একটা জরুরি কাজ থাকায় ঐকান্তিক ইচ্ছা সত্ত্বেও প্রভাতবাবু আমার বাসায় রাত্রিযাপন করিতে পারিলেন না। প্রতাপবাবু, সুখলালবাবু প্রভৃতিও রাত্রি ১১টার মধ্যেই নিজ নিজ ঘরে চলিয়া গেলেন, সুতরাং ঠাকুরকে একাকীই পাইলাম। পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, তিনি দুইবার নিরুদ্দেশ হইয়া গিয়াছিলেন, সেই সময় কোথায় কি করিয়াছেন তাহা জানিবার একটা কৌতূহল স্বভাবতঃই মনে ছিল। আজ সুযোগ পাইয়া কথাটা ঠাকুরের নিকট উত্থাপন করিলাম। বরদাবাবুর নিকট আমি কিছু কিছু শুনিয়াছিলাম, কিন্তু ঠাকুরের নিজ মুখে কথাগুলি না শোনা পর্য্যন্ত সুস্থির হইতে পারিতেছিলাম না। ঠাকুর কিছুক্ষণ নীরবেই রহিলেন, পরে শুরু করিলেন কৌশিকাশ্রমের কথা। গুরু, ঠাকুর ও তাঁহার দুইজন গুরুভ্রাতা একত্রে হিমালয় ভ্রমণ করিতেছিলেন। ঠাকুরের মুখে তাঁহার চারজন গুরুভ্রাতার কথা অনেকবার শুনিয়াছি, তিনজনের নাম ছিল, যথাক্রমে বৃন্দারণ্য, চৈতন্যভুক্ ও শঙ্করানন্দ; চতুর্থ নামটি স্মরণ করিতে পারিতেছি না। ইঁহাদের মধ্যে দুইজন হিমালয় ভ্রমণকালে কখনও কখনও ঠাকুরের সঙ্গী হইতেন, কোন্ দুইজন তাহা সঠিক বলিতে পারিব না। যাহাই হউক, গুরু তাঁহাদের লইয়া কৌশিকাশ্রমের দিকে অগ্রসর হইলেন। ঠাকুর বলিলেন যে, এই পথ অত্যন্ত দুর্গম, সাধারণ মানুষ সেখানে চলিতে পারে না। তুষারময় দেশ, কোন দিকেই আর কিছু দৃষ্টিগোচর হয় না। কয়েকটি যৌগিক বিভূতি আয়ত্ত করিতে না পারিলে, বিশেষতঃ দীর্ঘ সময়ব্যাপী কুম্ভক (নিশ্বাসরোধ) অবলম্বন না করিলে সেই পথে চলা একেবারেই সম্ভবপর নহে। একস্থানে প্রায় ২৪ ঘণ্টাকাল তাঁহাদিগকে একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়া অগ্রসর হইতে হইয়াছিল। কয়েক মাস চলিয়া তাঁহারা সেই আশ্রমে আসিয়া পৌঁছিলেন, তাঁদের তিনজনকে সেখানে রাখিয়া গুরু অন্যত্র চলিয়া গেলেন। ঠাকুর বলিলেন যে, তাঁহারা সেখানে প্রায় ছয় মাস অবস্থান করিয়াছিলেন। আশ্রমটি অতি মনোরম, তুষার মরুর মধ্যে যেন একটি অতি ক্ষুদ্র মরুদ্যান। আশ্রমে প্রবেশ করিয়াই তাঁহারা দেখিলেন যে, সেখানে পাঁচটি আসন রহিয়াছে, দুইখানা খালি, আর তিনখানাতে তিনজন মহাপুরুষ অধিষ্ঠিত রহিয়াছেন। তাঁহাদের প্রত্যেকেরই শরীর অত্যন্ত শীর্ণ, মাংস একপ্রকার নাই বলিলেই চলে, চামড়া মুচড়াইয়া বুকের পাঁজরার মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া গিয়াছে। মাংস শুকাইয়া যাওয়ায় তাহাদের চক্ষুগুলি কোটর প্রবিষ্ট কিন্তু অত্যন্ত তীক্ষ্ণ এবং উজ্জ্বল। প্রথম সাধুটির সম্বন্ধে ঠাকুর বলিলেন যে, তাঁহার অবয়ব এত দীর্ঘ ছিল যে ঠাকুর যখন তাঁহার সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন তখন দেখিলেন যে উপবিষ্ট অবস্থায়ই তাঁহার উচ্চতা দণ্ডায়মান ঠাকুরের প্রায় সমান। ঠাকুর হাত তুলিয়া তাঁহাকে অভিবাদন জানাইলেন, তিনি