আমি যেদিন সেই “দুনিয়া ভালো করা” ভদ্রলোককে আমার বাড়ীতে লইয়া আসিয়াছিলাম সেই দিন রাত্রিতেই ঠাকুর ঢাকা চলিয়া যাওয়ায় সে যাত্রায় আর তাঁহার সহিত আমার সাক্ষাৎ হয় নাই। কিছুদিন পরে বড়দিনের ছুটিতে ঢাকা যাইয়া শুনিলাম যে, ঠাকুর ইতিমধ্যে সেখানে গিয়াছিলেন, কয়েক দিনের জন্য বিক্রমপুর গিয়াছেন, শীঘ্রই ফিরিয়া আসিবেন। মনটা উৎফুল্ল হইয়া উঠিল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আবার এক দুশ্চিন্তাও আসিয়া উপস্থিত হইল। মাত্র ১০ দিনের ছুটি, ৩ দিন তো প্রায় পার হইয়া গেল, বাকী কয়টা দিনের মধ্যে ঠাকুর আসিয়া না পড়িলে তো আর তাঁহার সঙ্গে দেখা হইবে না। সেদিন বৈকালেই কিন্তু নিশ্চিন্ত হইতে পারিলাম। ঠাকুরের খোঁজে বীঁরেন মজুমদার মহাশয়ের ঔয়াইজ ঘাট রোডের দোকানে আসিয়া জানিলাম যে, সেদিন প্রাতঃকালেই ঠাকুর আসিয়াছেন এবং বীরেনবাবুর বাড়ীতেই আছেন। শুধু নিয়মরক্ষার জন্যই বৈকালে আসিয়া তিনি দোকানটি খুলিয়াছেন। প্রফুল্লবাবু ও হরিদাসবাবুও আমার সঙ্গে ছিলেন, তাহারা বীরেনবাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় করাইয়া দিলেন। আমার মনে হইল যে, বীরেনবাবু যেন অত্যন্ত বিষন্ন; কারণ জিজ্ঞাসা করাতে বলিলেন যে, দুপুর বেলা তাহার ঠাকুরের সঙ্গে এই দোকান সমন্ধে আলোচনা হইয়াছিল এবং সকল কথা শুনিয়া ঠাকুর নাকি দোকানটি বাড়ীতেই লইয়া যাইতে বলিয়াছেন। সেই জন্যই জীবিকার একমাত্র অবলম্বন এই দোকানটির ভবিষ্যৎ ভাবিয়া তাহার মন অত্যন্ত খারাপ হইয়া রহিয়াছে। আমি কি বলিয়াছিলাম স্মরণ নাই কিন্তু কয়েক বৎসরের মধ্যেই ঠাকুরের কথামতো দোকানটি বাড়ীতেই আনিতে হইয়াছিল। দোকানটি ছিল চার দরজার একটি বড় ঘর লইয়া। কয়েক মাস পরে গ্রীষ্মের ছুটিতে ঢাকা আসিয়া দেখিলাম যে, একটি দরজা গিয়াছে। আরও এক বৎসরের মধ্যে দুইটি দরজা চলিয়া গিয়া একটিতে আসিয়া ঠেকিল। কিছুকাল এই অবস্থায় থাকিয়া দোকানটি বাড়ীতেই চলিয়া আসিয়াছিল।
সে যাহাই হউক, কিছুক্ষণ পরেই বীরেনবাবু দোকান বন্ধ করিলেন এবং আমাদিগকে সঙ্গে লইয়া তাহার বাসায় ফিরিয়া আসিলেন। আমরা উপরে যাইয়া ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া তাঁহার নিকটে বসিলাম। সাধারণ কুশল প্রশ্নাদি ছাড়া অন্য কোন আলোচনা হইয়াছিল কিনা মনে পড়িতেছে না। প্রফুল্লবাবুর অনুরোধে ঠাকুর পরের দিন প্রাতঃকালে তাহাদের বাড়ীতে, অর্থাৎ আমার শ্বশুরালয়ে যাইতে স্বীকৃত হইলেন এবং স্থির হইল যে, তিনি দুই দিন সেখানেই থাকিবেন। ব্যবস্থাটা বীরেনবাবুর বিশেষ মনঃপূত হইল না বুঝিতে পারিলাম, কিন্তু ঠাকুর নিজে সম্মতি দেওয়ায় তিনি আর বিশেষ কিছুই বলিতে পারিলেন না। বীরেনবাবু সহজে ঠাকুরকে তাহার বাড়ী ছাড়িয়া অন্য কোথাও যাইতে দিতে চাহিতেন না, সুতরাং কথাটার এত সহজে মীমাংসা হইয়া যাওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিলাম। কিছুক্ষণ পরে ঠাকুরকে প্রণাম করিয়া বাড়ী ফিরিয়া আসিলাম।
