিছিল বাহির হইল। মাদক দোকানের সম্মুখে পিকেটিং চলিতে লাগিল; একদল গ্রেপ্তার হইতে না হইতেই অন্য দল আসিয়া তৎক্ষণাৎ কার্য্যভার হাতে লয়,পুলিশ গ্রেপ্তার করিয়া চলে,ইহার যেন আর শেষ নাই। ছেলেরা দলে দলে স্কুল, কলেজ খালি করিয়া রাস্তায় আসিয়া দাঁড়াইল,মনে হইল যেন জাতীর জীবনে এক মহা বিপর্যয় উপস্থিত হইয়াছে। একজনের পর একজন নেতা গ্রেপ্তার হইতে লাগিলেন,পাইকারি গ্রেপ্তারের তো কথাই নাই,শীঘ্রই দেখা গেল যে,জেলে আর স্থান সংকুলান হইতেছে না। দলে দলে লোক চাকুরী ছাড়িল, ওকালতি ছাড়িল, ডাক্তারি ছাড়িল, ব্যারিষ্টারী ছাড়িল, নির্বিচারে এই আন্দোলনে ঝাঁপাইয়া পড়িল। এমন উম্মাদনা জীবনে আর বোধ হয় দেখি নাই।

দেশের  শিক্ষাব্যাবস্থা ভাঙ্গিয়া পড়িবার উপক্রম হইল। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন হইতে কলিকাতায় আসিয়া “ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট ” হলে “শিক্ষার মিলন” নামে এক প্রবন্ধ পাঠ করিলেন।  স্যার আশুতোষ সেনেট হলে ছাত্রদের সমবেত করিয়া ওজস্বিনী ভাষায় তাহাদের সম্মুখে এক বক্তৃতা করিলেন।  কিছুটা কাজ যে না হইল তাহা নহে কিন্তু তাহাতে কর্ণধারগণের দুশ্চিন্তা দূর হইল না। বাহিরের অবস্থা যখন এই প্রকার সেই সময়ে আমার মনের মধ্যেও এক বিষম বিপ্লব চলিতেছিল।  এই আন্দোলনে যোগ দিব কি দিব না,এই চিন্তাই অহর্নিশি করিতেছিলাম।  রাত্রিতে ঘুম হইত না,আহারেও রুচি ছিল না।  বন্ধুবান্ধবদের সহিত নানা দিক হইতে কথাটার আলোচনাও   করিতাম কিন্তু কিছুই স্থির করিতে পারিতেছিলাম না। কথাটা  স্যার আশুতোষের কানেও উঠিয়াছিল এবং তিনি আমাকে ডাকাইয়া অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করিয়াছিলেন।  আমার মনের যখন দোদুল্যমান অবস্থা, কি করিব কিছুই ঠিক করিতে পারিতেছি না,এমন সময় একদিন  বৈকালে বরদাবাবু আমার বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বৃন্দাবন হইতে ঠাকুর তাহাকে একখানা চিঠি লিখিয়াছিলেন এবং তিনি ঐ চিঠিখানা আমাকে দেখাইতে লইয়া আসিয়াছেন। আমার সম্বন্ধে ঠাকুর লিখিয়াছেন ঃ “ইন্দুবাবুর মন বড়ই চঞ্চল হইয়াছে, তাহাকে একটু স্থির হইতে বলিবেন। ” ঠাকুরের অপার করুণায় আমার সমস্যার সমাধান হইয়া গেল,অনেক দিন পরে সে রাত্রিতে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাইতে পারিলাম।

জীবনে এই ব্যাপার টাহ্ লইয়া অনেক চিন্তা করিয়াছি এবং নিশ্চিন্তরূপে বুঝিতে পারিয়াছি যে, ঠাকুর আমাকে এক মহাবিপদ হইতে পরিত্রাণ করিয়াছিলেন।  আত্মবিশ্লেষণ করিয়া বুঝিয়াছি যে, সার্থক কংগ্রেসকর্মী হইতে হইলে যে সকল দোষ গুণ অত্যাবশ্যক আমার মধ্যে তাহার অধিকাংশই নাই। সুতরাং, হঠকারিতা করিয়া একটা কিছু করিয়া বসিলে আমার একূল- ওকূল দু’কূলই যাইত। তখনও ঠাকুরের সহিত আমার পরিচয় বেশি দিনের নয়,সুতরাং বৃন্দাবনে থাকিয়া যে তিনি আমার মনের চাঞ্চল্য টের পাইয়াছিলেন ইহাতে কম বিস্মিত হই নাই।  কিন্তু ক্রমে বুঝিয়াছি যে, তিনি সবই জানিতে পারেন, মনের নিভৃততম চিন্তাও তাঁহার অগোচরে থাকে না। একদিন তিনি জনৈক ভদ্রলোককে শাসনের ভঙ্গিতে বলিয়াছেন ঃ “আকাশ সর্বত্রই আছে।  ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে পাহারা,ফাঁকি দিবার জো নাই; পুন্ডরীক চক্ষে সবই প্রকাশ থাকে।  ” ইহার প্রমাণ আমি জীবন ভরিয়াই পাইয়াছি,কিন্তু কথাগুলো নিতান্তই ব্যাক্তিগত,সুতরাং এখানে কিছু প্রকাশ করা সম্ভব হইল না।