সেই ভাবেই প্রত্যভিবাদন করিলেন, কোন কথাবার্তাই হইল না। তাঁহারা তিনজনে এই তিনটি সাধুর সেবার ভার গ্রহণ করিলেন। তিনজনে মিলিয়া সারাদিন আশ্রমটি ঝাঁড়িয়া পুঁছিয়া রাখিতেন। আশ্রমের ধারেই পদ্মজাতীয় কয়েকটি ফুলের গাছ ছিল। প্রতিদিন প্রাতঃকালে প্রত্যেকে ঐ গাছগুলি হইতে একটি ফুল ও একটি পাতা সংগ্রহ করিয়া আনিতেন এবং সুদীর্ঘ বোঁটাটি ছিড়িয়া লইয়া ঐ পাতার উপরে সাধুদের সম্মুখে রাখিয়া একটু দূরে সরিয়া থাকিতেন। ফিরিয়া আসিয়া দেখিতেন যে, পাতাগুলি ঠিকই আছে কিন্তু বোঁটা কয়টি নাই, সহজেই বুঝিতেন যে সাধুরা ঐ বোঁটাগুলি গ্রহণ করিয়াছেন। এইভাবে ৫।৬ মাস কাটিয়া যাইবার পর হঠাৎ একদিন গুরু আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং তাঁহাদিগকে লইয়া ভিন্ন এক পথে যাত্রা শুরু করিলেন। আমি ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম যে, গুরু তাঁহাদের হঠাৎ সেই আশ্রমে রাখিয়া চলিয়া গিয়াছিলেন কেন? ঠাকুর বলিয়াছিলেন যে, দীর্ঘকাল অনাহারে থাকায় ঐ সাধু তিনটির শরীর পতনের উপক্রম হইয়াছিল। আসন ছাড়িয়া উঠিবার নিয়ম না থাকায় তাঁহাদের পক্ষে আহার্য্য সংগ্রহ করাও সম্ভবপর ছিল না। তখনও তাঁহাদের দেহত্যাগের সময় হয় নাই, ঐ দেহের আরও কিছু কাজ অসমাপ্ত রহিয়াছে, সেই জন্যই গুরু এই ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। পাঁচটি আসনের মধ্যে দুইটি খালি ছিল কেন, এই প্রশ্নের উত্তরে ঠাকুর বলিয়াছিলেন যে, ঐ দুইজন কোনও বিশেষ প্রয়োজনে সংসারে যাইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, কার্য্য শেষ হইয়া গেলেই স্বস্থানে ফিরিয়া আসিবেন।
গুরুর নেতৃত্বে আবার তাঁহারা চলিতে আরম্ভ করিলেন। ঠাকুর বলিলেন যে, যাইতে যাইতে একস্থানে তাঁহারা দেখিলেন যে সারি সারি বেদানার গাছ এবং তাহাতে অসংখ্য বেদানা ফলিয়া রহিয়াছে। কাঁচা, পাকা, সব রকমই আছে, কোন কোনটা বা এমন ভাবে ফাটিয়া রহিয়াছে যে, ভেতরের রসাল দানাগুলি বাহির হইয়া পড়িয়াছে, আর গাছের তলায় যে কত পড়িয়া রহিয়াছে, তাহার ইয়ত্তা নাই। প্রায় ৮|১০ মাইল রাস্তা এই বেদানা রাজ্যের ধার দিয়াই তাঁহাদের যাইতে হইয়াছিল। তাঁহারা কিছু বেদানা খাইয়াছিলেন কিনা জিজ্ঞাসা করায় ঠাকুর বলিয়াছিলেন যে, প্রয়োজন হয় নাই। আমি রহস্য করিয়া ঠাকুরকে বলিয়াছিলাম যে, একবার যদি সেখানে যাইবার ও ফিরিবার রাস্তা ভাল করিয়া বাৎলাইয়া দিতেন তবে বোধ হয় দু’চার বৎসরের মধ্যেই বেদানার কারবার করিয়া একেবারে লাল হইয়া যাইতে পারিতাম। আমার কথায় ঠাকুর হাসিয়া উঠিলেন, কিছু বলিয়াছিলেন কিনা ঠিক স্মরণ নাই। যাহা হউক, ইহার পর কিছুদূর চলিয়া তাঁহারা অপর একটি আশ্রমে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। এই আশ্রমের নিশ্চিন্ত, শান্তিময় পরিবেশের কথা ঠাকুর বিশেষ করিয়া