পরের দিন ভোর হইতেই অধীর আগ্রহে ঠাকুরের জন্য অপেক্ষা করিয়া রহিলাম কিন্তু ঠাকুর আসিলেন না। প্রফুল্লবাবু আমাকে যাচ্ছেতাই করিতে লাগিলেন। তিনি প্রস্তাব করিয়াছিলেন যে, অতি ভোরে আসিয়া ঠাকুরকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবেন। এই কথার উপর আমি বলিয়াছিলাম যে, প্রফুল্লবাবুর অতি ভোর অর্থ অন্ততঃ বেলা ৯টা। এই শীতের দিনে কখনই তিনি ৭টার পূর্বে গাত্রোত্থান করিতে পারিবেন না, তারপর শৌচ, দাঁত মাজা, মুখ ধোয়া ইত্যাদিতে অন্ততঃ ঘণ্টা দেড়েক প্রয়োজন, এক গলা পরিষ্কার করিতেই তাহার প্রায় ২০ মিনিট লাগে, সুতরাং তাহার পক্ষে ভোরে যাইয়া ঠাকুরকে লইয়া আসার কোন মানেই হয় না। আর ঠাকুর যখন বলিয়াছেন যে, তিনি নিজেই যাইতে পারিবেন, কাহারও আসার প্রয়োজন নাই, তখন তাঁহার উপর নির্ভর করিয়া বসিয়া থাকাই ভাল। এখন ঠাকুর না আসাতে প্রফুল্লবাবু আমার উপর খুব এক হাত লইলেন। একটু থামিয়া পরে আবার গম্ভীরভাবে বলিলেনঃ “নিশ্চয়ই বীরেনদা’র কারসাজি, একবার দেখিয়া আসিতে হইবে ব্যাপার কি।“ এই কথা বলিয়া তিনি জামা কাপড় পরিয়া বাহির হইয়া গেলেন এবং বেলা প্রায় একটার সময় ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন যে, ঠাকুরের কোনও সন্ধান পাওয়া গেল না। বীরেনবাবুর বাসা হইতে ভোরেই তিনিই বাহির হইয়া গিয়াছেন কিন্তু সম্ভাব্য সকল স্থানে অনুসন্ধান করিয়াও প্রফুল্লবাবু কোন কিনারাই করিতে পারেন নাই।
ব্যাপারটা কিছুই বুঝিতে পারলাম না এবং নিতান্ত বিষণ্ণ মনে দিনটা অতিবাহিত করিলাম। আমাদের সৌভাগ্যক্রমে সন্ধ্যার প্রাক্কালে ঠাকুর একাকীই আসিয়া উপস্থিত হইলেন। আমার শ্বশুরবাড়ীর সদরের একখানা ঘর পূর্ব হইতেই ঠাকুরের জন্য নির্দিষ্ট করিয়া রাখা হইয়াছিল, সেখানে গিয়া তাঁহাকে বসাইলাম। সংবাদ পাইয়া শ্বশুর মহাশয় (ঢাকা শাক্তি ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মঁথুরামোহন চক্রবর্তী) ও তাহার একজন বন্ধু ঠাকুরের সহিত দেখা করিতে আসিলেন। শ্বশুর মহাশয় ছিলেন বারদীর শ্রীশ্রীলোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার শিষ্য। কে যেন তাহাকে বলিয়াছিল যে, ঠাকুর লোকনাথ বাবার গুরুভ্রাতা বেণীমাধব ব্রহ্মচারীর শিষ্য। কথাটা যে সত্য নহে তাহা আমি আমার শ্বশুর মহাশয়কে জানাইয়াছিলাম কিন্তু তথাপি তিনি ঠাকুরকে ঐ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়াছিলেন, স্মরণ আছে। বেণীমাধব ব্রহ্মচারী সম্বন্ধেও অনেক কথাবার্ত্তা হইয়াছিল। তিনি জীবিত আছেন কিনা এবং থাকিলে কোথায় আছেন ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হইয়াছিল মনে আছে। কিন্তু সে-দিনকার ঠাকুরের কথায় স্পষ্ট কিছুই বুঝিতে পারি নাই। কিছুকাল পরে জানিতে পারিয়াছিলাম যে, বেণীমাধব ব্রহ্মচারী বাবা ইহার পরেও কয়েক বৎসর জীবিত ছিলেন এবং ঢাকার অতি নিকটে প্রাসিদ্ধ লাঙ্গলবন্ধ নামক স্থানে অবস্থান করিতেছিলেন। বরদাবাবু ও হরিদাসবাবুর মুখে শুনিয়াছি যে, একবার তাহারা দুইজন এবং আরও তিন-চারজনে মিলিয়া ঠাকুরের সমভিব্যাহারে বেণীমাধব ব্রহ্মচারী বাবাকে দর্শন করিতে গিয়াছিলেন। ছোট্ট একখান ভাঙ্গা কোঠায় বেণীমাধব বাবা থাকিতেন, ঠাকুর সেই ঘরের নিকটে আসিতেই তিনি বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইলেন। ঠাকুর এবং বেণীমাধব বাবা উভয়েই কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়াইয়া রহিলেন, কোন কথাবার্ত্তাই হইল না। মিনিট পাঁচেক পরে ব্রহ্মচারী ঘরের ভিতরে প্রবেশ করিলেন এবং ঠাকুরও চলিয়া আসিলেন। বরদাবাবু আমাকে বলিয়াছিলেন যে, বেণীমাধব বাবার চেহারা এত উগ্র মনে হইয়াছিল যে, বেশী নিকটে যাইতে তাহাদের সাহস হয় নাই, একটু দূরে থাকিয়াই তাহারা ব্যাপারটা লক্ষ্য করিয়াছিলেন। সেইসময়ে বেণীমাধব ব্রহ্মচারী বাবার বয়স প্রায় দুইশত বৎসর হইয়াছিল।
