একদিন কলেজে প্রভাতবাবু আমাকে বলিলেন যে, অনেকদিন ঠাকুরের কোন সংবাদ পাওয়া যাইতেছে না, একবার মতিবাবুর দোকানে খোঁজ লওয়া প্রয়োজন। ইহাতে আমার অন্য মত হওয়ার কোন কারন ছিল না, সুতরাং সেইদিনই ক্লাসের পর নিকটেই এক দোকানে জলযোগ সারিয়া লইয়া মতিবাবুর “সত্যনারায়ণ ভান্ডারে” যাইয়া উপস্থিত হইলাম। সেখানে যাইয়া দেখি যে, এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক হাতে চায়ের পেয়ালা এবং সম্মুখে একখানি পিতলের রেকাবে এক বান্ডিল বিড়ি, একটি ম্যাচবাক্স এবং গুটিকয়েক পান লইয়া বেশ জাঁকাইয়া বসিয়া আছেন। মতিবাবু পরিচয় করাইয়া দিলে জানিলাম যে, তিনি এ.বি.রেলওয়েতে চাকুরী করিতেন। বর্ত্তমানে সেখানে ধর্ম্মঘট আরম্ভ হওয়ায় কলিকাতায় আসিয়াছেন। কয়েকদিন যাবৎ বৈকালে নিয়মিত মতিবাবুর দোকানে আসেন এবং ঠাকুর আসিলেন কিনা সন্ধান লইয়া যান। মতিবাবুর কথার ভাবে বুঝিলাম যে, তিনি ইহাকে শ্রদ্ধার চোখেই দেখিতে আরম্ভ করিয়াছেন এবং ইহাকে একজন গুরুগতপ্রান ভক্ত বলিয়াই সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। রেলবাবু ( তাহাকে আমি এই নামেই উল্লেখ করিব) নীরবে চা’ পান সমাধা করিলেন এবং উপর্য্যুপরি তিনটি বিড়ি ধ্বংস করিয়া আমাদের দিকে তাকাইলেন। দেখিলাম যে, তাহার চোখে কেমন যেন ঢুলুঢুলু ভাব। মাথার চুল ছোট করিয়া ছাঁটা, গোঁফদারি কামান, বেশ হৃষ্টপুষ্ট চেহারা। আমরা মনে করিয়াছিলাম যে, ইনি ঠাকুরেরই আশ্রিত এবং সেই ধারণার বশবর্ত্তী হইয়া প্রভাতবাবু রেলবাবুকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিলেনঃ “আপনি তো নিশ্চয়ই ঠাকুরকে অনেকদিন দেখিতেছেন, তাঁহার কথা কিছু বলুন, আমরা শুনি।” রেলবাবু চোখ বুজিলেন, খানিকক্ষণ পরে অর্দ্ধনিমীলিত নেত্রে প্রভাতবাবুর দিকে তাকাইলেন এবং ধীরে ধীরে মাথা নাড়িতে লাগিলেন। প্রায় ৩।৪ মিনিট এই ভাবেই কাটিয়া গেল, পরে রেলবাবু আস্তে আস্তে বলিলেনঃ “ঠাকুরের কথা কি কিছু বলা যায় রে ভাই, জানিই বা কি, আর কিই বা বুঝিয়াছি।” এই কথা কয়টি বলিয়াই আবার চক্ষু বুজিলেন। এই অবসরে মতিবাবু আমাদিগকে জানাইলেন যে, রেলবাবু খ্যাতনামা অপর একজন মহাপুরুষের শিষ্য, কিন্তু ঠাকুরকেও প্রাণ ভরিয়া শ্রদ্ধা করেন এবং অনেকদিন ধরিয়া তাঁহার নিকট যাতায়াত করিতেছেন। কিন্তু বড় চাপা, সহজে কিছুই বলিতে চাহেন না। এই কথা শুনিয়া আমরা রেলবাবুকে চাপিয়া ধরিলাম যে, তাহাকে একটু ঠাকুর প্রসঙ্গ করিতেই হইবে। রেলবাবুও যে নিতান্ত অনিচ্ছুক তাহা মনে হইল না, কিন্তু একটা বাধা পড়িয়া গেল।
তখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছিল, দোকানের জনৈক কর্ম্মচারী ধূপ, দীপ জ্বালাইয়া আনিল। মতিবাবুর দোকানে কাচে ঢাকা একটি সুন্দর আসনের উপর লক্ষ্মীনারায়ণের একটি যুগল মুর্ত্তি ছিল। মুর্ত্তিটি মাটির কিন্তু অত্যন্ত মনোরম। দোকানে ধূপ বাতি দেওয়ার সময় সেই যুগল মুর্ত্তির একটু আরতি করা হইত। এই আরতি আরম্ভ হওয়ায় আমাদের কথা চাপা পড়িয়া গেল। রেলবাবু সোজা হইয়া আসন করিয়া বসিলেন এবং স্হির নেত্রে যুগল মুর্ত্তির দিকে তাকাইয়া রহিলেন। একটু পরেই তাহার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল এবং শিরদাঁড়া কাঁপিতে লাগিল। আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। অশ্রু, পুলক, কম্প প্রভৃতি যে সব সাত্ত্বিক লক্ষণের কথা শুনিয়াছি ইহাও কি তাহাই? আমার কেমন সন্দেহ হইতে লাগিল। শীঘ্রই আরতি থামিয়া গেল, আমরাও একটু পরেই বাড়ি ফিরিয়া আসিলাম।সেদিন আর রেলবাবুর সঙ্গে বিশেষ কোন কথাবার্তা হইল না।
কিন্তু আমাদের কিরকম একটা কৌতুহল হইয়াছিল,পরের দিনও আমি ও প্রভাতবাবু যথাসময়ে মতিবাবুর দোকানে যাইয়া উপস্থিত হইলাম। রেলবাবু সেখানেই ছিলেন এবং বরদাবাবুর সঙ্গে কথাবার্তা বলিতেছিলেন।একটু মনযোগ দিতেই বুঝিলাম যে,তিনি তাহার কলিকাতা আসিবার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বরদাবাবুকে অবহিত করিতেছেন।রেলবাবু বলিতেছিলেন যে, তাহার একটি ছোট ভাই আছে, সে কলিকাতাতেই থাকে। এমহার্ষ্ট ষ্ট্রীটে ছোট একখানি কয়লার দোকান খুলিয়াছে।এই ভাইটিকে তিনি অত্যন্ত ভালবাসেন এবং তাহাকে কোনও মহাপুরুষের পদাশ্রিত করিতে না পারায় তিনি অত্যন্ত অশান্তিতে দিন কাটাইতেছেন।তাহার নিজের গুরুদেব শ্রীদেহে থাকিলে কোনই চিন্তা ছিল না, ভাইকে জোর করিয়া টানিয়া লইয়া গিয়া গুরুদেবের পায়ে ফেলিয়া দিতেন। কিন্তু তিনি দেহত্যাগ করিয়াছেন এবং সেইজন্যই রেলবাবু ঠাকুরের খোঁজে কলিকাতায় আসিয়াছেন। ধর্মঘটের দরুন এখন তাহার অখণ্ড অবসর,ছোট ভাই কলিকাতাতেই আছে, ঠাকুরও প্রায়ই ঘুরিয়া ফিরিয়া এখানে আসেন,যদি একটা যোগাযোগ হইয়া যায় এই আশাতেই তিনি অপেক্ষা করিতেছেন। প্রভাতবাবু একবার ধর্মঘটের অবস্থা ও তাহার চাকুরীর ভবিষ্যতের কথা তুলিয়াছিলেন কিন্তু তিনি দক্ষিণ হস্তের মধ্যের তিনটি অঙ্গুলি দুইবার কপালে ঠেকাইয়া এমন সরাসরি ভাবে কথাটার জবাব দিয়াছিলেন যে,সে প্রসঙ্গ টা একেবারেই চাপা পড়িয়া গিয়েছিল।ক্রমে ক্রমে রেলবাবু তাহার ধর্মজীবনের অনেক কথাই আমাদিগকে বলিলেন। ঠাকুরের কথাও নানা ভাবে উঠিত এবং ধর্মপ্রাণতা দৃঢ়তর হইয়াছে, তাহাও তিনি আমাদিগকে বিশদভাবে জানাইলেন। আমি তখন নূতন ঠাকুরের সঙ্গ পাইয়াছি,তাঁহার সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানিনা, সুতরাং রেলবাবুর কথাগুলি মুগ্ধ হইয়া শুনিতাম। তিনি ভুলেও কোনো বৈষয়িক ব্যাপারের আলোচনা করিতেন না।ধর্মঘটের ফলাফল কিরূপ হইবে, তাহার চাকুরী থাকিবে কিনা, না থাকিলে পোষ্যবর্গের কি উপায় হইবে,ছোট ভ্রাতার দোকান কেমন চলিতেছে, এইসকল প্রশ্নের ধার করিয়া তিনি যাইতেন না,অথচ প্রতিদিন তাহার ছোট ভাই ঠাকুরের কৃপা লাভে সমর্থ হইবে কিনা,ঘন্টার পর ঘন্টা এই আলোচনা করিতেন। কথাবার্তা যাহা বলিতেন তাহাও বেশ যুক্তিপূর্ণ ও শাস্ত্রসম্মত বলিয়া মনে হইত।তাহার সম্বন্ধে আমাদের মনে এক উচ্চ ধারণা গড়িয়া উঠিতেছিল কিন্তু সত্যি কথা বলিতে কি,তাহার ঐ অশ্রু ও কম্পন আমরা সরলভাবে গ্রহণ করিতে পারিতাম না,একটা সন্দেহ থাকিয়াই যাইত।