বলিয়াছিলেন। বাঘ, ভালুক, হরিণ, নীলগাই এখানে একত্রে বাস করিত, কেহ কাহাকেও হিংসা করিত না। আমরা নিজেরা হিংস্র, সুতরাং আমাদের পক্ষে এরূপ একটা উদ্ভট কথা বিশ্বাস করিয়া উঠা সহজসাধ্য নহে। ঠাকুর কিন্তু বলিলেন যে নিজের ভিতরে হিংসা না থাকিলে মনুষ্যেতর জীবজন্তুরা হিংসা তো করেই না, বরং অনেক সময়ে আনুকূল্যই করে। এই প্রসঙ্গে তাঁহার গত যাত্রায় বৃন্দাবন থাকাকালীন একটি ঘটনার উল্লেখ করিলেন।
বৃন্দাবনে তিনি বাতে আক্রান্ত হইয়াছিলেন, হাঁটু দুইটি ফুলিয়া উঠিয়া তাঁহাকে একেবারে শয্যাশায়ী করিয়াছিল। এই বাতের আক্রমণে তিনি প্রায়ই ভুগিতেন এবং কি করিয়া যে এই রোগ তাঁহার দেহে অনুপ্রবিষ্ট হইয়াছিল “বেদবাণী”র দ্বিতীয় খণ্ডের সম্পাদকীয়তে তাহা সবিস্তারে বলিয়াছি, এখানে আর পুনরুক্তির কোন প্রয়াজন আছে বলিয়া মনে করি না। এ যাত্রায় আক্রমণ একটু বেশীই হইয়াছিল এবং শুশ্রূষা করিবারও কেহ সেখানে ছিল না। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, যখনই যন্ত্রণা দুঃসহ হইয়া উঠিত তখনই কোথা হইতে এক বৃহদাকার হনুমান ঠাকুরের ঘরে ঢুকিয়া খানিকক্ষণ তাঁহার পদসেবা করিয়া যাইত এবং ঠাকুরের যন্ত্রণারও অনেকটা উপশম হইত। এমন কি কুঁজা হইতে গ্লাসে জল গড়াইয়াও ঠাকুরকে খাইতে দিত। ঠাকুর সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিনই হনুমানটি ৩|৪ বার এইভাবে আসা-যাওয়া করিত। কিন্তু ঠাকুর যেদিন রোগমুক্ত হইলেন সেদিন হইতে আর ইহাকে দেখা যায় নাই। যতদূর স্মরণ হয়, এই প্রসঙ্গেই ঠাকুর আমাকে দামিনী মা’ র গল্পটি বলিয়াছিলেন। ভবানীপুর বকুলবাগানে কোনও এক মুখুজ্জ্যে পরিবারের একটি বাগান-বাড়ী ছিল, সেখানেই বাগানের এক কোণে একখানা মাটির ঘরে এক ভদ্রমহিলা বাস করিতেন। ইনি ছিলেন ঠাকুরের একজন একনিষ্ঠ সেবিকা এবং ঠাকুর ইহাকে “দামিনী মা” বলিয়া সম্বোধন করিতেন। দামিনী মা সপ্তাহে একদিন কি দুইদিন প্রাতঃকালে দুটো ভাতেভাত সিদ্ধ করিয়া খাইতেন, আর বাকি কয়দিন শুধু জল খাইয়াই কাটাইয়া দিতেন। ঠাকুর কখনও কখনও এই দামিনী মা’র নিকটে আসিয়া থাকিতেন। দামিনী মা’র দুইটি বিষধর কালসর্প ছিল, তাহারা এই ঘরেই থাকিত, এবং তিনি তাদের নামকরণ করিয়াছিলেন “কানাই, নিতাই” । ঠাকুর বলিলেন যে, যে-দিন দ্বিপ্রহরে রৌদ্র একেবারে ঝাঁ ঝাঁ করিয়া উঠিত এবং অসহ্য গরমে সকলকে অস্থির করিয়া ফেলিত, তখন এই কানাই নিতাই ধীরে ধীরে আসিয়া ঠাকুরের গায়ের উপর শুইয়া থাকিত। ঠাকুরকে এই গ্রীষ্মাতাপের মধ্যে খানিকটা আরামে রাখাই যে তাহাদের উদ্দেশ্য, ইহা সহজেই বোঝা যাইত।
