যতদূর স্মরণ হয়;১৯২০ খ্রীষ্টাব্দের জুলাই মাসের শেষের দিকে বরদাবাবু একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন এবং ঠাকুরের একখানি চিঠি আমাকে দেখাইলেন। ঠাকুর লিখিয়াছিলেন যে,তিনি বৃন্দাবন হইতে শীঘ্রই কলিকাতা আসিবেন, নিরিবিলি থাকিতে পারেন এমন একটি স্থান যেন বরদাবাবু তাঁহার জন্য স্থির করিয়া রাখেন। প্রভাতবাবুকেও চিঠিখানা দেখান হইল। তাহার বাড়ীতে তখন নিতান্তই স্থানাভাব, আর এদিকে আমার বাড়ীতে তেতলায় নির্জ্জন একখানা ঘর ছিল, আমার লেখাপড়ার কাজে ব্যবহৃত হইত। কিছুক্ষণ আলোচনার পর স্থির হইল যে, ঠাকুর আসিয়া আমার বাড়ীতেই উঠিবেন। বরদাবাবু চিঠিতে ঠাকুরকে এই বন্দোবস্তের কথা জানাইয়া দিলেন।
ইহার প্রায় ১০/১২ দিন পরে বরদাবাবু আমাকে জানাইলেন যে, ঠাকুরের উত্তর আসিয়াছে, তিনি অমুখ তারিখে(সঠিক তারিখটি কিছুতেই মনে করিতে পারিতেছি না) কলিকাতায় পৌঁছিবেন এবং আমার বাড়ীতেই থাকিবেন। আমি উৎফুল্ল হইয়া উঠিলাম কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটু আতঙ্কও যে না হইল, তাহাও বলিতে পারি না। তখন আমি ঠাকুরের সম্বন্ধে বলিতে গেলে কিছুই জানি না, তিনি আমার এখানে আসিলে যথারীতি তাঁহার সেবা-পরিচর্য্যা করিয়া উঠিতে পারিব কিনা সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল, সুতরাং কি করিতে হইবে, না হইবে, ইত্যাদি খুঁটিনাটি বরদাবাবুকে জিজ্ঞাসা করিতে উদ্যত হইলাম কিন্তু বরদাবাবু দু’একটা কথাতেই আমার সকল প্রশ্নের অবসান করিয়া দিলেন। তিনি বলিলেন: “আপনাকে কিছুই করিতে হইবে না, শুধু একখানা বিছানা পাতিয়া দিলেই চলিবে। ঠাকুর স্নান করেন না, আহারও একপ্রকার নাই বলিলেই চলে, কোন ঝঞ্ঝাটই নাই , আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আর আমি যখন অনেক সময়ই এখানে থাকিব, কোন অসুবিধা হইবে না। “বরদাবাবুর কথাতে অনেকটা আশ্বস্ত হইলাম বটে কিন্তু তবুও একেবারে নিশ্চিন্ত হইতে পারিলাম না।
কিন্তু ঠাকুর আসিবেন, এই আনন্দে আনুষঙ্গিক দুশ্চিন্তাগুলি শীঘ্রই চাপা পড়িয়া গেল, আমি সাগ্রহে সেই অতি শুভ দিনটির প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম। বরদাবাবু বলিয়াছিলেন যে, ঠাকুর সকাল বেলা ৯টা নাগাদ পৌঁছিবেন, আমি পূর্ব্বের দিনই ঘরদোর পরিষ্কার করাইয়া এবং ঠাকুরের বিছানাদির ব্যবস্থা করিয়া প্রস্তুত হইয়া রহিলাম। রাত্রিতে ভালো ঘুম হইল না, ভোর হইতেই অনর্থক উপর নীচ করিয়া, ৫/১০ মিনিট অন্তর ঘড়ি দেখিয়া রাস্তার দিকে তাকাইতে লাগিলাম। ক্রমে ৮টা, ৯টা, ১০টা বাজিয়া গেল কিন্তু ঠাকুর আসিলেন না। যখন ১১ টা বাজিয়া গেল, তখন আমি সকল আশা পরিত্যাগ করিয়া বিছানায় আসিয়া শুইয়া পড়িলাম। মনটা অত্যন্ত খারাপ হইয়া গেল।