বৈকালে মতিবাবুর দোকানে যাইয়া রেলবাবুর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করা আমাদের একটা প্রাত্যাহিক কর্ম হইয়া দাঁড়াইল।একদিন সেখানে যাইয়া শুনিলাম যে,ঠাকুরের চিঠি আসিয়াছে, ৩/৪ দিনের মধ্যেই তিনি কলিকাতা আসিবেন। কথা টা শুনিয়াই ভাবিলাম যে,বোধহয় এতদিনে রেলবাবুর কার্য্যসিদ্ধি হইতে চলিল।তিনি সেখানেই উপস্থিত ছিলেন কিন্তু তাহার দিকে চাহিয়া যেন একটু ভাবান্তর লক্ষ্য করিলাম। খবরটা শুনিয়া তাহার উৎফুল্ল হবারই কথা কিন্তু উৎফুল্ল হওয়া দূরে থাকুক,মনে হইল যে তিনি একটু বিষন্ন হইয়া পড়িয়াছেন।ব্যাপারটা কিছুই বুঝিতে পারিলাম না।মতিবাবুর প্রশ্নের উত্তরে তিনি শুধু বলিলেনঃ ” হরিষে- বিষাদ রে ভাই, হরিষে বিষাদ ; ঠাকুর সেই আসা আসিলেন কিন্তু আমাকে কালই কলিকাতা ছাড়িয়া চলিয়া যাইতে হইতেছে।” কথাটা একটু খুলিয়া বলিবার জন্য আমরা সকলে মিলিয়া তাহাকে চাপিয়া ধরিলাম কিন্তু তিনি সহজে আর কিছুই বলিতে চাহিলেন না।শেষে অনেক পীড়াপীড়ির পর যাহা বলিলেন তাহাতেও কথাটা মোটেই পরিষ্কার হইল না। তিনি বলিলেন যে,গতকল্য তিনি সংবাদ পাইয়াছেন যে তাহার ভ্রাতৃবধু কিছুদিন পূর্বে নারায়নগঞ্জে তাহার পিত্রালয়ে ঠাকুর কৃপালাভ করিয়াছেন। কি করিয়া কি হইল এই খবর টা বিশদভাবে জানিয়া না লইয়া তিনি ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিবেন না।কিন্তু ইহাতেও প্রকৃত কথাটা যে কি, কিছুই বোঝা গেল না।রেলবাবু ইহার অতিরিক্ত আর কিছুই বলিলেন না এবং আমাদের অনুরোধ উপরোধ অগ্রাহ্য করিয়া পরের দিন ঢাকা মেলে নারায়ণগঞ্জ রওয়ানা হইয়া গেলেন। রহস্য টা রহস্যই রহিয়া গেল।
নির্দিষ্ট দিনে ঠাকুর আসিয়া পৌঁছিলেন এবং মতিবাবুর বাড়ীতে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিলাম।আর কে কে সেখানে ছিল ঠিক স্মরণ নেই। আমি আসিতেই মতিবাবু ঠাকুরের নিকট রেলবাবুর কথাটা পাড়িলেন।ঠাকুর কিছুক্ষণ নীরবেই রহিলেন, পরে ধীরে ধীরে বলিলেন ঃ ” সকল বিষয়েরই একটা নিয়ম আছে। আম গাছে যখন বোল বের হয়, সেই বোল চিবাইলে আম্রত্ব একটু আধটু বুজিতে পারা গেলেও আমের স্বাদ পাওয়া যাও না।পরে যখন গুটি বাঁধিয়া ছোট্ট আমটি বের হয় তখন তার স্বাদ হয় কষা।আম যেমন বড় হইতে থাকে,তার স্বাদ ও ক্রমে অম্ল,অম্ল-মধুর এবং পরিণামে মধুর হইয়া দাঁড়ায়। ধৈর্য্য ধরিয়া স্বভাবকে আশ্রয় করিয়া থাকিলে আম নিজেই পাকিয়া মধুর হয়,কোনো চেষ্টার প্রয়োজন হয় না।কিন্তু মানুষের ধৈর্যের অভাব, কষা আমেই পাকা আমের স্বাদ পাওয়ার আশায় খানিকটা গুঁড় মাখিয়া লয়,ফল দাঁড়ায় এই যে,যে আমটি কালে পাকিয়া হয়তো মধুর হইতে পারিত তাহার আম্রত্বই নষ্ট হইয়া যায়। ” একটু নীরব থাকিয়া আবার বলিলেনঃ “ইহারই নাম পাটোয়ারী, এই পাটোয়ারীর মার্জনা নাই।” বুঝিলাম যে রেলবাবুটি একটি ইঁচড়ে পাকা ভন্ড কিন্তু কয়দিনের নিয়মিত সাহচর্য্যে রেলবাবুর উপর কেমন যেন একটু মায়া পড়িয়া গিয়েছিল এবং সেই জন্যই বোধহয় তাহার ঠাকুরের নিকট একটু ওকালতি করিয়াছিলাম। ঠাকুরকে বলিয়াছিলামঃ “আপনি যা-ই বলুন রেলবাবু কথাগুলি কিন্তু ভালই বলিতেন,বেশ যুক্তিযুক্ত ও তাৎপর্যপূর্ণ।” উত্তরে ঠাকুর বলিয়াছিলেনঃ “সব বই-পড়া কথা, কোনো মূল্য নাই।” ইহার কিছুদিন পরে এক ভদ্রলোকের নিকট রেলবাবু সম্বন্ধে আরও একটা কথা শুনিয়াছিলাম। তিনি একবার ঢাকাতে ঠাকুরের সাথে সাক্ষাৎ করিতে গিয়েছিলেন। ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া উঠিতেই তিনি নাকি রেলবাবু কে বলিয়াছিলেনঃ ” আপনি এইখেনে!” দুইটি মাত্র কথা কিন্তু ইহাতেই রেলবাবু এতটা বিচলিত হইয়া পড়েন যে, তিনি তত্ক্ষণাত্ সেখান হইতে চলিয়া গিয়াছিলেন।ঠাকুরের সামান্য দুটা একটা কথা, এমনকি শুধু একটা চাহনির মধ্যে যে,কি কঠোর বজ্র লুকায়িত থাকিতে পারে তাহার অনেক উদাহরণ আমার জানা আছে, সুতরাং রেলবাবুর এই আচরণে আমার আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই, আশ্চর্য হইয়াছিলাম শুধু এই ভাবিয়া যে,কিসের ভরসায় তিনি ঠাকুরের অপেক্ষা করিতেছিলেন? মনে হয় যেন গোড়া হইতেই তিনি মতলব আঁটিয়া রাখিয়াছিলেন যে,ঠাকুর আসিবার দুই একদিন পূর্বে কোন একটা অজুহাত দেখাইয়া সরিয়া পড়িবেন।
রেলবাবুর কথাটা বোধহয় একটু অতিমাত্রায় দীর্ঘ হইয়া গেল।কেহ কেহ হয়তো মনে করিতে পারেন যে,ইহার কোন প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু এই ব্যাপারটার সহিত একটা গুরুতর বিষয় জড়িত আছে, সেইজন্যই রেলবাবুর কথাটা ভূমিকা হিসাবে একটু বিশদভাবে বলিতে হইল।পূর্বেই বলিয়াছি যে,রেলবাবু যে আচরণ করিয়া গেলেন ঠাকুর তাহার আখ্যা দিলেন, “পাটোয়ারী” এবং এই পাটোয়ারীর কোন কোন ক্ষেত্রে এমন ভয়াবহ এবং উত্কট পরিণতি প্রত্যক্ষ করিশাছি যে,এখানে কথাটার একটা বিস্তৃত আলোচনা সঙ্গত মনে হইতেছে। এককথায়, পাটোয়ারী মানে হল ভন্ডামী,নিজের মনের প্রকৃত ভাব গোপন রাখিয়া কৃত্রিম আচরণ। এই পাটোয়ারী নানা সূত্রে আরম্ভ হইতে পারে। গুরুপদিষ্ট কর্ম প্রথম দিকে নীরস বলিয়া মনে হয় এবং কৃত্রিম উপায়ে এই নীরসতার মধ্যে একটু সরসতা আনিবার চেষ্টা হইতে পাটোয়ারী শুরু হইতে পারে। নানা উপায়ে একটা “আলগা রসের” সৃজন করিয়া তাহাতেই মত্ত হইয়া থাকিতে চায়।ঠাকুর ইহাকেই ” কষা আমে গুড় মাখা” বলিতেন।আমি এক ভদ্রলোককে জানিতাম যিনি সূর্য্যোদয়ের পূর্বে তারকব্রহ্ম নাম করিতে করিতে ঘাটে ঘাটে যাইয়া গঙ্গাস্নান করিতেন, কীর্তনাদিতে সহজেই মাতিয়া উঠিতেন,নিয়মিত ভাগবত পাঠে যাইতেন,কিন্তু গুরুপদিষ্ট কর্ম করিতে হইলেই তাহার মাথায় যেন আকাশ ভাঙিয়া পড়িত।বহুদিন যাবত্ আলগা রসের সাধনা করিতে করিতে তাহার এমন অবস্থা দাঁড়াইয়াছিল যে, ইষ্টকর্মের কথা তাহার আর মনেও আসিত না।তিনি ঠাকুরের নিকট যাতায়াত করিতেন,শুধু ঠাকুর কেন,অনেকের নিকটেই তিনি যাইতেন, অনেকের উপদেশই তিনি শুনিতেন,অথচ প্রকৃত প্রস্তাবে তিনি কারো কথাই শুনিতেন না।কৃত্রিম রসচর্চা তাহার এত মজ্জাগত হইয়া গিয়াছিল যে,অনেক সময়ে তাহার মাত্রাজ্ঞান পর্যন্ত থাকিত না।তিনি যেখানে ভাগবত শুনিতে যাইতেন সেখানে এক ভদ্রমহিলাও আসিতেন।কোনো পারিবারিক কারণে ভদ্রমহিলাটি কিছুর আর নিয়মিত আসিতে পারিলেন না,মাঝে মাঝে অনুপস্থতিতে হইতেন।এইরূপ এক অনুপস্থিতির পর তিনটা একদিন পাঠ শুনিতে আসিয়াছিলেন,হঠাৎ সেই পূর্বোল্লিখত ভদ্রলোক তাহার সম্মুখে আসিলেন এবং হাত নাড়িয়া সুর করিয়া তাহাকে বলিলেনঃ” মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,চিরদিন কেন পাই না”। একটা গন্ডগোল বাঁধিয়া গেল, লজ্জায় ও অপমানে ভদ্রমহিলা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হইলেন এবং কেহ কেহ উত্তেজিত হইয়া উঠিল।শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোক নিতান্ত বৃদ্ধ বলিয়াই ব্যাপারটা কোনো প্রকারে মিটিয়া গেল।ইনি ভদ্রবংশের সন্তান, চাকুরীও নেহাত মন্দ করেন নাই, ভদ্র সমাজেই ইহার গতিবিধি, অথচ একটা অসঙ্গত ও অভদ্র আচরণ অনায়াসেই করিয়া ফেলিলেন।ইহারও মূলে সেই কৃত্রিম রসচর্চা।ভদ্রলোক যদি জীবনে ধর্মের ধার দিয়াও না যাইতেন,তাহা হইলে তাহার এতটা বিকৃতি নিশ্চয়ই হইত না।