আমি অনেক সময়ে ভাবিয়াছি যে, সেদিন শ্বশুর মহাশয়ের প্রশ্নের একটা স্পষ্ট উত্তর ঠাকুরের মুখ দিয়া বাহির হইল না কেন? বেণীমাধব বাবা যে লাঙ্গলবন্ধে আছেন তাহা তো ঠাকুর নিশ্চয়ই জানিতেন। নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে যে, বেণীমাধব ব্রহ্মচারী লাঙ্গলবন্ধে আছেন, এই কথাটা প্রকাশ হইয়া পড়িলে লোকনাথ বাবার আশ্রিত ভক্তেরা তাঁহাকে অতিষ্ঠ করিয়া তুলিতেন। আমার মনে হয় যে, ইহা বোধহয় বেণীমাধব বাবার নিতান্তই অনভিপ্রেত ছিল এবং সেইজন্যই ঠাকুর স্পষ্টতঃ কিছুই বলেন নাই। ক্রমে বেণীমাধব বাবার সংবাদ কতকটা প্রকাশিত হইয়া পড়িয়াছিল এবং শুনিয়াছি যে তাঁহার ফটোও কেহ কেহ পাইয়াছিলেন। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, লোকনাথ বাবার ভক্তেরা কেহই এই সংবাদ পান নাই। হরিদাসবাবু ও বরদাবাবুর নিকট এবং পরে ঠাকুরের মুখে এই সংবাদ পাইবার পর আমি বহুবার মনে করিয়াছি যে, কথাটা আমার শ্বশুর মহাশয়কে জানাইব কিন্তু কেন জানি না, কথাটা বলিয়া উঠিতে পারি নাই। এই না-বলাটাকে কিন্তু একটা সাধারণ ভুল বলিয়া মনে করিতে পারিতেছি না। শ্বশুর মহাশয় এই সংবাদটা পাইলে যে কতটা আনন্দিত হইতেন তাহা আমার অজানা ছিল না। আমিও খবরটা তাহাকে জানাইবার জন্য অত্যন্ত উদ্গ্রীব হইয়া উঠিয়াছিলাম কিন্তু তথাপি কথাটা তাহাকে বলিতে পারি নাই। এক দিন দুই দিন নয়, প্রায় আট/ দশ বৎসরেও কথাটা বলিয়া উঠিতে পারিলাম না। ইহার মধ্যে অল্পাধিক পাঁচশত বার আমার শ্বশুর মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ হইয়াছিল। আরও আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, হরিদাসবাবুও শ্বশুর মহাশয়ের সহিত বিশেষ ভাবেই পরিচিত ছিলেন এবং হামেশাই তাহাদের দেখা সাক্ষাৎ হইত। কিন্তু হরিদাসবাবুরও কখন কথাটা তাহাকে জানাইতে ইচ্ছা হইল না। এরূপ অদ্ভুত ঘটনা আমার জীবনে অল্পই ঘটিয়াছে এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে বেণীমাধব বাবার অমোঘ ইচ্ছায়ই এই অসম্ভবও সম্ভব হইয়াছিল।
যাহাই হউক, সেই রাত্রিতেই আমার স্ত্রী ও প্রফুল্লবাবুর স্ত্রী ঠাকুরের নিকট “নাম” পাইয়াছিলেন স্মরণ আছে। ঠাকুর তাহাদিগকে অনেকক্ষণ ধরিয়া “পতিব্রতা ধর্ম” সম্বন্ধে উপদেশ দিয়াছিলেন। তাহারা কি বুঝিয়াছিলেন জানি না, কিন্তু আমার মনে হইতেছিল যে ঠাকুর তাঁহার সেই চিরন্তন অনন্যশরণ বা অনন্যচিন্তার কথাই বলিতেছেন। সাবিত্রীর দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিয়া ঠাকুর বুঝাইতেছিলেন যে, সাবিত্রী তাঁহার অনন্য পতিভক্তি দ্বারা সত্যবানকে যমের হাত হইতে উদ্ধার করিয়াছিলেন, অর্থাৎ সত্যকে কালের হাত হইতে উদ্ধার করিয়াছিলেন। সত্য দেশ, কাল, কার্য্যকারণ ইত্যাদিতে আবরিত হইয়া আছে, সেই সত্যকে এই আবরণ হইতে উদ্ধার করিতে হইলে প্রয়োজন অনন্য পতিসেবা। মূখ্যতঃ পতি শব্দে ঠাকুর বুঝাইতেন আশ্রয়, কিন্তু এই পতি শব্দকে গৌণ সাংসারিক অর্থে গ্রহণ করিলেও অনন্য পতিসেবা যে ক্রমে অনন্য ভগবৎ সেবায় রূপান্তরিত হইতে পারে তাহা সহজেই বুঝিতে পারা যায়। পক্ষান্তরে ঠাকুর বলিতেন যে, নিরপেক্ষ ভাবে স্ত্রীপূত্রাদির ভরণপোষণে যত্নশীল হইলে নির্মল জ্ঞান লাভ করিতে পারে। আসক্তিই বন্ধনের মূল। অনাসক্ত ভাবে কর্ম করিয়া গেলে সংসারে থাকিয়াই সব কিছুই পাইতে পারে।