তখন বুঝি নাই কিন্তু এখন বুঝিতে পারি, এই যে না-আসা ইহাও তাঁহার একটি পরম আশীর্ব্বাদ। ইহার পর আনুমানিক দুই সপ্তাহ কাল যেরূপ উৎকণ্ঠা, যেরূপ আবেগ ও যেরূপ আকুতি লইয়া কাটাইয়াছিলাম ও যেরূপ অনন্যভাব তাঁহার চিন্তা করিয়াছিলাম, তেমন বোধ হয় জীবনে আর কখনও হয় নাই। আমি তখন ২৫/২৬ বৎসর বয়স্ক তরলমতি যুবক, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও কিছু কিছু ঐতিহাসিক গবেষণার প্রাথমিক চেষ্টা, গান্ধীবাদ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ক্রিকেট, ফুটবল, সিনেমা, থিয়েটার ইত্যাদিতে বেশ মশগুল হইয়া আছি, দাবা খেলিয়া ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে রহস্যালাপেও অনেকটা সময় কাটাইয়া দেই; এহেন যে নিতান্ত বহির্মুখ আমি, সেই আমাকেও সব ভুলাইয়া একটা প্রবল আকর্ষণে টানিতে লাগিল। এ যে কি আকর্ষণ এবং ইহার যে কি শক্তি, তাহা বলিয়া বুঝান যাইব না। যিনি কখনও ইহা অনুভব করিয়াছেন শুধু তিনিই বুঝিতে পারিবেন। বৈষ্ণব কবিদিগের পূর্ব্বরাগের পদগুলির তাৎপর্য্য যেন নূতন করিয়া উপলব্ধি করিলাম।
এইভাবে প্রায় ১০/১২ দিন কাটিয়া গেল। মাঝে বরদাবাবু একদিন জানাইয়া গিয়াছিলেন যে, ঠাকুরের আর কোনও সংবাদ তিনি পান নাই, ঠাকুর কি করিলেন কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। আরও কয়েকদিন পরে বেলা প্রায় ১১টার সময় আমি কলেজে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছিলাম, এমন সময় সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনিতে পাইলাম। আমি তখন বিলাতী পোষাক পড়িতাম, আয়নার সামনে দাঁড়াইয়া টাই বাঁধিতে ছিলাম, সুতরাং বিশেষ মনোযোগ করিলাম না, ভাবিলাম আর কেহ দরজা খুলিয়া দিবে। আবার ডাক শুনিলাম “ইন্দুবাবু, ইন্দুবাবু”, মনে হইল যেন বরদাবাবুর গলা। আমি তাড়াতাড়ি দোতলার জানালা দিয়া উঁকি মারিয়া দেখিলাম যে, একটি থলিয়া হাতে বরদাবাবু দাঁড়াইয়া আছেন এবং তাহার পাশেই ঠাকুর। আমি তৎক্ষণাৎ টাইটা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া দ্রুতপদে নীচে নামিয়া গেলাম এবং দরজা খুলিয়া প্রাণ ভরিয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিলাম। পরে তাঁহাকে তেতলার সেই নির্দিষ্ট ঘরে লইয়া আসিলাম, বরদাবাবুও সঙ্গে সঙ্গে আসিলেন। পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে ঘরটি পরিষ্কার করিয়া