পাটোয়ারী এই ভদ্রলোকের একেবারে মজ্জাগত হইয়া গিয়েছিল। তিনি যে কৃত্রিমতা করিতেছেন ইহা বুঝিবার সামর্থ্যও তাহার ছিল না। আমি ইহাকে কখনোই রেহাই দিতাম না, নানাভাবে আঘাত করিয়া ইহার একটা চৈতন্য সম্পাদনের চেষ্টা করিতাম কিন্তু ফল কিছুই হইত না। একবার ঠাকুরের আশ্রিত এক ভদ্রলোকের বাড়ীতে মহোৎসবের ব্যবস্থা হইয়াছিল, আমি সেই উৎসবে যোগদান করিয়াছিলাম। সন্ধ্যার পরে সেই পাটোয়ারী সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আসিবামাত্রই গদগদ কণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন : “কি আনন্দ, কি আনন্দ, টাকায় এ কি আনন্দ হয় ?” আমি তাহাকে বললাম: “টাকা ছাড়া আপনি এখানে কি দেখলেন ?” রাসবিহারী এভেনিউর উপর তেতলায় দক্ষিণখোলা একটি প্রশস্থ হলঘর, মানে টাকা ; সুপ্রসিদ্ধ একটি দলের কীর্ত্তন, মানে টাকা ; চর্ব্বচোষা রকমারি প্রসাদের ব্যবস্থা মানে টাকা ; টাকাই তো সব।” তিনি আমার কথায় কর্ণপাত করিলেন না, কীর্ত্তনের আসনে গিয়ে বসিলেন এবং ” আহা, উহ ” ইত্যাদি শব্দ করিয়া নানাপ্রকার অঙ্গভঙ্গী করিতে লাগিলেন। জীবনে জীবনে এই প্রকৃতির আরও অনেকের সঙ্গে আমার পরিচয় হইয়াছে কিন্তু তাহাদের কথা বলিতে গেলে অনেকটা পুনরুক্তিই হবে, সুতরাং ভিন্ন প্রকারের এবং অপেক্ষাকৃত লঘুতর আর দুইটি দৃষ্ঠান্তের উল্লেখ করিয়া আমি এই প্রসঙ্গের উপসংহার করিব। শ্রীযতীন্দ্রমোহন দাশগুপ্ত মহাশয়ের ( সুপ্রসিদ্ধ চিকিৎসক ও কংগ্রেসকর্ম্মী ঠাকুরের একনিষ্ঠ সেবক ) গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে তিনদিনব্যাপী এক মহোৎসবের ব্যবস্থা হইয়াছিল, ঠাকুরও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। বহুদূর হইতে এক কীর্ত্তনের দল আমদানি করা হইয়াছিল। বেশ স্মরণ আছে যে, কখন ঠাকুরের নিকট বসিয়া, কখন কীর্ত্তন শুনিয়া, কখন অন্তরঙ্গ বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করিয়া এবং নানাবিধ উপাদেয় উপকরণে আকণ্ঠ প্রসাদ পাইয়া দিনগুলি মহানন্দে কাটাইয়াছিলাম। উৎসবের প্রথম দিন দ্বিপ্রহরে আমি ও প্রভাতবাবু কীর্ত্তনের আসরে একপার্শ্বে বসিয়াছিলাম। হঠ্যাৎ প্রভাতবাবু দুইটি ভদ্রলোকের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিলেন। ইহারা দুইজনেই ঠাকুরের আশ্রিত এবং কীর্ত্তনে ইহাদের একটা প্রবল অনুরক্তি ও উৎসাহ বরাবরই লক্ষ্য করিয়া আসিয়াছি। দেখিলাম যে দুইজনে গলা জড়াইয়া ধরিয়া অঝোরে কাঁদিতেছেন। চক্ষের জলে বুক ভাসিয়া যাইতেছে। মনে হইল যে কীর্ত্তনান্দে ইহারা এমন মাতিয়াছেন যে, ইহাদের বাহ্যজ্ঞান যেন লুপ্ত হইয়া গিয়াছে। ক্ষুধার উদ্রেক হইয়াছিল, নিচে একজন কর্ম্মকর্ত্তার নিকট সন্ধান লইয়া জানিয়াছিলাম যে, দেড়টা নাগাদ প্রসাদ পাওয়া যাইবে, সুতরাং মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখিতেছিলাম। বেলা যখন প্রায় কাঁটায় কাঁটায় একটা তখন দেখিলাম যে, উহাদের একজন বুক পকেট হইতে একটা ঘড়ি বাহির করিলেন এবং আস্তে আস্তে তাহাতে দম দিতে লাগিলেন। কান্না কিন্তু সমানভাবেই চলিতে লাগিল, কোনো ব্যতিক্রমই দেখা গেল না। কিছুক্ষণ পরে প্রসাদ পাইবার ডাক পড়িল, আমরাও উঠিলাম, এই আশ্রিত দুটিও উঠিলেন। যিনি ঘড়িতে দম দিতে ছিলেন তাহার নিকটে যাইয়া প্রভাতবাবু বলিলেন : “ক’টা বাজল দেখ ত? ” তিনি ঘড়ি দেখিয়া বলিলেন : ” একটা চল্লিশ মিনিট। ” তাহাতে প্রভাতবাবু বলিলেন : “না, আমার মনে হয় যেন তোমার ঘড়িটা শ্লো, আজ দম দিয়াছ তো? ” ভদ্রলোক উত্তর করিলেন যে, তিনি নিয়মিত একটার সময় ঘড়িতে দম দিয়া থাকেন, এবং আজও ঠিক সময়েই দম দিয়াছেন। আর যায় কোথায়? ইহার পর যে কান্ড আরম্ভ হইল তাহা না বলিলেও চলে, ভদ্রলোক একেবারে নাজেহাল হইয়া পড়িলেন। কিন্তু ইহাতে ঐ ভদ্রলোকের উপকারই হইয়াছিল, পরে দেখিয়াছি যে তিনি অনেকটা সাবধান হইয়া গিয়াছেন। নীচে নামিবার সময় দেখিলাম যে, বারান্দায় এক কোণে একটি পেয়ালায় করিয়া মূল কীর্ত্তনিয়া মহাশয় গরম দুগ্ধ পান করিতেছেন। প্রভাতবাবু তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন : “নিজে তো বেশ দুধ খা’চ্ছেন, দলের আর সকলে কি দোষ করল?” উত্তর হইল: কীর্ত্তনের পরে আমি কি খাই না কি খাই তাকি আর আমার খেয়াল থাকে।” বাস, আরম্ভ হইল আর এক দফা, প্রভাতবাবু সেই কীর্ত্তনিয়াকে একেবারে কাঁদাইয়া ছাড়িলেন। উপর বিলম্ব হইয়া গেল। সর্ব্বশেষ যে ঘটনাটির উল্লেখ করিব এইগুলির তুলনায় তাহা অনেকটা অকিঞ্চিৎকর কিন্তু পাটোয়ারীর প্রারম্ভ হিসাবে এইটিরও মূল্য আছে। যাদবপুর কৈবল্যধামে প্রতিবৎসর ১৩ই ফাল্গুন তারিখে প্রতিষ্ঠা-উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সেবার সকাল বেলা এই উৎসব উপলক্ষে আমি আশ্রমে গিয়েছিলাম। কীর্তন চলিতেছিল,দেখিলাম যে, আসরের একধারে বিভাসবাবু( বিভাসচন্দ্র দে, ইনি কন্ট্রাকটরী করিতেন, সম্প্রতি গত হইয়াছেন) বসিয়া রহিয়াছেন, আমিও যাইয়া তাহার একপাশে উপবেশন করিলাম। একটি যুবক কীর্তনের তালে তালে নাচিতেছিল, তাহার গায়ে একটি নূতন গরম কোট ছিল। একটু পরে দেখা গেল যে,সে কোটটি খুলিয়া অপর একজন ভদ্রলোকের নিকট রাখিয়া দিল। বিভাসবাবু জনান্তীকে আমাকে বলিলেনঃ “এইবার এই লোকটা আছাড় খাবে।” ঠিক তাহাই হইল, কিছুক্ষণ পরেই লোকটা ধপাস করিয়া পড়িয়া গেল এবং মাটিতে গড়াগড়ি সুরু করিল। সহজেই বোঝা গেল যে, শুধু নূতন কোটটির মায়াতেই সে এ পর্যন্ত্য বিশেষ কিছু করিয়া উঠিতে পারে নাই। আমার এই লোকটিকে দু’চারিটি কথা বলিবার ইচ্ছা ছিল কিন্তু ইহার “দশা” আর কিছুতেই ভাঙ্গিতে চাহিল না। আমার কলেজ ছিল,সুতরাং শীঘ্রই চলিয়া আসিতে হইল। এই লোকটির সহিত আমার আর কখনোও সাক্ষাৎ হয় নাই এবং ইহার পরিণতি কি হইয়াছে তাহাও আমি জানি না। কিন্তু আমার বিশ্বাস যে গোড়ার দিকে কেহ তাহাকে সমঝাইয়া দিয়া থাকিলে সে হয়তো আর অধিক দূর অগ্রসর হইতে পারে নাই।
দ্বিতীয়তঃ, পাটোয়ারীর উদ্ভব হয় প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা হইতে। প্রথম প্রথম হয়তো অনেকটা তামাসার ছলেই ব্যাপারটা আরম্ভ হয়। বন্ধুবান্ধবদের কাছে একটু বাহাদুরী নেওয়া, তাহাদের একটু চমক লাগাইয়া দেওয়া, ইত্যাদি বালক-সুলভ বুদ্ধি হইতে ইহা সুরু হয়। সত্যের মধ্যে কিছু কিছু মিথ্যার প্রকাশ পড়িতে থাকে। সময়ে সাবধান হইয়া গেলে ইহাতে বিশেষ কোনও অনিষ্ট হয় না কিন্তু একবার অভ্যাসে দাড়াইয়া গেলে মহা অনর্থের সুত্রপাত হয়। প্রতিষ্টার নেশা এক মারাত্মক নেশা, এই নেশায় একবার বসিলে মানুষের ক্রমে আর হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। কিন্তু যেখানে প্রতিষ্ঠা- কামনা গৌণ এবং মুখ্য উদ্দেশ্য বিষয় লিপ্সার চরিতার্থতা, সেই সকল ক্ষেত্রে আরও ভয়াবহ অবস্থার উদ্ভব হয়। রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও এরুপ দৃষ্টান্তের অভাব নাই,কিন্তু ধর্ম্মজীবনে ইহার ফল যে কি সাংঘাতিক হইয়া দাড়ায় এবং দেশের দশের কি মহা অনিষ্টের কারণ হয়,তাহা দৃষ্টান্ত দ্বারা বুঝাইবার অপেক্ষা রাখে না। মহাজনেরা বলিয়াছেন ঃ “প্রতিষ্ঠা শূকরীবিষ্ঠা” কিন্তু ইাহার প্রভাব এড়াইয়া যাওয়া সহজ নহে। গোড়া হইতে অত্যন্ত সতর্কতার সহিত চলিতে হয়। একবার হাল ছাড়িয়া দিলে জটের পর জট এমনভাবে পাকাইতে থাকে যে শেষের নিজের আর বিশেষ কিছু করিবার থাকে না, স্রোতে গা ভাসাইয়া দিতে হয়। আর কথা না বাড়াইয়া এখানে এক ভদ্রমহিলার দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিয়া বুঝাইতে চেষ্টা করিব যে, গোড়ায় একটু খ্যাতির প্রলোভন ক্রমে পাটোয়ারীতে পরিণত হইয়া কিরুপ উৎকট অবস্থা সৃষ্টি করিতে পারে।