আরও মনে পরিতেছে যে, ঠাকুর সেবাধর্ম সম্বন্ধেও কিছু আলোচনা করিয়াছিলেন। এখানেও স্মরণ রাখিতে হইবে যে, অনন্য ও নিরপেক্ষ না হইলে প্রকৃত সেবাধিকারী হওয়া যায় না। এ সম্বন্ধে ঠাকুর একটি গল্প বলিতেন, কথাটা বিশদ করিবার জন্য সেই গল্পটি এখানে বিবৃত করিব। কৃষ্ণভক্ত নারদ বীণা বাজাইয়া অহর্নিশ হরিগুণ গান করিয়া মহানন্দে কাল যাপন করেন, তথাপি তাঁহার একটা ক্ষোভ আর কিছুতেই যাইতে চাহে না। তিনি বরাবরই লক্ষ্য করিয়াছেন যে, প্রভুর নিকট ব্রজগোপীদিগের যে আদর, তাহা তিনি কোনদিনই লাভ করিতে পারিলেন না। এমনও কখন কখন তাঁহার মনে হইত যে, ইহাতে প্রভুর অবিচার ও পক্ষপাতিত্বই সূচিত হইতেছে। ইহা অতি সাংঘাতিক চিন্তা। এরূপ চিন্তা স্থায়ী হইলে নারদের পতন অবশ্যম্ভাবী, অথচ তিনি একজন প্রকৃত ভক্ত ও সাধক, এইজন্যই নারদের প্রতি কৃপাপরবশ হইয়া শ্রীকৃষ্ণ তাঁহার ভুল ভাঙ্গাইয়া দিতে ইচ্ছা করিলেন। ঘুরিতে ঘুরিতে নারদ একদিন মথুরায় আসিয়া উপস্থিত। সেখানে আসিয়া শুনিলেন যে, কিছুদিন যাবৎ শ্রীকৃষ্ণ শিরঃপীড়ায় অত্যন্ত কষ্ট পাইতেছেন, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করা সম্ভব হইবে না। নারদ কথাটা সহসা বিশ্বাস করিতে পারিলেন না, প্রভুর অসুখ, এও কি সম্ভব? অনেক অনুনয় বিনয় করিয়া তিনি প্রভুর সাক্ষাৎকারের অনুমতি পাইলেন এবং শ্রীকৃষ্ণের নিকট উপস্থিত হইয়া দেখিলেন যে, বাস্তবিকই তিনি দুই হাতে মাথা চাপিয়া ধরিয়া বিছানায় শুইয়া রহিয়াছেন এবং যন্ত্রণায় ছট্ফট্ করিতেছেন। নারদ নিজ চক্ষুকে বিশ্বাস করিতে পারিলেন না। এ তিনি কি দেখিলেন, এ যে স্বপ্নেও অগোচর। নারদ অস্থির হইয়া পড়িলেন। যাহাই হইক, একটু প্রকৃতিস্থ হইতেই তিনি শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ “এই ব্যাধির কি কোন প্রতিকার নাই?” শ্রীকৃষ্ণ বলিলেনঃ “আছে এবং তাহা অতি সহজ; কোন ভক্ত যদি তাহার পায়ের ধূলা আমার মাথায় দিতে পারে তাহা হইলেই এই অসুখ সারিয়া যায়।“ এই কথা বলিয়া শ্রীকৃষ্ণ নারদের নিকটেই তাঁহার একটু পায়ের ধূলা প্রার্থনা করিয়া বসিলেন। নারদ ভয়ে ও বিস্ময়ে একেবারে আঁতকাইয়া উঠিলেন। কি সর্বনাশ, প্রভু বলেন কি, আমি দিব তাঁহাকে পায়ের ধূলা! প্রকাশ্যে বলিলেনঃ “এ কী বিপরীত আদেশ করিতেছেন প্রভু? আমি আপনার দাসানুদাস, আমার সঙ্গে এরূপ পরিহাস কি আপনার সাজে?” তদুত্তরে শ্রীকৃষ্ণ বলিলেন যে, নারদ যদি নিজে দিতে না-ই পারেন, তাহা হইলে তিনি অন্য কাহারও নিকট হইতে তাঁহার জন্য একটু চরণধূলা আনিয়া দিন, চরণধূলা ছাড়া এই রোগের উপশম হইবে না, ইহা নিশ্চিত। নারদ বাহির হইলেন, ত্রিভূবনের প্রায় সর্বত্রই ঘুরিলেন কিন্তু চরণধূলা কোথাও মিলিল না। ব্রক্ষ্মা, মহাদেব, দেবতাগণ, যক্ষ, কিন্নর প্রভৃতি সকলেরই এক কথা। “এ কি সাংঘাতিক কথা! প্রভুকে পায়ের ধূলা দিলে নরকেও যে আমার স্থান হইবে না। আপনি দেবর্ষি নারদ, ধর্মজ্ঞ, মহাভক্তিমান, এ কি ভয়াবহ প্রস্তাব লইয়া উপস্থিত হইয়াছেন,” ইত্যাদি, ইত্যাদি, পায়ের ধূলা কেহই দিল না। নারদ মহা মুশকিলে পড়িলেন, শূণ্য হাতে প্রভূর নিকট ফিরিয়া যাইতেও পারেন না, অথচ কি করিয়া যে চরণধূলি সংগ্রহ করিবেন তাহাও ভাবিয়া পাইলেন না। আন্তরিক বিরাগবশতঃই হউক, অথবা অন্য যে কোন কারণেই হউক, এতক্ষ্ণ তাঁহার ব্রজগোপীদিগের কথা স্মরণ হয় নাই, কিন্তু এইবার বিপাকে পড়িয়া হঠাৎ তাহাদের কথা মনে হইল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বৃন্দাবনে যাইয়া উপস্থিত হইলেন। নারদকে দেখিয়া গোপীগণ অত্যন্ত আনন্দিত হইল এবং সকলে প্রায় একযোগে শ্রীকৃষ্ণের কুশল বার্তা জিজ্ঞাসা করিলেন। নারদের মুখে তাঁহার অসুখের কথা শুনিয়া গোপীগণ অত্যন্ত মর্মাহত হইলেন এবং বিষাদ-কাতর বদনে, এই রোগোপশমের উপায় কিছু আছে কিনা, নারদকে জিজ্ঞাসা করিলেন। নারদ যখন বলিলেন যে, একটু পায়ের ধূলা পাইলেই রোগ সারিয়া যায় তখনই তাঁহাদের মুখ হাস্যোজ্জ্বল হইয়া উঠিল এবং তাঁহারা একযোগে সকলেই নারদের দিকে পা বাড়াইয়া দিলেন। নারদ বিস্ময়ে হতবাক্ হইয়া গেলেন। এ কি আশ্চর্য্য ভগবৎপ্রীতি, ইহা তো বাস্তবিকই আর কোথাও নাই। নারদের ভুল ভাঙ্গিয়া গেল এবং তাঁহার মনেও আর কোন ক্ষোভ রহিল না। তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহার ও অন্যান্য সকলের ভগবৎপ্রীতি আত্মপ্রীতিরই নামান্তর, স্বকীয় শুভাশুভই তাহার মান। নিজের অনিষ্টাশঙ্কায় প্রভুর নিতান্ত প্রয়োজনীয় বস্তুটি কেহই দিতে পারিলেন না। কিন্তু ব্রজগোপীদের মনে কোন প্রশ্নই উঠিল না, কারণ তাঁহাদের কৃষ্ণপ্রীতি শুধু কৃষ্ণপ্রীতিই,আত্মপ্রীতির গন্ধও সেখানে নাই।
মুখ্যতঃ বলিতে গেলে ইহাই সেবা এবং অনন্যনিষ্ঠাই ইহার ভিত্তি। কিন্তু গৌণ অর্থে সংসার ধর্মেও সেবা কথাটি একটা বিশেষ স্থান অধিকার করিয়া রহিয়াছে এবং আমার মনে হয় যে গৌণ সেবা অভ্যাস করিতে করিতে ক্রমশঃ মুখ্য সেবায় উঠাই ইহার তাৎপর্য্য। ঠাকুর বলিতেছিলেন যে, নিরপেক্ষভাবে পূত্র-কণ্যা, আত্মীয়-পরিজন, আশ্রিতবর্গের সেবায়ই ভগবৎসেবাই হয়। যিনি অকর্তা বা আসক্তিশূণ্য, সম্যকরূপে নিরপেক্ষ, শুধু তিনিই হইতে পারেন। কিন্তু সেজন্য বসিয়া থাকিলে চলে না, ধীরে ধীরে এই সংসার ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষতা অভ্যাস করিতে হয়। আমাদের দেশে একান্নবর্ত্তী পরিবারগুলি এই শিক্ষার একটি চমৎকার ক্ষেত্র ছিল। উপার্জনের তারতম্যানুসারে উপভোগের তারতম্যের কথা কেহ মনেও আনিত না, যে যাহাই উপার্জন করুক সকলই আসিয়া একত্রে জমা হইত এবং প্রয়োজনানুসারে ব্যয় হইত, কাহারও বেলাই কোন ইতর বিশেষ ছিল না। ইহাই ছিল একান্নবর্ত্তী পরিবারের আদর্শ এবং নিরপেক্ষ সেবা অভ্যাস করিবার এমন সুন্দর প্রতিষ্ঠান খুব অল্পই দেখা যায়। বালক-বালিকারাও এই উদার পরিবেশে লালিত হওয়ায় অল্পাধিক পরার্থপরতায় অতি সহজেই অভ্যস্ত হইয়া যাইত। কিন্তু প্রধানতঃ অর্থনৈতিক এবং অল্পাধিক অন্যান্য কারণে এই প্রতিষ্ঠান ভাঙ্গিয়া চুরিয়া গিয়াছে, ইহাকে আর ফিরাইয়া আনা যাইবে না।