ঠাকুরের জন্য যথাযথ ভাবে সাজাইয়া রাখিয়াছিলাম এবং সেই ব্যবস্থাই অক্ষুন্ন ছিল। বরদাবাবু ও আমি ঠাকুরের বিছানাটা পাতিয়া ফেলিলাম, বরদাবাবু ঠাকুরের পা ধোয়াইয়া দিলেন; তিনি আসিয়া বিছানার উপরে বসিলেন। কোন কথাই বলিতে পারিলাম না, শুধু অপলক দৃষ্টিতে ঠাকুরের দিকে তাকাইয়া রইলাম। তিনিও আমার দিকেই তাকাইয়াছিলেন এবং মৃদু মৃদু হাসিতেছিলেন। কি দেখিয়াছিলাম জানি না, কিন্তু সেই দেখাটা আজও আমার মনে অক্ষয় হইয়া আছে।
প্রথমে তিনিই কথা বলিলেন। আমার কলেজের দেরী হইয়া যাইতেছে বলিয়া আমাকে চলিয়া যাইতে বলিলেন। আমি বলিলাম: “আজ আপনি আসিয়াছেন, কলেজে আর যাইব না, একদিন অনায়াসেই ছুটি লইতে পারিব। ” কিন্তু ঠাকুর বলিলেন যে, আমি চলিয়া গেলে তাঁহার কোন অসুবিধাই হইবে না, সুতরাং যাইতে হইল। বরদাবাবু ঠাকুরের নিকটেই রহিলেন, আমার স্ত্রীকে যথাকর্ত্তব্য উপদেশ দিয়া কলেজে চলিয়া গেলাম। ঘটনাটা সামান্য, কিন্তু তাৎপর্য্য সামান্য নয়। গোড়াতেই ঠাকুর আমায় বুঝাইয়া দিলেন যে, তাঁহার সহিত চলিতে হইলে কোন প্রকার ফাঁকি চলিবে না, কোন অজুহাতেই কর্ত্তব্যকর্ম্মের অবহেলা তিনি অনুমোদন করিবেন না। কথাটা অত্যন্ত গুরুতর এবং ঠাকুরের মূল শিক্ষার সহিত অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কিন্তু এখানে এই বিষয়ের কোন বিস্তৃত আলোচনা সমীচীন হইবে বলিয়া মনে হয় না। আমার বিশ্বাস আছে যে, প্রসঙ্গক্রমে কথাটা আপনিই পরিস্ফুট হইবে। যাহাই হউক , সেদিনকার আর বিশেষ কোনও ঘটনা মনে পড়ে না। পরের দিন কলেজ ছিল না, আমি সকালবেলা নিশ্চিন্ত মনে ঠাকুরের কাছে বসিয়া আছি, হঠাৎ ঠাকুর একখানা কাগজ ও কালি-কলম চাহিলেন। জিনিষগুলি নিকটেই ছিল, ঠাকুরকে দিতেই তিনি কিছুক্ষণ ধরিয়া নিবিষ্ট মনে কাগজখানার উপর একটি মনুষ্য দেহ আঁকিলেন, এবং পরে ঐ অঙ্কনটির সাহায্যে দেহতত্ব সম্বন্ধে প্রায় আধঘণ্টা ধরিয়া নানা কথা বলিলেন। ইহার পর তিনি আমাকে একটি”নাম”দিলেন এবং এই নামসাধনের একটি বিশেষ প্রক্রিয়া যত্ন সহকারে বুঝাইয়া বলিলেন। লৌকিক অর্থে আমি ঠাকুরের আশ্রিত পর্যায়ভুক্ত হইলাম।
কিন্তু এই “নাম”পাওয়ায় আমি বিশেষ কোনও পরিবর্ত্তন অনুভব করিলাম না। চিরাচরিত সংস্কার বশে এই “নামের”জন্য একটা আগ্রহ ছিল সন্দেহ নাই, কিন্তু দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের পর হইতে ধীরে ধীরে ঠাকুরের সঙ্গে একটা প্রীতির সম্পর্ক গড়িয়া উঠায় এই আগ্রহ অনেকটা শিথিল হইয়া গিয়াছিল। পরবর্ত্তী জীবনে অনেক সময়ে মনে হইয়াছে যে, এই ” নাম “না পাইলেও বোধ হয় বিশেষ কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হইত না, ঠাকুরের স্নেহানুগ্রহ সমানভাবেই পাইতাম। একটা দৃষ্টান্তের সাহায্যে আমার বক্তব্যটা পরিস্ফুট করিতে চেষ্টা করিব। ঢাকা জেলার অন্তর্গত বারদী গ্রামে শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার আশ্রমে প্রতি বৎসর ১৯শে জৈষ্ঠ তারিখে তাঁহার তিরোভাব উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসবে একাধিকবার যোগদান করার সৌভাগ্য আমার হইয়াছিল। সেখানে এক ভদ্রলোকের সহিত আমার পরিচয় হয় এবং তাহার অবিচলিত ইষ্ট-নিষ্ঠা দেখিয়া তাহার প্রতি বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট হই। একদিন কথাপ্রসঙ্গে ভদ্রলোকের বয়সের কথা উঠিয়া পড়িল এবং মনে মনে একটা হিসাব করিয়া দেখিলাম যে, ব্রহ্মচারী বাবার দেহত্যাগের সময় ইহার বয়স ৬/৭ বৎসরের অধিক হইতে পারে না। এত অল্প বয়সে ইহার দীক্ষা না হওয়াই সম্ভব, তাহা হইলে ভদ্রলোকের এই ইষ্ট-নিষ্ঠা ও ইষ্টপ্রীতি কোথা হইতে আসিল? কথাটা তাহাকে জিজ্ঞাসা না করিয়া পারিলাম না এবং উত্তরে তিনি বলিলেন: “আমার যখন ৬/৭ বৎসর বয়স তখন প্রায়ই পিসিমার সঙ্গে বাবার আশ্রমে আসিতাম। একদিন দেখি যে, এক ভদ্রলোক কতকগুলি আম আনিয়া বাবাকে উপঢৌকন দিলেন। আমগুলি বেশ বড় বড়, দেখিয়া মনে হইল যে খাইতেও বেশ সরসই হইবে। লোভ সংবরণ করিতে পারিলাম না, ব্রহ্মচারী বাবার কাছে একটা আম চাহিয়া বসিলাম। ” তিনি সবচেয়ে বড় আমটি হাতে লইয়া আমাকে বলিলেন: “বাবা বলিয়া ডাক, তবে দিব।” সেখানে তখন অনেকেই উপস্থিত ছিলেন, তাহাদের সন্মুখে ব্রহ্মচারী বাবাকে ‘বাবা’ বলিয়া ডাকিতে কেমন যেন বাধ বাধ ঠেকিল, বাবাও আমটি পাশে সরাইয়া রাখিয়া দিলেন। আমটির দিকে সতর্কদৃষ্টি রাখিয়া খানিকক্ষণ এদিক ওদিক পায়াচারি করিলাম, হঠাৎ চাহিয়া দেখি যে লোকজন অনেক কমিয়া গিয়াছে, ব্রহ্মচারী বাবা প্রায় একাই বসিয়া আছেন। তাড়াতাড়ি তাঁহার কাছে যাইয়া বলিলাম : “বাবা, আম্গা না দিবেন কইছিলেন?” বাবাও একটু মৃদু হাসিয়া আমটি তৎক্ষণাৎ আমার হাতে তুলিয়া দিলেন। এই যে বাপ-ব্যাটা সম্বন্ধ তিনি সেদিন পাতাইয়া লইলেন, তাহা লইয়াই আছি, “দীক্ষা-টিক্ষার কথা কোন দিন মনেও হয় নাই”। এই ভদ্রলোকের যে অব্যভিচারী ইষ্ট-নিষ্ঠা দেখিয়াছি তথাকথিত দীক্ষিতদিগের মধ্যে অনেকেরই তাহা দেখি নাই। এইজন্যই বলিতেছিলাম যে, ঠাকুরের নিকট ” নাম ” না পাইলেও আমার বোধহয় বিশেষ ক্ষতি হইত না। কিন্তু ইহা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত কথা, অন্যের সহিত ইহার কোন সম্পর্ক নাই।