তখনও আমি সেই বিডন স্ট্রিটের মেসেই আছি। এখন আর ইহাকে মেস না বলিলেও চলে,আমি আর আমার তিনজন আত্মীয় বামুন চাকর লইয়া সেখানে থাকিতাম। একদিন এক ভদ্রলোক আসিয়া সংবাদ দিয়া গেলেন যে, পরের দিন প্রাতঃকালে ঠাকুর আমার এখানে আসিবেন। উকিলবাবু সেখানে না থাকাতে অত্যন্ত আরাম বোধ করিলাম, কিন্তু তখন বুঝি নাই যে, নূতন যিনি জুটিয়াছেন তিনি কত বেশী মারাত্মক। আমার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়া গঙ্গাস্নান উপলক্ষে কলিকাতায় আসিয়া আমাদের ঐ বাসাতেই ছিলেন। এরুপ একটি অদ্ভুত স্ত্রীলোক জীবনে অতি অল্পই দেখিয়াছি। তিনি সধবা কিন্তু স্বামীর ধার বড় একটা ধারিতেন না, নিঃসন্তান হওয়ায় অনেকটা ঝাড়া হাত পা ছিলেন, কোন একটা সুযোগ পাইলেই এখানে সেখানে যাইয়া দু’চার মাস কাটাইয়া আসিতেন। তাহার বয়স তখন পঞ্চাশের উপরে, সেজন্যই কেহ বিশেষ কিছু মনে করিত না। ধর্ম্মের নামে তিনি সকল বিরুদ্ধ সমালোচনা উড়াইয়া দিতে চাহিতেন। স্বামী,সংসার,আত্মীয় পরিজন, সকলই মায়া মরীচিকা মাত্র, সেই জন্যই তিনি তাহাদের সংস্পর্শ এড়াইতে চাহিতেছেন, ইহাই ছিল তাহার বিসদৃশ আচরণের কৈফিয়ৎ। সকলে জানিত যে, তিনি আহার এক প্রকার ছাড়িয়াই দিয়াছেন, সামান্য ফলমূল খাইয়া থাকেন, এক কথায় তিনি নিজেকে একজন ধম্মর্পরায়ণা, নিষ্ঠাবতী সাধিকা বলিয়া জাহির করিতে চেষ্টা করিতেন এবং প্রথম পরিচয়ে কেহ কেহ যে প্রতারিত না হইত এমন কথাও বলিতে পারি না।
আমি ইহাকে পুর্ব্বেও কয়েকবার দেখিয়াছিলাম এবং ইহার আচরণ সর্ব্বদা পছন্দ না করিলেও আমার মনে ইহার প্রতি বিশেষ কোন বিদ্বেষ ভাব ছিল না। সুতরাং উকীলবাবুর উপস্থিতিতে যেরুপ সন্ত্র্রস্ত হইয়া উঠিয়াছিলাম এক্ষেত্রে সেরুপ কিছুই হইল না। ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশিবার সুযোগ না হওয়ায় এই ভদ্রমহিলার প্রকৃত স্বরুপ আমার কাছে তখনও অজ্ঞাতই ছিল। ইনি ঠাকুরকে চিনিতেন এবং ইহার প্রতি কথাবার্ত্তায় তাহার প্রতি একটা সশ্রদ্ধ ভাবই প্রকাশ পাইত। প্রতাপবাবু এখানে নাই, ইনিই ঠাকুরের সেবার ভারথেকে লইতে পারিবেন, এরুপ ভাবিয়াই আমি বরং আশ্বস্তই হইলাম। ঠাকুর আসিবেন শুনিয়া ভদ্রমহিলা গদগদস্বরে বলিলেনঃ “রাম আসবে, কি ভাগ্যি, কি ভাগ্যি, তোমার বরাতেই আমার এত সৌভাগ্য” এবং আমার মাথায় হাত বুলাইতে লাগিলেন। যাহাই হউক, পরের দিন সকাল বেলা প্রায় ৯’টার সময় ঠাকুর আসিয়া পৌঁছিলেন, সঙ্গে একজন অপরিচিত ভদ্রলোক। ইনি ঠাকুরকে পৌঁছাইয়া দিয়াই বাড়ী চলিয়া গেলেন। যাইবার সময় আমাকে বলিয়া গিয়াছিলেন যে, ঠাকুর তখন সামান্য কয়েক টুকরা কাঁচকলা আহার করেন, অন্য কিছুই গ্রহণ করেন না। এই কাঁচকলা একটা বিশেষ প্রণালীতে প্রস্তুত করিতে হয়। টুকরাগুলি একটু বড় বড় করিয়া কাটিয়া, পরিষ্কার ভাবে ধুইয়া, ভাল ঘি কিংবা মাখনে সাঁৎলাইয়া লইতে হয় এবং পরে একটু নুন ও গোলমরিচের গুড়া মাখাইয়া ভাপে সিদ্ধ করিতে হয়। আমি নিজে বাজারে যাইয়া দেখিয়া শুনিয়া কয়েকটি ভাল কাঁচকলা লইয়া আসিলাম, ভাল ঘি ঘরেই ছিল, ইকমিক কুকারও একটা ছিল; আমি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দিদিকে (ঐ ভদ্রমহিলাকে এখন হইতে ‘দিদি’ বলিয়াই উল্লেখ করি) ব্যাপারটা বুঝাইয়া দিয়া তাহার উপরেই এই কাঁচকলা প্রস্তুতের ভার অর্পণ করিলাম। তিনি ও তৎক্ষণাৎ স্নান সারিয়া ফেলিলেন এবং ইকমিক কুকার, কাঁচকলা ইত্যাদি লইয়া পাশের ঘরে চলিয়া গেলেন।
ইতিমধ্যে প্রভাতবাবু আসিয়া পড়িলেন। তিনি পূর্ব্বেই জানিতেন যে, ঠাকুর আসিবেন, ৯’টার ভিতরেই স্নানাহার সারিয়া চলিয়া আসিয়াছেন। কি একটা কারণে দুইদিন কলেজ বন্ধ ছিল, প্রভাতবাবু বলিলেন যে, এই দুইদিন তিনি এখানেই থাকিবেন, বাড়ীতেও সেইরূপ ব্যবস্থা করিয়া আসিয়াছেন। জামা ছাড়িয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া প্রভাতবাবু স্থির হইয়া বসিলেন এবং কিছুক্ষণ ঠাকুরের স নানাবিধ কথাবার্ত্তা চলিল। ইতিমধ্যে দিদি একখানা রেকাবিতে ঠাকুরের জন্য ৬/৭ টুকরা কাঁচকলা লইয়া আসিলেন। ঠাকুর একটি টুকরা তুলিয়া মুখে দিয়াই হাত দিয়া রেকাবিখানা সরাইয়া দিলেন। দিদির অনুরোধ সত্বেও ঠাকুর কিছুতেই ঐ কাঁচকলা গ্রহন করিলেন না। দিদি যে বিশেষ অপ্রস্তুত হইয়াছেন এরূপ মনে হইল না, যেন একটু রাগতভাবেই রেকাবিখানা লইয়া চলিয়া গেলেন এবং ঠাকুরও একখানি চাদর মুড়ি দিয়া শুইয়া পড়িলেন। ব্যাপারটা কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। প্রভাতবাবুকে কথাটা খুলিয়া বলিলাম এবং তাহাকে লইয়া পাশের ঘরে যাইয়া অনুসন্ধান করিয়া দেখিলাম যে, কুকার মোটে জ্বালানই হয় নাই, ঘি যেমন ছিল ঠিক তেমনই রহিয়াছে। আমি অবাক হইয়া গেলাম, মানুষ যে এমন কান্ডজ্ঞানহীন ও দায়িত্বজ্ঞানহীন হইতে পারে তাহা স্বপ্নেও কখন ভাবি নাই। বামুনের নিকট জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম যে, রান্নাঘরের উনানে একটি ছোট এ্যালুমিনিয়ামের কড়ায় কাঁচকলা সিদ্ধ করিয়া দিদি তাহাতে নূন এবং আরও কি মিশাইয়া ঠাকুরের নিকট লইয়া গিয়াছেন। উনানে তখনও আঁচ ছিল, প্রভাতবাবু তাড়াতাড়ি আর একটি কাঁচকলা কাটিয়া ঐ ভদ্রলোকের নির্দ্দেশ মত ঘি’য়ে সাঁৎলাইয়া লইলেন এবং পরে নুন ও গোল মরিচ মাখাইয়া কুকারে চাপাইয়া দিলেন। কিঞ্চিদধিক আধঘন্টা পরে সেই কাঁচকলা আনিয়া দেওয়া হইল, ঠাকুর সব কয়টি টুকরাই তৃপ্তির সহিত গ্রহণ করিলেন। আহারের পর ঠাকুর একটি গল্প বলিলেন। গল্পটি কিছুতেই স্মরণ করিতে পারিতেছি না, তবে উহার মর্ম্মার্থ ছিল এই যে, কোন অর্দ্ধপরিচিত ও অপরীক্ষিত লোকের উপর সেবার ভার ন্যস্ত করিতে নাই। ঠাকুর এ যাত্রায় দুইদিন আমার বাড়ীতে ছিলেন, দ্বিতীয় দিনও প্রভাতবাবুই ঠাকুরের আহার্য্য প্রস্তুত করিয়াছিলেন, দিদিকে কাছেও ঘেঁষিতে দেওয়া হয় নাই।