আমাদের নেতারা সকলেই একবাক্যে বলিতেছেন যে, ভারত এখন স্বাধীন হইয়াছে, আবালবৃদ্ধবনিতা সকলকেই এখন সেবাপ্রাণতায় উদ্বুদ্ধ হইতে হইবে, আর বসিয়া থাকিলে চলিবে না। কিন্তু উপযুক্ত পরিবেশের সৃষ্টি করিতে না পারিলে শুধু কথায় কোন কাজই হইবে না। নিজের অভিজ্ঞতা হইতে বলিতে পারি যে, গত ২০/২৫ বৎসরের মধ্যে আমরা অত্যন্ত আত্মসর্বস্ব হইয়া উঠিয়াছি। নিজ নিজ ক্ষুদ্র বেষ্টনীর বাহিরে আমাদের সেবাপরায়ণতা আর অগ্রসর হইতে চাহে না। মনকে চোখ ঠারিবার উপায়ের অবশ্য অভাব নাই, দুই চারিটা সেবা প্রতিষ্ঠানে কিছু কিছু চাঁদা দিয়াই আমরা মনে করি যে, আমাদের কর্ত্তব্য সম্পাদন হইয়াছে। কিন্তু প্রকৃত সেবা যে একটা শিক্ষণীয় বস্তু এবং সমগ্র জীবন দিয়াই যে ইহার সাধনা করিতে হয়, এমন কোন ধারণার ধারও আমরা ধারি না। সেবার স্থান অধিকার করিয়াছে বরাতী সেবা এবং সেই জন্যই যে দেশে কাহারও মৃত্যু হইয়াছে সংবাদ পাইলে স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া দলে দলে লোক আসিয়া জুটিত, সেখানেও অনেক ক্ষেত্রে সৎকার-সমিতির শরণাপন্ন হইতে হয়। পারিবারিক এবং সামাজিক দৈনন্দিন জীবনে এই সেবাকর্ম্মের সাধনা করিতে হয় এবং তাহা না করিলে বা করিবার সুযোগ না থাকিলে মানুষ আত্মসর্ব্বস্ব হইয়া উঠিতে বাধ্য। শুনিতে পাই যে, আধুনিক যুগে রাষ্ট্রের সংজ্ঞাই বদলাইয়া গিয়াছে। এখন আর রাষ্ট্র শুধু শাসক নহে, প্রধাণতঃ ইহা লোক-সেবক; সুতরাং সেবা যখন প্রধানতঃ রাষ্ট্রেরই কর্ত্তব্য, ব্যাক্তিগত সেবাধর্ম্মের এখন একটা নূতন ব্যাখ্যার প্রয়োজন। কিন্তু মানুষ লইয়াই রাষ্ট্র, এবং মানুষের মধ্যে যদি সেবাধর্ম্মের দীক্ষা না থাকে, তবে অচিরেই রাষ্ট্র লোক-সেবক না হইয়া লোক-দমন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হইতে বাধ্য।
একথা ভুলিলে চলিবে না যে, প্রকৃত সেবাচারীর দাবী অতি সামান্য, দায়িত্বই বেশী। কিন্তু বর্ত্তমানে আমরা নিজ নিজ দাবী সম্বন্ধে অত্যন্ত সজাগ হইয়া উঠিয়াছি এবং দায়িত্ববোধ ঠিক সেই পরিমাণেই অন্তর্হিত হইয়া গিয়াছে। আর ইহাও মনে রাখিতে হইবে যে, প্রকৃত সেবাচারীর বিশেষ কোন মতলব থাকে না, সেবার প্রেরণায়ই সে সেবা করিয়া যায়। সেবাচারীর লক্ষ্ণগুলি কোথাও বড় একটা খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। কিন্তু মুশকিল হইল এই যে, তথাপি সকলেই আমাদের সেবা করিতে চায়। একদিকে কংগ্রেস, অপরদিকে সাম্যবাদী, মধ্যখানে কতকগুলি দল এবং উপদল, ইহারা সকলেই সেবাচারী এবং নিজ নিজ সামার্থ্যানুসারে আসর জমাইবার চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু মজা হইল এই যে, ইহাদের মধ্যে কেহ প্রকৃত জনহিতকর কোন কার্য্য করিলে বা করিতে চাহিলে অন্যান্যের চক্ষু টাটাইয়া উঠে, অর্থাৎ সকলের ইচ্ছা যে সেবাটা একাই করে, আর কাহাকেও অংশীদার হইতে দিতে চাহে না। সেবাধিকার এখন কংগ্রেসের, অন্যান্যোরা আমাদের ঘাড়ে সেবা চাপাইবার জন্য ওত পাতিয়া আছে, একবার সুযোগ পাইলেই হয়। কথাগুলি বলিতে হইতেছে এইজন্য যে, আমাদের নিকট “সেবা” কথাটার একটা বিশেষ মর্য্যাদা আছে এবং ইহার যথেচ্ছ ব্যবহার কোনমতেই বরদাস্ত করিতে পারি না। সেদিন দেখিলাম যে, একটা দোকানের সম্মুখে সাইন বোর্ডের তলার দিকে লেখা রহিয়াছেঃ “আপনাদের সেবার জন্যই আমাদের এই আয়োজন।“ এক এক সময় ভ্রম হয় যে আজকাল “সেবা” বলিয়া যাহা শুনি সেগুলি বোধ হয় বেশীর ভাগই এই জাতীয়।