যাহারা ঠাকুরকে জানেন না, তাহাদের অনেকের নিকটেই হয়তো কথাটা নিতান্ত অবিশ্বাস্য বলিয়া মনে হইবে, কিন্তু মনুষ্যেতর জীবজন্তুদের সহিত ঠাকুরের যে একটা অন্তরঙ্গতা ছিল, তিনিও তাহাদের বুঝিতেন এবং তাহারাও তাঁহাকে বুঝিত, এ বিষয়ে আমার নিজের মনে কোন সন্দেহই নাই। কবিবর নবীনচন্দ্র লিখিয়াছেন: “সর্প দংশন করিতে, গরু মহিষ মারিতে আসিতেছে, আর রাম ঠাকুর বারণ করা মাত্র চলিয়া গিয়াছে।” আমি আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা হইতেই কবিবরের এই কথাটার সাক্ষ্য দিতে পারি। “বেদবাণী”র দ্বিতীয় খণ্ডের সম্পাদকীয়তে আমি একটি ঘটনা বিবৃত করিয়াছিলাম, নিতান্ত প্রয়োজনবোধে আবার এইখানে তাহার পুনরুল্লেখ করিব। আমার দর্জিপাড়ার বাসায় “মেজের উপর পাতা বিছানায় ঠাকুর বসিয়া আছেন, আমি ও আর একজন ভদ্রলোক পাশেই একখানা মাদুরের উপর বসিয়া আছি, এমন সময় হঠাৎ দেখি যে, এক ভীষণ-দর্শন বিচ্ছু (কাঁকড়া-বিছা) বিছানার উপর উঠিয়া ধীরে ধীরে উহার দিকে অগ্রসর হইতেছে। আমি চিৎকার করিয়া উঠিলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘরের কোণে রক্ষিত একখানা লাঠি হাতে তুলিয়া লইলাম। ঠাকুর বলিলেন: “মারিবেন না, ও কোন অনিষ্ট করিবে না।“ মনে হইল যেন অঙ্গুলী সঙ্কেতে উহার নিষ্ক্রমনের পথ দেখাইয়া দিলেন এবং আমরা আশ্চর্য্য হইয়া দেখিলাম যে, ঠাকুরের অভিভাবিত পথেই বিচ্ছুটি ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল।” এই ঘটনার আনুমানিক এক বৎসর পরে ঠাকুর আমার সেই বিডন স্ট্রীটের মেসে আসিয়াছিলেন। বৈকালে আমাকে বললেন : “চলেন, একটু বেড়াইয়া আসি।” তৎক্ষণাৎ বাহির হইয়া পড়িলাম এবং বিডন স্ট্রীট ধরিয়া পশ্চিম দিকে চলিয়া সেন্ট্রাল এভেনিউর মোড়ে আসিয়া পৌঁছিলাম। এই রাস্তাটা তখনও ভালভাবে চালু হয় নাই, তথাপি ঠাকুর এই পথেই দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হইলেন এবং খানিক দূর যাইয়া বাঁ হাতের একটা গলিতে ঢুকিয়া আবার পূর্ব্ব দিকে চলিতে লাগিলেন, আমিও সঙ্গে সঙ্গে চলিলাম। কিছুদূর আসিতেই “পালান, পালান, মোষ ক্ষেপেছে, মোষ ক্ষেপেছে”, একাধিক ব্যক্তির এইরূপ মিলিত চিৎকার কানে আসিল। নিকটেই একটা সঙ্কীর্ণ গলি ছিল, আমি ঠাকুরকে বলিলামঃ “চলুন, এই গলির ভিতর ঢুকিয়া পড়ি।” ঠাকুর বলিলেনঃ “কোন ভয় নাই, এখানেই দাঁড়াইয়া থাকেন।” আমি ঠাকুরের পাশ ঘেঁষিয়া দাঁড়াইলাম, ভয় যে ছিল না এমন কথা বলিলে মিথ্যা কথা বলা হইবে। আধ মিনিটের মধ্যেই দেখিলাম যে, একটা প্রকাণ্ড মোষ শিং উচাইয়া ক্ষিপ্রবেগে ধাইয়া আসিতেছে। ঠাকুর একদৃষ্টে মোষটার দিকে তাকাইয়া রহিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই উহার গতি মন্থর হইয়া গেল। আমাদের নিকটে আসিয়া মোষটা একটু দাঁড়াইল, ঠাকুর উহার গায়ে হাত বুলাইয়া দিলেন এবং সে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক গতিতে চলিয়া গেল, ক্ষিপ্ততার আর কোন লক্ষণই তাহার মধ্যে দেখা গেল না।