বৈকালে ঠাকুর আমাকে প্রভাতবাবুর জন্য ভাল মাছ আনাইতে বলিলেন এবং আমি নিজে বাজারে যাইয়া একটি উৎকৃষ্ট গঙ্গার ইলিশ কিনিয়া আনিলাম। বাড়ী আসিয়া শুনিলাম যে, মাংস রান্না হইতেছে এবং এক ভদ্রলোক ঠাকুরের জন্য কিছু আম ও রাবড়ি দিয়া গিয়াছেন। প্রভাতবাবু প্রস্তাব করিলেন যে, সে রাত্রিতে আর মাছ রাঁধিয়া কাজ নাই, সাঁৎলাইয়া রাখিয়া দেওয়া হউক। কথাটা শুনিয়া ঠাকুর বলিলেনঃ “সামনের জিনিষ খাইয়া ফেলাই ভাল, কাল কি হইবে কে জানে।” শেষে প্রভাতবাবু একটা মাঝামাঝি বন্দোবস্ত করিলেন। সেই রাত্রিতে কিছুটা মাছ ভাজা খাওয়া হইল এবং বাকীটা রাখিয়া দেওয়া হইল। পরের দিন প্রাতঃকালে রান্নাঘরে একটা গোলমাল শোনা গেল। বামুন বলিতেছে যে, সে উপরের তাকে বেশ শক্ত করিয়া ঢাকিয়া মাছের টুকরাগুলি রাখিয়া দিয়াছিল, এখন দেখে যে একখানাও নাই, ঢাকনাটা নীচে পড়িয়া আছে। দিদি বলিতেছেন যে, নিশ্চয়ই সে মাছের টুকরাগুলি যত্ন করিয়া রাখে নাই, তাহার দোষেই সব বিড়ালে খাইয়া গিয়াছে। বামুন ঢাকনাটা দেখাইয়া বলিল যে, বিড়ালে ফেলিয়া দিলে ঢাকনাটা কখনই এভাবে থাকিতে পারিত না, নিশ্চয়ই কেউ ঢাকনাটাকে নামাইয়া রাখিয়াছে; যে এই কার্য্য করিয়াছে সে-ই মাছগুলি চুরি করিয়া খাইয়াছে। দিদি বলিলেন যে, যত সব আজগুবি কথা, নিশ্চয়ই বিড়ালে খাইয়াছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি কোন প্রকারে গোলমালটা থামাইয়া দিলাম এবং ভৃত্য প্রভাসকে একটি ভাল মাছ আনিতে বলিয়া দিলাম। মাছের টাকা লইতে আমার ঘরে আসিয়া প্রভাস গোপনে আমাকে বলিল যে, একটু গভীর রাত্রিতে দিদিই মাছের টুকরাগুলি খাইয়াছেন, সে স্বচক্ষে দেখিয়াছে। সে রাত্রিতে বাহিরে গিয়াছিল, রান্নাঘরে আলো দেখিয়া উকি মারিয়া দেখে যে, দিদি বেশ মৌজ করিয়া টুকরার পর টুকরা মুখে তুলিতেছেন এবং আরামে নিঃশ্বাস ফেলিতেছেন। সহসা কথাটা বিশ্বাস করিতে প্রবৃত্তি হইল না কিন্তু প্রভাসকে অবিশ্বাসও করিতে পারিলাম না। যাহা হউক, তাহাকে এই বিষয় লইয়া আর কোন উচ্চবাচ্য করিতে নিষেধ করিয়া দিলাম। কথাটা শুনিয়া প্রভাতবাবু বলিলেনঃ “ঠাকুরের কথা না শোনাতেই এই বিভ্রাট ঘটিয়াছে, এমন ভাল মাছটা শেষে কিনা দিদির পেটে গেল।”
সেদিন অনেকেই ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে আসিলেন কিন্তু রাত্রি ৮/৮-৩০’র মধ্যেই সকলে চলিয়া গেলেন। কাঁচকলার ব্যাপারের পর দিদি আর ঠাকুরের নিকট আসেন নাই, এখন নিরিবিলি পাইয়া ধীরে ধীরে আসিয়া ঠাকুরের নিকট বসিনেল এবং তাঁহার একখানা পায়ে হাত বুলাইতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ এই ভাবে নীরবে কাটিয়া গেল, আমরা কেহই কিছু বলিলাম না। প্রভাতবাবুর বোধ হয় হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল যে, কাঁচকলার ব্যাপারটা দিদির সঙ্গে বোঝাপড়া করিয়া লওয়া হয় নাই, তাই তিনি দিদিকে কথাটা জিজ্ঞাসা করিয়া বসিলেন। আমি ভাবছিলাম যে, দিদি অত্যন্ত লজ্জিত ও অপ্রস্তুত হইবেন, সেই জন্যই প্রসঙ্গটা আর উত্থাপন করি নাই কিন্তু এখন দেখিলাম যে, মস্ত একটা ভুল করিয়া বসিয়াছিলাম। দিদি প্রভাতবাবুর অনুযোগটাকে মোটে আমলেই আনিলেন না এবং বেশ সপ্রভিত ভাবেই বলিলেনঃ “কেন তাতে হইয়াছে কি? কাঁচকলা সিদ্ধ আগুনের জ্বালেও হইতে পারে, ভাপেও হইতে পারে, সিদ্ধ, তাহা যে আবার ঘি’য়ে সাঁৎলাইয়া লইতে হয় এমন কথা জীবনেও শুনি নাই, রামের যত সব আজগুবি ফরমাশ।” ইহার পর আর কথা চলে না, আমরাও কিছু বলিলাম না, ঠাকুরও কিছু বলিলেন না, আবার কিছুক্ষণ নীরবে কাটিয়া গেল। হঠাৎ এক সময় দিদি ঠাকুরের পায়ে মাথা ঠেকাইয়া প্রণাম করিলেন এবং পরে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ “রাম, আমার কি কোন ব্যবস্থাই করবে না? তোমাকে বলিয়া বলিয়া যে হয়রান হইয়া গেলাম।” ঠাকুর বলিলেনঃ “আপনাকে তো বলাই হইয়াছে যে, পতিসেবাই ধর্ম্ম।” এই কথাটায় দিদির বেশ একটু আঁতে ঘা লাগিত; পূর্ব্বেও দেখিয়াছি, এখনও দেখিলাম যে কথাটা তিনি মোটেই সহ্য করিতে পারেন না। দিদি একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলিয়া উঠিলেন এবং কতকটা উষ্মার সহিত বলিলেনঃ “এ সব বাজে কথা কে শুনতে চায়? আসল কথাটা বল।” ঠাকুর বলিলেন যে, আসল নকল তিনি কিছু জানেন না, এক কথাই জানেন এবং তাহাই বলিয়াছেন। পরে বিশদভাবে পতিব্রতা ধর্ম্ম কি, পতিসেবা কাহাকে বলে, ইত্যাদি বুঝাইয়া দিলেন। দিদির দিকে চাহিয়া মনে হইল যে, তিনি নিতান্ত তাচ্ছিল্যের সহিত কথাগুলি শুনিতেছেন। ঠাকুরের কথা শেষ না হইতেই তিনি উঠিয়া গেলেন। দিদির সহিত কথাবার্ত্তায় পরে বুঝিয়াছিলাম যে, ব্রজগোপীরা যেমন স্বামী ছাড়িয়া কৃষ্ণভজন করিয়াছিলেন, সেই জাতীয় একটা কোন নির্দ্দেশ তিনি ঠাকুরের নিকট চাহিতেছিলেন। তাহা হইলেই তিনি তাহার এই অসামাজিক আচরণের এবং স্বামী ও অন্যান্য আত্মীয় পরিজনাদির প্রতি অমার্জ্জনীয় তাচ্ছিল্যের একটা সমর্থন পাইয়া যাইতেন।
ঠাকুর চলিয়া গেলেন কিন্তু দিদি আমাদের ছাড়িলেন না। কয়েক দিনের মধ্যেই বামুনকে বিদায় দিয়া রান্নাঘরে অধিষ্ঠিত হইলেন। আমাদের বুঝাইলেন যে, তাহার তো কোন কাজ নাই, এই চারজন লোকের রান্না তিনি অনায়াসেই করিতে পারিবেন; অযথা এতগুলি টাকা বামুনের পিছনে খরচের কোন প্রয়োজন নাই। প্রভাস আমাকে বলিল যে, এখন হইতে ভাল মাছটাছ আর কেহই কিছু পাইবে না, বেচারী ধমক খাইয়া চলিয়া গেল। তাহার পর আরম্ভ হইল এক নির্য্যাতনের পালা। মধ্যাহ্নে খাইতে বসিয়া দেখি যে, রান্না হইয়াছে শুধু ডাল আর একটু মাছের ঝোল। তরকারী রান্না হয় নাই কেন জিজ্ঞাসা করাতে দিদি বলিলেন যে, ডালেই যথেষ্ট তরকারী দেওয়া হইয়াছে। ডালের ভিতর পাইলাম দুই খন্ড মূলা, আর কিছুই না। ডালটা তবু কোন প্রকারে খাইতে পারিলাম কিন্তু মাছের বাটিতে হাত দিয়া চক্ষু স্থির হইয়া গেল। বুঝিলাম যে, ইহাতে তেলের বিন্দুও নাই এবং আঁশটে গন্ধে আমার বমির উপক্রম হইল। মাছখানা একটু নাড়াচাড়া করিয়া সরাইয়া রাখিলাম, খাইতে পারিলাম না। প্রভাসকে ডাকিয়া দই আনাইলাম, ঘরে আম ছিল, তাহা দিয়াই কোন প্রকারে ক্ষুন্নিবৃত্তির চেষ্টা করিলাম। কিন্তু তাহাতেও সম্পূর্ণ সফলকাম হইতে পারিলাম না। দিদির হাত হইতে ভাত যেন আর পাতে পড়িতে চাহে না। সামান্য দুটি দিয়াই তিনি জিজ্ঞাসা করেন “আর চাই”, মানুষ কতবার চাহিতে পারে, সুতরাং আধপেটা খাইয়াই উঠিতে হইল। এইরূপ দিনের পর দিন চলিতে লাগিল। প্রভাসের কথাও অক্ষরে অক্ষরে ফলিল, মাছের ভাল টুকরাগুলি আমরা চোখেও দেখিতাম না, রাত্রিতে দিদিই সেগুলি সাবাড় করিতেন। আমি প্রায়ই প্রভাতবাবুর বাড়ীতে অথবা হোটেলে খাইয়া আসিতাম, বাড়ীতে একবার বসিয়া শুধু নিয়ম রক্ষা করিতাম, খাওয়া হইত না।
আমিও দিদির উপর প্রতিশোধ লইবার এক ফন্দী আবিস্কার করিলাম। যখন তখন পতিসেবার কথা তুলিয়া তাহাকে উত্যক্ত করিতাম এবং তিনিও ক্ষেপিয়া যাইতেন। ইহাতে যাহাই হউক কিছুটা সান্তনা পাইতাম। একদিন বৈকালে প্রভাতবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং জানাইলেন যে, রাত্রিতে তিনি এইখানেই থাকিবেন। আমি প্রমাদ গণিলাম; প্রভাতবাবু ভোজনবিলাসী লোক, আর এদিকে দিদির এমন মর্ম্মান্তিক ব্যবস্থা। কিন্তু প্রভাতবাবু অবস্থাটা জানিতেন, নিজেই বাজারে গিয়া হাঁসের ডিম ও কিছু মাছ কিনিয়া আনিলেন, তেল, মসলা প্রভৃতিও আলাদা লইয়া আসিলেন, যেন দিদির খপ্পরে আর কিছুতেই না পড়িতে হয়। নিজেই ষ্টোভ জ্বালিয়া আমর ঘরে ডিমগুলি সিদ্ধ করিবার আয়োজন করিলেন। ডিমগুলি সিদ্ধ হইয়া গিয়াছে, খোসাও ছাড়ান হইয়াছে, এইবার কড়ায় তেল চাপাইয়া ডালনা রান্না সুরু হইবে এমন সময় দিদি আসিয়া উপস্থিত হইলেন। “আমি থাকিতে প্রভাত রান্না করিবে, কি-ই বা রান্না, এতো আমি আধ ঘন্টায়ই রান্নাঘরের উনানে সারিয়া দিতে পারিতাম, আবার ষ্টোভ ধরান কিসের জন্য” ইত্যাদি বলিয়া একেবারে ষ্টোভটির সামনে আসিয়া বসিলেন। কিন্তু প্রভাতবাবুও নাছোড়বান্দা, ষ্টোভটি ঘরের এক কোণে সরাইয়া লইয়া এমনভাবে বসিলেন যে, দিদির আর ষ্টোভের নিকটে যাইবার উপায় থাকিল না। আমি জিনিষগুলি আগাইয়া দিলাম এবং প্রভাতবাবু কড়ায় তেল ঢালিয়া দিলেন। দিদির কিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়, বোধ হয় তাহা দেখিবার জন্যই প্রভাতবাবু ইচ্ছা করিয়াই খানিকটা বেশী পরিমাণে তেল ঢালিয়া দিয়াছিলেন। দিদি একেবারে হা হা করিয়া উঠিলেন এবং প্রভাতবাবুকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেনঃ “মুদির দোকান ফেল পড়বে যে।” আমরা কোন কথাই বলিলাম না, রান্না চলিতে লাগিল। ডিম ও মাছ প্রস্তুত হইয়া যাইতেই প্রভাস একটা এ্যালুমিনিয়মের প্যানে করিয়া চাল ধুইয়া লইয়া আসিল। প্রভাতবাবু যে ভাতও আলাদা রান্নার ব্যবস্থা করিয়াছেন, ইহা আমি জানিতাম না। দিদি অনেক কিছুই বলিলেন আমরা গ্রাহ্যও করিলাম না। কিন্তু আমাদের ফাঁড়া তখনও কাটে নাই, পরিবেশন করিবার জন্য তিনি উঠিয়া পড়িয়া লাগিলেন কিন্তু প্রভাতবাবু কিছুতেই স্বীকৃত হইলেন না। অনেক দিন পরে নিজের বাসায় পরিতোষপূর্ব্বক আহার করিলাম। আমাদের খাওয়া দেখিয়া দিদির মুখের যে অবস্থা হইয়াছিল, তাহা পাঠক-পাঠিকারা কল্পনা করিয়া লইবেন। আমি বলিয়া উঠিতে পারিব না।
আহারের পর দিদি প্রভাতবাবুকে বলিলেনঃ “খাওয়া তো হইল, এইবার একটু ঠাকুরের কথা বল, শুনি।” প্রভাতবাবু সমস্তই জানিতেন, সুতরাং তিনি তৎক্ষণাৎ বলিলেনঃ “ঠাকুরের তো ঐ এক কথা, পতিসেবা, পতিব্রতা ধর্ম্ম।” দিদি ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিলেন, “তোমাদের যেমন ঠাকুর তেমন তোমরা” ইত্যাদি অনেক কিছু বলিয়া নিজের ঘরে চলিয়া গেলেন। ইহার কয়েক দিন পরে একটা অনিবার্য্য কারণে দিদি আমাদের ঘাড় হইতে নামিলেন, আমরা হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলাম। দিদি ঢাকা চলিয়া গেলেন।
এই দিদির স্বামী, সংসার, আত্মীয়, পরিজন, সবই ছিল, মধ্যবিত্ত গৃহস্থ হিসাবে অবস্থাও নেহাৎ মন্দ ছিল না। কিন্তু এসব কিছুই তাহার ভাল লাগিল না, হঠাৎ তাহাকে এক অস্বাভাবিক ও উৎকট ধর্ম্মচর্চ্চায় পাইয়া বসিল। ধর্ম্মটর্ম্ম অবশ্য সবই বাজে, আসল মতলব লোকের কাছে একটু বাহবা পাওয়া, অর্থাৎ প্রতিষ্ঠা। তিনি আহার ছাড়িয়া দিলেন এবং তাহার আচরণের দ্বারা দেখাইতে লাগিলেন যে, সংসারে তাহার কোনও আসক্তি নাই। কেহ কেহ যে তাহার আচরণে তাহাকে একজন প্রকৃত ধর্ম্মপরায়ণা বলিয়া ভুল না করিলেন এমনও নহে, সুতরাং তাহার একটু খ্যাতিও হইল। কিন্তু ইহার সমস্তটাই কৃত্রিম, শীঘ্রই তিনি চুরি করিয়া খাইতে আরম্ভ করিলেন। চুরি করিয়া খাওয়া সকল সময়ে জোটে না, ফল দাঁড়াইল এই যে নব্য মনস্তাত্তিকেরা যাহাকে অবদমন repression বলে, তাহারও তাহাই হইল, নিজে খাইতে পান না বলিয়া অপরের তৃপ্তিপূর্বক আহারও আর তিনি সহ্য করিতে পারেন না। যা-তা করিয়া ঠাকুরের কাঁচকলা তৈয়ার করায় এবং আমাদিগকে নির্ব্বিচারে খাওয়ার কষ্ট দেওয়ার ইহাই অন্তরর্নিহিত কারণ। কৃত্রিমতা আশ্রয় করিয়া চলিতে চলিতে এই মানসিক বিকৃতি তাহার মজ্জাগত হইয়া গিয়াছিল এবং ইচ্ছা করিলেও তাহার আর ফিরিবার উপায় ছিল না। জীবনের শেষ দিন পর্য্যন্ত তিনি এই ভাবেই কাটাইয়া গিয়াছেন। পাটোয়ারী যে কি ভয়াবহ বিকৃতি এবং একবার আরম্ভ হইলে ইহা যে কি মর্ম্মান্তিক দুরবস্থার মধ্যে লইয়া যাইতে পারে, এই দিদিই তাহার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
আলোচনাটা দীর্ঘ হইয়া পড়িতেছে এবং পাঠক-পাঠিকারা হয়তো বিরক্ত হইয়া উঠিতেছেন কিন্তু বিষয়টা এত গুরুতর যে আরও দুই চারিটি কথা না বলিয়া পারিতেছি না। ইষ্টপথের সর্ব্বপ্রধান বাধক এই পাটোয়ারী, সুতরাং ইহাকে যথাসম্ভব বিশ্লেষণ করিয়া বুঝিয়া লওয়া অবশ্য কর্ত্তব্য বলিয়া মনে করি। পূর্ব্বে দুই প্রকারের পাটোয়ারীর উল্লেখ করিয়াছি। তৃতীয়তঃ, আমার মনে হয় যে, অনুকরন প্রবৃত্তি হইতেও ধীরে ধীরে পাটোয়ারী গড়িয়া উঠিতে পারে। বিষয়টা জটিল এবং ইহা লইয়া অনায়াসেই একটা বিতর্কের সৃষ্টি হইতে পারে, সুতরাং আমাদিগকে সাবধানে অগ্রসর হইতে হইবে। ধর্ম্মজীবনের প্রথম অবস্থায় এই অনুকরণ প্রবৃত্তি একটু বিশেষ ভাবে সজাগ হইয়া উঠে। নিজের বিশেষ কোন অভিজ্ঞতা না থাকায় যাহারা এই পথে বহুদিন ধরিয়া আছেন, তাহাদের সহিত আলাপ আলোচনা করিবার এবং কিছুটা তাহাদের অনুকরণ করিবার ইচ্ছা স্বভাবতঃই আসে। নিজের অভিজ্ঞতা হইতে বলিতে পারি যে, যখন কেহ প্রথম ঠাকুরের সম্পর্কে আসিয়াছে, অনেক ক্ষেত্রেই দেখিয়াছি যে পুরাতন আশ্রিতবর্গের মধ্যে যাহাদের অধিক পছন্দ হইয়াছে, তাহাদের অনুকরণের একটা চেষ্টাও সঙ্গে সঙ্গেই আসিয়াছে। ইহা যে একটা গুরুতর অপরাধ এমন কথা আমি বলিতেছি না। পক্ষান্তরে, ক্ষেত্রবিশেষে ইহার প্রয়োজনীয়তাও অস্বীকার করা যায় না। পাঁচজনকে দেখিয়াই শিখিতে হয় এবং নিজের পথ পরিষ্কার করিয়া লইতে হয়। কিন্তু ইহাতে বিপদের সম্ভাবনাও বড় অল্প নহে। একথা ভুলিলে চলিবে না যে, প্রাক্তনানুসারে মানুষের দেহ, মন ও প্রকৃতির গঠন বিভিন্ন প্রকারের হইয়া থাকে এবং এইজন্যই যাহা একের পক্ষে স্বাভাবিক ও মঙ্গলপ্রদ, অপরের পক্ষে ঠিক তাহাই হয়তো অমঙ্গলের কারণ হইতে পারে। এই জন্যই ঠাকুর বলিয়াছেনঃ “পরের বুদ্ধিতে অধিক চলিলে মলিন হয়। আপন বুদ্ধিই সমাদরের যোগ্য।” আরও বলিয়াছেনঃ “পরের ঐশ্বর্য্যের প্রতি লোভ করিতে নাই। নিজের যে টুকু ভক্তি শ্রদ্ধা ভগবান দেন সেইটুক নিয়াই সন্তোষ থাকিতে হয়,” (বেদবাণী, প্রথম খণ্ড, ২০২ এবং ২৮৭ নং)। একটু ধৈর্য ধরিয়া থাকিলে নিজ নিজ স্বভাবোপযোগী অভীষ্ট পন্থা আপনিই গড়িয়া উঠে। কিন্তু ধৈর্য্য বস্তুটা এ সংসারে বিরল এবং সেই জন্যই তাড়াতাড়ি ফল পাইতে গিয়া যেমন “কষা আমে গুড় মাখিয়া লই,” অন্যের অনুকরণ করিতে গিয়াও সেইরূপ নানাবিধ জঞ্জালের সৃষ্টি করিয়া ফেলি।