যাহাই হউক, সে রাত্রীতে ঠাকুর আমার স্ত্রীকে যে কথাগুলি বলিয়াছিলেন তাহাতে আমি ইহাই বুঝিয়াছিলাম যে, সংসারই সেবাধর্ম্ম শিক্ষার ও সাধনার প্রশস্ত ক্ষেত্র এবং ক্রমে অভ্যাসের দ্বারা নিরপেক্ষ ভাবে ইহা করিতে পারিলে এই সেবাই ভগবৎ সেবায় রূপান্তরিত হইয়া যায়। ঠাকুর সর্ব্বদাই গার্হস্থ্য ধর্ম্মকে একটা প্রকৃষ্ট মর্য্যাদা দিয়া আসিয়াছেন। তিনি বলিতেন যে, “বিবাহ করিলে বন্ধন হয় না, আসক্তিই বন্ধনের কারণ। ব্রক্ষ্মা, বিষ্ণু, শিব সকলেই বিবাহ সংসার পালন করিয়াছেন।“ স্ত্রীপুত্রাদির মধ্যেও ভগবান সম্যকরূপেই বিরাজ করেন, নিরপেক্ষভাবে তাহাদের ভরণপোষণে, তৃপ্তিদানে, তৃপ্তিলাভে ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। তাঁহার দীর্ঘ জীবনের প্রায় অর্দ্ধাংশ তিনি অক্লান্তভাবে গৃহে গৃহে ঘুরিয়াই কাটাইয়া গিয়াছেন। যখন কাহারও বাড়ীতে আসিতেন তখন সে বাড়ীরই একজন হইয়া যাইতেন। যে কয়দিন থাকিতেন নিতান্ত আপনার জনের মতই থাকিতেন, আবার যখন চলিয়া যাইতেন একবার ফিরিয়াও তাকাইতেন না। তিনি আমাকে এবং আমার স্ত্রীকে বহুবার বলিয়াছেনঃ “আমি তো আপনাদের এখানে সর্ব্বদাই আছি” এবং তাঁহার আচরণে স্পষ্টই মনে হইয়াছে যে, আমার পক্ষে আমার এই গৃহ অপেক্ষা প্রকৃষ্টতর স্থান যেন আর কোথাও নাই। তীর্থ ভ্রমণে যাওয়া, নানাস্থানে ঘুরিয়া বিগ্রহাদি দর্শন করা ইত্যাদি বিষয়ে কোনদিন কোন কথাই তিনি আমাকে বলেন নাই। কিন্তু আমি জানি যে, কেহ সন্ন্যাসী হইয়া বাহির হইয়া গিয়াছেন শুনিলে তিনি কখন কখন বলিয়াছেনঃ “উনি তো সন্ন্যাসী হ’ন নাই, উনি সুখান্বেষী হইয়াছেন।“ এই কথা হইতে কেহ যেন সিদ্ধান্ত করিয়া না বসেন যে, ঠাকুর প্রকৃত সন্ন্যাসকে অশ্রদ্ধা বা অবজ্ঞার চক্ষে দেখিতেন। “সুখান্বেষী” কথাটা তিনি মর্কট বৈরাগ্যকে লক্ষ্য করিয়াই ব্যবহার করিতেন। সে যাহাই হউক, তাঁহার যাহা শিক্ষা কার্য্যতঃ গৃহই তাহার কেন্দ্র। কিন্তু একদল লোক এই গৃহকে বিষাক্ত করিয়া তুলিতে ও ক্রমে ক্রমে ইহাকে ভাঙ্গিয়া ফেলিতে কোমর বাঁধিয়া লাগিয়া গিয়াছে। ইহাও দক্ষযজ্ঞেরই অপর এক অধ্যায় এবং পরিণতি সম্বন্ধেও আমাদের কোন সন্দেহ নাই।
কিছুতেই নিশ্চিন্ত মনে ঠাকুরের কথার অনুসরণ করিতে পারিতেছি না, মাঝে মাঝে ফ্যাঁকড়া বাহির হইয়া আমাকে বিভ্রান্ত করিয়া দিতেছে। যাহাই হউক, সে রাত্রীতে আর কোনও কথা হইয়াছিল বলিয়া স্মরণ হইতেছে না। পরের দিন অনেকেই ঠাকুর দর্শনে আসিলেন, মহানন্দে সকাল বেলাটা কাটিয়া গেল, কিন্তু ছোট্ট একটি ঘটনা ছাড়া উল্ল্যেখযোগ্য আর কিছুই মনে আসিতেছে না। বেলা প্রায় ৯টা, আমি বাহিরের বারান্দায় দাঁড়াইয়া সিগারেট টানিতেছিলাম, এমন সময় সামনের রাস্তা হইতে এক ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেনঃ “এখানে নাকি একজন সাধু আছেন?” আমি বলিলামঃ “হ্যাঁ আছেন, আপনি আসুন।