এই দুইটি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে আমি দৃঢ়তার সহিত বলিতে পারি যে, ঠাকুরের সঙ্গে এই জন্তু জানোয়ারের যে একটা বোঝাপড়া ছিল তাহা আমি অকপটে বিশ্বাস করি। ঠাকুরের মুখে শোনা যে দুইটি ঘটনা বিবৃত করিয়াছি তাহাও আমার নিকট প্রত্যক্ষেরই সমতুল্য, সুতরাং এই বিষয়ে আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নাই। তথাপি পাঠক-পাঠিকাদের অবগতির জন্য অত্যন্ত বিশ্বস্ত সূত্রে জানা আরও চারিটি ঘটনার উল্লেখ করিব। শ্রীশ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় বর্তমানে পাহাড়তলী কৈবলাধাম ও অন্যান্য তিনটি ধামের মোহান্ত মহারাজ পদে অধিষ্ঠিত আছেন।* তাঁহাকে পূর্ব্বাপর শ্যামাদা’ বলিয়াই ডাকিয়া আসিয়াছি, সুতরাং এই নামেই তাঁহার উল্লেখ করিব। শ্যামাদা’ একবার কাশীতে ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলেন। সেখানে যাইয়া অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলেন যে, ঠাকুর কাশী শহরের বাহিরে একটা ভাঙ্গা বাড়ীতে অবস্থান করিতেছেন, অনেক কষ্টে খুঁজিয়া খুঁজিয়া শ্যামাদা’ সেই বাড়ীটি বাহির করিলেন। শ্যামাদা’ দেখিলেন যে, একটি স্ত্রীলোক দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন কিন্তু তাঁহাকে দেখিয়াই স্ত্রীলোকটি সরিয়া গেলেন, শ্যামাদা’ আর কাহাকেও সেখানে দেখিতে পাইলেন না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া রহিলেন, শেষে উপায়ান্তর না দেখিয়া একটা ভাঙ্গা সিঁড়ি ধরিয়া উপরে চলিয়া গেলেন। সম্মুখেই একখানা ঘর, খোলা দরজার নিকট যাইতেই দেখিলেন যে, ঠাকুর বসিয়া রহিয়াছেন এবং প্রকাণ্ড একটা সাপ ঠাকুরের সারা অঙ্গ জড়াইয়া তাঁহার ঘাড়ের উপর মাথাটি রাখিয়া স্থির হইয়া রহিয়াছে। শ্যামাদা’কে দেখিয়া ঠাকুর বলিলেনঃ “আপনি এখানে কেন? শীগ্গির চলিয়া যান।” উত্তরে শ্যামাদা’ বলিলেন যে, ঠাকুরের খোঁজেই তিনি আসিয়াছেন এবং তখনই চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলেন কিন্তু যাইবার পূর্ব্বে একবার ঐ সাপের কথাটা জিজ্ঞাসা না করিয়া পারিলেন না। তাহাতে ঠাকুর বলিলেন যে, তাঁহার জ্বর হইয়াছে এবং নিকটে কেহই নাই দেখিয়া এই সাপটি আসিয়া তাঁহারা পরিচর্য্যা করিতেছে। এই কথার পর শ্যামাদা’ আর সেখানে দাঁড়াইলেন না, দরজা হইতেই ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া বাহির হইয়া গেলেন। আরও একটি ঘটনার কথা শ্যামাদা’র মুখে শুনিয়াছিলাম। তিনি এবং আর একজন ভদ্রলোক ঠাকুরকে সঙ্গে লইয়া বিক্রমপুরে কোথায় যেন যাইতেছিলেন। কিছুক্ষণ চলিবার পর তাঁহারা দেখিলেন যে, কিছু দূরে প্রকাণ্ড একটা বানর সঙ্কীর্ণ রাস্তাটি আটকাইয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। এই অঞ্চলের বানরগুলি অত্যন্ত হিংস্র, কখন কখন মানুষ ধরিয়া টানিয়া ছিড়িয়া ফেলিয়াছে, এরূপ খবরও শোনা যাইত, সুতরাং শ্যামাদা’ এবং তাঁহার সঙ্গী সেই ভদ্রলোকটি স্বভাবতঃই একটু ভীত হইলেন। ঠাকুর কিন্তু বলিলেন যে, কোন ভয়ের কারণ নাই, বানরটা কিছুই করিবে না এবং আগাইয়াই চলিলেন। ঠাকুর ঐ বানরটির নিকটে আসিতেই শ্যামাদা’ ও তাঁহার সঙ্গী সেই ভদ্রলোকটি আশ্চর্য্য হইয়া দেখিলেন যে, সে মাটিতে মাথা ঠেকাইয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিল এবং পরে ধীরে ধীরে একদিকে চলিয়া গেল।