এই অনুকরণ দুই প্রকারের হইতে পারে, সজাগ ও অন্ধ। যেখানে ইহা সজাগ সেখানে বিশেষ অনিষ্টের আশঙ্কা থাকে না, কারণ শোধরাইবার পথ উন্মুক্তই থাকে। কিন্তু অন্ধ অনুকরণের পাটোয়ারীতে রূপান্তরিত হইতে বিশেষ বিলম্ব হয় না। বাহুল্য ভয়ে এই বিশয়ে শুধু একটি মাত্র দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিব। আমার বিশিষ্ট বন্ধু হরিদাসবাবুর পিতা ৺রুক্সিণীকান্ত আচার্য্য মহাশয়ের মত একজন একনিষ্ঠ ভক্ত ও আদর্শ গৃহী জীবনে অতি অল্পই দেখিয়াছি। তিনি যে কিরূপ আত্মস্থ ছিলেন ছোট একটি ঘটনা বিবৃত করিলেই পাঠক-পাঠিকারা তাহা বুঝিতে পারিবেন। গ্রীষ্মাবকাশের ছুটিতে ঢাকা যাইতেছিলাম, নারায়ণগঞ্জ ষ্টেসনে হরিদাসবাবুর প্রতিবেশী আমাদের অপর একটি বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হইয়া গেল। তাহার নিকট শুনিলাম যে, হরিদাসবাবুর বড় ছেলেটি পূর্ব্বের দিন জলে ডুবিয়া মারা গিয়াছে। কথাটা শুনিয়া মনটা অত্যন্ত বিষণ্ন হইয়া গেল। ছেলেটিকে শিশুকাল হইতেই দেখিয়াছি এবং তাহার প্রতি স্বভাবতঃই একটা স্নেহাকর্ষণ ছিল। কিন্তু সত্য কথা বলিতে কি, বিশেষ চিন্তিত হইয়াছিলাম এই ভাবিয়া যে, এই শোক-সন্তপ্ত পরিবারের মধ্যে যাইবই বা কি করিয়া, আর বলিবই বা কি? সেদিন বৈকালে আর গেলাম না; রেলে, ষ্টীমারে ক্লান্ত হইয়া আসিয়াছি, আজ না-ই বা গেলাম, এই ভাবে মনকে বুঝাইলাম। পরের দিন প্রাতঃকালে চা খাইতে প্রায় ৮টা বাজিয়া গেল, ভয়ানক রৌদ্র উঠিয়াছে, ভীষণ গরম, সুতরাং যাওয়া হইল না। আমি সহজেই বুঝিতে পারিলাম যে, আমার মনটা না-যাইবার অজুহাত খুঁজিয়া বেড়াইতেছে। বৈকালে কিন্তু আর না যাইয়া পারিলাম না, সন্ধ্যার একটু পরে হরিদাসবাবুর বাড়ী আসিয়া পৌঁছিলাম। সেখানে যাইয়া কিন্তু আমার সকল সঙ্কোচ ও দুর্ভাবনার অবসান হইয়া গেল। দেখিলাম যে, আচার্য্য মহাশয় তাহার ঘরে তক্তাপোশের উপর বসিয়া রহিয়াছেন, সমস্ত পরিবারটিই সেখানে। আচার্য্য মহাশয় ঠাকুর প্রসঙ্গ করিতেছেন এবং সকলে তন্ময় হইয়া তাহাই শুনিতেছে। একটা গভীর শোক-সন্তপ্ত পরিবারে এমন একটি সুস্থ, শান্ত চিত্র জীবনে আর কখনও দেখি নাই। শুধু আচার্য্য মহাশয়ের প্রভাবেই ইহা সম্ভব হইয়াছিল। তিনি আমাকে একাধিকবার বলিয়াছেন যে, যে-বস্তুর সন্ধানে দুই দুই বার ভারতের প্রায় সমস্ত তীর্থ পরিভ্রমণ করিয়া বেড়াইয়াছেন, আমাদের ভাগ্যে বৃদ্ধ বয়সে তাহা তিনি ঘরে বসিয়াই পাইয়াছেন। ঠাকুরকে যে তিনি কি চক্ষে দেখিতেন, সামান্য একটা কথাতেই তাহা বুঝা যাইবে। বৈকালে ভাগবতের অন্ততঃ কিছুটা অধ্যয়ন করা আচার্য্য মহাশয়ের নিত্যকর্ম্মের মধ্যে ছিল। তিনি নিয়ম মত বৈকালে ভাগবত খুলিয়া বসিয়াছেন এমন সময় ঠাকুর আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ঠাকুরকে দেখিয়া আচার্য্য মহাশয় উঠিতে যাইতেছেন, এমন সময় ঠাকুর বলিলেনঃ “আপনে ভাগবত পড়েন।” আচার্য্য মহাশয় একবার সম্মুখে বিলম্বিত ভাগবতখানার দিকে এবং একবার ঠাকুরের দিকে অঙ্গুলী নির্দ্দেশ করিয়া বলিলেনঃ “কোন ভাগবত, এই ভাগবত, না ঐ ভাগবত?”
ঠাকুরকে দেখিলেই প্রথমটায় আচার্য্য মহাশয় কেমন যেন বিহ্ল হইয়া পড়িতেন। একদিন বৈকালে আমি, বীরেনবাবু ও আরও একজন ভদ্রলোক ঠাকুরকে সঙ্গে লইয়া তাহার বড়ীতে আসিয়া পৌঁছিলাম। তখন গ্রীষ্মাবকাশ উপলক্ষে আমি ঢাকাতে ছিলাম। বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম যে, বৃদ্ধ আচার্য্য মহাশয় তাহার ঠাকুরঘরের বারান্দায় একখানা মাদুর পাতিয়া বসিয়া রহিয়াছেন। তিনি ঠাকুরকে দেখিয়াই তাড়াতাড়ি উঠিয়া দাঁড়াইতে চেষ্টা করিলেন কিন্তু পারিলেন না, আবার বসিয়া পড়িতে বাধ্য হইলেন। চিৎকার করিয়া হরিদাসবাবুকে ডাকিলেন এবং মাদুরখানা তুলিয়া উঠানে পাতিয়া দিতে অগ্রসর হইলেন। আবার কি ভাবিয়া মাদুরখানা রাখিয়া দিলেন এবং বারান্দার কোণ হইতে একটা বড় পাথরের বাটি তুলিয়া লইলেন, ইচ্ছা যে ঠাকুরের পা ধোয়াইয়া দিবার জন্য জল লইয়া আসিবেন। কিন্তু কূপ হইতে জল তুলিয়া আনা তাহার সাধ্যাতীত, সুতরাং আবার হরিদাসবাবুকে ডাকিলেন। শেষ পর্য্যন্ত কিছুই করিতে না পারিয়া অবশ হইয়া বসিয়া পড়িলেন এবং ঠাকুরের দিকে তাকাইয়া ঝরঝর করিয়া কাঁদিতে লাগিলেন। আচার্য্য মহাশয়ের আচরণের মাধুর্য্য কিছুই প্রকাশ করিতে পারিলাম না, শুধু ইহাই বলিতে পারি যে, এমন মর্ম্মষ্পর্শী আত্ম-বিহ্লতা অতি অল্পই দেখিয়াছি। ঠাকুরও যেভাবে দাঁড়াইয়া ছিলেন এবং যে অপরূপ দৃষ্টিতে আচার্য্য মহাশয়ের দিকে তাকাইয়া ছিলেন, তাহাও অবর্ণনীয়, কিছুই বলিবার চেষ্টা করিব না।
পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, সেখানে বীরেনবাবু ও আরও একজন ভদ্রলোক উপস্থিত ছিলেন। ইহার অনেক দিন পরে ঠাকুরকে সঙ্গে লইয়া সেই ভদ্রলোকের বাসায় যাইতে হইয়াছিল। তিনি তখন তাহার বাহিরের ঘরে একখানা চেয়ারে বসিয়াছিলেন। ঠাকুরকে দেখিয়াই তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন, আবার বসিয়া পড়িলেন, এবং তাহার পরবর্ত্তী কার্য্যকলাপে বুঝিতে কোন কষ্টই হইল না যে, তিনি আচার্য্য মহাশয়কে অনুকরণ করিবার একটা ব্যর্থ প্রয়াস করিতেছেন। ব্যাপারটা এত বিসদৃশ ও হাস্যকর মনে হইল যে, অন্য দিকে মুখ ফিরাইয়া থাকিতে বাধ্য হইলাম। এই ভদ্রলোককে সহজ সরল বলিয়াই জানিতাম। তাহার সহিত আমার যথেষ্ট ঘনিষ্টতা ছিল এবং তাহাকে একটু ভালোও বাসিতাম। কিন্তু এই ঘটনার পর আমার চক্ষু খুলিয়া গেল। ক্রমে বুঝিতে পারিলাম যে, পাটোয়ারী তাহার এমন মজ্জাগত এবং স্বাভাবিক হইয়া গিয়াছিল যে, সহজে কিছু বুঝা যাইত না। চক্ষের সম্মুখে পূর্ব্বোক্ত ব্যাপারটি না ঘটিলে হয়তো তিনি আরও কিছুকাল আমাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া চলিতে পারিতেন। পরে তিনি এতদূর অগ্রসর হইয়াছিলেন যে, ঠাকুরকেও আর মানিতে চাহিতেন না। এই পোড়া দেশে শিষ্যবর্গের অভাব বড় কাহারও একটা হয় না; ইনিও কয়েকজন সংগ্রহ করিয়া লইলেন এবং নিজেকে ঠাকুরের সমকক্ষ এবং কখন কখন ঠাকুর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া প্রচার করিতে লাগিলেন।