“ এইবার ভদ্রলোকের চেহারার দিকে আমার নজর পড়িল; আবক্ষলম্বিত কাঁচাপাকা দাড়ি, বাবরি চুল, দু’একটা জট পাকাইতে সুরু হইয়াছে, পরিধানে রক্তাম্বর, পায়ে খড়ম, খালি গা, কপালে একটা প্রকাণ্ড লাল রঙের ফোটা, গলায় দুই তিনটি বড় রুদ্রাক্ষের মালা, উভয় হাতে বালা ও তাগার আকারে আরও কতকগুলি রুদ্রাক্ষ, বুঝিলাম যে, ইনি একজন তান্ত্রিক। ভদ্রলোক আমার নিকটে আসিতে আরও বুঝিলাম যে, কিছুক্ষণ পূর্ব্বে তিনি “কারণ” সেবা করিয়াছেন। দরজার কাছে আসিয়া ঠাকুরকে দেখিয়াই তাহার কিন্তু ভাবান্তর উপস্থিত হইল। হঠাৎ তিনি জিভে এক কামড় দিয়া ফেলিলেন এবং খট্খট্ করিয়া সিঁড়ি দিয়া রাস্তায় নামিয়া গেলেন। তাহার ভাব দেখিয়া মনে হইল যে, তিনি যেন একটা ঘোরতর বিপদে পড়িতে পড়িতে অতি কষ্টে বাঁচিয়া গিয়াছেন। প্রথমে ব্যাপারটা বুঝিতে পারি নাই কিন্তু একটু পরেই বুঝিতে পারিলাম যে, ঠাকুরের গলার তুলসীর মালাছড়াই এই বিভ্রাট বাধাইয়াছে। এই প্রসঙ্গে আরও একজন ভদ্রলোকের কথা মনে হইতেছে, তিনিও ঐ পাড়াতেই থাকিতেন। এই দ্বীতিয় ব্যাক্তি ছিলেন একজন নৈষ্ঠিক বৈষ্ণব এবং অতি প্রত্যূষে উঠিয়া ঠাকুর পূজার জন্য পুষ্পচয়ন তাহার নিত্যকর্ম্মের মধ্যে ছিল। তাহার বাড়ীর অতি নিকটেই ছিল শক্তিব্রহ্মচর্য্যাশ্রম, সেখানে লোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার মূর্ত্তি প্রাতিষ্ঠিত ছিল এবং নিত্য সেবাপূজা হইত। এই ভদ্রলোকের ধারণা ছিল যে, লোকনাথ ছিলেন অদ্বৈতবাদী, সুতরাং ফুল তুলিতে যাইয়া তিনি ঐ আশ্রমের বাহিরে যাহা পাইতেন শুধু তাহাই লইয়া আসিতেন, কারণ অদ্বৈতবাদী লোকনাথের আশ্রমের ফুল তাহার ঠাকুর সেবায় ব্যবহৃত হইতে পারে না। ইহাদের একজন শাক্ত, আর একজন বৈষ্ণব কিন্তু বস্তুতঃ ইহাদের মধ্যে কোন প্রভেদ নাই, সাম্প্রদায়িক সঙ্কীর্ণতায় উভয়েই অন্ধ। দিনটা মহানন্দে কাটিয়া গেল। কিন্তু বৈকালে বীরেন্দ্র মজুমদার রূপী অক্রূর আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং কি সব অজুহাত দেখাইয়া বলিলেন যে, ঠাকুরকে তখনই তাহার বাসায় লইয়া যাইবেন। আমরা সকলেই অত্যন্ত বিরক্ত হইলাম, কারণ কথা ছিল যে ঠাকুর এখানে দুই দিন থাকিবেন। বীরেনবাবু বলিলেন যে, কাল আসিয়াছেন, আজ যাইবেন, দুইদিন তো হইলই, এখন না গেলেই চলিবে না। আমি বলিলাম যে, শ্বশুর মহাশয় আসুন, তারপর ঠাকুর যাইতে হয় যাইবেন, আমরা বাধা দিব না। কিন্তু বীরেনবাবু কোন কথাই শুনিতে চাহিলেন না, তৎক্ষ্ণাৎ ঠাকুরকে লইয়া রওয়ানা হইতে মনস্থ করিলেন। ঠাকুরকে বলিতেই তিনি ছোট ছেলেটির মত উঠিয়া দাঁড়াইলেন। ইতিমধ্যে শ্বশুর মহাশয় আসিয়া পড়ায় বীরেনবাবুকে বাধ্য হইয়াই একটু অপেক্ষা করিতে হইল। তারপর আরম্ভ হইল দুইজনে বাদানুবাদ। শ্বশুর মহাশয় বলিলেন যে, দুইদিন থাকিবার কথা, সুতরাং কাল বৈকালে ঠাকুর যাইবেন, ইহার পূর্ব্বে যাইবার কথা উঠিতেই পারে না, আর বীরেনবাবু বলিতেছিলেন যে, বিশেষ প্রয়োজন আছে, তখনই ঠাকুরের না গেলেই চলিবে না। আমি কিন্তু লক্ষ্য করিতেছিলাম ঠাকুরকে, হরিদাসবাবুই তাঁহার দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিলেন। তিনি থাকিবেন কি যাইবেন ইহা লইয়াই তর্ক, কিন্তু তিনি এমনভাবে দাঁড়াইয়াছিলেন যেন এই ব্যাপারের সহিত তাঁহার কোন সম্পর্কই নাই। শেষ পর্য্যন্ত বীরেনবাবুই জয়ী হইলেন এবং আমাদের সকলের প্রাণে মর্ম্মান্তিক কষ্ট দিয়া ঠাকুরকে লইয়া চলিয়া গেলেন। সে যাত্রায় আরও তিন-চারবার ঠাকুরের সঙ্গ পাইয়াছিলাম কিন্তু উল্লেখযোগ্য কিছুই মনে পড়িতেছে না।