তৃতীয় দৃষ্টান্তটি পাইয়াছি ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রীমহেন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী মহাশয়ের নিকট হইতে। ঠাকুর তখন ডিঙ্গামানিকে তাঁহাদের বাড়ীতে ছিলেন। এক ভদ্রলোকের বাড়ীতে সত্যনারায়ণ পূজার ব্যবস্থা ছিল, তিনি আসিয়া ঠাকুরকে ধরিলেন যে, এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে তাঁহাকেও একবার ঐ ভদ্রলোকের বাড়ীতে পায়ের ধূলা দিতে হইবে। ঠাকুর স্বীকৃত হইলেন এবং সেই দিন সন্ধ্যার সময় দুইজন ব্যক্তিকে সঙ্গে লইয়া সেই ভদ্রলোকের বাড়ীর দিকে রওয়ানা হইলেন। সেখানে যাইতে হইলে একটি ছোট মাঠ পার হইয়া যাইতে হইত। এই মাঠের মধ্য দিয়া যাইবার সময় হঠাৎ ঠাকুরের পা এক সাপের গায়ে পড়িয়া গেল এবং সঙ্গে সঙ্গেই এক ভীষণ গোক্ষুর ফণা তুলিয়া তর্জন করিয়া উঠিল। সমভিব্যাহারী ভদ্রলোক দুইটি ভয়ে দূরে সরিয়া গেলেন, ঠাকুর কিন্তু দাঁড়াইয়াই রহিলেন এবং মৃদুস্বরে সেই সাপকে বলিলেনঃ “আমি না জানিয়া তোমাকে ব্যথা দিয়াছি, আমাকে ক্ষমা কর।” এই কথার পর সাপটা ফণা নামাইয়া ধীরে ধীরে একদিকে চলিয়া গেল। চতুর্থ ঘটনাটি আমি স্নেহভাজন কেশবের (বাল্যকাল হইতেই ঠাকুরের শ্রীচরণাশ্রিত শ্রীকেশবচন্দ্র গুহ, ইনি রেলবিভাগে চাকুরী করেন) মুখে শুনিয়াছি। ঠাকুর চৌমুহনী থাকাকালীন কেশব একবার তিন দিনের ছুটি লইয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিল। সে যেদিন সেখানে পৌঁছায় তার পরের দিন বিকাল বেলা হঠাৎ একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ রবে ভীষণভাবে চিৎকার সুরু করিয়া দিল। কুকুরটি ঠাকুরের নিকট ঐ বাড়ীতেই থাকিত। নিতান্ত শান্তশিষ্ট কুকুর, হঠাৎ তাহার এই চিৎকারের কারণ কেহই বুঝিয়া উঠিতে পারিল না। কুকুরের এই কর্ণভেদী ঘেউ ঘেউ আর্তনাদ প্রায় এক ঘণ্টা ধরিয়া চলিল এবং উপস্থিত সকলেই অস্থির হইয়া উঠিলেন। ঠাকুর তখন তাঁহার ঘরে খাটে চিং হইয়া বুকের উপর হাত দুইটি রাখিয়া চক্ষু বুজিয়া শুইয়া ছিলেন। মেঝেতে সতরঞ্চির উপর কয়েক জন, ভদ্রলোক বসিয়া ছিলেন, কেশবও সেইখানেই ছিল। হঠাৎ দেখা গেল যে, কুকুটি দরজার নিকটে আসিয়া এক লাফে ভদ্রলোকদের ডিঙ্গাইয়া ঠাকুরের খাটের কাছে আসিল এবং সম্মু্খের পা দুইটি খাটের উপর তুলিয়া ঠাকুরের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল। কেশব আমাকে বলিয়াছে যে তাহার স্পষ্টই মনে হইয়াছিল যে, কুকুরটি যেন ঠাকুরের কাছে কোন