এই নিরর্থক অনুকরণ প্রবৃত্তিকে ঠাকুর যে কি চক্ষে দেখিতেন, আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা হইতেই তাহা আমি বলিতে পারি। “ক্ষৌরী হইব, নাপিত ডাকাইয়া আনেন,” এরূপ কথা ঠাকুরের মুখে কখনও শুনিয়াছি বলিয়া মনে পড়ে না। প্রযোজন মত আমরাই নাপিত ডাকাইয়া আনিতাম, ঠাকুরকে বড় একটা জিজ্ঞাসাও করিতাম না। ঠাকুর সেদিন আমার বিডন ষ্ট্রীটের বাসায় ছিলেন। তাঁহার দিকে তাকাইয়া হঠাৎ আমার মনে হইল যে, গোঁফদাড়ি যেন অনেকটা বড় হইয়া গিয়াছে, একবার কামাইয়া দেওয়া প্রয়োজন। তখনই নাপিত ডাকাইলাম এবং ঠাকুরও ছোট ছেলেটির মত নাপিতের সম্মুখে গিয়া বসিলেন। নাপিত তাহার কার্য্য সুরু করিল। ইতিমধ্যে একটা কথা আমার মনে পড়িয়া গেল। বরদাবাবু একদিন আমাকে বলিয়াছিলেন যে, যখনই তিনি ঠাকুরের জন্য নাপিত ডাকেন, দাড়িগোঁফের সঙ্গে সঙ্গে মাথাটিও মুন্ডন করাইয়া দেন। কথাটা আমার মনে পড়ায়, দাড়িগোঁফ কামান হইয়া গেলে মাথাটিও কামাইয়া দিতে নাপিতকে নির্দ্দেশ করিলাম। ইহাতে এক বিপর্য্যয় হইয়া গেল। ঠাকুর এমন ভাবে আমার দিকে তাকাইলেন যে, আমার হাড় পর্য্যন্ত কাঁপিয়া গেল। আমি কিছুই বুঝিতে পারিলাম না এবং মনে মনে একটু ক্ষুণ্নই হইলাম। নাপিতকে বিদায় করিয়া দিয়া ঠাকুরকে একা ফেলিয়াই তেতলায় চলিয়া গেলাম। সেখানে নিরিবিলি একখানা ঘর ছিল, সেই ঘরে একাকীই কিছুক্ষণ বসিয়া রহিলাম। আমার মন তখন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ, ঠাকুরের প্রতি এক নিদারুণ অভিমানে এলোমেলো নানা বিষয়ে চিন্তা করিতে লাগিলাম। ধীরে ধীরে অশান্ত মন শান্ত হইয়া আসিল। একবার ভাবিলাম যে, ঠাকুর একাকী রহিয়াছেন, নীচেই চলিয়া যাই, কিন্তু অভিমান তখনও সম্পূর্ণ তিরোহিত হয় নাই, সুতরাং বসিয়াই রহিলাম। সুস্থ মনে একটু বিচার করিতেই বুঝিলাম যে, ঠাকুর তো অন্যায্য কিছুই করেন নাই, আমার শাসনের প্রয়োজন ছিল, শাসন করিয়াছেন, ইহাতে আমি ক্ষুব্ধ হই কেন? আমি বরদাবাবুর অন্ধ অনুকরণ করিতে গিয়াছিলাম, কাজেই ঠাকুর আমাকে শাসন করিয়াছেন। বরদাবাবু কি ভাবিয়া কি করিতেন তা তো আমি জানি না। বরদাবাবু হয়তো মুণ্ডিতমস্তক ঠাকুরকে দেখিয়া একটা অপার আনন্দ উপভোগ করেন এবং ভাবগ্রাহী ঠাকুরও সেই জন্যই তাহার ইচ্ছায় অসম্মতি প্রকাশ করেন না। আমার তো এ রকম কিছুই মনে হয় নাই। বরদাবাবু করেন, সুতরাং আমিও করি, এইরূপ ভাবিয়াই তো আমি নাপিতকে ইঙ্গিত করিয়াছিলাম। আমার এই অন্ধ অনুকরণ প্রবৃত্তিকে ঠাকুর যে এক কঠোর আঘাত হানিয়াছেন, তাহা আমার মঙ্গলের জন্যই করিয়াছেন, ক্ষোভের বিন্দুমাত্র কারণও ইহাতে নাই। এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে মন শান্ত হইয়া আসিল এবং আবার নীচে নামিয়া আসিলাম। ঠাকুর তখন উপস্থিত ৩/৪ ভদ্রলোককে কি একটা কথা বুঝাইতেছিলেন, আমি উপরে চলিয়া যাইবার পর ইহারা আসিয়াছিলেন। ইহার মধ্যেই ঠাকুর একবার আমার দিকে চাহিলেন। সে চাহনিতে কি ছিল জানি না, কিন্তু আমার হৃদয় জল হইয়া গেল, আমি অশ্রু সংবরণ করিতে পারিলাম না।
প্রসঙ্গটাকে ইচ্ছামত বিস্তার করিবার আরও অনেক উপকরণ আমার হাতে আছে কিন্তু আমি মনে করি যে, যাহা বলা হইয়াছে তাহাই যথেষ্ট। কিন্তু এই অনুকরণ প্রসঙ্গে একটা জটিল প্রশ্নের অবতারণা হইতে পারে। “মহাজনো যেন গতঃ স পন্থা” অর্থাৎ মহাজনের পথই পথ; ঠাকুরের মুখেও শুনিয়াছি যে, পূর্ব্বাপার মহাজনপুঞ্জের পথই পথ। তাহাই যদি হয়, তাহা হইলে মহাজনের পথানুসরণ আর মহাজনের অনুকরণ একই হইয়া দাঁড়ায় কিনা, এরূপ একটা প্রশ্ন স্বভাবতঃই উঠিতে পারে। গীতাতে ভগবান বলিয়াছেনঃ “যদ্যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ” অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যাহা করেন, অন্যান্য লোকেও তাহাই করে। মহতেরা যে দৃষ্টান্ত রাখিয়া যান সাধারণ লোকেরা তাহারই অনুসরণ করিতে চেষ্টা করে। ইহাই যদি সত্য হয়, তাহা হইলে অনুকরণ বৃত্তিকে একান্ত দোষাবহ বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া চলে না। আবার এ কথাও পাওয়া যায় যে, মহাজনেরা তোমাকে যাহা করিতে বলিয়াছেন তাহাই কর, তাঁহাদের আচরণ অনুকরণ করিতে যাইও না, বিপদে পড়িবে। তাঁহাদের কর্ত্তৃত্ববুদ্ধি নাই, স্বভাবেই কর্ম্ম উপস্থিত করে, স্বভাবেই নিস্পন্ন হইয়া যায়, তাঁহারা শুধু সাক্ষীস্বরূপ থাকেন। আর আমরা কর্ম্ম করি কর্ত্তৃত্ববুদ্ধি বা কর্ত্তব্যবুদ্ধির দ্বারা চালিত হইয়া নিজ নিজ বুদ্ধি বিবেচনা মত, সুতরাং তাঁহাদের কর্ম্মে ও আমাদের কর্ম্মে, তাঁহাদের আচরণে ও আমাদের আচরণে একটা মূলগত বৈষম্য রহিয়াছে এবং আমাদের পক্ষে তাঁহাদিগের অনুকরণ বা অনুসরণ সম্ভব ও নহে, যুক্তিযুক্তও নহে। ঠাকুরের এমন অনেক আচরণের খবর আমি জানি, যাহার অনুকরণের কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিতে পারি না। তাহা হইলে মহাজনের দৃষ্টান্ত, মহাজনের পথ, এ সকল কথার অর্থ কি? ঠাকুরের মুখে বিভিন্ন সময়ে যাহা শুনিয়াছি তাহাতে মনে হয় যে ভাগবতকার এই বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত করিয়াছেন তাহাই যুক্তিযুক্ত। রাস পঞ্চাধ্যায়ে ভাগবতকার বলিয়াছেনঃ
“ঈশ্বরাণাং বচঃ সত্যং তথৈবাচরিতং ক্কচিৎ।
তেষাং যৎ স্ববচোযুক্তং বুদ্ধিমাংস্তৎ সমাচরেৎ।।”
শ্রীধর স্বামী ‘ঈশ্বর’ শব্দের অর্থ করিয়াছেন নিরহঙ্কার পুরুষ, অর্থাৎ যাঁহার অহংবুদ্ধি নাই, সুতরাং কর্ত্তৃত্ববুদ্ধিও নাই। এইরূপ যে মহাজন, তাঁহারা যাহা বলেন তাহা সত্য এবং তাঁহাদের আচরণ কখন কখন সত্য, সকল সময়ে সত্য নহে। তাঁহাদের কথার সহিত তাঁহাদের যে যে আচরণের সঙ্গতি থাকে, বুদ্ধিমান ব্যক্তি শুধু সেইগুলিরই অনুসরণ করেন। এই সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করিয়া ভাগবতকার একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিয়াছেন। সমুদ্র মন্থনে বিষ উঠিয়াছে, সেই বিষানলে সৃষ্টি ছারখার হইয়া যাইবার উপক্রম, কেহই কোন উপায় ভাবিয়া পাইতেছে না, এমন সময় মহাদেব আসিয়া সেই অত্যুগ্র হলাহল নিঃশেষে পান করিয়া ফেলিলেন। তাঁহার কন্ঠ নীল হইয়া গেল কিন্তু সৃষ্টি রক্ষা পাইল। আমাদের মধ্যে যদি কেহ এই মহাদেবের আচরণের অনুকরণ করিতে যায় তাহার ফল কি দাঁড়াইবে তাহা না বলিয়া দিলেও চলে।
পাটোয়ারীর প্রসঙ্গটা হয়তো একটু অতিমাত্রায় দীর্ঘ হইয়া গেল, কিন্তু আমার কৈফিয়ৎ এই যে, ঠাকুরের নিকট অনেককেই আসিতে দেখিয়াছি; মদ্যপ, লম্পট, মামলাবাজ, জুয়াচোর, ইত্যাদি অনেকেই আসিয়াছে গিয়াছে কিন্তু ঠাকুরের ব্যবহারে বিশেষ কোন ইতর বিশেষ দেখি নাই। পাটোয়ারের কিন্তু অনেক লাঞ্ছনাই দেখিয়াছি। পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে , ঠাকুর স্পষ্টই বলিতেন যে, পাটোয়ারীর মার্জ্জনা নাই। তথাকথিত সভ্য সমাজে চলিতে হইলে একটু আধটু পাটোয়ারী বোধ হয় অপরিহায্য এবং বিশেষ করিয়া সেইজন্যই প্রথম হইতেই সাবধানতা অবলম্বন করিতে হয়। পাটোয়ারী বুদ্ধি যে কখন কাহাকে কিভাবে পাইয়া বসে তাহা বুঝিয়া উঠা অত্যন্ত দুষ্কর। আমরা দেখিয়াছি যে, সামান্য একটু প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা হইতে ক্রমে মহা অনর্থের সূত্রপাত হইতে পারে। ধর্ম্মার্থীকে সর্ব্বদাই সজাগ থাকিতে হয় এবং অত্যন্ত সতর্কতার সহিত প্রতি পদে অগ্রসর হইতে হয়। কথাই আছে যে, “যেজন শ্রী কৃষ্ণ ভজে সে বড় চতুর।” সজাগ না থাকিলে কখন যে কি হইয়া যাইবে কেহই বলিতে পারে না। এইজন্যই ভক্ত কবি অশ্বিনী দত্ত গাহিয়াছেনঃ
“ঝাঁপ দিয়ে রসের সাগরে, কেউ ভাসে কেউ ডুবে মরে।
নামপ্রেমে মাখা যেমন, কামপ্রেমে মাখা তেমন,
রসিক জানে রসের আস্বাদন।
হংস হ’লে কলে কৌশলে জল ছেড়ে দুধ পান করে,
বেহুসিয়ার হ’লে পরে দংশনেতে ঢলে পড়ে।”