একটা নালিশ জানাইতেছে। ২|৩ মিনিট এই ভাবে থাকিয়া কুকুরটি আবার ভদ্রলোকদের ডিঙ্গাইয়া বাহির হইয়া গেল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঠাকুরও উঠিয়া বসিলেন। ঠাকুর জিজ্ঞাসা করিলেনঃ “এখানে পশুর ডাক্তার পাওয়া না?” উপস্থিত একজন ভদ্রলোক বলিলেন “না বাবা, এখানে পাওয়া যায় না, নোয়াখালীতে পাওয়া যায়।” ইহার পর ঠাকুর সেখানকার তত্ত্বাবধায়কদিগকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেনঃ “আপনারা কিছুই দেখেন না, ওকে একটু যত্ন করবেন, যা-তা খাইতে দিবেন না। শজনা ডাঁটা খাইতে দিয়াছিলেন, সেই ডাঁটা ওর গলায় আটকাইয়া গিয়াছিল।” ঠাকুরের এই কথার পরেই ধীরে ধীরে কুকুরের সেই চিৎকার থামিয়া গেল। এতগুলি লোকের মধ্যে একমাত্র ঠাকুরই যে একটা উপায় করিয়া দিতে পারেন, কুকুর তাহা বুঝিল এবং তাহার আবেদনের মর্ম বুঝিয়া লইতে ঠাকুরেরও বিলম্ব হইল না।
এই জাতীয় আরও কয়েকটি ঘটনা আমার জানা আছে কিন্তু তাহাদের সত্যতা সম্বন্ধে নিঃসন্দিদ্ধ হইতে না পারায় এখানে সেগুলির কোন উল্লেখ করিলাম না। যাহাই হউক, যাহা বলা হইয়াছে তাহা হইতে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, ঠাকুরের সঙ্গে মনুষ্যেতর জীবজন্তুদের একটা ঘনিষ্ঠ অন্তরঙ্গতা ছিল কিন্তু বিষয়টা আমাদের সাধারণ বুদ্ধির অগম্য। ঠাকুরের সঙ্গে এই কথাটা লইয়া আলোচনা করিবার সুযোগ আমি একাধিকবার পাইয়াছি এবং তাঁহার কথার ভাবে যাহা বুঝিয়াছি তাহাই সংক্ষেপে এইখানে বলিবার চেষ্টা করিব। পূৰ্বেই বলিয়াছি যে, ঠাকুর বলিতেন যে নিজের মধ্যে হিংসা না থাকিলে অপরেও হিংসা করে না। একদিন প্রসঙ্গক্রমে আমাকে বলিয়াছিলেন যে, “প্রাণে”র সঙ্গে আত্মীয়তা করিয়া লইতে পারিলে সকল “প্রাণী”ই আত্মীয় হইয়া যায়, কাহারও সহিত আর কোন বাদ-বিসম্বাদ থাকে না। প্রাণ মূলতঃ এক, আধার-ভেদে বিভিন্ন বলিয়া প্রতীয়মান হয় মাত্র। যেমন ইলেকট্রিক বাল্ব নানা প্রকারেরই হইতে পারে, ৫, ১০, ৫০, ৬০, ১০০, ৫০০, ১০০০ প্রভৃতি বিভিন্ন শক্তির হইতে পারে, রঙও সাদা, লাল, হলুদ প্রভৃতি নানা রকমের হইতে পারে, কিন্তু যে-বৈদ্যুতিক শক্তির প্রভাবে ইহারা জ্বলে তাহা একই, প্রাণও ঠিক তদ্রূপই। বিভিন্ন জীবে আবরণ-ভেদে পৃথক বলিয়া মনে হইলেও বস্তুটি এক এবং এই প্রাণকে স্বরূপতঃ বুঝিতে পারিলে যাবতীয় প্রাণীকেই বুঝিতে পারা যায়। ইহাই মিত্রভাবের ভিত্তি। একখানি পত্রে ঠাকুর লিখিয়াছিলেনঃ “মিত্রভাবে সর্বদাই সর্বভূতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব দর্শণ, ঈশ্বরকে ভালবাসা, সকলের মধ্যেই আত্মার মত অর্থাৎ আপন শরীরে যেমন সুখদুঃখ অনুভূতি হয়, তদ্রূপ পরদেহে আপন দেহের মতন সুখদুঃখ বোধ করিতে পারিলে মিত্রভাব হয়। ইহাই প্রেম বলে, পরহিতে রত ইহাই মিত্রভাব। ইহা যদি স্থায়ী হয় তাতেই সর্বদা মিত্রভাবে ভগবানকে পায়। (বেদবাণী, দ্বিতীয় খণ্ড, ১৩৬ নং) । প্রকৃত অহিংসারও ইহাই বনিয়াদ; বলাবাহুল্য যে অধুনা প্রচলিত অহিংসার সঙ্গে ইহার কোনও সম্পর্ক নাই।
সে যাহাই হউক, পরের দিন প্রাতঃকালে আবার অনেকে আসিয়া জুটিলেন। এক জনের কথা বেশ স্পষ্ট মনে আছে। ইনি একজনপাঠক, ভাগবত পাঠ এবং কথকতাই ইহার উপজীবিকা ছিল। আমি ইহাকে চিনিতাম এবং ইতিপূর্বে দু’তিন জায়গায় আমি ইহার ব্যাখ্যাও শুনিয়াছিলাম। এই ভদ্রলোক সাষ্টাঙ্গে ঠাকুরকে প্রণাম করিলেন এবং পরে অত্যন্ত বিনীতভাবে বলিলেনঃ “পেটের দায়ে ভাগবত শুনাই, কিছুই জানি না, কিছুই বুঝি না। আমার একমাত্র সান্ত্বনা এই যে, ইহাই আমার পুরুষানুক্রমিক বৃত্তি, বাপ দাদা ও করিয়া গিয়াছেন, আমিও করিতেছি। কিন্তু জানিয়া শুনিয়া এই যে অপরাধ করিতেছি, ইহার কি মার্জনা নাই?” ঠাকুর বলিলেনঃ “বৃত্তি হিসাবে ভাগবত পাঠ অপরাধ হয় না, অপরাধ হয় পাটোয়ারীতে।” আর কোনও কথা হইল না। কিছুক্ষণ পরে ভদ্রলোক উঠিলেন এবং আমিও তাহার সঙ্গে বাহির হইয়া আসিলাম। তিনি তামাক খাইতেন জানিতাম, সুতরাং তামাকের বন্দোবস্ত করিয়া তাহাকে লইয়া পাশের ঘরে গিয়া বসিলাম। পাঠক মহাশয় বলিতে লাগিলেন যে, ঠাকুরের কথায় আজ তাহার ঘাড় হইতে মস্ত একটা বোঝা নামিয়া গিয়াছে। তাহার ভাগবত পাঠ যে নানাপ্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়, ইহা তাহার অবিদিত নাই এবং এজন্য নিজেকে সর্বদা নিতান্ত অপরাধী বলিয়া গণ্য করিতেন। কিন্তু আজ ঠাকুরের কথায় তিনি আশ্বস্ত হইয়াছেন এবং তাহার মন হালকা হইয়া গিয়াছে। একটু পরে আমাকে বলিলেনঃ “কিন্তু পাটোয়ারীর কথা ঠাকুর কি বলিলেন ঠিক বুঝিতে পারিলাম না।” আমি তাহাকে বলিলাম যে, মিথ্যা আচরণকেই ঠাকুর বলেন পাটোয়ারী। তাহাদের অর্থাৎ পাঠকশ্রেণীর ব্যক্তিদের পক্ষে পাটোয়ারীর বিরুদ্ধে সজাগ থাকা বিশেষভাবে প্রয়োজন। ব্যবসার খাতিরে এবং পরিস্থিতির চাপে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খানিকটা পাটোয়ারী তাহাদের পক্ষে অপরিহার্য্য হইয়া পড়ে। তাহারা সর্বদা ধর্মোপদেশ দিয়া বেড়ান এবং লোকে স্বভাবতঃই মনে করে যে, যে-উপদেশ তাহারা বিতরণ করিতেছেন, তাহার অন্ততঃ কিছুটা নিশ্চয়ই তাহারা অর্জ্জন করিয়াছেন। ব্যাসাসনে যাহারা বসেন তাহাদের প্রতি লোকেরমনে স্বভাবতঃই একটা শ্রদ্ধার ভাব জাগিয়া উঠে এবং এই শ্রদ্ধা কার্য্যের দ্বারা অভিব্যক্ত করিতেও তাহারা কার্পণ্য করেন না, প্রণামের ছড়াছড়ি পড়িয়া যায়, উপটৌকনের ভিড় জমিয়া উঠে। এমতাবস্থায় সম্পূর্ণরূপে পাটোয়ারী বর্জন করিয়া চলা অত্যন্ত দুষ্কর হইয়া পড়ে এবং এই বিষয়ে সাবধান হইতেই ঠাকুর তাহাকে বলিয়াছেন। পাঠক মহাশয় আমার কথার সারবত্তা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিলেন এবং একটু পরেই বিদায় লইলেন। ইহার ঘণ্টাখানেক পরে ঠাকুরও অন্যত্র চলিয়া গেলেন।